হযরত উসমান রাঃ এর জীবনী

নবীজির অন্যতম সাহাবী এবং উমর রাঃ এর মৃত্যুর পর নির্বাচিত হওয়া আমিরুল মুমিনীন হযরত উসমান রাঃ এর জন্ম হয় আরবের তায়েফ শহরে।

তিনি “আ’মুল ফীল” তথা হস্তিবর্ষের ছয় বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। সেই মোতাবেক তিনি নবীজির পাঁচ বছরের ছোট ছিলেন।

হযরত উসমান রাঃ এর পিতার নাম হলো, আফফান। এরপরের পূর্বপুরুষদের নাম যথাক্রমে দেয়া হচ্ছে এভাবে যে,

উসমান বিন আফফান বিন আবুল আস বিন আবদুশ শামস বিন আবদুল মানাফ বিন কুসাই বিন কিলাব বিন মুররা বিন ফাহার বিন মালেক …………. বিন আদনান।

এভাবেই আবদুল মানাফে গিয়ে তার বংশতালিকা নবীজির বংশতালিকার সাথে মিলে যায়।

হযরত উসমান রাঃ এর মায়ের নাম হলো, আরওয়া বিনতে কুরাইজ।

উনার পূর্বপুরুষদের নাম যথাক্রমে হলো, আরওয়া বিনতে কুরাইজ বিন রাবিআ বিন হাবিব বিন আব্দুশ শামস বিন আব্দুল মানাফ বিন কুসাই ………………… বিন আদনান।

উসমান রাঃ এর নানী ছিলেন উম্মুল হাকিম বাইজা বিনতে আব্দুল মুত্তালিব। তিনি নবীজির সম্মানিত পিতা আব্দুল্লাহর আপন সহোদর বোন ছিলেন।

ঐতিহাসিক যুবায়ের বিন বাক্কার রহ. এর মতে, তারা উভয়ে জমজ ছিলেন। উসমান রাঃ এর মা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন।

জাহেলি যুগে হযরত উসমান রাঃ এর উপনাম ছিল আবু আমর।

কিন্তু নবীজির কন্যা রুকাইয়া রাঃ এর সাথে তার বিয়ের পর যখন তার গর্ভে আব্দুল্লাহ রাঃ এর জন্ম হয় তখন থেকে তিনি আবু আব্দুল্লাহ উপনাম ধারণ করেন।

হযরত উসমান রাঃ কে যুন-নুরাইন উপাধীতে ডাকা হতো। আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি রহ. বলেন,

মাহলাব ইবনে আবু সুফরা রহ. কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন উসমান রাঃ কে যুন-নুরাইন নামে ডাকা হয়।

তখন তিনি বলেছিলেন, তিনি ব্যতিত আর কেউ এমন ছিল না যে, নবীজির দুই মেয়েকে পর পর বিয়ের গৌরব অর্জন করেছেন। যুন-নুরাইন মানে দুই নূরের অধিকারী।

হযরত উসমান রাঃ এর গঠন ছিল মধ্যমাকার। অতিরিক্ত খাটো বা অতিরিক্ত লম্বা ছিলেন না। দাঁড়ি ছিল লম্বা।

মাথার চুল ছিল ঘন।

এ ছাড়াও তিনি ছিলেন উত্তম ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সর্বদা ইবাদাতে মগ্ন থাকতেন। রাতে তাহাজ্জুত ও কুরআন তেলওয়াত করতেন।

এই লেখায় যা যা থাকছে :

হযরত উসমান রাঃ এর স্ত্রী সন্তানগণ

উসমান রাঃ সর্বমোট বিয়ে করেছিলেন ৮ টি। আর প্রতিটি বিয়েই হয়েছিল তার ইসলাম গ্রহণের পরে। তার স্ত্রীদের নাম নিচে দেয়া হলো,

১. রুকাইয়া বিনতে রাসূল সা.। তার গর্ভে আব্দুল্লাহ রাঃ নামে একজন পুত্র সন্তান জন্মগ্রহন করেন।

২. উম্মে কুলসুম বিনতে রাসূল সা.। রুকাইয়া রাঃ এর ইন্তিকালের পরে উসমান রাঃ তাকে বিয়ে করেন।

৩. ফাখতা বিনতে গাজওয়ান রাঃ। তিনি ছিলেন আমির উতবা ইবনে গাজওয়ানের বোন। তার গর্ভে আব্দুল্লাহ আল আসগার রহ. জন্মগ্রহণ করেন।

৪. উম্মে আমর বিনতে জুনদুব আল আজদিয়া রাঃ। তার গর্ভে আমর, খালিদ, আবান, উমর ও মারইয়াম রহ. জন্মগ্রহণ করেন।

৫. ফাতিমা বিনতে ওয়ালিদ ইবনে আবদুস শামস। তার গর্ভে ওয়ালিদ, সায়িদ, উম্মু সাআদ রহ. জন্মগ্রহণ করেন।

৬. উম্মুল বানিন বিনতে উয়াইনা রহ.। তার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল মালিক রহ.।

৭. রামলা বিনতে শায়বা রহ.। তার গর্ভে আয়েশা, উম্মে আবান, উম্মে আমর রহ. জন্মগ্রহণ করেন।

৮. নায়লা বিনতে ফুরাফিসা। তিনি বিয়ের সময় খৃষ্টান ছিলেন। কিন্তু পরে মুসলমান হয়ে বাকী জীবন অতিবাহিত করেন।

হযরত উসমান ইবনে আফফান রাঃ এর  সন্তান ছিল ১৬ জন। তাদের মধ্যে ৯ জন পুত্র এবং ৭ জন কন্যা।

নয়জন পুত্র যথাক্রমে:

১. আব্দুল্লাহ রাঃ। তার মা ছিলেন নবীজির কন্যা রুকাইয়া রাঃ। হিজরতের দুই বছর পূর্বে তার জন্ম। তিনি বাবা-মায়ের সাথে মদিনায় হিজরত করেন। শৈশবে একটি মোরগ তার চোখের পাশে ঠোকর দেয়। এর ফলে তিনি মারাত্মক আহত হন। এই আঘাতের ফলেই প্রভাব পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই অসুখে ৪র্থ হিজরীতে তিনি ইন্তিকাল করেন। তখন তার বয়স ছিল ৬ বছর।

২. আব্দুল্লাহ আল আসগার রহ.। তার মা ছিলেন ফাখতা বিনতে গাজওয়ান।

৩. আমর রহ.। তার মায়ের নাম ছিল আমর বিনতে জুনদুব। তিনি তার পিতার নিকট হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। ৮০ বছর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন।

৪. খালিদ রহ.। তার মায়ের নাম ছিল আমর বিনতে জুনদুব।

৫. আবান রহ.। তার মায়ের নাম ছিল আমর বিনতে জুনদুব। তিনি ছিলেন ফিকাহ্ শাস্ত্রের ইমাম। আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের শাসনামলে তিনি মদীনার গভর্নর ছিলেন। তিনি ১০৫ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।

৬. উমর রহ.। তার মায়ের নাম ছিল আমর বিনতে জানদুব।

৭. ওয়ালিদ রহ.। তার মায়ের নাম ছিল ফাতিমা বিনতে ওয়ালিদ মাখজুমী।

৮. সায়িদ রহ.। তার মায়ের নাম ছিল ফাতিমা বিনতে ওয়ালিদ মাখজুমী। মুয়াবিয়া রাঃ এর শাসনামলে ৫৬ হিজরীতে তিনি খোরাসানের গভর্নর ছিলেন।

৯. আবদুল মালিক রহ.। তার মায়ের নাম ছিল বানিন বিনতে উয়াইনা। বাল্যকালেই তিনি ইন্তিকাল করেন।

সাতজন কন্যা যথাক্রমে:

১. মারইয়াম রহ.। তার মায়ের নাম ছিল আমর বিনতে জুনদুব।

২. উম্মে সায়িদ রহ.। তার মায়ের নাম ছিল ফাতিমা বিনতে ওয়ালিদ মাখজুমী।

৩. আয়েশা রহ.। তার মায়ের নাম ছিল রামলা বিনতে শায়বা রহ.।

৪. উম্মে আবান রহ.। তার মায়ের নাম ছিল রামলা বিনতে শায়বা রহ.।

৫. উম্মে আমর রহ.। তার মায়ের নাম ছিল রামলা বিনতে শায়বা রহ.।

৬. মারইয়াম রহ.। তার মায়ের নাম ছিল নায়লা বিনতে ফুরাফিসা।

৭. উম্মুল বানিন রহ.। তার মা ছিলেন একজন উম্মুল ওয়ালাদ (মায়ের মর্যাদাপ্রাপ্ত দাসী)।

উসমান রাঃ এর ভাই-বোন

হযরত উসমান রাঃ এর ৩ ভাই ও ৪ বোন ছিল। তার সকল ভাই আপন সহোদর ছিলেন না। বৈপিত্রীয় এবং বৈমাত্রিয় ভাই-বোন ছিল উনার। তাদের পরিচয় যথাক্রমে আলোচনা করা হলো।

ভাই

১. ওয়ালিদ ইবনে উকবা রাঃ। তার পিতা উকবা ইবনে মুয়িত বদরযুদ্ধে নিহত হয়।

হুদায়বিয়ার সন্ধির পর ওয়ালিদ তার ভাই আমারাকে নিয়ে বোন উম্মে কুলসুমকে ফিরিয়ে নিতে মদীনায় আসেন।

উম্মে কুলসুম ইতিপূর্বে ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় হিজরত করেন। কিন্তু নবীজি তাকে ফেরত দেন নি।

ওয়ালিদ মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করেন।

২. আমরা ইবনে উকবা রাঃ। তিনি বেশ বিলম্বে ইসলাম গ্রহণ করেন।

৩. খালিদ ইবনে উকবা।

বোন

১. আমেনা বিনতে আফফান রাঃ। তিনি ছিলেন উসমান রাঃ এর সহোদর বোন। জাহেলি যুগে তিনি বিনুনি বাঁধার পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

হিশাম ইবনে মুগিরার আজাদকৃত গোলাম হাকিম বিন কায়সানের সাথে তার বিয়ে হয়।

আব্দুল্লাহ বিন জাহাশ রাঃ এর সেনাদল হাকিমকে গ্রেপ্তার করে মদীনায় নিয়ে আসে।

এরপর তিনি মুসলিম হয়ে মদীনাতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। চতুর্থ হিজরীতে বীরে মাউনার যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

আমেনা তখনো মক্কায় মুশরিক অবস্থায় ছিলেন। মক্কা বিজয়ের সময় তিনি তার মা ও বোনদের সাথে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন।

তিনি আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবার সাথে রাসূলের নিকট বাইয়াত হন।

তখন তিনি হিন্দের মতো শিরক, চুরি এবং জিনা না করার অঙ্গীকার করেন।

২. উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা রাঃ। তিনি মক্কায় ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেন।

এরপর মদিনায় হিজরত করে রাসূলের বায়আত হন। তিনি ছিলেন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করা প্রথম নারী।

৩. উম্মে হাকিম বিনতে উকবা।

৪. হিন্দ বিনতে উকবা রাঃ। তিনি মক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন এককালে মক্কার কুরাইশদের সর্দার আবু সুফিয়ানের স্ত্রী।

হযরত হামজা রাঃ কে ওহুদের ময়দানে শহীদ করার পর তিনি তার কলিজা চিবিয়েছিলেন।

এরপরও নবীজি ইসলাম গ্রহণের পর তাকে মাফ করে দিয়েছেন।

আবু সুফিয়ানও মক্কা বিজয়ের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত আব্বাস রাঃ তাকে নবীজির নিকট নিয়ে আসেন। সেখানেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।

আবু সুফিয়ানের মেয়ে হাবিবা রাঃ নবীজির সম্মানিতা স্ত্রী ছিলেন।

হযরত উসমান রাঃ এর ইসলাম গ্রহণ

জাহেলি যুগেও হযরত উসমান রাঃ বংশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। তিনি ছিরেন সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী।

গোত্রের লোকেরা তাকে ভালোবাসতো, সম্মান করতো, পছন্দ করতো। উসমান রাঃ ছিলেন খুবই লাজুক স্বভাবের। কিন্তু সত্যকে চিনতে পারতেন।

হযরত উসমান রাঃ জাহেলি যুগেও কখনো মূর্তিপূজা করেন নি। সামাজিক কোনো বন্ধ কাজেও জড়ান নি। তিনি মদপানও করেন নি কখনো।

উসমান রাঃ বলতেন, মানুষের সবচেয়ে বড় নিয়ামত হচ্ছে তার জ্ঞানবুদ্ধি। আর এই জ্ঞানকে নিভিয়ে দেয় মদ বা অ্যালকোহল।

জাহেলি যুগে তিনি আরবদের জ্ঞানশাস্ত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন। আরবি সাহিত্য, বংশতালিকা এবং ইতিহাস সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান ছিল।

তিনি বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতেন। তাই তার অভিজ্ঞতার ভান্ডারও ছিল অনেক। ইথিওপিয়া ও শামে তিনি প্রায় সময়েই যাতায়াত করতেন।

উত্তরাধিকারসুত্রে পাওয়া সম্পদ তিনি ব্যবসার মাধ্যমে উত্তমভাবে ব্যয় করেন। আল্লাহ তার ব্যবসায় বরকত দিয়েছিলেন।

তিনি বনু উমাইয়ার শীর্ষ ব্যবসায়ীদের একজন ছিলেন। সেকালে তিনি এতটাই সম্মানের পাত্র ছিলেন যে, আরবীয় নারীরা তাদের সন্তাদের ঘুম পাড়ানোর সময় বলতো,

أحبك والرحمن حب قريش لعثمان

রহমানের শপথ! আমি তোমাকে ঠিক সেভাবেই ভালোবাসি যেভাবে কুরাইশরা উসমানকে ভালোবাসে।

হযরত আবু বকর রাঃ যখন উসমানকে ইসলামের দাওয়াত দেন তখন কোনো দ্বিধা-সংশয় ছাড়াই তিনি সঙ্গে সঙ্গে দাওয়াতে সাড়া দেন।

উসমান রাঃ এর বয়স ছিল তখন ৩৪ বছর। তিনি ছিলেন প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম। উসমান রাঃ যেভাবে ইসলাম গ্রহন করেন, তা তিনি নবীজিকে এভাবে বলেন,

হে আল্লাহর রাসূল! আমি মাত্রই শাম থেকে ফিরে এসেছি। আমাদের কাফেলা যখন শাম থেকে ফিরছিল, তখন আমরা মাআন ও জারকার মধ্যখানে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম।

সে সময় আমার চোখে তন্দ্রার ভাব চলে আসে। তখন আমি এক আহবানকারীকে বলতে শুনি, হে ঘুমন্ত ব্যক্তিরা! উঠো। আহমাদ মক্কায় আবির্ভূত হয়েছেন।

এরপর আমরা মক্কায় পৌঁছে আপনার নবুয়ত সম্পর্কে জানতে পারি। নিঃসন্দেহে এটি ছিল এমন ঘটনা, যা মানুষের অন্তরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে পারে না।

উসমান রাঃ এর হাবশায় হিজরত

হযরত উসমান রাঃ এর ইসলাম গ্রহণের পর নবীজি সা. অত্যন্ত খুশী হন। মুসলমানদের সংখ্যা তখন ক্রমে ক্রমেই বাড়তে থাকে।

নবীজি সা. তখন তার স্বীয় কন্যা হযরত রুকাইয়া রাঃ কে উসমান রাঃ এর সাথে বিবাহ দেন। ইতিপূর্বে রুকাইয়াকে নবীজি আবু লাহাবের পুত্রের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু আবু লাহাব নবীজির সাথে শত্রুতার জের ধরে যখন সূরা লাহাব অবতীর্ণ হয় তখন সে ও তার স্ত্রী তার ছেলে উতবাকে নবীকন্যা রুকাইয়া রাঃ কে তালাক দেয়ার আদেশ দেয়।

যখন হযরত উসমান রাঃ নবীজির মেয়ের তালাকের সংবাদ শুনেন তখন তিনি নবীজির নিকট এসে রুকাইয়া রাঃ কে বিয়ের প্রস্তাব দেন।

নবীজি সা. তখন তার প্রস্তাব গ্রহণ করে তার মেয়েকে উসমান রাঃ এর হাতে তুলে দেন। উসমান রাঃ ছিলেন কুরাইশদের মধ্যে সুদর্শন যুবক।

নবীজির কন্যা রুকাইয়া রাঃ ও ছিলেন পরম সুন্দরী ও ধৈর্য্যশীল নারী। যখন উভয়জনের মধ্যে বিয়ে সংগঠিত হলো তখন মানুষ বলতে লাগলো,

মানুষ দেখেছে সুন্দর যুগল, তারা ছিলেন উসমান ও রুকাইয়া।

হযরত আব্দুর রহমান ইবনে উসমান কুরাইশি রাঃ থেকে বর্ণিত যে, নবীজি একবার তার কন্যার ঘরে উপস্থিত হন।

তখন রুকাইয়া রাঃ উসমানের মাথা ধুইয়ে দিচ্ছিলেন।

নবীজি রুকাইয়াকে বলেছিলেন, মা আবু আব্দুল্লাহর (উসমান রাঃ এর উপনাম) সাথে উত্তম আচরণ করবে।

সে আমার সাহাবী ও চরিত্রে আমার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সংগতিশীল।

আবু লাহাব ও তার স্ত্রী ভেবেছিল, নবীজির মেয়েকে তালাকের মাধ্যমে তারা নবীজিকে মানসিক হয়রানিতে ফেলবে।

কিন্তু আল্লাহ হযরত রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুম রাঃ এর কপালে সৌভাগ্য লিখে রেখেছিলেন।

উসমানের বিয়ের মাধ্যমে আবু লাহাব ও উম্মে জামিল লজ্জিত হয়।

উসমান রাঃ এর হাবশায় হিজরত

যখন মক্কায় আস্তে আস্তে ইসলামের বাণী প্রকাশ হতে লাগলো তখন মানুষ ইসলাম সম্পর্কে জানতে লাগলো।

ধনী ও উচ্চশ্রেণীর লোকেরা ইসলামের বিরোধিতা শুরু করলো।

গরীব-অসচ্ছল ব্যক্তিরা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে লাগলো। এটা মক্কার মুশরিকরা সহ্য করতে পারে নি। তারা মুসলমানদের উপর নির্যাতন শুরু করলো।

হযরত উসমান রাঃ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হয়েও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তার চাচা হাকাম বিন আস তাকে রশি দিয়ে বেঁধে জিজ্ঞাসা করতো,

তুমি তোমার বাপ দাদার ধর্ম ছেড়ে নতুন ধর্ম গ্রহণ করতে গেলে কেন? যতক্ষণ তুমি বাপ-দাদার ধর্মে ফিরে না আসবে, ততক্ষণ আমি তোমাকে বাঁধনমুক্ত করবো না।

উসমান রাঃ তখন নির্ভীকচিত্তে বলেছিলেন, আল্লাহর কসম! আমি ওই ধর্ম থেকে ফিরে আসবো না। হাকাম শেষ পর্যন্ত রশি খুলে দিতে বাধ্য হয়।

মুসলমানদের উপর নির্যাতনের মাত্রা ছিল খুবই বেশি। কাফেররা হযরত ইয়াসির রাঃ ও তার স্ত্রী সুমাইয়া রাঃ কে হত্যা করে।

নবীজি তখন মুসলমানদের নিরাপত্তা নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি নিরাপদ স্থান খুঁজতে থাকেন। সাহাবাদেরকে তিনি তখন বলেন,

