সেতুর যুদ্ধ বা জিসিরের যুদ্ধ – হযরত উমর রা. এর খেলাফতকালের শুরুর দিকে ইরাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পারসিকদের যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন হযরত আবু উবায়েদ সাকাফি ও মুসান্না বিন হারেসা রা.।

হযরত মুসান্না বিন হারেসা রা. খলিফা আবু বকর রা. এর যামানা থেকেই ইরাকে মুসলমানদের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।

পরবর্তীতে মুসান্না রা. খলিফার নিকট আরো সৈন্যের সাহায্য চান। তখন আবু উবায়েদ সাকাফি রহ. এর নেতৃত্বে উমর রা. সেনাবাহিনীকে পাঠিয়ে দেন।

পারস্যের রাজনৈতিক অবস্থা তখন ছিল শোচনীয়। একজন শাসক ক্ষমতার বসার পরই অন্যজন বিদ্রোহ করে ক্ষমতা কেড়ে নিত।

পারস্যের সিংহাসনে তখন রাজবংশের একটি মেয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করছিল। কারণ, সকল পুরুষকে বিদ্রোহ করে হত্যা করা হয়।

এই মেয়েটি তখন পারস্যের সামরিক দায়িত্ব অন্যতম পারসিক সেনাপতি রুস্তম পাহলোয়ানকে দেয়। রুস্তম তখন আরব সীমান্তের কৃষক ও সাধারণ লোকদের ভয় দেখিয়ে বিদ্রোহের জন্য উসকানি দেয়।

হযরত মুসান্না রা. তখন ছিলেন মদীনায়। তিনি সৈন্য আবেদন করে ইরাকে ফিরে আসছিলেন। পথিমধ্যে জানতে পারেন, হিরা অঞ্চলে বিদ্রোহ শুরু হয়েছে ও পারস্যের সেনাপ্রধান রুস্তমের আরেক সেনাপতি জাবান ফুরাত নদীর তীর ধরে এগিয়ে আসছে।

এছাড়াও পারস্যের আরেকটি বাহিনী নার্সি নামক এক ব্যক্তির নেতৃত্বে কাসকার এলাকা দিয়ে এগিয়ে আসছে।

হযরত মুসান্না বিন হারেসা রা. এই সংবাদ শুনে হিরা অঞ্চল খালি করে পেছনে কৌশলগতভাবে সরে যান। তিনি আবু উবায়েদ সাকাফি রহ. এর বাহিনীর অপেক্ষা করছিলেন।

এই সময়েই খুব দ্রুত আবু উবায়েদ সাকাফি রহ. এর বাহিনী চলে আসে। তখন এই বাহিনীর সাথে পারসিক সেনাপতি জাবানের সাথে একটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়।

কিন্তু পারসিকরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। যুদ্ধে সেনাপতি জাবানকে গ্রেপ্তার করা হয়।

উক্ত গ্রেপ্তারকারী জাবানকে চিনতো না বিধায় জাবান নিজের পরিবর্তে দুটি গোলামকে মুক্তিপণ দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নেয়।

কিন্তু ইতিমধ্যেই অন্য একজন মুসলমান তাকে চিনে ফেলায় জাবানকে ধরে মুসলিম সেনাপতি আবু উবায়েদ সাকাফি রহ. এর নিকট হাজির করা হয়।

সবকিছু শোনার পর তিনি বললেন, যেহেতু একজন মুসলমান তাকে নিরাপত্তা দিয়েছে, তাই তাকে আটক করা উচিৎ হবে না।

সেতুর যুদ্ধ বা জিসিরের যুদ্ধ

এই পরাজয়ের পর পারস্যের সেনাপতি রুস্তম সবচেয়ে অভিজ্ঞ সেনাবাহিনীকে নিয়ে বাহমান জাদাবিয়াকে সেনাপতি নিযুক্ত করে।

এই বাহিনীকে উৎসাহ প্রদান করার জন্য রুস্তম তাদেরকে শামের শাহী পতাকা ‘দেরাফশ কাবিয়ানি’ প্রদান করে।

পারসিক এই বাহিনীটি ফুরাত নদীর পূর্ব অংশ কুসসুন নাতেফে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে।

সময়টা হলো ১৩ হিজরীর শাবান মাস। মুসলিম বাহিনী সেখানে উপস্থিত হলে দেখতে পায়, দুই বাহিনীর মাঝে নদী অন্তরায় হয়ে আছে।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে পারস্যের সেনাপতি বাহমান আবু উবায়েদ রহ. কে আহবান করে বলে, হয় তোমরা নদী পার হয়ে চলে আসো অথবা আমাদেরকে নদী পার হয়ে তোমাদের নিকট যেতে দাও।

উত্তরে হযরত আবু উবায়েদ সাকাফি রহ. মুসলমানদের সাহসিকতা প্রকাশের লক্ষ্যে নিজেরাই নদী পার হওয়ার মনস্থ করলেন।

যদিও মুসলিম বাহিনীর অনেক অভিজ্ঞ সৈন্য ও সাহাবীরা ভিন্নমত পোষণ করলেন।

কিন্তু আবু উবায়েদ রহ. বলেন, পারসিকদের নিকট আমরা কখনোই এই ধারণা তৈরি হতে দিব না যে, আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই।

অবশেষে নদীতে সাঁকো (আরবিতে জিসির) তৈরি করা হয়। মুসলমানরা নদী পার হওয়ার জন্য তৈরি হন।

কিন্তু মুসলমানরা নদীর অপর পার্শ্বে পৌঁছানোর পূর্বেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পারস্যের সেনাবাহিনীরা সেখানে উপযুক্ত স্থানে ঘাঁটি করেছিল।

