ওমর রাঃ মৃত্যু – ২৩ হিজরীর শেষের দিকের কথা। হযরত ওমর রাঃ সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি পুরো মুসলিম ভূখন্ডে সফর করবেন। আর প্রতিটি প্রদেশে তিনি দুইমাস করে অবস্থান করবেন।

সেই বছর তিনি হজ্জ্ব পালনের জন্য মদীনা থেকে মক্কায় গমন করেন। ফেরার সময় তিনি আবতাহ উপত্যকায় অবস্থান করে আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন,

হে আল্লাহ! আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমার শক্তি এখন দুর্বলতার দ্বারা পরিবর্তিত হচ্ছে। আমার প্রজারা দূর দূরান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

আমার আংশকা হয়, আপনি তাদের ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। আর হে আল্লাহ! আমাকে আপনার রাস্তায় শাহাদাত নসিব করুন এবং রাসূলের শহরে মৃত্যুদান করুন।

গোপন ষড়যন্ত্র

হযরত ওমর রাঃ এর খেলাফতের শেষের দিকে মুসলিম বিশ্বের সীমানা অনেক বিস্তৃত হয়েছিল। পারস্য সম্রাটের বাদশাহী তখন অতীত হয়ে গিয়েছে।

রোমানরা তখন এশিয়া থেকে পালিয়ে ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে। ইহুদীদেরকে আরব ভূমি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। শাম ও মিসর থেকে খৃষ্টানদের প্রভাব মুছে যাচ্ছিল।

মানুষ দলে দলে ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছিল। এর মধ্যেও কিছু লোক নিজের স্বার্থে বাহ্যিকভাবে কালিমা পড়ে মুসলমানদের বেশ-ভূষা ধারণ করে।

পড়ুন: আবু বকর রাঃ এর খেলাফতের শেষের দিকে ওমর রাঃ

তারা বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের মতো জীবন-যাপন করছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা মুসলমানদের থেকে প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ খুঁজছিল।

যেহেতু সে সময় সকলেই কালিমা পড়ুয়া মুসলমানের মতো জীবন-যাপন করছিল, তাই ইতিহাস সুনির্দিষ্টভাবে এই মুনাফিকদের চিহ্নিত করতে পারে নি।

ওমর রাঃ এর উপর হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ

পারস্যের সম্রাট ইয়াজদাগিরদের একজন নিকটাত্মীয় ছিল হুরমুজান। সে মুসলমানদের সাথে লড়াই করে যুদ্ধে বন্দী হয়।

এরপর তাকে ওমর রাঃ এর নিকট নিয়ে আসার পর ইসলাম গ্রহণ করে। তখন ওমর রাঃ তাকে মদীনায় থাকার জন্য জায়গা নির্ধারণ করে দেন।

লোকটি বাস্তবেই খাঁটি মনে ইসলাম গ্রহণ করেছিল নাকি, তা নিয়ে ইতিহাস আজো দ্বিধায় আছে। কিন্তু বাহ্যিক বিষয়গুলো দেখলে তার প্রতি অনেক সন্দেহের তীর ধাবিত হয়।

আবার হতে পারে, সম্রাট ইয়াজদাগিরদের সাথে তার যোগাযোগ ছিল। নাহওয়ান্দের যুদ্ধের পর ইয়াজদাগিরদ সর্বশেষ শক্তি সঞ্চয় করে মুসলমানদের উপর হামলা চালায়।

কিন্তু তখনো সে ব্যর্থ হয় এবং পলায়ন করে। পারসিক সাম্রাজ্য তখন মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলো। হয়তো এ জন্য তারা জোট বেধে হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে আগ্রহী হয়।

অগ্নিপূজক গোলাম ফিরোজ

হযরত ওমর রাঃ হজ্ব থেকে ফিরে এসে সরকারি দায়িত্বে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। ইতিহাসবিদরা বর্ণনা করেন, মদীনায় তখন অগ্নিপূজক গোলাম ফিরোজ আবু লুলু বসবাস করতো।