তোমরা যদি হিজরত করে হাবশায় (ইথিওপিয়া) চলে যাও তাহলে হয়তো শান্তিতে জীবন-যাপন করতে পারবে। কারণ সেখানকার বাদশাহ্ কল্যানকামী।

সাহাবারা তখন এক এক করে হাবশায় পাড়ি জমাতে লাগলেন। সাহাবারা লোহিত সাগরের উপকূলে গিয়ে জাহাজে করে হাবশায় হিজরত করেন।

উসমান রাঃ এর হাবশায় হিজরত হয় নবুয়তের পঞ্চম বর্ষে। হযরত উসমান রাঃ ও তার স্ত্রী রুকাইয়া রাঃ হাবশায় হিজরত করেন।

মুক্তভাবে আল্লাহর ইবাদত করার সৌভাগ্য তারা সেখানে অর্জন করেন।

উস্মাহর মধ্যে উসমান ই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি নিজের স্ত্রীসহ হিজরত করেন।

এরপর যখন নবীজি হিজরত করে মদীনায় চলে যান তখন তারা হাবশা থেকে ফিরে আসে।

নবীজির সাথে উসমান রাঃ

ইসলাম গ্রহণের পরই নবীজির সাথে হযরত উসমান রাঃ এর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে। হযরত উসমান রাঃ ছিলেন কুরআশের অন্যতম সম্রান্ত যুবক।

নবীজি সা. তার সাথে নবীকন্যা রুকাইয়া রাঃ কে বিবাহ দেন। এরপর থেকে নবীজির সব কাজেই হযরত উসমান রাঃ থাকতেন একদম শীর্ষে।

উসমান রাঃ কুরআনী নীতির আলোকে শিক্ষালাভ করতে থাকেন। নবীজি ছিলেন তার দীক্ষাগুরু। কাফেরদের শত বাধা টলাতে পারে নি তাকে।

মদীনায় হিজরতের পর রাসূল সা. ইসলামী রাষ্ট্রের গোঁড়া সুদৃঢ় করার প্রতি মনোযোগ দেন।

তিনি প্রথমেই আনসার ও মুহাজির সাহাবীদেরকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দেন।

হযরত উসমান রাঃ ভাই হিসেবে পান হযরত আউস ইবনে সাবিত রাঃ কে। উসমান ছিলেন অত্যন্ত সম্পদশালী।

তিনি কখনো ইসলামের জন্য সম্পদ ব্যয় করতে কার্পণ্য করেন নি।

বদরযুদ্ধে হযরত উসমান রাঃ

২য় হিজরীতে মুসলমানরা যখন বদরের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন তখন উসমান রাঃ ও তাদের সাথে প্রস্তুত হলেন।

উসমান রাঃ এর স্ত্রী হযরত রুকাইয়া রাঃ ছিলেন তখন গুটিবসন্তে রোগে আক্রান্ত।

এ অবস্থায় নবীজি সা. উসমান রাঃ কে তার স্ত্রীর নিকট থাকতে আদেশ দেন।

এরপর রাসূল সা. মুজাহিদদের নিয়ে রওয়ানা হন। উসমান রাঃ মদীনায় স্ত্রীর নিকট রয়ে যান।

রুকাইয়া রাঃ এর অসুখ ক্রমে ক্রমেই বাড়তে থাকে।

একটা সময়ে রুকাইয়া রাঃ এর শেষ সময় চলে আসে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার বোন জায়নাব রাঃ কে দেখতে আকুল হয়ে উঠেন।

কিন্তু তিনি তখন মক্কায় ছিলেন। তাই উসমান রাঃ তার আবদার পূর্ণ করতে পারেন নি। এরপর কালিমায়ে তাইয়্যেবা পড়ে রুকাইয়া রাঃ নশ্বর পৃথিবীকে বিদায় জানান।

নবীজির মেয়ে রুকাইয়া রাঃ এর মৃত্যুর সময়ে নবীজি মদীনার বাহিরে জিহাদরত ছিলেন।

উসমান রাঃ ভ্রারক্রান্ত হৃদয়ে স্ত্রীকে জান্নাতুল বাকীতে দাফন করেন।

উপস্থিত সকলের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। যখন লোকজন রুকাইয়া রাঃ কে দাফন করে বাড়ির পথ ধরে তখন জায়েদ ইবনে হারিসা রাঃ বদরের বিজয়ের সংবাদ নিয়ে মদীনায় উপস্থিত হন।

বিজয়ের সংবাদ শুনে সকলের দুঃখ যেন চলে গেল। নবীজি মেয়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তার কবর জিয়ারত করলেন।

মুনাফিকরা বলতে থাকে, উসমান বদরে অংশ নেয় নি। নবীজি তাদের যুক্তি খন্ডনের জন্য তাকেও মুজাহিদদের মতো গণিমতের অংশ দেন।

এ জন্য উম্মাহর সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হলো, উসমান রাঃ বদরি সাহাবীদের একজন ছিলেন। কারণ তিনি নবীজি আদেশেই মদীনায় ছিলেন।

উহুদযুদ্ধে হযরত উসমান রাঃ

উহুদযুদ্ধের শুরুতে মুসলমানরা বিজয়ী হয়। কিন্তু একটি ভুলের কারণে তারা পরাজিত হওয়ার ধারপ্রান্তে চলে যায়।

যখন কাফেররা হঠাৎ পাহাড়ের পেছন থেকে তীব্র আক্রমণ করে তখন অনেকেই দিশেহারা হয়ে মদীনা অভিমুখে পালিয়ে যান।

হযরত উসমান রাঃ ছিলেন তাদের একজন। তারা যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফিরে আসে নি।

আরেকদল নবীজির মিথ্যা শাহাদাতের সংবাদ শুনে অস্থির হয়ে যান।

আরেকদল ময়দানে দৃঢ়পদ থাকেন। কুরআনে আল্লাহ এই তিনদলের কথা উল্লেখ করে সকলকে ক্ষমার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

    اِنَّ الَّذِیۡنَ تَوَلَّوۡا مِنۡکُمۡ یَوۡمَ الۡتَقَی الۡجَمۡعٰنِ ۙ اِنَّمَا اسۡتَزَلَّهُمُ الشَّیۡطٰنُ بِبَعۡضِ مَا کَسَبُوۡا ۚ وَ لَقَدۡ عَفَا اللّٰهُ عَنۡهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ حَلِیۡمٌ

    নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্য থেকে যারা পিছু হটে গিয়েছিল সেদিন, যেদিন দু’দল মুখোমুখি হয়েছিল, শয়তানই তাদের কিছু কৃতকর্মের ফলে তাদেরকে পদস্খলিত করেছিল। আর অবশ্যই আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করেছেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, সহনশীল।

    (সূরা আলে ইমরান ১৫৫ নং আয়াত)

গাফতান যুদ্ধে উসমান রাঃ

নবীজি সা. মুসলমানদেরকে গাফতানিদের উপর চড়াও হওয়ার নির্দেশ দিলে ৪০০ জন মুজাহিদ সাহাবী বের হন। তার সাথে ছিল কয়েকটি ঘোড়া।

উসমান রাঃ কে তখন নবীজি মদীনায় স্থলাভিষিক্ত হিসেবে রেখে যান। নবীজি যখন গাফতানিদের নিকট গেলেন তখন তারা বিনা যুদ্ধেই আত্মসমর্পন করে।

নবীজি এ সময়ে প্রায় ১১ দিন মদীনার বাহিরে অবস্থান করেন।

বাইয়াতে রেদওয়ানে উসমান রাঃ

হুদাইবিয়ার সময়ে যখন নবীজি মক্কার নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছলেন তখন উসমান রাঃ কে দূত হিসেবে মক্কায় প্রেরণ করেন।

উসমান রাঃ বের হওয়ার পর বালদা নামক স্থানে কুরাইশদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। তারা জিজ্ঞাসা করে, কোথায় যাচ্ছ তুমি?

উসমান রাঃ বলেন, আমাকে নবীজি প্রতিনিধি বানিয়ে তোমাদের নিকট পাঠিয়েছেন।

তিনি তোমাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান জানাচ্ছেন, নিশ্চয় তার দ্বীন আল্লাহ বিজয়ী করবেন।

কাফেররা উসমান রাঃ এর কথাগুলো হজম করতে পারছিল না। তাই তারা বললো, আপনার কথাগুলো শোনার জন্য আমরা প্রস্তুত নই।

কিন্তু মুহাম্মাদ জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করতে পারবেন না। আপনি ফিরে গিয়ে তাকে বলুন, তিনি চাইলেও এখানে আসতে পারবেন না।

এদিকে আবান ইবনে সায়্যিদ নামে জনৈক ব্যক্তি উসমান রাঃ কে স্বাগত জানিয়ে মক্কায় নিয়ে যায়।

এরপর মক্কার প্রত্যেক নেতার সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করা হয়।

তারা সকলেই উসমান রাঃ এর কথায় এড়িয়ে যায়। তারা বলে, মুহাম্মাদ কখনো মক্কায় প্রবেশ করতে পারবেন না। আর আপনি যেহেতু এসেছেন, তাই আপনি তাওয়াফ করে যান।

কিন্তু উসমান রাঃ তাদের প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়ে বলেন, আমি কখনো মুহাম্মাদ সা. কে ছাড়া কাবা তাওয়াফ করবো না।

উসমান রাঃ যখন মক্কায় তার কর্মতৎপরতা চালাচ্ছিলেন তখন মুসলমানদের নিকট ‍গুজব ছড়িয়ে পড়লো, উসমান রাঃ কে হত্যা করা হয়েছে।

তাই অবস্থার প্রেক্ষিতে নবীজি কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শপথ গ্রহণ করেন। সাহাবীগণ নবীজির ডাকে সাড়া দেন।

সর্বপ্রথম আবু সিনান আব্দুল্লাহ রাঃ নবীজির হাতে বায়আত গ্রহণ করেন।  সালামা ইবনে আকওয়া তিনবার নবীজির হাতে বায়আত গ্রহণ করেন।

বাইয়াত শেষে নবীজি তার ডান হাত সম্পর্কে বলেন, এটি উসমানের হাত। এরপর ওই হাতটি তার অন্য হাতে রেখে উসমানের বায়আত গ্রহণ করেন।

এই সাহাবীদেরকেই বাইয়াতের রেদওয়ানের সাহাবী বলা হয়। তার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪০০  জন।

তাবুকযুদ্ধে হযরত উসমান রাঃ

নবম হিজরীতে রোমসম্রাট হিরাক্লিয়াস আরব অঞ্চল জবরদখলের পায়তারা করে। সে তার বাহিনীকে নিয়ে যুদ্ধের জন্য আরব অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

নবীজি এই সংবাদ জানার পর তিনি সাহাবীদেরকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বলেন। সময়টা ছিল প্রচন্ড গরমের।

তা ছাড়া তখন সবেমাত্র ফল পেকেছে।

এই মুহুর্তে সবকিছু ফেলে যুদ্ধে যাওয়াটা ছিল বিরাট কষ্টের। তা ছাড়া দুর্ভিক্ষের কারণে অর্থকড়িও ছিল কম।

তাই নবীজি সাহাবীদেরকে যুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহের আহবান জানান।

সাহাবীরা সামর্থ্য অনুযায়ী সম্পদ নিয়ে আসতে থাকে। নারীরা অলঙ্কার বিক্রি করে যুদ্ধের জন্য অর্থকড়ি পাঠায়। কিন্তু তারপরও তা যুদ্ধের জন্য যথেষ্ঠ ছিল না।

তাই নবীজি তখন বলেন, কেউ কি আছ, যে যুদ্ধের প্রয়োজনীয় জিনিষ সংগ্রহ করে দিবে? আর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন।

উসমান রাঃ আল্লাহর এই সন্তুষ্টির কথা শুনে এগিয়ে আসেন। তিনি তাবুক যুদ্ধের জন্য ৯৪০ টি উট এবং ৬০ টি ঘোড়া দান করেন।

এভাবে উট ও ঘোড়া মিলিয়ে তিনি হাজার সংখ্যক বাহনের ব্যবস্থা করে দেন। এ ছাড়া নবীজি দরবারে ১০ হাজার দিনার (প্রায় ৩৬৪ কোটি ৯৩ লাখ ৪১৫৳ টাকা সমপরিমান মূল্য) উপস্থিত করেন।

রাসূল সা. উসমান রাঃ এর দান করা সম্পদ দেখছিলেন আর বলছিলেন, আজকের পর থেকে উসমান যাই করুক, কিছুতেই তার ক্ষতি হবে না।

রাসূল সা. সাহাবীদেরকে নিয়ে দামেষ্ক ও মদীনার নিকটবর্তী অঞ্চল তাবুক নামক স্থানে পৌছেন।

এখানে এসে নবীজি জানতে পারেন, হিরাক্লিয়াস ভয়ে পিছু হটেছে।

মুসলিম বাহিনী উসমান রাঃ এর দেয়া যাবতীয় যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন।

নবীজির সাথে উসমান রাঃ এর সম্পর্ক ছিল খুব নিবীড়। উসমান রাঃ যে কোনো প্রয়োজনে সর্বদা রাসূলের পাশে দাঁড়াতেন।

উম্মে কুলসুম রাঃ ও উসমান রাঃ

হযরত উম্মে কুলসুম রাঃ ছিলেন রাসূল সা. এর সম্মানিতা কন্যা। প্রথমে তার বিয়ে হয় আবু লাহাবের পুত্রের সাথে। কিন্তু সূরা লাহাব অবতীর্ণ হওয়ার পর সে উম্মে কুলসুমকে তালাক দেয়।

উম্মে কুলসুম রাঃ এর মূল নাম কি ছিল, তা জানা যায় না। তবে কয়েক ইতিহাসবিদ বর্ণনা করেন যে, তার নাম ছিল উমাইয়া। তিনি বয়সে ফাতেমা রাঃ এর বড় ছিলেন।

হযরত উসমান রাঃ এর প্রথম স্ত্রী রুকাইয়া রাঃ বদর যুদ্ধের সময় যখন ইন্তিকাল করেন, তখন এর কাছাকাছি সময়ে উমর রাঃ এর কন্যা হাফসা রাঃ এর স্বামীও ইন্তিকাল করেন।

উমর রাঃ তখন তার মেয়ের ব্যাপারে উসমান রাঃ এর নিকট প্রস্তাব নিয়ে আসেন। তিনি উসমান রাঃ কে বলেন, আপনি হাফসাকে বিয়ে করবেন?

উসমান রাঃ যেহেতু হাফসা রাঃ এর ব্যাপারে নবীজির আগ্রহের কথা জানতেন তাই উমরের প্রস্তাবে তিনি নীরব থাকেন।

উমর রাঃ নবীজির কাছে এই বিষয়ে অনুযোগ পেশ করলে নবীজি বললেন, তুমি কি এর চেয়ে উত্তম কিছু চাও? আমি হাফসাকে বিয়ে করবো আর উসমানের নিকট আমার কন্যা উম্মে কুলসুমকে বিয়ে দিব?

উম্মে কুলসুম রাঃ এর বিয়ের ঘটনা

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাঃ নবীকন্যা উম্মে কুলসুম রাঃ এর বিয়ের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন,

নবীজি উম্মে কুলসুমকে উসমানের সাথে বিয়ে দিলে উম্মে আয়মানকে বললেন,

আমার কন্যাকে রুখসত করার প্রস্তুতি নাও এবং দফ বাজাও। উম্মে আয়মান রাঃ তা করলেন। তিনদিন পর নবীজি তার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন,

মা, স্বামীকে কেমন পেলে? উম্মে কুলসুম বলেন, আব্বা, উত্তম হিসেবে পেয়েছি।

হযরত উম্মে কুলসুম রাঃ উসমান রাঃ এর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকাকালে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। তিনি নবম হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।

নবীজি তার জানাজার সালাত পড়ান এবং দাফনের সময় তার কবরের পাশে বসে পড়েন। নবীজি তখন বললেন,

তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে আজ রাতে স্ত্রীর সাথে সহবাস করো নি?

হযরত আবু তালহা রাঃ বললেন, আল্লাহর রাসূল, আমি আছি। নবীজি বললেন, তুমি তার কবরে নামো।

উম্মে কুলসুমের বিচ্ছেদ উসমানের মধ্যে বেশ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তিনি ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন।

নবীজি দেখতে পান, তিনি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে চলে যাচ্ছেন।

নবীজি তখন তার পাশে গিয়ে বললেন, উসমান আমার আর কোনো মেয়ে থাকলে তাকেও তোমার হাতে তুলে দিতাম।

এই কথাটি হযরত উসমান রাঃ এর প্রতি নবীজির ভালোবাসার প্রমাণ এবং নবীজির বিশ্বস্ততার দলীল।

হযরত উসমান রাঃ কূপ

যখন নবীজি সা. মদীনায় আসেন তখন মদীনায় পানির সংকট ছিল অনেক। সেই সময়ে মদীনায় রুমা নামক কূপের পানি ছিল মিষ্ট এবং খাওয়ার উপযোগী।

নবীজি সা. তখন সাহাবীদেরকে বললেন, যেই ব্যক্তি এই রুমা কূপ কিনে মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত করে দিবে, সে জান্নাতে এর চেয়ে উত্তম বিনিময় পাবে।

মিষ্ট পানির এই রুমা কূপটি ছিল একজন সাহাবীর। তার নাম রুমা ইবনে গিফারী রাঃ।

তিনি এই কূপের পানি প্রতি মশক এক মুদের বিনিময়ে বিক্রি করতো।

মুদ বলা হয়, সে সময়ের আরবের একটি পরিমাপক একককে। নবীজি সা. তখন রুমা রাঃ কে বললেন, তুমি কি কূপটি জান্নাতের বিনিময়ে বিক্রি করবে?

উক্ত সাহাবী তখন বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার ও আমার সন্তানদের জন্য এটা ছাড়া আয়ের ভিন্ন কোনো উৎস নেই।

হযরত উসমান রাঃ যখন জানতে পারলেন যে, রুমা কূপ উক্ত ব্যক্তি বিক্রি করবে না।

তখন তিনি তার নিকট থেকে ৩৫ হাজার দিরহামের বিনিময়ে কূপটি ক্রয় করে নেন। যা বাংলাদেশি টাকায় ১৫৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

উসমান রাঃ উক্ত কূপ ক্রয় করার পর নবীজির নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি কূপটি কিনে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেই, তাহলে কি আমার জন্যও সেই অঙ্গীকার থাকবে?