মুসলমানদের সেখানে জায়গা ছিল সংকীর্ণ। সামনে পারসিক বাহিনী। পেছনে খরস্রোতা ফুরাত নদী। পিছূ হটলেই ডুবে মরতে হবে।

তুমুল লড়াই শুরু হলে পারসিকরা তাদের হাতিগুলোকে মুসলমানদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

হাতিগুলো সাথে ছিল ঘন্টাধ্বনি। আরবি ঘোড়াগুলো ইতিপূর্বে হাতি দেখে নি।

এত বড় হাতি ও ঘন্টার শব্দ শুনে ঘোড়াগুলো ছুটাছুটি শুরু করে। এগুলো মুসলমানদের নিয়েন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়।

পাশাপশি পারসিকদের তীরের আওতাধীন থাকায় মুসলমানদের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছিল।

মুসলিম সেনাপতির মৃত্যু

অবস্থা বেগতিক দেখে মুসলিম সেনাপতি আবু উবায়েদ সাকাফি রহ. ঘোড়া থেকে নেমে শুধুমাত্র তলোয়ার হতে করে পারসিক হাতিগুলোর দিকে অগ্রসর হন।

সেনাপতির সাথে আরো অনেক মুজাহিদও হাতিগুলো দিকে অগ্রসর হন। মুসলমানরা প্রাণ হাতে নিয়ে হাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।

আবু উবায়েদ সাকাফি পারসিকদর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিটির দিকে অগ্রসর হন। তিনি তরবারির মাধ্যমে শক্তভাবে হাতিটিকে আঘাত করেন।

কিন্তু হাতিটি আহত হয়ে আবু উবায়েদ সাকাফি রহ. কে শুঁড় দিয়ে প্যাচিয়ে আছাড় মারে।

এরপর পা দ্বারা পিষ্ট করে দেয়। সেনাপতি আবু উবায়েদ সাকাফি রহ. সেখানেই শহীদ হয়ে যান।

মুসলিম মুজাহিদরা এই দৃশ্য দেখে সাকিফ গোত্রের অপর একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়। অনেকে পিছু হটতে থাকে।

আবু উবায়েদ সাকাফি রহ. এর লাশ উদ্ধারের জন্য কেউ কেউ অগ্রসর হয়। কিন্তু হাতিগুলো তাদেরকেও আক্রমণ করে শহীদ করে দিচ্ছিল।

মুসলমানরা তখন পিছু হঠতে থাকে। কিন্তু সাফিক গোত্রের জানবাজরা কাফেরদের সাথে আরো জোরেশোরে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হন।

এদিকে এক মুজাহিদ মুসলিমরা যাতে পলায়ন না করে, এই চিন্তায় নদীর সাঁকো ভেঙ্গে ফেলে। এতে মুসলমানরা পুরো অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

এই পুলের যুদ্ধে হযরত মুসান্না বিন হারেসা রা. ও উপস্থিত ছিলেন। তিনিও আহত হন। হাজার হাজা মুসলমান শহীদ ও আহত হয়।

মুসান্না বিন হারেসা রা. নেতৃত্বের দায়িত্ব নিজ হাতে নিয়ে ভাঙ্গা সাঁকোটি মেরামত করেন। এছাড়াও মুসলিম মুজাহিদদের সাহস যোগাতে থাকেন।

এরপর মুসলমানদের জানবাজ একদল মুজাহিদদের পারসিকদের সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত রেখে বাকীদেরকে নদী পার হওয়ার সুযোগ দেন ‍মুসান্না বিন হারেসা রা.।

অবশেষে ৩ হাজার মুসলমান জীবিত ফিরে আসেন। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ৯ হাজার মুজাহিদদের মধ্যে ৪ হাজার মুজাহিদ শহীদ বা নদীর ঢেউয়ে মারা যান। ২ হাজার মুজাহিদ আত্মগোপন করেন।

ইতিহাসখ্যাত এই সেতুর যুদ্ধ বা ব্রিজের যুদ্ধ বা সাঁকো যুদ্ধ অথবা সেতুর যুদ্ধে ৬ হাজার পারসিক সেনাবাহিনী মারা গিয়েছিল। নবীজির সময় থেকে তখন পর্যন্ত এই যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের বড় ধরনের পরাজয়।

খলিফা উমর রা. এর নিকট সেতুর যুদ্ধ এর সংবাদ

মুসলমানদের মধ্য থেকে অনেকেই ময়দানে স্থির থাকতে না পেরে পালিয়ে যায়।

কেউ কেউ মদীনায় এসে পড়ে। এই পরাজয়ের সংবাদ খলিফার নিকট আনেন আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ রহ.।

খলিফা উমর রা. তখন মসজিদের মিম্বরে বসে ছিলেন। আব্দুল্লাহকে দেখে বললেন, কি সংবাদ নিয়ে এসেছ? আব্দুল্লাহ বললেন, সঠিক সংবাদ নিয়ে এসেছি।

এরপর আব্দুল্লাহ খলিফার নিকট গেলেন এবং কানে কানে প্রকৃত অবস্থা জানালেন।

হযরত উমর রা. সকলকে সান্তনা দিলেন। কোনো তিরষ্কার করেন নি। এই যুদ্ধের পর নতুন করে আরেকটি যুদ্ধ হয় পারসিকদের সাথে।

পারসিকরা আগেরবার জিতে ভেবেছিল, এবারও জিতবে। কিন্তু তাদের শোচনীয়ভাবে পরাজয় হয়। ইতিহাসে সেই যুদ্ধটি বুহাইব যুদ্ধ নামে খ্যাত।

তথ্যসুত্র

মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৪১-১৪৩

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড ৭, ‍পৃষ্ঠা ৫৭-৫৯

জীবন ও কর্ম, উমর ইবনে খাত্তাব রা., খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৩৬-১৩৮

Scroll to Top