সে ২১ হিজরীতে পারস্যের সর্বশেষ যুদ্ধক্ষেত্র অর্থাৎ নিহাওয়ান্দের যুদ্ধে বন্দী হয়েছিল। মদীনায় আনার পর হযরত মুগিরা রাঃ এর ভাগে উক্ত গোলাম পড়ে।

ব্যক্তিগতভাবে সে একজন চিত্রকর, কাঠমিস্ত্রি এবং কামার ছিল। বিভিন্ন জিনিষ তৈরিতে সে অত্যন্ত দক্ষ ছিল। ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধি পাওয়ার পর ওমর রাঃ অমুসলিমদের মদীনায় থাকতে দিতেন না।

পড়ুন: যেসব ফেতনা খলিফা আবু বকর রাঃ এর সময়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল

কিন্তু তার শৈল্পিক গুণের মাধ্যমে মদীনাবাসীর উপকৃত হওয়ার বিষয়টি সামনে হযরত মুগিরা রাঃ উমর রাঃ এর নিকট সুপারিশ করলে তিনি ফিরোজকে মদীনায় থাকার অনুমতি দেন।

ফিরোজের অভিযোগ

তৎকালীন সময়ে নিয়ম ছিল, যোগ্যতাসম্পন্ন গোলমানদের দ্বারা ব্যক্তিগত সেবা নেওয়ার পরিবর্তে তাদেরকে নিজ নিজ কাজ ও পেশা গ্রহণের সুযোগ প্রদান করা।

কাজের মাধ্যমে সে যে পারিশ্রমিক লাভ করবে তার একটি অংশ মনিবকে দিবে, যাকে খারাজ বা কর বলা হয়।

হযরত মুগিরা বিন শুবা রাঃ ফিরোজের লাভ থেকে প্রতিদিন দুই দিরহাম বা ২৫০ টাকা কর বাবদ নিতেন। কেননা ফিরোজের ব্যবসা অনেক ভালো চলতো।

ফিরোজ প্রতিদিন ২৫০ করে মনিবকে দিতে অপারগতা প্রকাশ করে উমর রাঃ এর নিকট অভিযোগ করে বলে, আমার মনিব আমার থেকে বেশি পরিমাণ কর আদায় করেন।

উমর রাঃ তাকে জিজ্ঞাসা করেন, কত উসুল করেন?

সে উত্তর দেয়, প্রতিদিন ২ দিরহাম বা ২৫০ টাকা।

হযরত উমর রাঃ বলেন, তুমি কোন কোন কাজের মাধ্যমে অর্থকড়ি উপার্জন করো? সে বললো, কাঠ ও লোহার আসবাব নির্মাণ ও চিত্রকর্মের মাধ্যমে।

পড়ুন: নাহাওয়ান্দের যুদ্ধে কিভাবে পারস্যের কোমর ভেঙ্গে যায়?

সব শুনে উমর রাঃ তাকে বললেন, তোমার রোজগার হিসেবে তো কর বাবদ টাকা ঠিকই আছে।

এতে তো কোনো বেশি পরিমাণ আদায় করা হচ্ছে না।

ফিরোজ তখন এই বলে চলে যায় যে, তার ইনসাফের পাল্লা আমি ছাড়া সবার জন্যই অবারিত।

উমর রাঃ এর মহানুভবতা ও বিচক্ষণতা

তা সত্ত্বেও ওমর রাঃ ভাবলেন যে, একজন বিচারপ্রার্থীকে নিরাশ করা ঠিক হবে না।

তাই তিনি হযরত মুগিরা রাঃ এর নিকট কর কমিয়ে দেয়ার জন্য সুপারিশ করার কথা চিন্তা করলেন।

কয়েকদিন পর ফিরোজকে কোথাও যেতে দেখে তার মনস্তুষ্টির জন্য উমর রাঃ বললেন,

শুনলাম তুমি নাকি ভালো ধরনের চাক্কি বানাতে পার, আমাকে কি একটি বানিয়ে দিবে?