নবীজি বললেন, হ্যাঁ। তোমার জন্যও তা থাকবে। উসমান রাঃ তখন বললেন, তাহলে আমি  কূপটি মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত করে দিলাম।

আল্লাহ তা’আলা হযরত উসমান রাঃ এর দান কবুল করেছেন। তিনি আজো এই কূপ বহমান রেখেছেন। এখনো এই কূপে পানি আছে।

কূপটির পাশে একটি বাগান আছে। সেটিও উসমান রাঃ ক্রয় করে নিয়েছিলেন।

সৌদি মন্ত্রনালয় উক্ত স্থানটিকে যদিও প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত রেখেছে, তারপরও সেই বাগানে এখনো উক্ত কূপ থেকে পানি দেয়া হয়।

উসমানী খেলাফতকালের শাসক ও বর্তমান সৌদি শাসকদের পরিচর্যায় এখানে প্রায় ১৬০০ খেজুর গাছ আছে।

প্রতি বছর এই বাগানের খেজুর বিক্রির পর তার অর্ধেক মূল্য এতিম ও গরীবদের মাঝে বিতরণ করা হয়।

আবু বকরের যুগে হযরত উসমান রাঃ

১১ হিজরীতে নবীজি সা. এর ইন্তিকালের পর খলিফা হন হযরত আবু বকর রাঃ। আবু বকর রাঃ খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পরে তিনি বিজ্ঞ সাহাবীদেরকে মজলিসে শুরার অন্তর্ভুক্ত করেন।

হযরত উসমান বিন আফফান রাঃ ছিলেন আবু বকর রাঃ এর মজলিসে শুরার অন্যতম একজন সদস্য। আবু বকর রাঃ দুইজন সাহাবীকে দুই কারণে বেশি গুরুত্ব দিতেন।

দৃঢ়তা ও কঠোরতার জন্য উমর রাঃ কে এবং নম্রতা ও ধৈর্যের জন্য উসমান রাঃ কে। উমর রাঃ ছিলেন আবু বকর রাঃ এর মন্ত্রী এবং উসমান রাঃ ছিলেন জেনারেল সেক্রেটারির ভূমিকায়।

নবীজির ইন্তিকালের পর যখন আস্তে আস্তে ফেতনা প্রকাশ পেতে থাকে তখন সর্বপ্রথম যাকাত অস্বীকার করার ফেতনার উত্থান ঘটে।

এর পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে ধর্মত্যাগ ও মুরতাদ হওয়ার প্রবনতা বেড়ে যায়।

কিছু স্থানে মিথ্যা নবুয়তের দাবীদাররা লোকদের ধোঁকা দিয়ে তাদের ঈমান নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে থাকে।

তখন আবু বকর রাঃ অভিজ্ঞ সাহাবীদেরকে ডেকে বলেন, আপনাদের অভিমত কি? তখন অন্যদের পাশাপাশি উসমান রাঃ বলেন, আপনি এই উম্মাহর হিতাকাঙ্ক্ষী এবং তাদের উপর খুবই দয়ালু।

আপনি মুসলমানদের জন্য যা কল্যানকর মনে করেন, তা নির্দ্বিধায় করে যান। নিশ্চয় আপনার ব্যাপারে সন্দেহের কিছু নেই।

এরপর হযরত তালহা, ‍যুবায়ের, আবু উবায়দা, সায়িদ বিন জায়েদ রাঃ সহ উপস্থিত মুহাজির ও আনসার সাহাবারা এই কথার সাথে একমত পোষণ করেন এবং বলেন, উসমান সত্য বলেছেন।

পরামর্শক হিসেবে হযরত উসমান রাঃ

উসমান রাঃ হযরত আবু বকর রাঃ কে বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছেন।

যখন আল্লাহর রাসূলের খলিফা হযরত আবু বকর রাঃ বাহরাইনের গভর্নর নিযুক্তির ব্যাপারে পরামর্শ চাইলেন তখন উসমান রাঃ বললেন,

রাসূল সা. যেই ব্যক্তিকে বাহরাইনে পাঠানোর পর যেখানকার মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং তাদের ইসলাম গ্রহণের সংবাদ রাসূলের নিকট এনেছিলেন। তাকে সেখানে পাঠিয়ে দিন।

অর্থাৎ হযরত আ’লা ইবনে হাজরামি রাঃ কে সেখানে পাঠিয়ে দেন। কারণ সেখানকার লোকেরা তাকে চেনে এবং তিনিও তাদেরকে চেনেন।

এরপর আবু বকর রাঃ হযরত আ’লা ইবনে হাজরামি রাঃ কে বাহরাইনের গভর্নর বানিয়ে পাঠান।

যখন হযরত আবু বকর রাঃ মৃত্যুশয্যায় শায়িত তখন ওমর রাঃ কে শাসক হিসেবে নিযুক্তির ব্যাপারে যখন উসমান রাঃ কে জিজ্ঞাসা করলেন তখন তিনি বললেন,

আমার জানামতে তার ভেতরটা বাহির হতে অনেক উত্তম। আমাদের মধ্যে তার সমকক্ষ কেউ নেই। তার এই মন্তব্যের ব্যাপারে আবু বকর রাঃ বললেন,

আল্রাহ আপনার উপর রহম করুন, আপনি তার কথা না বললে আমি কষ্ট পেতাম।

আবু বকর রাঃ এর শাসনামলে অর্থনৈতিক মন্দা

হযরত আবু বকর রাঃ এর শাসনামলে একবার অনাবৃষ্টি দেখা দিল। লোকজন তার নিকট এসে বললো, বৃষ্টি না হওয়ায় ফসল উৎপন্ন হচ্ছে না। আমরা কঠিন পরিস্থিতির শিকার।

আবু বকর রাঃ তখন তাদেরকে বললেন, ধৈর্য্য ধরুন সন্ধা পর্যন্ত, ইনশাল্লাহ আল্লাহ অস্থিরতা দূর করে দিবেন।

ইতিমধ্যে উসমান রাঃ এর বাণিজ্যিক কাফেলা ১০০ উট বোঝাই গম নিয়ে শাম থেকে মদীনায় আসে।

সংবাদ পেয়ে লোকেরা তার নিকট ভিড় জমায়। উসমান রাঃ তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে উপস্থিত ব্যক্তিদের বললেন, আপনারা কি চান?

তারা বললো, আপনি জানেন বর্তমানে খরা চলছে, বৃষ্টি না হওয়ায় ফসল উৎপন্ন হচ্ছে না, মানুষ দুর্দশায় আছে। আপনার কাছে তো গম আছে। তাই তা আমাদের নিকট বিক্রি করুন।

উসমান রাঃ তাদেরকে বললেন, আপনারা আমাকে শাম থেকে কেনা মূল্যের উপর কত টাকা লাভ দেবেন? তারা বললো, আমরা ১০ টাকার (মুদ্রা) বিনিময়ে ১২ টাকা লাভ দেব।

উসমান রাঃ বললেন, আমি তো অন্য জায়গা থেকে এর থেকেও বেশি মুনাফা পাচ্ছি।

ব্যবসায়ীগণ তখন বললেন, তাহলে আমরা আপনাকে ১০ টাকার বিনিময়ে ১৫ টাকা লাভ দিব।

উসমান রাঃ বললেন, আমি এর থেকেও বেশি মুনাফা পাচ্ছি। ব্যবসায়ীগণ বললেন,

মদীনায় তো আমরা ব্যতিত অন্য কোনো ব্যবসায়ী নেই। আপনাকে এর চেয়ে বেশি মুনাফা কে দেবে?

তিনি বললেন, আল্লাহ আমাকে এর চেয়েও বেশি মুনাফা দিবেন। তিনি ১ টাকার বিনিময়ে ১০ টাকা দিবেন।

অর্থাৎ ১ দিরহামের (৩ গ্রাম রুপার মূল্য সমপরিমাণ) বিনিময়ে ১০ দিরহাম দিবেন।

আপনারা কি এর চেয়েও বেশি দিতে পারবেন? লোকেরা বললো, এটা তো অসম্ভব। তখন উসমান রাঃ বললেন, আমি এই খাদ্য মদীনার দরিদ্রদের জন্য সদকা করে দিলাম।

উমরের যুগে উসমান রাঃ

খলিফা হযরত আবু বকর রাঃ এর ন্যায় হযরত উমর রাঃ এর সময়কালেও উসমান রাঃ এর মর্যাদা ছিল অনেক।

মানুষ উমর রাঃ এর নিকট কিছু জানলে চাইলে উসমান বিন আফফান রাঃ বা আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ এর সহায়তা নিত।

একবার ওমর রাঃ কতিপয় লোকসহ বেরিয়ে সিরার নামক জায়গায় শিবির স্থাপন করলেন। উসমান রাঃ তখন উমরকে বললেন,

কি খবর, কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা করছেন? ওমর রাঃ তখন লোকজনকে উপস্থিত করে বললেন, আমি ইরাকে জিহাদ অগ্রসর করতে চাই।

উমর রাঃ খেলাফতের দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি বাইতুল মাল থেকে বেতন গ্রহণের ব্যাপারে সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করলে উসমান রাঃ বললেন, আপনি নিজে খান ও মানুষকে তা থেকে খাওয়ান।

বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতি আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ রাঃ উমর রাঃ কে বাইতুল মাকদিসে যেতে অনুরোধ করলে তিনি সাহাবীদের সাথে পরামর্শে বসেন।

উসমান রাঃ পরামর্শ দেন, আপনি সেখানে যাবেন না। আপনার না যাওয়াতে খৃষ্টানরা লাঞ্ছিত হবে।

আপনি না গেলে তারা ভাববে, আপনি তাদেরকে হিসেবেই ধরছেন না।

তবে হযরত আলী রাঃ সেখানে যাওয়ার পক্ষে পরামর্শ দেন।

পরে উমর রাঃ মুসলমানদের সহজতা এবং যুদ্ধের কঠিন পরিস্থিতি লাঘব করার উদ্দেশ্যে আলির মতকে প্রাধান্য দেন।

আমিরুল মুমিনীন হযরত উমরের যুগে ইসলামের বিজয়ধারা ক্রমশ বাড়তে থাকে।

এ সময় বিজিত এলাকা হতে প্রচুর ধনভান্ডার আসতে থাকে।

উমর রাঃ এই সম্পদের ব্যাপারে সাহাবীদের পরামর্শ চান। উসমান রাঃ বললেন,

আমি দেখতে পাচ্ছি সম্পদ পরিমাণে বেশি এবং তা সবার জন্য যথেষ্ট।

তবে যদি মানুষের সংখ্যা গণনা না করা হয় তাহলে কে কতুটুকু নিয়েছে, তা নিয়ে ভবিষ্যতে সংশয় দেখা দিতে পারে।

তাই খলিফা হযরত উমর রাঃ উসমান রাঃ এর পরামর্শ নিয়ে সকল তথ্য নথিভুক্ত করা শুরু করেন।

হযরত উমর রাঃ এর সময় হিজরী সন গণনা নিয়ে বড় একটি কাজ হয়।

কোনো কোনো বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, উসমান রাঃ মুহাররাম থেকে হিজরী সন গণনা শুরু করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

খারাজ ভূমি

হযরত উসমান রাঃ উমর রাঃ এর এই সিদ্ধান্তকে জোরালো সমর্থন দেন যে,

বিজিত এলাকার ভূমি বিজেতাদের মধ্যে বণ্টন না করে ভূমির মালিকদের জিম্মায় রাখা এবং বর্তমান মুসলমান ও তাদের সন্তানদের জন্য আয়ের উৎস হিসেবে রেখে দেয়া হোক,

যাতে তারা চিরকাল এ থেকে উপকৃত হতে পারে।

১৩ হিজরীতে উমর রাঃ খেলাফতে আরোহণ করার পর আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ কে হজ্জের কাফেলার আমির নিযুক্ত করেন।

তিনি সাহাবীদের নিয়ে হজ্জ সম্পাদন করেন। একইভাবে উমরের খেলাফতের শেষ বছর

তথা ২৩ হিজরির হজেও আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ খলিফার সঙ্গে ছিলেন।

ওমর রাঃ উম্মাহাতুল মুমিনীনদের হজ্জের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং তাদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ এর সাথে উসমান রাঃ কে দেয়া হয়।

উসমান রাঃ বাহনে চড়ে কাফেলার আগে আগে চলছিলেন। কাউকে নিকটে আসতে দেন নি।

যখন প্রান্তরে তাবু টাঙানো হতো তখন উসমান রাঃ ও আব্দুর রহমান রাঃ অন্য কোনো লোকদের উম্মাহাতুল মুমিনীনদের নিকটে আসতে দেন নি।

ওমরের পরে খলিফা নির্বাচন

হযরত ওমর রাঃ মৃত্যুর পূর্বে তার স্থলাভিষিক্ত নির্বাচনের জন্য হযরত উসমান, আলী, আব্দুর রহমান বিন আউফ, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস, তালহা ও যুবাইর বিন আওয়াম রাঃ এর সমন্বয়ে যেই কমিটি গঠন করেছিলেন, তারা সকলে এক স্থানে বসে পরামর্শে বসেন।

হযরত ওমর রাঃ এর অসিয়ত অনুযায়ী আবু তালহা রাঃ কামরার বাহিরে পাহারায় নিযুক্ত ছিলেন। কারো জন্যই ভেতরে প্রবেশের অনুমতি ছিল না।

পরামর্শের শুরুতে হযরত তালহা রাঃ হযরত উসমান রাঃ কে, হযরত যুবায়ের রাঃ হযরত আলী রাঃ কে, হযরত সাদ রাঃ আব্দুর রহমান রাঃ কে দায়িত্ব অর্পণ করে নিজেরা মুক্ত হয়ে যান।

তখন খেলাফতের জন্য শুধুমাত্র তিনজন ব্যক্তি ছিলেন। হযরত উসমান, হযরত আলী ও হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ।

এ অবস্থায় হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ হযরত উসমান ও আলী রাঃ কে বলেন,

আপনাদের দুজনের মধ্যে যে কোনো একজন নিজের অধিকার ছেড়ে দিন। যিনি অধিকার ছেড়ে দিবেন, এ বিষয়ে তিনি ফায়সালা করবেন।

তিনি আল্লাহ এবং ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে যাকে উত্তম মনে করবেন, তার ব্যাপারে ফায়সালা করবেন।

হযরত উসমান ও আলী রাঃ চুপ থাকলেন। তখন আব্দুর রহমান রাঃ বললেন, আচ্ছা তাহলে কি আপনারা আমাকে ফয়সালা করার অধিকার প্রদান করবেন?

আল্লাহর কসম! আমি আপনাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তিকে নির্বাচন করতে ত্রুটি করবো না। হযরত উসমান ও আলী রাঃ আনন্দচিত্তে এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন।

নির্বাচন

হযরত ওমর রাঃ মৃত্যুর পূর্বে শুরা কমিটিকে বলেছিলেন যে, লোকেরা আলী বা উসমানের মধ্য থেকে কাউকে গ্রহণ করবে।

যেহেতু এই দুজনই উম্মাহর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তাই তাদের মধ্যে যিনিই খলিফা হতেন তিনিই কল্যানকর হিসেবে সাব্যস্ত হতেন।

হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ বড় বড় সাহাবি ও ‍বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের নিকট গিয়ে তাদের মতামত জানলেন।

তিনি গ্রামের বেদুইন, সেনাছাউনিতে অবস্থানরত মুজাহিদ ও মদীনায় আগমণকারী বিভিন্ন কাফেলাকে তাদের অভিমত জিজ্ঞাসা করলেন।

সকলের সর্বসম্মত মত ছিল, উসমান রাঃ ই এই পদের জন্য অধিক উপযুক্ত।

চতুর্থ দিন ফজরের নামাজের পর আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ মসজিদের মিম্বরে আরোহণ করেন। প্রথমে তিনি আলি রাঃ এর হাত ধরে বলেন,

আপনার আল্লাহর রাসূলের আত্মীয়তা এবং প্রথম ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য রয়েছে। আমি আপনার নিকট হতে এই ওয়াদা নিচ্ছি যে,

যদি আপনার ব্যাপারে খেলাফতের ফায়সালা করি তাহলে আপনি ইনসাফ করবেন।

আর যদি আমি উসমানের ব্যাপারে ফায়সালা নেই তাহলে আপনি সন্তুষ্টচিত্তে তার আদেশ-নিষেধ মান্য করবেন।

এরপর তিনি হযরত উসমানকেও একই কথা বলেন। উভয়েই এই কথার উপর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।

এরপর আব্দুর রহমান রাঃ আলী রাঃ কে সম্মোধন করে বললেন,

আমি লোকজনকে ভালোভাবে জিজ্ঞাসা করেছি, তাদেরকে যাচাই করেছি। তারা উসমানকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তাই আপনি সামান্য পরিমাণও কষ্ট নিবেন না।

এরপর তিনি বলেন, উসমান! আপনি হাত বাড়ান। এরপর তিনি তার হাত ধরে এই বলে বাইয়াত হন যে,

আমরা আপনার নিকট আল্লাহর নির্দেশে রাসূল ও তার পরবর্তী দুই খলিফার রীতিতে বাইয়াত হচ্ছি।

এরপর আলী রাঃ ও উসমান রাঃ এর নিকট বাইয়াত হন। সেই মসলিসেই মুহাজির-আনসার সকলেই একত্র হয়ে উসমান রাঃ এর হাতে বাইয়াত হয়ে যান।

একটি ভুল বর্ণনা

উসমান রাঃ খলিফার হওয়ার বিষয়টি সকল মুসলমান সন্তুষ্টিচিত্তে মেনে নিয়েছেন। হযরত আলী রাঃ ও মেনে নিয়েছেন।

তারিখুত তাবারীতে একটি ঘটনা আছে যে, উক্ত বাইয়াতের মসলিসে হযরত মিকদাদ রাঃ ও আম্মার বিন ইয়াসির রাঃ আলী রাঃ এর খলিফা হওয়ার ব্যাপারে আওয়াজ তুলেছিলেন।

কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল একটি বর্ণনা। এই ঘটনা বর্ণনা করে আবু মিখনাফ। সে ছিল রাফেজীদের সদস্য। তার বর্ণনা ছিল পুরোপুরি বানোয়াট

খলিফা হিসেবে হযরত উসমান রাঃ

খলিফা হিসেবে উসমান রাঃ নির্বচিত হন দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর রাঃ এর শহীদ হওয়ার পর। হযরত উমর রাঃ আততায়ীর হাতে আহত হলে তিনি মজলিসে শুরা গঠন করে তাদেরকে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব দেন।

উক্ত কমিটিতে ছিলেন হযরত উসমান, আলী, আব্দুর রহমান বিন আউফ, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস, তালহা ও যুবাইর বিন আওয়াম রাঃ।

পরবর্তীতে সাহাবীদের ঐক্যমতে হযরত উসমান রাঃ খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। হযরত উসমান রাঃ যখন খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন তখন ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমানা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

খোরাসান, পারস্য, ইরাকের অনারব অংশ, ইরাকের আরব অংশ, আলজাজিরা, শাম, মিসর, আর্মেনিয়অ ও আজারবাইজানের বিভিন্ন এলাকা তখন ইসলামী মানচিত্রে যুক্ত হয়েছে।

পাশাপাশি হযরত উমর রাঃ এর যুগে বিজয়ের যে ধারা শুরু হয়েছিল, সে ধারায় বিজয়ের জন্য তখনো বহু ময়দান বাকি ছিল।

শুরা সম্পর্কে রাফেজীদের মিথ্যাচার

হযরত উসমান রাঃ এর খলিফা নির্বচন নিয়ে পরবর্তীতে অনেক ফেতনা ও মিথ্যাচারের জন্ম হয়। শিয়া, রাফেজীদের মিথ্যাচারে ইতিহাসের পৃষ্ঠা ভরপুর হয়ে আছে।

অনেক প্রাচ্যবিদরা এসব মিথ্যা ঘটনা যাছাই-বাছাই না করেই প্রচার-প্রসারে লিপ্ত হয়েছেন। ফলে আধুনিক অনেক ইতিহাসবিদ এই ভুল গ্রহণ করে বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।

এই ভুল ইতিহাস ছড়ানোর জন্য উদাহরণস্বরুপ আবু মিখনাফ রাফেজি রচিত আশ শুরা নামক গ্রন্থটির কথা উল্লেখ করা যায়।

অনুরুপ ইবনে উকদা এবং ইবনে বাবুইয়া ও এই বিষয়ে সতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছে।

শুরাব্যবস্থা এবং উসমান রাঃ এর বাইয়াত সম্পর্কে ওয়াকিদি রহ. এর সনদে ইবনে সা’দ রহ. নয়টি বর্ণনা সন্নিহিত করেছেন।

শিয়াদের সুত্রে বর্ণিত তথ্যগুলো সম্পূর্ণ ভেজালে ভরপুর। এগুলোর পেছনে কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা নেই। সেগুলো হচ্ছে:

শিয়ারা বলে থাকে, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ শুরা পরিচালনা করাটা হযরত আলী রাঃ মেনে নিতে পারেন নি।

আবু মিখনাফ, হিশাম কালবি এবং আহমাদ আল জাওহারি বর্ণনা করেছে, ভোট সমান অবস্থায় উমর রাঃ আব্দুর রহমানকে সিদ্ধান্তদাতা হিসেবে নিয়োগ দেন।

তখনই আলী রাঃ বুঝে ফেলেন, তার হাত থেকে শাসনব্যবস্থা চলে যাচ্ছে। কেননা তিনি জানতেন, আব্দুর রহমান শশুরের দিক থেকে উসমান রাঃ এর আত্মীয়।

এবার আমরা এই অভিযোগটি যাছাই করে দেখি।

শাইখুল ইসলাম ইমাম তাকিউদ্দিন ইবনে তাইমিয়া রহ. হযরত উসমান এবং আব্দুর রহমান রাঃ এর মধ্যে আত্মীয়তাকে অস্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ উসমানের ভাই ও ছিলেন না, চাচাতো ভাই ও ছিলেন না। বংশগতভাবেও এক ছিলেন না।

উসমান রাঃ ছিলেন বনু উমাইয়া গোত্রের সদস্য আর আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ ছিলেন বনু জুহরা গোত্রের সদস্য।

আর বনু জুহরা গোত্রের লোকজন ছিল তুলনামূলকভাবে বনু হাশিমের সাথে সম্পৃক্ত। কেননা বনু জুহরা হলো রাসূল সা. এর মামার বংশ।

হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ ও সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাঃ ছিলেন একই বংশের সদস্য।

সা’দ রাঃ সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেন,

জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাঃ বলেন, “সা‘আদ আগমন করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

ইনি হলেন আমার মামা অতএব (আমার মামার মতো) কেউ তার মামাকে দেখাক”।

এখন কথা হলো, শিয়ারা কেন বললো, উসমান রাঃ এর শশুর সম্পর্কে আত্মীয় হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ।

হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ যেহেতু ওয়ালিদ ইবনে উকবা রাঃ এর বোন উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা রাঃ কে বিয়ে করেন, এ জন্য শিয়ারা এই অভিযোগ তোলে।

আর ওয়ালিদ ইবনে উকবা রাঃ ছিলেন বনু উমাইয়া গোত্রের সদস্য এবং তিনি উসমান রাঃ এর বৈমাত্রিয় ভাই।

তিনি মক্কা বিজয়কালে ইসলাম গ্রহণ করেন।

উমাইয়া ও হাশিম গোত্র নিয়ে অভিযোগ

শিয়া ইতিহাস লেখক আবু মিখনাফের বর্ণনা থেকে বলা হয়, বাইয়াত গ্রহণের সময় উমাইয়া ও হাশিম গোত্রের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়।

অথচ এই কথার কোনো ভিত্তি নেই এবং কোনো সহীহ বা হাসান হাদীস দ্বারা এর কোনো প্রমাণ মেলে না।

আবার কতিপয় ইতিহাসবিদ এসব কথাকে তাদের পুঁজি করে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা রচনা করেছেন।

হযরত আলি রাঃ এর উপর অপবাদ আরোপ

বিখ্যাত ইতিহাস লেখক ইবনে জারির রহ. সহ আরো অনেক ইতিহাসবিদ অজ্ঞাত পরিচয় সুত্রে বর্ণনা করেছেন,

খলিফা নির্ধারণ শেষে আলী রাঃ ইবনে আউফ রাঃ কে বলেছিলেন,

আপনি তো আমাকে ধোঁকা দিলেন। যেহেতু উসমান আপনার শশুরালয়ের আত্মীয়, তাই তাকে আমার উপর প্রাধান্য দিলেন।

তখন আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ সূরা ফাতহের ১০ নং আয়াত তেলওয়াত করেন,

যারা তোমার কাছে বাই‘য়াত গ্রহণ করে, তারা শুধু আল্লাহরই কাছে বাই‘য়াত গ্রহণ করে; আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর; অতঃপর যে কেউ ওয়াদা ভঙ্গ করলে তার ওয়াদা ভঙ্গের পরিণাম বর্তাবে তারই উপর। আর যে আল্লাহকে দেয়া ওয়াদা পূরণ করবে অচিরেই আল্লাহ তাকে মহা পুরস্কার দেবেন।

অথচ এই ঘটনা সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং ভিত্তিহীন। এমন কোনো ঘটনা সহীহ সনদে পাওয়া যায় না।

হযরত আমর ইবনে আস ও মুগিরা বিন শুবা রাঃ এর উপর অপবাদ

আবু মিখনাফ শুরা সংক্রান্ত বর্ণনায় বলে, পরামর্শের সময় আমর ইবনে আস রাঃ এবং মুগিরা বিন শুবা রাঃ সেখানে বসলে সা’দ রাঃ তাদের এই বলে তাড়িয়ে দিয়ে বলেন,

তোমরা তো এটাই চাচ্ছ যে, এখান থেকে যাওয়ার পর বলবে, আমরাও শুরার সদস্য ছিলাম। এই কথাগুলো সম্পূর্ণরূপে সাহাবীদের শানের খেলাফ।

উসমান রাঃ এর খুতবা

খলিফা হওয়ার পর হজরত উসমান রাঃ মুসলমানদের সম্মুখে সর্বপ্রথম প্রদত্ত খুতবায় বলেন, ‘লোকসকল, তোমরা একটি অস্থায়ী ঘরে আছো।

জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো তোমরা পূরণ করছো। মৃত্যুর পূর্বেই নেক কাজ করে নাও। সকাল-সন্ধ্যা যেকোনো সময় মৃত্যু চলে আসতে পারে।

সাবধান! দুনিয়ার জীবন পুরোটাই ধোঁকা। লক্ষ রেখ, যেন তোমরা কোথাও ধোঁকা না খাও। শয়তান যেন আল্লাহর ব্যাপারে তোমাদের ধোঁকায় ফেলে না দেয়।

বিগত লোকদের মাধ্যমে শিক্ষা অর্জন করো। দুনিয়াদাররা কোথায় গেল? যারা একসময় দুনিয়ার পাগল ছিল, যারা দুনিয়া আবাদ করেছে, তাতে উন্নতি অগ্রগতি সাধন করেছে, তারা কিছুকাল মাত্র ভোগ করেছে।

তারা কি দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়নি? আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াকে দ্বিতীয় পর্যায়ে রেখেছেন, তেমনই তোমরাও দুনিয়াকে দ্বিতীয় পর্যায়ে রাখো। পরকালের প্রত্যাশী হও।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় হজরত উসমান মক্কি- জীবনের প্রাণসংহারক বহু কষ্ট-মুসিবত সহ্য করেছেন।

একসময় তিনি হিজরত করে মদিনায় আসেন। ইসলাম নামক বৃক্ষের প্রবৃদ্ধির বহু স্তর স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। একজন অহি-লেখক এবং হাফেজে কুরআন হওয়ার সুবাদে কালামুল্লাহর প্রতিটি শব্দের ব্যাপারে তিনি সম্যক অবগত ছিলেন।

দিবারাত্রি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গভীর সাহচর্যলাভের ফলে তিনি শরিয়তের মেজাজ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করতে পেরেছিলেন।

তিনি আবু বকর সিদ্দিক রাঃ এর জমানায় উদ্ভূত বড় বড় ফেতনা এবং তার দমন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। হজরত উমর ফারুক রাঃ এর বিজয়কাল সম্পর্কে তিনি ভালোভাবেই অবগত ছিলেন।

মুসলমানদের প্রতিটি বিজয়াভিযানে খেলাফতের পক্ষ থেকে পরামর্শের মধ্যে তিনিও অংশীদার ছিলেন। এজন্য খেলাফতের লাগাম হাতে নেওয়ার পর একজন খলিফা হিসেবে তার করণীয় সম্পর্কে তিনি ভালোভাবেই সচেতন ছিলেন।

সাধারণ দৃষ্টিতে তাকালে তার জন্য খেলাফতের জিম্মাদারি পালন করাটা সামান্যও কষ্টসাধ্য ছিল না। কেননা সেটা ইসলামের বিজয়কাল ছিল।

পূর্ব থেকে পশ্চিম কোথাও ইসলামের বিরুদ্ধে মাথা ওঠানোর মতো কোনো শক্তি ছিল না। হজরত উমর ফারুক রাঃ নিজের অসাধারণ পরিচালনাগত যোগ্যতার মাধ্যমে উম্মতকে একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থা উপহার দিয়েছিলেন।

এই উত্তম ব্যবস্থায় কোনো ধরনের ফাটল সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ না দেওয়াই তখন হজরত উসমান রাঃ এর দায়িত্ব ছিল।

পরীক্ষাগার

কিন্তু সাড়ে বাইশ লক্ষ বর্গমাইল (৩৬ লক্ষ ২১ হাজার বর্গকিলোমিটারের) এই বিশাল সাম্রাজ্যের সকল বিষয় দেখাশোনা করা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন জিম্মাদারি ছিল।

মুসলমানদের আমিরকে আল্লাহর সামনে যেমন জবাবদিহি করতে হয় তেমনিভাবে সাধারণ জনগণের সামনেও তার জবাবদিহিতার একটি বিষয় থাকে।

এটা অনেক বড় পরীক্ষা ছিল। হজরত উমর রাঃ তার শাসনকালের শেষবছর (যখন তার বয়স ষাটও হয়নি) দোয়া করছিলেন,

হে আল্লাহ, আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমার শক্তি কমে গেছে। আমার জনগণ বহু দূরদূরান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে।

কারো অধিকারে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি কিংবা ত্রুটি আমার দ্বারা সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই আমাকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নিন।

ওইদিকে খেলাফতের শুরুতেই হজরত উসমান রাঃ এর বয়স ছিল সত্তর বছর। সুস্থতা এবং শারীরিক শক্তির দিক থেকে তিনি হজরত উমর রাঃ এর সমতুল্য ছিলেন না।

তা সত্ত্বেও তিনি মুসলমানদের দেখাশোনা, তাদের অধিকার সংরক্ষণ এবং খেলাফতের কেন্দ্র মজবুত করার জন্য নিজেকে ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন।

নিঃসন্দেহে এর পেছনে অসাধারণ ঈমানি শক্তি, আত্মোৎসর্গের স্পৃহা, কোরবানি ও বিপদ সহ্য করার যোগ্যতা এবং আধ্যাত্মিক শক্তি সক্রিয় ছিল।

ফেতনার গন্ধ

উসমান রাঃ গভীর দৃষ্টিতে মুসলিম উম্মাহর সকল বিষয় লক্ষ করছিলেন। ফলে বিশেষ দুটি বিষয় তার দৃষ্টিগোচর হয়, যে-জন্য তার প্রস্তুতি গ্রহণ করাটা জরুরি ছিল।

একটি বিষয় হলো, হজরত উমর ফারুক রাঃ এর শাহাদাত একটি বড় ফেতনার সংকেত দিচ্ছিল।

হজরত হুযাইফা রাঃ থেকে বর্ণিত হাদিস সম্পর্কে হজরত উসমান রাঃ অবগত ছিলেন।

হজরত উমর রাঃ হজরত হুজাইফা রাঃ কে বলেছিলেন, আমাকে সেই ফেতনার ব্যাপারে সংবাদ দাও,

যা উম্মাহকে ঢেউয়ের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

হজরত হুযাইফা রাঃ উত্তর দেন, আমিরুল মুমিনিন, আপনার এবং সেই ফেতনার মাঝে একটি মজবুত দরজা প্রতিবন্ধক হিসেবে রয়েছে, আপনার জীবদ্দশা পর্যন্ত যা বন্ধ থাকবে।

পরবর্তীতে হজরত হুজাইফা রাঃ নিজেই বলেছিলেন, হজরত উমর রাঃ নিজেই সেই দরজা ছিলেন।

তার মৃত্যুর পর ফেতনাগুলো প্রকাশ পেতে থাকবে ।

রাসূলের ভবিষ্যদ্বানী

হজরত উসমান রাঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনার ব্যাপারে খুব ভালোভাবে অবগত ছিলেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, তাকে পরীক্ষাসহ সুসংবাদ দাও, তাকে যার মোকাবেলা করতে হবে।

মৃত্যুর পূর্বে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার উসমান রাঃ কে একা ডেকে নিয়ে তাকে কিছু রহস্যের কথা বলেছিলেন, যা শুনে তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বলেছিলেন, অচিরে আল্লাহ তোমাকে একটি পোশাক (খেলাফতের দায়িত্ব) পরিধান করাবেন।

মুনাফিকরা যদি তোমার থেকে সেটা ছিনিয়ে নিতে চায় তা হলে তুমি একদম খুলবে না। অবশেষে তুমি আমার সাথে মিলিত হবে ।

হজরত উসমান রাঃ এবং তার পরামর্শক সাহাবিগণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসকে চাক্ষুষ বিষয়ের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন।

উমর ফারুক রাঃ এর পর বিভিন্ন ফেতনার প্রকাশ ঘটার ব্যাপারে তাদের কোনো সন্দেহ ছিল না।

এইসকল হাদিস ছাড়াও স্বয়ং খলিফার মসজিদের মেহরাবে শহিদ হওয়া, হত্যাকারী সম্পর্কে জানার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রভৃতি বিষয় বলে দিচ্ছিল যে, শত্রুরা এখন সম্মুখযুদ্ধের পরিবর্তে গোপন লড়াই শুরু করেছে।

এখন বিভিন্ন ফেতনা-ফাসাদ তৈরি করা এবং তা উসকে দেওয়ার পথ অবলম্বন করাকেই তারা নিজেদের কর্মপন্থা স্থির করে নিয়েছে।

এটা নিশ্চিত যে, এসব ফেতনার রাস্তা আর বন্ধ করা যাবে না। হ্যাঁ, অবশ্যই তাদের সঙ্গে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে।

যথাসম্ভব ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। এতে অবশ্যই সফলতার আশা ছিল। আর সাহাবিগণ চেষ্টাপ্রচেষ্টার জন্য নির্দেশিতও ছিলেন।

হজরত উসমান বিন আফফান রাঃ এর সামনে এটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

আর নিঃসন্দেহে খেলাফতের জিম্মাদারি গ্রহণ করার সাথে সাথেই তিনি এ সকল ফেতনা মোকাবেলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন।

এজন্য তিনি আপন প্রতিরক্ষামূলক পলিসিতে সবসময় এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখতেন।

রোমানদের বিরুদ্ধে উসমান রাঃ

হযরত উমর রাঃ এর মৃত্যুর মাধ্যমে জিহাদের পতাকা অস্তমিত হয় নি। পূর্বের মতোই তা বহাল তবিয়তে চলতে থাকে।

সে সময় কুফার সেনাছাউনিতে সবসময় ৪০ হাজার মুজাহিদ প্রস্তুত থাকতো। যাদের মধ্যে প্রতি বছর ১০ হাজার মুজাহিদ সীমান্তে নিয়োজিত থাকতো।

তাদের মধ্যে ৬ হাজার আজারবাইজানে আর ৪ হাজার রায় শহরে অবস্থান করতো। (তারিখুত তাবারী, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ২৪৬)

হযরত উসমান রাঃ এর শাসনকালের পূর্ব থেকেই ওয়ালিদ উবনে উকবা রাঃ আলজাজিরার গভর্নর ছিলেন।

তিনি আপন সেনাপতি সালমান বিন রাবিয়া রহ. কে ১২ হাজার মুজাহিদ দিয়ে আর্মেনিয়া পাঠিয়েছিলেন। যারা কয়েকটি অঞ্চল জয় করে প্রচুর গণিমত নিয়ে আসে।

রোমানরা উমর রাঃ এর শাহাদাতের ফলে ভাবতে থাকে, মুসলমানদের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই তারা শামের সীমান্তে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

হযরত উসমান রাঃ এই ব্যাপারে অবগত হয়ে ওয়ালিদ ইবনে উকবা রাঃ কে চিঠি লিখেন। তাকে শামের মুসলমানদের সাহায্যে ১০ হাজার মুজাহিদ পাঠাতে বললেন।

ওয়ালিদ ইবনে উকবা রাঃ তৎক্ষণাৎ সালমান বিন রাবিয়া রহ. এর নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনীকে শামের সীমান্তে পাঠিয়ে দেন।

হযরত হাবিব বিন মাসলামা রাঃ সেখানে স্থানীয় মুজাহিদদের সাথে সাহায্যের অপেক্ষায় ছিলেন।

ওদিকে রোমানরা ৮০ হাজার সৈন্য নিয়ে শিবির স্থাপন করে।

হাবিব বিন মাসলামা রাঃ পরিকল্পনা পরিবর্তন করে আক্রমণ করতে খুব দক্ষ ছিলেন। তিনি শত্রুদের উপর রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন।

যখন তিনি নিজ তাবু থেকে বের হতে লাগলেন তখন তারা সম্মানিতা স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, এরপর আবার কোথায় সাক্ষাৎ হবে?