সে তখন আশ্চর্য ভঙ্গিতে বললো, আমি এমন চাক্কি বানাবো পূর্ব এবং পশ্চিমে বসবাসকারী সকলেই তা দেখতে পারবে।

হযরত উমর রাঃ তার কথাবার্তায় প্রতিশোধের গন্ধ পাচ্ছিলেন। সাথি-সঙ্গীদের তিনি বললেন,

এই গোলাম তো আমাকে হুমকি দিয়ে গেল। তা সত্ত্বেও তিনি তাকে গ্রেপ্তার করেন নি।

ওমর রাঃ মৃত্যু ও হত্যাকান্ড

২৭ জিলহজ্জ বুধবার আমিরুল মুমিনীন রীতিমতো ফজরের নামাজ পড়ানোর জন্য মেহরাবে উপস্থিত হন।

যখনই তিনি তাকবীরে তাহরীমা বলেন, তখন লুকিয়ে থাকা ফিরোজ বেরিয়ে আসে।

সে উমর রাঃ এর পিঠে খঞ্জর দ্বারা পরপর ছয়টি আঘাত করে।

অসম সাহসী ও পাহাড়সম হিম্মতের অধিকারী উমর রাঃ কোনোরূপ টু-শব্দ করেন নি।

আঘাতে তিনি মারাত্মক আহত হয়ে পড়ে যান। আক্রমণটি এতটাই আকস্মিক ছিল যে, পেছনের কাতারে দাড়ানো মুসলমানরা টেরই পান নি কিছু।

যখন তারা ওমর রাঃ এর কেরাতের আওয়াজ শুনতে পেলেন না তখন পেছনের কাতারের লোকেরা তাসবিহ বলে লোকমা দিতে থাকে।

উল্কা ও নক্ষত্রের ব্যাপারে কুরআন কি আমাদের ভুলতথ্য দিয়েছে? পড়ুন

এরমধ্যেই ফিরোজ পলায়ন করে। কেউ কেউ বিষয়টি বুঝতে পেরে তাকে পাকড়াও করার চেষ্টা করেন।

কিন্তু সে তাদেরকেও খঞ্জর দ্বারা আঘাত করে।

প্রায় ১৩ জন মুসলমান রক্তাক্ত হয়ে পড়ে যান। তার খঞ্জর চালানোর দক্ষতার কথা আগে কেউ জানতো না।

আঘাত এতটাই তীব্র ছিল যে, ৯ জন মুসলমান তৎক্ষণাত সেখানে মারা যান।

গ্রেপ্তার হওয়া থেকে বাঁচার জন্য ফিরোজ নিজের গলায় খঞ্জর চালিয়ে আত্মহত্যা করে।

আমিরুল মুমিনীন আহত হয়ে মেহরাবে পড়ে ছিলেন। তার হুশ তখনো ছিল।

তিনি নামাজ পড়ানোর জন্য আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ কে সামনে বাড়িয়ে দেন।

তিনি সংক্ষেপে দু রাকাত নামাজ পড়ান। ধারালো খঞ্জর ওমর রাঃ এর পেট ও পিঠ ছিঁড়ে ফেলেছিল।

এরপরও তার অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে ছিল।

নামাজ শেষ হওয়ার পর তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ইবনে আব্বাস! দেখ তো লোকটা কে ছিল?

তখন তিনি দেখে এসে বলেন, মুগিরা বিন শুবা রাঃ এর গোলাম।

ওমর রাঃ তখন বললেন, ও আচ্ছা। তাহলে সেই কারিগর!