তিনি বললেন, রোমান সেনাপতির তাবুতে কিংবা জান্নাতে।

তিনি রাতে অন্ধকারে রোমানদের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এ সময় তার স্ত্রী বেশভূষা পরিবর্তন করে প্রাণোৎসর্গকারী মুজাহিদদের মধ্যে শামিল হয়ে যান।

হযরত হাবিব বিন মাসলামা রাঃ বিজলির মতো আকস্মিক শত্রুদের উপর আক্রমণ করেন।

তিনি লড়াই করতে করতে রোমান সেনাপতির তাবু পর্যন্ত পৌঁছে যান।

তিনি দেখতে পান তার স্ত্রী তার আগেই সেখানে পৌঁছে গেছেন। এই যুদ্ধে রোমানদের পরাজয় হয়। মুসলমানরা বিজিত হয়ে ফিরে আসে।

রোমানদের আলেকজান্দ্রিয়া দখল

এই পরাজয়ের পরও রোমানরা মনে করছিল, মুসলমানরা কিঞ্চিৎ হলেও দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই আক্রমণ করে কিছুটা হলেও ভূমি দখল করা যাবে।

তাই তারা মিসরের উপকূলবর্তী শহর আলেকজান্দ্রিয়া দখল করার পরিকল্পনা নেয়। রোমান সেনাপতি মুনায়েল সেখানে অত্যন্ত শক্তিশালী নৌবাহিনী নিয়ে পৌঁছে যায়।

স্থানীয় রোমানরা আগেই বিদ্রোহ করে বসে। এর ফলে রোমানরা আলেকজান্দ্রিয়া দখল করতে সক্ষম হয়।

কিন্তু মিসরের গভর্নর হযরত আমর বিন আস রাঃ তাদেরকে বেশিদিন বিজয়ের আনন্দ উপভোগের সুযোগ দেন নি।

২৫ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে তিনি পাল্টা হামলা করে রোমান নৌবাহিনীকে পরাজিত করেন।

এর মাধ্যমে তিনি পুনরায় আলেকজান্দ্রিয়ায় ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেন।

আলেকজান্দ্রিয়ার স্থানীয় কিবতিরা জনগোষ্ঠী বিদ্রোহের সময় সঙ্গ দেয় নি। তাই রোমানরা পরাজিত হওয়ার পর পালানোর সময় তাদের আর্থিক ক্ষতিসাধন করে।

হযরত আমর ইবনে আস রাঃ কিবতিদের যথাসম্ভব ক্ষতিপূরণ দেয়ার চেষ্টা করেন।

প্রাচ্যবিদরা মুসলমানদের এই কার্যক্রমকে ডাকাতি বলে উল্লেখ করে থাকে। অথচ এ ধরণের কার্যক্রম বাইজেন্টাইনরাও করতো।

উভয় পক্ষ থেকে চলমান এই কার্যক্রমকে যুদ্ধই বলতে হবে। যা ছিল প্রচলিত যুদ্ধ থেকে ভিন্ন।

এটাকে ডাকাতি বা লুটপাট বলে আখ্যা দেয়াটা রাজনৈতিক নীতিমালা সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে।

উসমান রাঃ এর আফ্রিকা অভিযান

মিশর সীমান্তের সাথে সংযুক্ত উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ ভূমি তৎকালীন সময়ে রোমান শাসক জুরজিরের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

প্রথম দিকে সে রোমান সম্রাটের অধীনস্থ গভর্নর ছিলেন। কিন্তু এশিয়া থেকে রোমানদের নিয়ন্ত্রণ বিলুপ্ত হওয়ার পর তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে দেন।

তার রাজ্য মিশর সীমান্ত থেকে নিয়ে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্তমানে এখানে তিউনিশিয়া, লিবিয়া, আলজাজিরা এবং মরক্কো অবস্থিত।

একবার মিসরের গভর্নর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সাদ ইবনে সারাহ রাঃ ১০ হাজার মুজাহিদ নিয়ে আফ্রিকার বিশাল মরুভূমি পাড়ি দেন।

এরপর তিনি রোমানদের শাসক জুরজিরের সীমান্তে প্রবেশ করেন। এখানে খন্ড খন্ড কয়েকটি যুদ্ধ হয়।

প্রতিপক্ষের বহুসংখ্যক সৈন্য বন্দি ও নিহত হয়।

স্থানীয় মানুষরা জুরজিরের জুলুম-নির্যাতন এবং রোমানদের কঠোরতার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করছিল।

তারা ইসলামের সৌন্দর্য দেখে দলে দলে ইসলাম কবুল করতে থাকে।

কোনো কোনো এলাকার লোকেরা যুদ্ধ ব্যতিতই সন্ধি করে ফেলে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সাদ রাঃ এর উদ্দেশ্য যেহেতু ইসলাম প্রচার, আর তা যুদ্ধ ব্যতিতই অর্জন হয়েছিল, তাই তিনি আফ্রিকা থেকে ফিরে আসেন।

আফ্রিকায় জিহাদ পরিচালনার জন্য খলিফার অনুমতি

২৬ হিজরী তথা ৬৪৬ খ্রিষ্টাব্দে হযরত আমর ইবনে আস রাঃ মিশরের গভর্নর পদ থেকে অব্যাহতি নেন।

তখন তার স্থলে নিযুক্তি দেয়া হয় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সাদ রাঃ কে।

আব্দুল্লাহ রাঃ মিশরে পৌছে একের পর এক বিভিন্ন দিকে অশ্বারোহী বাহিনী পাঠাচ্ছিলেন, যেভাবে আমর রাঃ পাঠাতেন।

এদিকে জুরজির মুসলমানদের উত্তর আফ্রিকায় ইসলাম প্রচার-প্রসার ভালোভাবে নেয় নি। তাই সে যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে থাকে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সাদ রাঃ এর নিকট সকল তথ্য পৌঁছলে খলিফা উসমান রাঃ এর নিকট এই অঞ্চলে জিহাদ পরিচালনার অনুমতি চান।

তখন হযরত উসমান রাঃ সাহাবাদেরকে একত্র করে এ ব্যাপারে তাদের পরামর্শ চান।

তখন হযরত সায়িদ ইবনে যায়েদ রাঃ ব্যতিত সকল সাহাবী আফ্রিকা বিজয়ের ব্যাপারে নিজেদের অভিমত পেশ করেন।

হযরত সায়িদ ইবনে যায়েদ রাঃ ছিলেন উমর রাঃ এর সীমানার উপর অটল। উসমান রাঃ সকলের ঐক্যমতে এবং উপস্থিতিতে জিহাদের ঘোষণা দিয়ে দেন।

এই যুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য মদীনা থেকে অনেক স্বেচ্ছাসেবী মুজাহিদ যোগদান করেন।

তা ছাড়া অনেক সাহাবী যেমন, হাসান, হুসাইন, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর রাঃ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

মুসলমানরা ২০ হাজার মুজাহিদ নিয়ে জুরজিরের এলাকায় প্রবেশ করেন।

সেনাপতি জুরজির তখন সুবাইতিলা নামক স্থানের ১ মঞ্জিল সামনে ১ লক্ষ ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করছিল।

অবশেষে উভয় বাহিনী মুখোমুখি হয়। জুরজিরের বাহিনী মুসলমানদের ৬ গুণ বড় ছিল।

কিন্তু মুসলমানরা তাদের দেখে সামান্য পরিমাণও ভীত হন নি।

কেননা কাদেসিয়া ও ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলমানরা কম থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর রহমতে বিজয় অর্জন করেছিলেন।

আল্লাহর নিকট আস্থা ও বিশ্বাসই মুসলমানদের পদতলে বিজয় এনে দিত।

যুদ্ধের পূর্বে আব্দুল্লাহ ইবনে সাদ ইবনে আবু সারাহ রাঃ জুরজিরের নিকট ইসলাম কবুল করার দাওয়াত পেশ করেন অথবা জিযিয়া দেয়ার প্রস্তাব রাখেন।

কিন্তু সে তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। অবশেষে তুমুল লড়াই শুরু হয়। কয়েকদিন পর্যন্ত এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকে।

প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত লড়াই হতো।

উসমান রাঃ এর আফ্রিকা তে সাহায্যকারী বাহিনী পাঠানো

হযরত উসমান রাঃ এই যুদ্ধের ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন। তখন তিনি মদীনা থেকে সাহায্যকারী বাহিনী প্রেরণ করেন।

যার নেতৃত্বে ছিল হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাঃ।

যেহেতু শিশুকাল থেকেই তার বরকতের কথা লোকমুখে প্রসিদ্ধ ছিল এ জন্য মুসলমানরা তাকে দেখে অভ্যর্থনা জানিয়ে জোরে জোরে তাকবির দিতে থাকেন।

এই তাকবীর ধ্বনি শুনে জুরজির ভীত হয়ে পড়ে। সে এই তাকবিরের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তার লোকেরা বলে, মুসলমানদের সাহায্যকারী বাহিনী চলে এসেছে।

জুরজির এতে ভীষণ পেরেশান হয়ে যায়। কিন্তু সৈন্যদের মনোবল ঠিক রাখার জন্য সে ঘোষণা করে,

যে ব্যক্তি মুসলমানদের আমির আব্দুল্লাহ বিন সাদকে হত্যা করতে পারবে, তাকে আমার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিব এবং ১ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা (৩৬১ কোটি ২৫ লাখ টাকা) উপহার দিব।

এই ঘোষণার ফলে রোমানদের মধ্যে ব্যাপক স্পৃহা তৈরি হয়। মুসলমানরা এই কথা জানতে পারলে নিজের আমিরের ব্যাপারে শঙ্কিত হয়ে উঠে।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন সাদ রাঃ সতর্কতাবশত একদিন যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি উপস্থিত না হয়ে আড়াল থেকে তদারকি করতে থাকেন।

তখন হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রাঃ তাকে বললেন, আপনিও ঘোষণা দিয়ে দিন, যে ব্যক্তি জুরজিরকে হত্যা করতে পারবে,

তাকে ১ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা (৩৬১ কোটি ২৫ লাখ টাকা) উপহার দিব। পাশাপাশি জুরজিরের মেয়ের সাথে তাকে বিয়ে দিব।

সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন সাদ রাঃ এর প্রস্তাবটি পছন্দ হয়। তিনি এই ঘোষণা দেয়ার পর জুরজির ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

নতুন দিকে যুদ্ধের মোড়

কয়েকদিন পর্যন্ত যুদ্ধের কোনো ফায়সালা হচ্ছিল না। হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর রাঃ যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন আনার জন্য পরামর্শ দেন যে,

আগামীকালের যুদ্ধে আমরা কিছু সৈন্য তাবুতে রাখবো। যখন উভয় বাহিনী যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাবে তখন এই তাজাদম সৈন্য এসে ক্লান্ত শত্রুর উপর আক্রমণ করবে।

কমান্ডাররা সকলে ঐক্যমত পোষণ করেন। ফলে আব্দুল্লাহ বিন সাদ ইবনে আবু সারাহ রাঃ এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন।

রীতিমতো সূর্য উদিত হওয়ার পর পর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। নির্বাচিত কিছু অশ্বারোহীকে তাবুতে আরাম করার নির্দেশ দেয়া হয়।

সারাদিন যুদ্ধ শেষে বিকেলের দিকে হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর রাঃ কিছু বাহাদুর মুজাহিদ নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।

তাদের কাতার লন্ডভন্ড করে তাদেরকে পেছন দিকে তাড়িয়ে দেন। জুরজির সেখানে ঘোড়ার উপর বসে ছিল। দুজন বাঁদি তাকে বাতাস দিচ্ছিল।

জুরজির ও তার দেহরক্ষীরা আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাঃ কে আসতে দেখে মনে করে, হয়তো শত্রুদের কোনো দূত আসছে।

তাই সে পলায়ন কিংবা প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করে নি। কিন্তু একটুপর তাদেরকে হাতিয়ার কোষমুক্ত করতে দেখে ঘাবড়ে যায়।

জুরজির ঘোড়া হাঁকিয়ে পলায়নের চেষ্টা করে। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাঃ তার নিকট পৌঁছে যান এবং তরবারি দ্বারা শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলেন।

বাদশাহকে নিহত হতে দেখে কাফেরদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। গোটা বাহিনী পলায়ন শুরু করে। তাদের শাহজাদিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ওয়াদা অনুযায়ী তাকে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাঃ এর নিকট সোপর্দ করা হয়।

মুসলিম বাহিনী সামনে অগ্রসর হয়ে কাফেরদের রাজধানী নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন।

এই বিজয়াভিযানে মুসলমানরা বহু গণিমত অর্জন করেন। তার পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, প্রত্যেক মুসলমান সৈনিক ১ হাজার দিনার ( ৩ কোটি ৬১ লাখ ২৫ হাজার টাকা) করে পেয়েছিলেন।

মাস্তুল যুদ্ধ

মাস্তুল যুদ্ধ ছিল হযরত উসমান রাঃ এর শাসনকালে সবচেয়ে বড় বিপজ্জনক যুদ্ধ। এটি ৩৪ হিজরীতে সংগঠিত হয়।

এই যুদ্ধে উভয়পক্ষের সৈন্যরা জাহাজের মাস্তুল বেঁধে যুদ্ধ করেছে বিধায় এটাকে জাতুস সাওয়ারা বা মাস্তুল যুদ্ধ বলা হয়।

রোম সম্রাট যখন দেখতে পায়, মুসলমানরা কনস্টান্টিনোপলের প্রাচীরের নিকট চলে আসছে এবং সমুদ্র যুদ্ধে কুবরুসবাসীর উপর বিজয়লাভ করেছে, তখন সে বিশাল এক নৌবাহিনী তৈরি করে।

এতে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ যুদ্ধ জাহাজ ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, রোমানরা এর পূর্বে কখনো এত বড় সৈন্যসমাবেশ ঘটায়নি।

সে এই অপ্রতিরোধ্য সামরিক শক্তি নিয়ে রোম সাগরে অবতীর্ণ হয়। অপরদিকে এশিয়া মাইনরের পশ্চিম তীর দিয়ে স্থলভাগেও সৈন্য নিয়ে সম্রাট সামনে অগ্রসর হতে থাকে।

হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এই সংবাদ পাওয়ার পর শাম থেকে নিজের নৌবাহিনী একত্রিত করেন এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবু সারাহ রাঃ মিসর থেকে নিজের নৌবাহিনী একত্রিত করেন।

এই উভয় বাহিনী বাইজেন্টাইনদের ইসলামী ভূখন্ডে প্রবেশের পূর্বেই তাদের সামনে হাজির হন।

কুবরুস এবং রোডস দ্বীপের মাঝামাঝি অবস্থিত কিলিকিয়ায় এক রাতে উভয় বাহিনী মুখোমুখি হয়।

মুসলমানদের জাহাজ ছিল ২০০ টি। এই বাহিনী কয়েক বছর পূর্বে তৈরি করা ছিল। তার ফলে মুসলিম নাবিকদের নৌযুদ্ধের অভিজ্ঞতা তেমন ছিল না।

অপরদিকে বাইজেন্টাইনরা ছিল অপ্রতিরোধ্য। তারা বহু বছর যাবৎ সমুদ্র যুদ্ধে প্রতাপ বিস্তার করে আসছে। তাদের বাহিনী ছিল মুসলমানদের তিন গুণ বড়।

সে সময় মুসলমানদের নৌযুদ্ধের কার্যক্রম ছিল এই যে, তারা জাহাজে করে কোথাও অবতরণ করতো এবং নিকটবর্তী কোনো ময়দানে লড়াই করতো।

কিন্তু এবার সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ হলো লড়াইক্ষেত্র। মুসলমানরা পূর্ণ হিম্মতের সাথে তাদের মোকাবেলায় অবতীর্ণ হন।

যুদ্ধের সূচনা

মুজাহিদদের আমির হযরত আব্দুল্লাহ বিন আবু সারাহ রাঃ জাহাজের মাস্তুলগুলো একটির সাথে অপরটি বেঁধে সারি বানানোর নির্দেশ দেন।

তিনি মুজাহিদদের সর্বদা তেলওয়াত ও যিকিরে মশগুল থাকার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। বাতাসের গতি তখন মুসলমানদের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে যাচ্ছিল।

ফলে রোমানরা সহজেই পাল তুলে মুসলমানদের দিকে অগ্রসর হতে পারছিল। পক্ষান্তরে মুসলমানরা অগ্রসর হতে চাইলে পাল তোলা অধিক ক্ষতিকর ছিল।

তাই কেবল বৈঠা দিয়ে সাধারণ গতিতেই জাহাজগুলো আগে বাড়ছিল। এটা দেখে মুসলিম সেনাপতি জাহাজ নোঙর করার নির্দেশ দেন।

হঠাৎ করেই আল্লাহর কুদরতে বাতাস মুসলমানদের অনুকূলে এসে যায়। ফলে মুসলমানদের হিম্মত ও সাহস বৃদ্ধি পেয়ে যায়।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আবু সারাহ্ রাঃ প্রতিপক্ষকে তীরে অবতরণ করে তরবারির মাধ্যমে হার-জিতের ফায়সালা করার প্রস্তাব রাখেন।

বাইজেন্টাইন কমান্ডার ভাবে, হয়তো মুসলমানরা সমুদ্রে যুদ্ধ করতে ভয় পাচ্ছে। তাই সে দম্ভভরে বলে, যুদ্ধ সমুদ্রে হবে, সমুদ্রে।

এই উত্তর শুনে হযরত আব্দুল্লাহ বিন আবু সারাহ রাঃ নোঙর উঠিয়ে পাল তুলে দেয়ার নির্দেশ দেন।

মুসলমানদের যুদ্ধজাহাজগুলো রোমানদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

এরপর উভয়বাহিনীর যুদ্ধজাহাজ প্রতিপক্ষের জাহাজের সাথে মিলিয়ে নেয়। এর সাথে সাথে সেনারা তরবারি ও খঞ্জরের মাধ্যমে একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

হাজার হাজার মানুষের টুকরো সমুদ্রে পড়তে থাকে। সমুদ্রের পানি রক্তে লাল হয়ে যায়। হাজার হাজার মুসলমান শহীদ হন।

কিন্তু রোমানদের ক্ষয়-ক্ষতি মুসলমানদের থেকেও বেশি ছিল। এর মধ্যেই সমুদ্রে উত্তাল হয়ে উঠে। উভয়পক্ষের জাহাজ খরকুটোর ন্যায় দুলতে থাকে।

এর মধ্যে সম্রাট কনস্টান্টিন নিজেও আহত হন। তাই তিনি অবশিষ্ট সৈন্যদেরকে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেন।

এভাবে আল্লাহ মুসলমানদেরকে একটি গৌরবময় বিজয় দান করেন। মুসলমানরা পার্শ্ববর্তী উপকূলে অবতরণ করেন।

উসমান রাঃ এর কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পরিকল্পনা

আমিরুল মুমিনীন হযরত উসমান রাঃ রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পরিকল্পনা থাকেন।

যেহেতু কনস্টান্টিনোপল জিহাদে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদদের জন্য হাদীসে ক্ষমা ও জান্নাতের সুসংবাদ রয়েছে, তাই সাহাবারা তা জয় করাটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন।

হযরত মুয়াবিয়া রাঃ পূর্বেই কনস্টান্টিনোপল উপকূল পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করেছেন। সমস্যাটা হলো, শহরের তিনদিকেই হলো সমুদ্র।

ভৌগলিকভাবে শহরটিতে এই দিক থেকে আক্রমণ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু এত সহজে সাহাবারা হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না।

হযরত উসমান রাঃ অত্যন্ত উন্নত মনোবলের অধিকারী ছিলেন। তিনি প্রথমে পুরো ইউরোপ জয় করে স্থলভাগ দিয়ে উত্তর দিক থেকে কনস্টান্টিনোপল ঘেরাও করার সিদ্ধান্ত নেন।

এ জন্য তিনি একটি নকশা প্রস্তুত করেন। প্রথমেই স্পেন এরপর ফ্রান্স এরপর ইতালি এরপর বলকান অঞ্চলে (বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, আলবেনিয়া, গ্রিস, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, মেসিডোনিয়া, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, মন্টেনিগ্রো, কসোভা) অভিযান পরিচালনা করতে হবে।

এরপর এসব অঞ্চল আয়ত্বে এনে কনস্টান্টিনোপল পৌঁছাতে হবে। এ ভিত্তিতে উসমান রাঃ আফ্রিকার সিপাহসালার হযরত উকবা ইবনে নাফে রাঃ কে চিঠি লিখেন।

মুসলিম বাহিনী সে সময় মরক্কো পর্যন্ত ভূখন্ড নিজেদের আয়ত্তে এনে ফেলেছিলেন। স্পেন এবং মরক্কোর মাঝে শুধু সমুদ্র প্রতিবন্ধক ছিল।

ইতিপূর্বে হযরত উসমান রাঃ এর নির্দেশে ২৭ হিজরীতে আফ্রিকার ইসলামী বাহনী সমুদ্র অতিক্রম করে  স্পেনে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।

মুসলমানরা তখনই বিজয়ী হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু সেটি ভূখন্ড হস্তগত করার মতো অভিযান ছিল না। বরং তা ছিল গেরিলা আক্রমণ।

এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য শত্রুদের শক্তিমত্তা যাছাই করা উদ্দেশ্য ছিল। এটাই ইউরোপে মুসলমানদের প্রথম পদক্ষেপ।

সাহাবীদের খোরাসান বিজয়

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমের রাঃ সারখাস এলাকাকে শক্তিমক্তার মাধ্যমে এবং তুস শহরকে সন্ধির মাধ্যমে জয় করেন।

এরপর হেরাত ও বাগদিস এলাকাও নত হতে বাধ্য হয়। মার্ভের অগ্নিপূজক শাসক বার্ষিক ২২ লক্ষ দিরহাম (৯৭ কোটি ২ লক্ষ টাকা প্রায়) জিযিয়া প্রদানের শর্তে সন্ধি করে।

এরপর হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমের রাঃ বিখ্যাত তাবেয়ী আহনাফ বিন কায়েস রহ. কে সামনে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন।

তিনি বলখ, জুযাজান, ফারইয়াব, তাখারা এবং তালিকানের মতো দুর্গম অঞ্চলে যু্দ্ধবাজ তুর্কি ও অগ্নিপূজকদের সাথে লড়াই করে বিজয়ী হন।

এর মধ্যে কিছু কিছু এলাকায় সন্ধির মাধ্যমে জয় অর্জিত হয়। তেমনিভাবে কিরমান, সিজিস্তান, যারানজ,

কান্দাহার, যাবুল, গজনি ও কাবুল সাহাবী ও মুজাহিদদের নিকট পদানত হয়।

এই বিজয়াভিযানে হযরত আকরা বিন হাবেস, হযরত আব্দুর রহমান বিন সামুরা, হযরত মুজাশি বিন মাসউদ,

হযরত আব্দুল্লাহ বিন খাযেম রাঃ দের মধ্যো সাহাবারা অংশ নিয়েছিলেন।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমের রাঃ এবং তার সেনাপতিগণ এক-দেড় বছরের মধ্যেই পূর্বাঞ্চলে ইসলামি শাসন হিন্দুস্থানের সীমানা পর্যন্ত পৌঁছে দেন।

তেমনিভাবে হযরত উসমান রাঃ এর শাসনামলে ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমানা হিন্দুস্থান থেকে উত্তর আফ্রিকার উপকূল এবং রোম উপসাগরে পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

হযরত উমর রাঃ এর আমলে মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা ছিল ২২ লক্ষ বর্গমাইল আর উসমান রাঃ এর সময়ে ছিল ৪৪ লক্ষ বর্গমাইল।

উসমান রাঃ এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

মুসলিম উম্মাহর বিজয়যাত্রা ও গৌরবময় ক্রমবিকাশ হযরত আবু বকর রাঃ ও হযরত উমর রাঃ এর যুগ থেকে শুরু করে ‍উসমান রাঃ এর শাসনকালের ১১ তম বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

এই সময়টা ছিল শান্তি ও নিরাপত্তার। সেই সাথে বিজয়যাত্রাও ছিল অব্যাহত। হযরত উসমান রাঃ একজন শ্রেষ্ঠ শাসকের ভূমিকা পালন করে গেছেন।

কিন্তু শাসনকালের শেষ বছরগুলোকে কিছু দুষ্টপ্রকৃতির মানুষ তার শাসনব্যবস্থা ভেঙ্গে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল।

এই ষড়যন্ত্র কবে এবং কোথায় শুরু হয়েছিল, তা পুরোপুরি নির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। তবে ধারণা করা হয়,

৩৪ হিজরীতে এই আন্দোলনকে প্রথম প্রকাশিত হতে দেখা যায়।

তবে এটি আরো বহু পূর্ব থেকেই তলে তলে ঘি ঢালছিল, তা অনুমান করা যায়। এসব ষড়যন্ত্রকারীদের নেতা কে ছিল, সেটা তেমন একটা জানা যায় না।

তারপরও আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা নামে জনৈক ইহুদীর বর্ণনা পাওয়া যায় এই কাজের সাথে।

হযরত উসমান রাঃ খলিফা নির্বাচিত হওয়ার কয়েক বছর পর ইয়ামানের রাজধানী সানা’য় এক ইহুদী ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিল।

মানুষের মুখে মুখে তার নাম ছড়িয়ে পড়লো-আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা। সে মুসলিম হওয়ার পর কোনো সাহাবী বা তাবেয়ীর নিকট শিক্ষা অর্জন না করেই মানুষকে দীক্ষা দেয়া শুরু করলো।

ইয়ামান, হিজাজ, কুফা, বসরা, শাম এলাকায় সে দরবেশ হিসেবে মানুষের নিকট পরিচিত হতে লাগলো।

মানুষ তার ব্যাপারে ভাবলো, সে তো একজন সংশোধনকারী!

সে খৃষ্টানদের সেন্ট পলের ন্যায় অতিভক্তি প্রকাশ করে অজ্ঞ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে লাগলো।

বহু সরলমনা মুসলমান তাকে মনে করতে লাগলো, সেই ইসলামের সবচেয়ে বড় পণ্ডিত ও রাহবার।

সে মানুষের মধ্য থেকে একতা ও সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তির নামে বানোয়াট ও অনৈতিক কথাবার্তা ছড়াতে লাগলো।

আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা’র নতুন আকীদা প্রসার

সে তার প্রথম মতবাদ প্রচার শুরু করলো নবীজির প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে। সে বলতে লাগলো,

রাসূল সা. অবশ্যই ঈসা আ. এর থেকে শ্রেষ্ঠ (নাউযুবিল্লাহ্)। সুতরাং রাসূল সা. পূনরায় দুনিয়াতে ফিরে আসবেন।

এরপর সে তার দ্বিতীয় মতবাদ প্রচার করলো এই বলে যে, প্রত্যেক নবীর একজন করে স্থলাভিষিক্ত থাকে। আর নবীজির স্থলাভিষিক্ত হলেন হযরত  আলী রাঃ (নাউযুবিল্লাহ্)।

এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা তার ভক্তদের হযরত উসমান রাঃ বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য উসকে দিয়ে বলতো,

যে ব্যক্তি নবীজির অসিয়ত বাস্তবায়ন করতে দেয় না, তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে?

এই কথার মাধ্যমে তার অজ্ঞ ভক্তরা হযরত উসমান রাঃ কে খেলাফতের দখলদার বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে।

তখন সে তাদেরকে আরো উত্তেজিত করার জন্য বলে বেড়ায়,

নবীজির স্থলাভিষিক্তের উপস্থিতিতে উসমান রাঃ অন্যায়ভাবে খেলাফত দখল করে রেখেছে। সুতরাং তোমরা এর প্রতিবাদে বেরিয়ে পড়ো এবং সংগ্রাম করো।

বিশৃঙ্খলার কেন্দ্রসমূহ

আব্দুল্লাহ ইবনে সাবার ফেতনার ঘাঁটি ছিল তিনটি। ১.কুফা ২.বসরা ৩.মিসরের প্রধান শহর ফুসতাত।

কুফা এবং বসরা শহর দুটো আবাদ হয়েছিল হযরত উমর রাঃ এর যামানায়।

আর সে সময় থেকেই এখানে মানুষেরা বিদ্রোহ করাকে একটা স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত করেছিল। তাই হযরত মুসা আশআরী রাঃ কে উমর রাঃ বসরার গভর্নর নিযুক্ত করে পাঠান।

তখন উমর রাঃ হযরত মুসা আশআরী রাঃ কে বলেছিলেন, আপনাকে আমি এমন এক জায়গায় পাঠাচ্ছি, যেখানে শয়তান ডিমও দিয়েছে এবং ছানাও ফুটতে শুরু করেছে।

উমর রাঃ এর শাসনামলে কুফার গভর্নর ছিলেন হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রাঃ। তিনি ছিলেন আশআরে মুবাশশারার অন্যতম সাহাবী।

কিন্তু তাকেও লোকজনের সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে হয়। কিছু মানুষ ওমর রাঃ এর কাছে অভিযোগ করে, তিনি সঠিকভাবে নামাজ আদায় করান না।

এমনকি এক ব্যক্তি সাদ রাঃ কে বলেছিল, আপনি তো ইনসাফ করেন না, সম্পদ ন্যায্যভাবে বণ্টন করেন না এবং জিহাদও করেন না।

এসব কারণে হযরত সাদ বিন আবু ওয়াক্কাস রাঃ এর বদলে সেখানে আম্মার ইবনে ইয়াসির রাঃ কে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়।

কিন্তু তার ব্যাপারেও লোকেরা ওমর রাঃ এর নিকট অভিযোগ করে। তখন উমর রাঃ বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন,

তাদের নিকট কঠোর শাসক পাঠালে দোষ ধরে, আর নম্র শাসক পাঠালে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।

এসব ছাড়াও আরেকটি এলাকায় সকলের অগোচরে বিশৃঙ্খলার কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছিল। সেটি ছিল দামেস্ক। এটি ছিল প্রাচীন শহরগুলোর অন্যতম।

দামেস্ক ছিল বনু উমাইয়ার রাজনৈতিক কেন্দ্র এবং দামেস্কবাসী ছিল শাসকদের প্রতি আস্থাশীল ও আনুগত্যশীল।

এজন্য এখানে ইবনে সাবা অত্যন্ত চতুরতার সাথে কাজ করছিল।

উসমান রাঃ এর রাজনৈতিক পলিসি

কিছু কিছু ঐতিহাসিকরা বলেন, উসমান রাঃ তার শাসনকালের প্রথম ছয় বছর আবু বকর ও উমর রাঃ এর আদর্শ অনুযায়ী চলেছেন।

কিন্তু এরপর তিনি পরিবর্তিত হয়ে গেছেন। আর এই পরিবর্তনের দ্বারা তারা বুঝাতে চায় যে, তিনি ছয় বছর রাসূলের আদর্শে চলেছেন। কিন্তু পরে আর সেভাবে চলেন নি।

তিনি তখন জুলুম-নির্যাতন, বিশ্বাসঘাতকতা ও অপহরণের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে লোকেরা তার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল।

অন্যদিকে কিছু ঐতিহাসিকরা বলেন, হযরত উসমান রাঃ বিন্দুমাত্র পরিবর্তিত হন নি।

এই উভয় মত থেকে প্রথম মতটি নির্জলা মিথ্যাচার ও অপবাদ।

আর দ্বিতীয় মতটি সম্পর্কে কথা বলো, এটি এ অর্থে সঠিক যে, তিনি শেষ ছয় বছরে ন্যায়পরায়ণ, বিশ্বস্ত, দেশ ও জাতির কল্যানকামী এবং রাষ্ট্রের একজন যোগ্য শাসকরূপে চলেছেন।

তবে বাস্তবতা হলো, ২৭-২৯ হিজরী পর্যন্ত মুসলিমবিশ্বে একটি পরিবর্তন ঘটেছিল। যার ব্যাখ্যা হলো, এ সময় মুসলিমবিশ্বের আটটি অংশ ছিল।

যথা: মক্কা, মদিনা, ইয়ামেন, বাহরাইন, কুফা, বসরা, দামেস্ক, মিসর।

মদীনা, মক্কা, ইয়ামেন ও বাহরাইনে এককথায় বলতে গেলে জাজিরাতুল আরবে তখন কোনো সেনাছাউনি ছিল না।

এসব এলাকার গভর্নরদের হাতে ছিল সমাজ পরিচালনা ও বিচারব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব।

দামেষ্ক, মিসর, কুফা ও বসরায় তখন সেনাছাউনি ছিল। যোগাযোগ ও বসবাসের দিক থেকে এগুলো ছিল বড় বড় শহর। দেশের সামরিক শক্তি ছিল এই চার শহরের গভর্নরদের হাতে।

এই চার শহরের বড় দুটি শহরের গভর্নর ছিল হযরত উসমান রাঃ এর আত্মীয়। শামে মুয়াবিয়া রাঃ ও কুফায় ওয়ালিদ ইবনে উকবা রাঃ।

অন্যদিকে অপর দুই শহরের গভর্নর ছিল ভিন্ন গোত্রের। বসরায় আবু মুসা আশআরী রাঃ ও মিসরে আমর ইবনে আস রাঃ।

কিন্তু ২৭ হিজরীর আগ পর্যন্ত উক্ত গভর্নররাই শহরগুলো পরিচালনা করতেন।

কিন্তু ২৭ হিজরীতে উসমান রাঃ মিসর থেকে আমর ইবনে আস রাঃ কে অব্যাহতি দিয়ে সেখানে তার দুধভাই আব্দুল্লাহ ইবনে আবু সারাহ্ রাঃ কে গভর্নর নিযুক্ত করেন।

আর ২৯ হিজরীতে বসরা থেকে আবু মুসা আশআরী রাঃ কে অব্যাহতি দিয়ে সেখানে আপন মামাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন আমের রাঃ কে গভর্নর নিযুক্ত করেন।

আত্মীয়দের নিয়োগ ও জনরোষ

এই অদলবদল হযরত উসমান রাঃ তার দুরদর্শীতার মাধ্যমে অন্যদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু মানুষ এটা দেখেছিল অন্যরকম দৃষ্টিতে।

এছাড়াও আমরা যদি সম্পূন্ন চিত্রটা দেখি যে, কারা কারা উসমান রাঃ এর আত্মীয় ছিল তাহলে আমরা দেখতে পাই তারা সকলেই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন।

সে সময় বড় বড় চার শহরের গভর্নরই ছিলেন হযরত উসমান রাঃ এর বংশের ব্যক্তিরা বা আত্মীয়রা। আর উসমান রাঃ নিজেও যেহেতু উমাইয়া বংশের ব্যক্তি ছিলেন,

তাই অজ্ঞ ব্যক্তিরা ধারণা করতে লাগলো যে, হযরত উসমান রাঃ জাতীয় কল্যানের ভিত্তিতে নয়।

বরং নিজের বংশের মান-মর্যাদা উঁচু করার লক্ষ্যে আত্মীয়-স্বজনকে পদের অধিকারী বানিয়ে দিয়েছেন।

ওয়ালিদ ইবনে উকবা এর বিরুদ্ধে অভিযোগ

হযরত ওয়ালিদ ইবনে উকবা রাঃ ছিলেন বনু উমাইয়া পরিবারের একজন বীর সন্তান। তিনি ছিলেন রাসূলের সাহচর্য পাওয়া একজন সাহাবী।

ওয়ালিদ রাঃ হযরত আবু বকর রাঃ ও উমর রাঃ এর গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসক ছিলেন। তাদের নিকট তিনি ছিলেন একজন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি।

১২ হিজরীতে পারস্য বিরোধী অভিযান পরিচালনাকালে খলিফা আবু বকর রাঃ ও সেনাপ্রধান খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ এর মধ্যে যুদ্ধ-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র আদান-প্রদানের দায়িত্বে ছিলেন ওয়ালিদ ইবনে উকবা রাঃ।

এরপর আবু বকর রাঃ ওয়ালিদকে গভর্নর ইয়াজ ইবনে গানাম ফিহরি রাঃ এর সাহায্যে পাঠান। ১৩ হিজরীতে ওয়ালিদ রাঃ কে কুজাআ এলাকায় জাকাত আদায়ের জন্য কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

১৫ হিজরীতে উমর রাঃ  ওয়ালিদ ইবনে উকবাকে তাগলিব ও আল জাজিরার প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। এসব এলাকা খৃষ্টান অধ্যুষিত ছিল।

ওয়ালিদ রাঃ প্রজ্ঞার সাথে সেখানে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে খৃষ্টানদের ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসেন।

হযরত উসমান রাঃ এর খেলাফতকালে ওয়ালিদ ইবনে উকবা রাঃ কুফা অঞ্চলের গভর্নর ছিলেন। তার শাসনামলে কুফা থেকে মুসলিম বাহিনী পূর্বাঞ্চলে বিজয়ধারা অব্যাহত রাখে।

বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম শাবি রহ. বলেন, তোমরা যদি ওয়ালিদ ইবনে উকবার জিহাদী কৃতিত্ব ও সমরকুশলতা দেখতে, তখন কী বলতে! তিনি জিহাদ করে বহু দূর এলাকা পর্যন্ত চলে যেতেন।

মানুষ ওয়ালিদ ইবনে উকবাকে অত্যন্ত ভালোবাসতো। কুফায় তিনি ৫ বছর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উসমান রাঃ তার সম্পর্কে বলেন,

আমি ওয়ালিদকে এ জন্য গভর্নর বানাই নি যে, সে আমার ভাই। বরং তাকে এ জন্য বানিয়েছি যে,

সে হচ্ছে রাসূলের ফুফু উম্মে হাকিম বাইজা বিনতে আব্দুল মুত্তালিবের কন্যার পুত্র।

ওয়ালিদ ইবনে উকবা রাঃ এর বিরুদ্ধে মদপানের অভিযোগ

ইতিহাসবিদরা বর্ণনা করেন, ওয়ালিদ ইবনে উকবা রাঃ এর বিরুদ্ধে মদপানের ব্যাপারে চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না।

আল্লামা ইবনে হাজার রহ. বলেন, বলা হয়ে থাকে, কুফার কতিপয় অধিবাসী শত্রুতাবশত তার ব্যাপারে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়।

আল্লামা ইবনে খালদুন রহ. এদিকে ইঙ্গিত করে বলেন, উসমান রাঃ এর প্রসাশক ও গভর্নরদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছিল।

ইমাম তাবারী রহ. বিস্তারিত ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। তা হলো,

আবু জায়নাব ও আবু মুরি এবং জুনদুব ইবনে জুহাইরের ছেলেরা আলী ইবনে হায়সামানের ঘরের সিঁদ কেঁটে তাকে হত্যা করে।

ওয়ালিদ ইবনে উকবা রাঃ তখন তাদের উপর কিসাসের আইন বাস্তবায়ন করেন। সন্তানদের অন্ধ ভালোবাসায় উক্ত তিন ব্যক্তি ক্ষেপে যায়।

তখন তারা বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। কঠিনভাবে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। একবার তার ঘরে খৃষ্টান কবি আবু জুবাইদ আসে।

উক্ত কবির মদপানের অভ্যাস ছিল। ওয়ালিদ কিছু সময় আবু জুবাইদের সাথে থাকার কারণে কতক অজ্ঞ ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে মদপানের অভিযোগ তোলে।

আর এই ঘটনাটাই বড় করে উক্ত তিন ব্যক্তি উসমান রাঃ এর নিকট গিয়ে বলে, আমরা ওয়ালিদকে মদের বমি করতে দেখেছি।

ওয়ালিদ রাঃ এর উপর শাস্তি প্রয়োগ

শরীয়তের বিচার সংগঠিত হয় সাক্ষী প্রমাণের দ্বারা। যেহেতু লোকেরা ওয়ালিদ রাঃ এর ব্যাপারে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিল এবং কসম করেছিল, তাই শরয়ীভাবে তার উপর হদ কায়েম করা হয়।

আব্দুল্লাহ বিন আদি বিন খিয়ার রহ. বলেন, (উক্ত ঘটনার পর একদিন) যখন উসমান রাঃ নামাজের জন্য বের হলেন তখন আমি তার নিকট গেলাম।

আমি বললাম, আপনার কাছে আমার একটি প্রয়োজন ছিল, আর সেটি একটি কল্যানকর কথা। হযরত উসমান রাঃ বললেন, আরে ভাই! আমি তোমাদের থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

এরপর হযরত উসমান রাঃ নামাজে চলে গেলেন। নামাজের পর উসমান রাঃ নিজে বার্তাবাহক পাঠিয়ে আমাকে ডেকে নিলেন।

আমি উসমান রাঃ এর নিকট উপস্থিত হলে তিনি বললেন, তুমি যেই কল্যানকর কাজটির কথা বলেছিলে, সেটি কি? আমি তখন প্রথমে কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করলাম। তারপর আরো কিছু কথা বলে এরপর বললাম, মানুষ ওয়ালিদ ইবনে উকবার বিষয়ে আপনার বিলম্বের কারণে নানারকম বাজে মন্তব্য করছে।

সুতরাং আপনার জন্য উত্তম হলো, অনতিবিলম্বে তার উপর হদ (দণ্ড) কায়েম করুন। উসমান রাঃ তখন বললেন, ভাতিজা! তুমি কি নবীজিকে দেখেছিলে?