উত্তরে বলা হলো, জি হ্যাঁ। সেই।

এরপর ওমর রাঃ বললেন, আল্লাহ তাকে ধ্বং স করুন। আমি তো তার ব্যাপারে ইনসাফের ফায়সালা করেছিলাম।

তিনি আরো বলেন, আল্লাহর শুকরিয়া যে, তিনি কালিমা পড়ুয়া কারো হাতে আমাকে মৃত্যুদান করেন নি।

ওমর রাঃ মৃত্যু এর পূর্বে শেষ অসিয়ত

ওমর রাঃ কে তখন ‍উঠিয়ে ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। আঘাত অত্যন্ত মারাত্মক ছিল। রক্ত কোনোক্রমেই বন্ধ হচ্ছিল না।

এ জন্য তিনি বারবার বেহুশ হয়ে যাচ্ছিলেন। তাকে খাবার হিসেবে প্রথমে নাবিজ ও দুধ দেয়া হয়। কিন্তু সবকিছু ক্ষতস্থান দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল।

এটা দেখে চিকিৎসক তার জীবনের ব্যাপারে নিরাশা প্রকাশ করেন।  পুত্র আব্দুল্লাহ রাঃ তার দায়িত্বে থাকা ‍ঋণের হিসাব করেন।

দেখা যায় তার পরিমাণ ৮৬ হাজার দিরহাম অর্থাৎ ৩৪,৩১৪,০০০ টাকা প্রায়।

এগুলোর কোনটির পর কোনটি আদায় করতে হবে, তা তিনি সন্তানকে বুঝিয়ে দেন।

পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের চিন্তা অবশ্যই তার ছিল। এ জন্য তিনি অত্যন্ত যৌক্তিক ফায়সালা করেন।

পৃথিবীর এত এত ধর্মের মাঝে কোন ধর্ম সঠিক? জানুন

তিনি ছয়জন মহান সাহাবীর নাম উল্লেখ করেন।

হযরত উসমান, আলী, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ, তালহা, যুবায়ের, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রাঃ এর সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করেন।

তিনি বলেন, আমার মৃত্যুর তিনদিনের মধ্যেই যেন উনারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে কাউকে আমির নির্বাচন করে নেন।

ওমর রাঃ তার ছেলেকে উক্ত কমিটিতে রাখেন নি। তিনি শুধু তাকে পরামর্শসভায় অংশগ্রহণের অনুমতি দিয়েছিলেন।

শেষ ইচ্ছা

উমর রাঃ এর প্রবল আগ্রহ ছিল প্রিয়তম ব্যক্তিত্ব হযরত মুহাম্মাদ সা. এর পাশে দাফন হওয়ার। তাই তিনি আয়েশা রাঃ এর নিকট আবেদন করলেন।

তখন আয়েশা রাঃ তাকে বলেন, আমি জায়গাটি আমার জন্য পছন্দ রেখেছিলাম। কিন্তু আমি উমরকে প্রাধান্য দিচ্ছি।

ওমর রাঃ যখন এটা জানতে পারেন তখন তিনি বলেন, এ চেয়ে বড় কোনো তামান্না আর নেই।

ওমর রাঃ মৃত্যু

তিনদিন আহত থেকে ২৪ হিজরীর মহরম মাসের ১ তারিখে পৃথিবীর ইতিহাসের এই নজিরবিহীন শাসক মৃত্যুর ডাকে সাড়া দেন।

হযরত সুহাইব বিন রুমি রাঃ ওমর রাঃ অসুস্থ হওয়ার পর ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। জানাযাও তিনি পড়ান। পরবর্তী খলিফা নির্বাচন হওয়া পর্যন্ত তিনি নামাজের দায়িত্ব পালন করেন।

ইন্তিকালের পর ওমর রাঃ কে রাসূল সা. ও আবু বকর রাঃ এর পাশে সমহিত করা হয়।

হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন, ওমর রাঃ এর মৃত্যুর সময় বয়স ছিল ৫৮/৫৯ বছর।

তথ্যসুত্র

মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খন্ড ৩। পৃষ্ঠা ২৩৫-২৪৯

Scroll to Top