আমি বললাম, না। তবে তার শিক্ষা আমার নিকট পৌছেছে।

এরপর উসমান রাঃ কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করে বললেন, নবীজি যতদিন ছিলেন, ততদিন নবীজির আদেশ অমান্য করি নি এবং তার সাথে প্রতারণাও করি নি।

আবু বকর রাঃ যতদিন ছিলেন, ততদিন তার আদেশ অমান্য করি নি এবং তাকে ধোঁকা দেই নি।

উমর রাঃ যতদিন ছিলেন ততদিন তার আদেশ অমান্য করি নি।

এরপর আমাকে যখন তাদের স্থলাভিষিক্ত তথা খলিফা বানানো হলো তখন কি তোমাদের উপর আমার সেই হক নেই?

আমি বললাম, অবশ্যই আছে।

দণ্ড

এরপর উসমান রাঃ বললেন, তাহলে লোকদের পক্ষ থেকে আমাকে যা বলছো, তার কি কোনো বৈধতা আছে? ইনশাল্লাহ ওয়ালিদের ব্যাপারে আমি হকের উপর থাকবো।

এরপর হযরত উসমান রাঃ ওয়ালিদ ইবনে উকবা রাঃ এর ব্যাপারে দণ্ডবিধি আরোপ করে আলী রাঃ কে বললেন, তাকে চাবুক মারুন।

হযরত আলী রাঃ তার ছেলে হাসান রাঃ কে আদেশ করে বললেন, ওঠো, তাকে চাবুক মারো।

হাসান রাঃ বললেন, এ কাজের তাপ যেন সেই সহ্য করে, যে এর শীতলতা লাভ করেছে। অর্থাৎ তিনি কাজটি করতে চাচ্ছিলেন না।

এরপর আলী রাঃ আব্দুল্লাহ বিন জাফর রাঃ কে বললেন, ওঠো, তাকে চাবুক লাগাও। তখন তিনি তাকে চল্লিশ চাবুক লাগালেন।

এরপর আলী রাঃ বললেন, এবার থামো।

এই মজলুম সাহাবী নিজেই দেখলেন, দুরাচাররা কিভাবে ভালো মানুষদের উপর যুলুম চাপিয়ে দিচ্ছে। আর এর কু-প্রভাব কিভাবে সমাজে ছড়িয়ে পড়ে!

হযরত উসমান রাঃ এর শাহাদাতের পর তিনি নিজেকে সব ধরনের সামাজিক কার্যক্রম থেকে দূরে সরিয়ে নেন। রাক্কা এলাকা থেকে ১৫ মাইল দূরে একটা জায়গায় বসবাস করতে থাকেন।

৬১ হিজরীতে তিনি ইন্তিকাল করেন। আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিন। আমীন।

সাবায়ী ফেতনা ও বিরুদ্ধাচরণ

হযরত উসমান রাঃ এর খেলাফতের শেষ ছয় বছরের দিকে সাবায়ী ফেতনা তথা আব্দুল্লাহ ইবনে সাবার ফেতনা ভালোভাবেই শেকড় গেড়েছিল।

ইসলামী শাসনব্যবস্থাকে টুকরো টুকরো করা এবং গৃহযুদ্ধ উসকে দেয়াই ছিল তাদের টার্গেট।

হযরত উসমান রাঃ এর গুরুত্বপূর্ণ গভর্নরদের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের ব্যাপারে মিথ্যা অভিযোগ তুলতে লাগলো।

তারা প্রথমে এই কথা উঠালো যে, হযরত উসমান রাঃ স্বজনপ্রীতি করেন। আর অন্যদের বঞ্চিত করেন।

আরো বলা হয় যে, উসমান রাঃ প্রবীণদের বাদ দিয়ে যুবকদের প্রাধান্য দিতেন।

নিজ নিজ পদে যদি উক্ত যুবকরা যোগ্য হয়ে থাকে, তাহলে কি তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা আদৌ যুক্তিসঙ্গত?

হযরত উসমান রাঃ কর্তৃক নিযুক্ত গভর্নররা আশানুরূপ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আব্দুল্লাহ বিন আমের রাঃ বসরার গভর্নর হয়ে খোরাসান অঞ্চলে ধারাবাহিক বিজয় শুরু করেন।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আবি সারাহ রাঃ মিসর ও আফ্রিকার জিডিপি উন্নয়নে অবদান রেখেছিলেন ও সমুদ্রে যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছিলেন।

কিন্তু এরপরও সুষ্কৃতিকারীরা হযরত উসমান রাঃ এর ব্যবস্থাপনাগত এসব সিদ্ধান্তকে নেতিবাচক রঙ চড়িয়ে উম্মাহকে বিভ্রান্ত করছিল।

এসব ভয়ঙ্কর সাবায়ী ফেতনা এর মধ্যে একটা সময় অনেক সাধারণ মানুষ এবং কিছু উল্লেখযোগ্য মানুষও ফেঁসে গেল।

যাদের মধ্যে মুহাম্মাদ বিন আবু হুজাইফা ও মুহাম্মাদ বিন আবু বকর রাঃ অন্যতম।

প্রবীন গভর্নরদের পরিবর্তনের সময় তাদের প্রক্রিয়া

কুফার গভর্নর হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রাঃ ছিলেন আশআরে মুবাশশারা তথা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবীদের অন্যতম।

প্রক্ষান্তরে তার পরিবর্তে যাকে কুফার শাসনব্যবস্থায় নিযুক্ত করা হয়েছিল, তিনি হলেন মক্কাবিজয়কালে ইসলামগ্রহণকারী হযরত ওয়ালিদ ইবনে উকবা রাঃ।

আর মিসরের গভর্নর হযরত আমর বিন আস রাঃ এর স্থলে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল হযরত আব্দুল্লাহ বিন আবি সারাহ রাঃ কে।

হযরত মুসা আশআরী রাঃ এর পরিবর্তে বসরায় নিযুক্ত করা হয়েছিল আব্দুল্লাহ বিন আমের রাঃ কে। দায়িত্বগ্রহণের সময় তার বয়স ছিল ২৫ বছর।

ঐতিহাসিকগণ এই সাহাবীদেরকে দানশীল, সাহসী, সম্রান্ত, দূরদর্শী ও ন্যায়পরায়ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

হযরত আবু মুসা আশআরী রাঃ যখন জানতে পারলেন বসরায় তার পরিবর্তে আব্দুল্লাহ বিন আমের রাঃ কে নিযুক্ত করা হয়েছে তখন তিনি বসরাবাসীকে সম্বোধন করে বললেন,

তোমাদের জন্য এমন এক যুবক আসছে, যার দাদি ও ফুফিদের বংশ অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত।

সাবায়ীদের ষড়যন্ত্র

৩৪ হিজরীতে কুফায় অনাকাঙ্খিত একটি ঘটনা ঘটে যায়। তখন কুফার গভর্নর ছিলেন হযরত সাঈদ ইবনে আস রাঃ।

তিনি একটি বিশেষ কাজে মদীনায় আমিরুল মুমিনীন হযরত উসমান রাঃ এর নিকট আসেন।

শহরে গভর্নর না থাকায় দুষ্ট লোকেরা আন্দোলন শুরু করে।

তারা হযরত সাঈদ ইবনে আস রাঃ এর বরখাস্তের দাবী করতে থাকে। তাদের এ দাবী নিয়ে তখন তারা মদীনায় প্রতিনিধিদল পাঠায়।

মদীনা থেকে ফেরার পথে রাস্তায় হযরত সাঈদ ইবনে আস রাঃ এর সাথে উক্ত প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ হয়। তখন কুফার প্রতিনিধিদল বললো,

আল্লাহর কসম! আমাদের হাতে তলোয়ার থাকাবস্থায় সাঈদ কুফায় প্রবেশ করতে পারবে না। গভর্নর হযরত সাঈদ ইবনে আস রাঃ এই অবস্থা দেখে বললেন,

তোমাদের এই দাবী পূরণের জন্য একজন প্রতিনিধি খলিফার নিকট এবং একজন প্রতিনিধি আমার নিকট পাঠানোই যথেষ্ঠ ছিল।

এরপর হযরত সাঈদ ইবনে আস রাঃ মদীনায় পূনরায় ফিরে আসেন এবং আমিরুল মুমিনীন হযরত উসমান রাঃ কে উক্ত ঘটনা খুলে বলেন।

উসমান রাঃ বিরোধীদের সাথে অতিরিক্ত বিরোধ না করে তাদের দাবী অনুযায়ী হযরত মুসা আশআরী রাঃ কে কুফার গভর্নর হিসেবে প্রেরণ করেন।

খলিফার উপর প্রাণঘাতি আক্রমণের চেষ্টা

৩৪ হিজরীতে অন্য একটি ঘটনা মদীনায় ঘটে। যা দ্বারা বিদ্রোহীদের মনোভাব সম্পর্কে আরো বিস্তারিত বুঝা যায়। এ সময়ে কুফার এক অধিবাসী মদীনায় আসে।

তার নাম ছিল কামিল বিন জিয়াদ। সে তখন সাবায়ীদের ফেতনার দ্বারা আক্রান্ত ছিল।

একদিন সে তাদের শরীরের পোশাকের মধ্যে খঞ্জর ‍লুকিয়ে রাখে।

এরপর সে খলিফা হযরত উসমান রাঃ এর উপর আক্রমণ করার জন্য নির্জন স্থানে সুযোগ বুঝে অগ্রসর হয়। হযরত উসমান রাঃ তা বুঝে ফেলেন।

ফলে তিনি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। মুহুর্তের মধ্যে লোকজন জড়ো হয়।

কামিল বিন জিয়াদ তখন কসম করে বলে, আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না।

লোকেরা তখন তার কথা যাছাই করতে চাইলো। কিন্তু উসমান রাঃ বললেন, আমি চাই না, সে মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হোক।

তারপর তিনি বললেন, এই হতভাগাকে ছেড়ে দাও। পরবর্তীতে কামিল বিন জিয়াদ হয়তো তওবা করে ফিরে আসে।

কারণ, তার থেকে ইমাম বুখারী রহ. হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর সে হযরত আলী রাঃ ও আবু হুরায়রা রাঃ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছে।

এ ছাড়াও ইবনে সাদ, ইবনে হিব্বান, আজলি ও ইয়াহয়া বিন মাইন রহ. প্রমুখ সালাফরা কামিল বিন জিয়াদকে সিকাহ তথা নির্ভরযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন।

সাহাবীদের সাথে হযরত উসমান রাঃ এর পরামর্শ

মুসলিমবিশ্বের এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে আমিরুল মুমিনীন হযরত উসমান রাঃ একদিন সকল প্রাদেশিক গভর্নর ও কর্মকর্তাদের মদীনায় ডাকলেন।

তারপর সকলের সামনে এই সঙ্কট তুলে ধরে পরামর্শ চাইলেন। সকল গভর্নরই একমত ছিলেন যে, চক্রান্তকারীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আমাদের পেছনে লেগেছে।

চক্রান্তকারীরা সাধারণ জনগণকে উসকে দিচ্ছে। উক্ত পরামর্শসভায় কোনো গভর্নর হযরত উসমান রাঃ এর কোনো সমালোচনা করলো না।

মিসর বিজেতা হযরত আমর বিন আস রাঃ খানিকটা উত্তপ্ত কথা বললেন। তার উদ্দেশ্য ছিল যে,

বিরোধীপক্ষীয় ব্যক্তিরা যেন আমর বিন আস রাঃ এর নিকট তাদের মনের কথা খুলে বলে। যাতে তিনি তাদেরকে সংশোধন করতে পারেন।

বসরার গভর্নর হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমের রাঃ বললেন, মানুষকে জিহাদে ব্যস্ত করে দিন।

তাহলে তারা অন্যদিকে চিন্তা করার সুযোগ পাবে না।

শামের গভর্নর হযরত মুয়াবিয়া রাঃ বললেন, আপনি সেনাপতিদের মাধ্যমে জনগণের নিয়ন্ত্রণ নিন। যাতে তারা জনগণকে নিয়ন্ত্রণ রাখে।

মিসরের গভর্নর হযরত হযরত আব্দুল্লাহ বিন সাদ রাঃ পরামর্শ দিলেন, মানুষের উপর অঢেল সম্পদ ব্যয় করুন। তাহলে তারা আর বিরুদ্ধাচরণ করবে না।

হযরত সাঈদ বিন আস রাঃ বললেন, সাবায়ীদের ষড়যন্ত্র তথা ফেতনার মূল গোঁড়া কেঁটে দেয়া উচিৎ।

অর্থাৎ যারা ফেতনা ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।

হযরত উসমান রাঃ এ কথা শুনে বললেন, যদি ভিন্ন কোনো শঙ্কা না থাকতো তাহলে এটাই করা উচিৎ ছিল।

উসমান রাঃ জানতেন, যদি ধর-পাকড় করা হয়, তাহলে অপরাধীদের সাথে অনেক নিরপরাধ মানুষও নিপীড়নের শিকার হয়।

আর যারা মূল ফেতনাবাজ তারা জনসম্মুখে কমই আসে। তাই হযরত উসমান রাঃ গভর্নরদের বললেন, মানুষকে জিহাদে প্রেরণ করা হোক।

এর মাধ্যমে হয়তোবা সাবায়ীদের ষড়যন্ত্র কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে।

উসমান রাঃ এর বিরুদ্ধে বানোয়াট চিঠি

৩৫ ‍হিজরীতে সাবায়ীরা মুসলিম উম্মাহর মাঝে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বাধানো এবং ইসলামী শাসনব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলার ষড়যন্ত্র করে।

তাদের এই ষড়যন্ত্রের মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল চারটি। যথা:

১. ইরাক ও মিসরবাসী এবং বনু হাশেমের প্রতি অধিক আগ্রহী ব্যক্তিদের ব্যবহার করে উসমান রাঃ এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করা।

এর মধ্যে মদীনার বড় তিন সাহাবী তথা আলী, তালহা, যুবায়ের রাঃ কে উক্ত আন্দোলনে জড়িত করা।

২. উসমান রাঃ কে জোরপূর্বক খেলাফত থেকে ইস্তফা নেওয়ার চাপপ্রয়োগ করা। এরপর খেলাফতের খালি মসনদ নিয়ে বিবাদ সৃষ্টি করা।

৩. উসমান রাঃ ইস্তফা না নিলে গোপনে তাকে হত্যা করে এর দায় হযরত আলি, যুবায়ের, আমর ইবনে আস ও উম্মাহাতুল মুমিনীনদের উপর চাপানো।

৪. মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা। তাকে মুহাজিররা আনসারদের খেলাফত না মানে। আবার আনসাররা মুহাজিরদের খেলাফত না মানে।

(মুহাজির সাহাবী হলো, যারা ইসলাম গ্রহণ করার পর মদীনায় হিজরত করেছে। আনসার হলো, মদীনার সাহাবীরা।)

আদালতের কাঠগড়ায় হযরত উসমান রাঃ

৩৫ হিজরীতে সাবায়ীরা সিদ্ধান্ত নিল, হযরত উসমান রাঃ এর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ প্রচলিত আছে,

তা লিপিবদ্ধ করে খলিফার নিকট পাঠানো হবে।

এরপর ফিরে এসে প্রচার করতে হবে, হযরত উসমান নিজের ভুল স্বীকার করেছেন। কিন্তু তিনি ভুল থেকে ফিরে আসতে আগ্রহী নন।

হযরত উসমান রাঃ উক্ত দলটিতে মদীনায় মসজিদে নববীর উন্মুক্ত মসলিসে কথা বলার সুযোগ দেন।

সকল সাহাবী একমত হয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন, বিদ্রোহী প্রতিনিধিদলের সকলকে হত্যা করা হোক।

কিন্তু উসমান রাঃ তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেন নি।

হযরত উসমান রাঃ একটি কুরআনের নুসখা এনে সামনে রাখলেন। তারপর তিনি প্রতিনিধিদলের আপত্তি শুনলেন।

এরপর প্রতিটি আপত্তির স্পষ্ট জবাব দিলেন। শেষ পর্যন্ত অভিযোগকারীরা মুখে কালি মাখতে বাধ্য হলো।

উসমান রাঃ ষড়যন্ত্রকারীদের কথোপকথনের সুযোগ দিয়ে তাদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে লাগলেন।

কিন্তু তারা উসমান রাঃ এর নম্র ব্যবহার দেখে আরো মাথায় চড়ে বসলো। তারা রটিয়ে দিল, উসমান রাঃ অভিযোগ মেনে নিয়েছেন।

কিন্তু তিনি তওবা করছেন না এবং ইস্তফাও দিচ্ছেন না। এভাবে তারা জনগণকে ক্ষেপিয়ে দিতে লাগলো।

এই ঘটনার কিছুদিন পর সাবায়িরা হযরত আলি, তালহা, যুবায়ের, আয়েশা রাঃ ও মদীনার বিশিষ্ট সাহাবীদের পক্ষ থেকে একটি মিথ্যা চিঠি ছড়িয়ে দিল।

এটি রাতারাতি মিসর, কুফা, বসরাসহ বড় বড় শহরে ছড়িয়ে গেল। সেই চিঠিতে লেখা ছিল,

যদি জনগণ জিহাদ করতে চায় তাহলে তারা যেন মদীনার এসে খলিফার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে।

এরপর ষড়যন্ত্রকারীরা মদীনায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। কুফা, মিসর, বসরা থেকে এসে তারা জড়ো হলো। এভাবে গেলে তো তারা ধরা খেয়ে যাবে।

তাই তারা বুদ্ধি করলো, আমরা হাজির বেশে যাব। এরপর উসমানকে বরখাস্ত করবো। সে না চাইলে তাকে হত্যা করে ফেলবো।

এভাবেই সাবায়িরা উসমান রাঃ কে হত্যার অভিযান শুরু করে।

সাবায়ীদের মদীনা আক্রমণ

হযরত উসমান রাঃ এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীরা মদীনায় এসে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। মদীনা ছিল চারদিক থেকে বেষ্টিত ইসলামী শহর।

তাই মদীনার প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার তেমন প্রয়োজন ছিল না। তাই মদীনাতে তেমন কোনো সেনাবাহিনী থাকতো না।

৩৫ হিজরীর শাওয়াল মাসের শেষের দিকে হাজীর বেশে বিদ্রোহীরা মদীনা থেকে ৪৮ মাইল দূরে ছাউনি ফেললো।

কাফেলার সাধারণ লোকদেরকে এখানে রেখে নেতারা সামনে অগ্রসর হয়। মূলত সাধারণ লোকদেরকে তারা এটা বুঝিয়ে এনেছিল যে,

মদীনায় একজন অত্যাচারী শাসক বসে আছে। যে মানুষের রক্ত নিয়ে খেলে। কেউ তাকে পছন্দ করে না। এমনকি সাহাবীরাও তার প্রতি সন্তুষ্ট নন।

এই ভুলের উপর তাদেরকে রাখা হয়েছিল। যাতে চূড়ান্ত মূহুর্তে তাদেরকে ব্যবহার করা যায়। এরপর নেতারা মদীনায় প্রবেশ করলো।

তারা হযরত আয়েশা, হযরত আলী, হযরত যুবায়ের রাঃ সহ বড় বড় সাহাবীদের সাথে সাক্ষাৎ করলো। কিন্তু কোনো সাহাবীই তাদেরকে সমর্থন করলো না।

অবস্থা খারাপ দেখে তারা বললো, আমরা তো শুধুমাত্র কয়েকজন গভর্নরের বরখাস্তের দাবী করছি।

মদীনার বাহিরে সাহাবীদের পাহারা

হযরত আলী রাঃ এবং হযরত যুবায়ের রাঃ পূর্বেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাদের নাম ব্যবহার করে বিদ্রোহীরা জনগণকে উষ্কানী দিচ্ছে।

তারা তারা প্রত্যেকেই পৃথক পৃথক দল নিয়ে মদীনার বাহিরে পাহারায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কেননা তারা সকলেই উসমান রাঃ এর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।

হযরত আলী রাঃ তার পুত্র হাসানকে এবং হযরত ‍যুবায়ের রাঃ তার পুত্র আব্দুল্লাহকে এবং হযরত তালহা রাঃ তার দুই পুত্রকে পাহারার পূর্ণ দায়িত্ব দিলেন।

তাদের প্রতি এই আদেশ করা হলো যে, সর্ব অবস্থায় যেন তারা সজাগ থাকে। যেন মদীনায় বিদ্রোহীরা প্রবেশ করতে না পারে।

বানানো চিরকুট নিয়ে বিদ্রোহীদের অগ্নি প্রজ্জ্বলন

বিদ্রোহীরা যখন বুঝতে পারলো যে, মদীনায় প্রবেশ অনেকটা অসম্ভব। তাই তারা ফিরে যাওয়ার মনস্থ করলো। তখনই একটা বানোয়াট ঘটনা ঘটলো।

বিদ্রোহীরা সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে দেখতে পেল। সে পালিয়ে মিসর যাচ্ছিল। কাফেলার লোকেরা তাকে আটক করে জিজ্ঞাসা করলো,

তুমি কে? কোথায় যাচ্ছ? তখন সে বললো, আমি খলিফার বার্তাবাহক। আমাকে মিসরের গভর্নরের নিকট পাঠানো হয়েছে।

উক্ত ব্যক্তিকে তল্লাশি তার নিকট হতে একটি চিঠি পেল। যেটিকে লেখা ছিল, কাফেলার লোকেরা মিসর যাওয়ার পর তাদের সবাইকে হত্যা করবে।

লোকেরা এটা দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়লো। এরপর সাবায়ীদের মদীনা তে আক্রমণ শুরু হয়। তারা তাকবীর দিয়ে মদীনায় প্রবেশ করলো। অল্প সময়ের মধ্যেই অন্য পাশ দিয়ে বসরা ও কুফার লোকেরাও প্রবেশ করলো।

এরপর বিদ্রোহীরা আলী রাঃ এর নিকট গিয়ে বললো, আমি উসমান রাঃ বিরুদ্ধে আমাদের সাথে অংশগ্রহণ করুন।

আলী রাঃ তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমি কখনোই তোমাদের সঙ্গী হবো না।

লোকরা তখন আলী রাঃ কে বললো, তাহলে কেন আপনি আমাদেরকে মদীনায় আসতে বললেন,

আলী রাঃ বললেন, আমি তোমাদের কাউকেই মদীনায় আসতে বলি নি। আর আমি কখনোই বিদ্রোহ করতে বলি নি।

এটা শুনে সাধারণ বিদ্রোহীরা একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগলো। কারণ, তাদের ধারণাই ছিল না,সাহাবীদের নামে চিঠিগুলো ছিল বানোয়াট।

হযরত উসমান রাঃ এর শাহাদাত

বিদ্রোহীরা মদীনায় এসে শহর অবরোধ করে। তারা মসজিদে নববীতে উসমান রাঃ কে নামাজ পড়াতে এবং খুৎবা দিতে বাঁধা দিতে লাগলো।

জুমার দিন হযরত উসমান রাঃ মসজিদে নববীতে খুৎবা দিতে উঠলেন। তখন বিদ্রোহীরা হাঙ্গামা শুরু করলো। তারা উসমান রাঃ এর দিকে পাথর মারতে লাগলো।

পাথরের আঘাতে তিনি অচেতন হয়ে পড়লেন। লোকেরা তাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেলেন। হযরত আলী, তালহা, যুবায়ের রাঃ উনার সেবা করার জন্য এগিয়ে গেলেন।

বিদ্রোহীরা উসমান রাঃ কে খেলাফত থেকে ইস্তফা দিতে চাপ প্রয়োগ করলে লাগলো। কিন্তু উসমান রাঃ তখন তাদেরকে বললেন,

আল্লাহ আমাকে যেই পোশাক পরিয়েছেন, তা আমি খুলে ফেলবো না।

এ ছাড়াও এটি উসমান রাঃ এর প্রতি রাসূল সা. এর অসিয়ত ছিল। তিনি একবার উসমান রাঃ কে একান্তে ডেকে বলেছিলেন,

যদি আল্লাহ তোমাকে এই পদ দান করেন আর মুনাফিকরা তা খুলে ফেলতে চায় তাহলে তুমি তা খুলে ফেলবে না।

বিদ্রোহীরা তখন খলিফাকে অবরোধ করে রাখলো। মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো এই মর্মান্তিক খবর। লোকেরা বিভিন্ন দেশ থেকে আসার প্রস্তুতি নিতে লাগলো।

কিন্তু তখনি বিদ্রোহীরা একটা ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে দিল যে, সন্ধি হয়ে গেছে। বিদ্রোহীরা সরে পড়েছে। অথচ এটি ছিল ভুল সংবাদ।

ইতিমধ্যেই গ্রীস্মের উত্তাপ বেড়ে গেল। সাথে সাথে বিদ্রোহীরাও অবরোধকে আরো কঠোর করে তুললো।

তারা উসমান রাঃ এর ঘরে খাবাপ পৌঁছার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো।

আলি রাঃ এই ঘটনা জানতে পেরে ক্ষোভের সাথে বললেন, তোমাদের আচরণ মুসলমানদের মতো নাকি কাফেরদের মতো?

এই মানুষটি তোমাদের কি ক্ষতি করেছে যে, তোমরা তাকে অবরোধ করে হত্যা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ?

ঘনিয়ে এলো হজের সময়

এই অবরোধ থাকতে থাকতেই হজের সময় ঘনিয়ে এলো। খলিফা হযরত উসমান রাঃ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ কে আদেশ করলেন,

তুমি হাজীদের কাফেলা নিয়ে মক্কায় রওয়ানা হও। হযরত ‍ইবনে আব্বাস রাঃ বললেন, হে আমিরুল মুমিনীন! আল্লাহর কসম,

আমার নিকট এসব দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হজের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু উসমান রাঃ তাকে বুঝিয়ে হজে পাঠিয়ে দিলেন। উক্ত হজ কাফেলার সাথে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাঃ হজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

কারণ, আয়েশা রাঃ চিন্তিত ছিলেন, বিদ্রোহীরা উসমান রাঃ এর পর উম্মুল মুমিনীনদের উপর হামলা করতে পারে।

কারণ, ইতিমধ্যেই তারা উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে হাবিবা রাঃ ও হযরত সাফিয়া রাঃ কে তারা জনসম্মুখে অপমান করেছিল।

এই সময়ে অনেক সাহাবী মদীনা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। মিসর বিজেতা হযরত আমর ইবনে আস রাঃ দুঃখে তার দুই পুত্রকে নিয়ে মদীনা ত্যাগ করে ফিলিস্তিন চলে যান।

হযরত হাসসান বিন সাবেত রাঃ ও মদীনা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তালহা রাঃ ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

হযরত ‍যুবায়ের রাঃ ও মদীনার বাহিরে চলে গিয়েছিলেন। কারণ, বিদ্রোহীরা এই প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছিল যে, যুবায়ের রাঃ হলো আমাদের নেতা। নাউযুবিল্লাহ!

আমিরুল মুমিনীনের উপদেশমূলক ভাষণ

বিদ্রোহীদের এই অবরোধকালে একদিন হযরত উসমান রাঃ তার বাড়ির প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন,

আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, তোমরা কি জান না যে, আমি নিজে বীরে রুমা নামক কূপটি ক্রয় করে মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছি?

উপস্থিত লোকেরা বললো, জি হ্যাঁ।

এরপর উসমান রাঃ বললেন, তাহলে এরপরও কেন তোমরা আমার জন্য এই কূপের পানি বন্ধ করে দিলে? তারপর তিনি বললেন,

তোমরা কি জান না যে, আমি মসজিদে নববীর জন্য আরো জমি ক্রয় করে মসজিদকে সম্প্রসারণ করেছি। তাহলে কেন তোমরা আমাকে মসজিদে যেতে বাধা দিচ্ছ?

আমিরুল মুমিনীনের কথাগুলো এতটাই মর্মস্পর্শী ছিল যে, বিদ্রোহীদের মধ্যেও কেউ কেউ বলে উঠলো, আমিরুল মুমিনীদের বিরুদ্ধাচরণ করা ঠিক হচ্ছে না।

হজের পরবর্তী সময়

হজের পর মদীনায় সংবাদ আসলো, হাজী সাহেবরা ফিরে আসছেন। এরইমধ্যে সংবাদ আসলো, কূফা ও বসরা থেকে সেনাবাহিনী আসছে।

এদিকে বিদ্রোহীরা উসমান রাঃ এর থেকে ইস্তফা গ্রহণে অক্ষম হয়ে পড়লো। তারা সিদ্ধান্ত নিল, হযরত উসমান রাঃ এর উপর অতর্কিত হামলা করে তাকে শহীদ করা হবে।

কিন্তু আশতার নাখায়ীর মতো প্রথম সারির বিদ্রোহীও এই ভয়ানক কাজের সাথে একমত ছিল না।

সে উম্মুল মুমিনীন উম্মে হাবিবা রাঃ কে পাঠিয়ে উসমান রাঃ কে অন্যত্র সরিয়ে নিতে চাইলো।

কিন্তু অন্যান্য বিদ্রোহী নেতারা আশতার নাখায়ীর এই চেষ্টা ব্যর্থ করে দিল। এরপর আসলো সেই মর্মান্তিক দিন।

দিনটি ছিল জিলহজ মাসের ১৮ তারিখ। হযরত উসমান রাঃ এদিন রোজা রেখেছিলেন। সেদিন তিনি ২০ জন গোলামকে আজাদ করেছিলেন।

এরপর তিনি কুরআন তেলওয়াতে মগ্ন হয়ে পড়েন। এদিকে উসমান রাঃ এর সুরক্ষার জন্য অনেক সাহাবী এবং তাবেয়ী তার ঘরের নিকট একত্রিত হন।

এর মধ্যে হযরত আবু হুরায়রা, হাসান, হোসাইন, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, সাঈদ ইবনে আস, মুহাম্মাদ বনি তালহা অন্যতম।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাঃ বর্ম পরিধান করে সেখানে অবস্থান করছিলেন। বিদ্রোহীরা উসমান রাঃ কে হত্যার সিদ্ধান্ত নিল।

তারা ঘরের দরজায় আক্রমণ করলো। তখন উপরোক্ত সাহাবীরা পূর্ণ শক্তিতে তা প্রতিহত করলেন। দেখতে দেখতে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়।

হযরত তালহা রাঃ আমিরুল মুমিনীনকে রক্ষা করতে ঢাল বর্ম নিয়ে এলেন। তিনি তীর নিক্ষেপ করতে লাগলেন শত্রুদের প্রতি।

উসমান রাঃ তখন নিরাপত্তায় নিয়োজিত সকলকে বললেন, আপনারা বাড়ি চলে যান। এই প্রহরা উঠিয়ে নিন।

তিনি সকলকে এটা বুঝাতে চাইলেন যে, খেলাফত কোনো বাদশাহী নয়। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্ব। তাই নিজ স্বার্থের জন্য রক্তপাত করা উচিৎ নয়।

হযরত উসমান রাঃ এর আদেশ পালন করে সবাই চলে গেলেন। তবে হযরত হাসান রাঃ রয়ে গেলেন। তিনি উঠলেন না।

উসমান রাঃ তখন কুরআন তেলওয়াত করছিলেন। একটুপর তিনি বললেন, আল্লাহর কসম করে বলছি, তুমি চলে যাও।

তারপর তিনি দুইজনকে ডেকে এনে বাইতুল মালের সংরক্ষণের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন।

হযরত উসমান রাঃ এর মৃত্যু

বিদ্রোহীরা যখন দেখলো কোনো প্রহরা নেই তখন তারা একজনকে পাঠালো ভেতরের অবস্থা দেখতে।

এরপর সে এসে বললো, ভেতরে পুরো খালি। তখন একজনকে পাঠানো হলো উসমান রাঃ কে হত্যা করতে।

কিন্তু সে উসমান রাঃ কে দেখে হত্যার সাহস করলো না।

শুধু বললো, আপনি খেলাফত ছেড়ে দিন। উসমান রাঃ বললেন, আল্লাহ আমাকে যেই পোশাক পরিয়েছেন তা আমি খুলতে পারি না।

তখন উক্ত ব্যক্তি বাহিরে এসে বললো, এই ব্যক্তিকে হত্যা করা আমাদের জন্য হালাল নয়। এরপর অন্য একজন গেল।

তাকে উসমান রাঃ বললেন, তোমার মাঝে এবং আমার মাঝে আল্লাহর কালাম বিদ্যমান। সেও তখন বিচলিত হয়ে চলে গেল।

এভাবে বিদ্রোহীরা এক এক করে লোক পাঠাতে লাগলো। কিন্তু প্রত্যেকেই অনুতপ্ত হয়ে ফিরে গেল।

হযরত আবু বকর রাঃ এর পুত্রও ভুলের শিকার হয়ে বিদ্রোহীদের সাথে ছিল।

এবার তাকে পাঠানো হলো। উসমান রাঃ তাকে দেখে বললেন, তোমার এই রাগ-ক্ষোভ আল্লাহর দানের বিপরীত তো নয়?

তারপর তাকে বললেন, তুমি আমার হত্যাকারী হতে পার না। তোমার পিতা যদি যদি এটা দেখতেন তাহলে কখনোই এটি পছন্দ করতেন না।

এ কথা শুনে মুহাম্মাদ বিন আবু বকর ও লজ্জা ও অনুতাপে ফিরে গেল। এরপর বিদ্রোহী নেতারা উসমান রাঃ এর ঘরে প্রবেশ করে।

আমিরুল মুমিনীন আগের মতোই কুরআন তেলওয়াত করছিলেন।

এ সময় বিদ্রোহীদের মধ্য থেকে রোমান নামক একজন লোহার লাঠি দিয়ে উসমান রাঃ কে আঘাত করলো।

এরপর আব্দুর রহমান বিন গাফেকি নামে আরেকজনও লোহার অস্ত্র দিয়ে আঘাত করলো।

হযরত উসমান রাঃ এর হত্যাকারীর নাম কি

এরপর “কৃষ্ণযম” নামে এক ব্যক্তি অগ্রসর হয়ে পূর্ণ শক্তিতে উসমান রাঃ এর গলা চেপে ধরে। উসমান রাঃ ছটফট করতে থাকেন।

তারপর সে খাপ থেকে তরবারি বের করে উসমান রাঃ এর উপর আঘাত হানে। সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে রক্তের ধারা ছিটকে কুরআনের উপর পড়ে।

এরপর আরেক হতভাগা বর্শা দিয়ে উসমান রাঃ এর উপর আঘাত হানে। তখন উসমান রাঃ উচ্চারণ করেন, আল্লাহর নামে চললাম এবং আল্লাহর উপরই ভরসা করলাম।

এদিকে শোরগোলের আওয়াজ ঘরের নারীদের অংশে পৌছে যায়। তখন উসমান রাঃ এর স্ত্রী নায়লা এবং তার কন্যারা তাকে বাঁচাতে চিৎকার করে ছুটে আসেন।

এ সময় সুদান বিন হুমরান নামক জনৈক অভিশপ্ত নায়লার উপর আক্রমণ করে। এতে তার হাতের কয়েকটি আঙ্গুল কেটে যায়।

এর মধ্যে মিসরের এক বিদ্রোহী উসমান রাঃ এর বুকে তরবারি রেখে দেহের পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করে। সঙ্গে সঙ্গে তার দেহ এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়।

ইসলামের এই মহান খলিফা এবং নবীজির জামাতা হযরত উসমান রাঃ ৩৫ হিজরীর ১৮ জিলহজ সুর্যাস্তের আগে শহীদ হন।

কতক বিদ্রোহীকে হত্যা

উসমান রাঃ সেদিন কয়েকজন গোলামকে এই শর্তে মুক্ত করে দিয়েছিলেন যে, তারা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে না।

তারা হাঙ্গামার খবর শুনে যখন ঘটনাস্থলে আসে তখন তারা জানতে পারে হযরত উসমান রাঃ কে শহীদ করা হয়েছে।

তারপর তারা বিদ্রোহীদের উপর আক্রমণ করে। তাদের একজন পাপিষ্ঠ সুদান বিন হুমরানের মাথা দেহ থেকে আলাদা করে দেয়।

অরপর একজন কুতাইরা নামক আরেকজন বিদ্রোহীকে জাহান্নামে পাঠায়। এখানে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে দুইজন গোলাম শহীদ হন।

এরমধ্যেই হযরত হাসান রাঃ ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাঃ এবং মারওয়ান বিন হাকাম রহ. হাঙ্গামার শব্দ শুনে ফিরে আসেন।

তারা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। তারা তিনজনই ভীষণ আহত হন। মদীনার লোকজন পরে তাদেরকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে।

বিদ্রোহীরা শেষে উসমান রাঃ এর ঘরে লুটপাট করে। ঘরের সমস্ত কিছু লুটপাটের পর তারা বাইতুল মালের দিকে অগ্রসর হয়।

সেখানেও তারা লুটপাট করে। এর ফলে বুঝা যায়, তারা ছিল দুনিয়া পুজারি এবং দাঙ্গাবাজ।

জানাযা ও দাফন

উসমান রাঃ এর শাহাদাতের পর এই সংবাদ মূহুর্তের মধ্যেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

সেই রাতে হযরত আলী, হযরত তালহা, হযরত হাসান, হযরত যায়েদ বিন সাবেত রাঃ সহ অন্যান্য সাহাবীরা উসমান রাঃ এর ঘটে ছুটে আসেন।

জানাযায় অংশগ্রহণের জন্য মদীনায় নারী শিশুরা পর্যন্ত উপস্থিত হয়। উসমান রাঃ এর খাটিয়া তার ঘরের মধ্যেই রাখা হলো।

মানুষ দলে দলে গিয়ে তা যিয়ারত করে আসছিল। শহীদ হওয়ায় উসমান রাঃ কে গোসল দেওয়া হয় নি। রক্তাক্ত জামাকেই কাফন হিসেবে রাখা হলো।

এরপর মারওয়ান বিন হাকাম রহ. জানাযার নামাজ পড়ালেন। তারপর হযরত উসমান রাঃ এর খাটিয়াকে জান্নাতুল বাকিতে নিয়ে যাওয়া হলো।

জান্নাতুল বাকিতেই ইসলামের এই ‍উদীয়মান সূর্য এবং জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী হযরত উসমান রাঃ চিরতরে হারিয়ে যান।

Scroll to Top