আবু বকর রাঃ খেলাফত এবং ওমর রাঃ

আবু বকর রাঃ খেলাফত – নবীজি সাঃ এর মৃত্যুতে সাহাবায়ে কেরাম মারাত্মকভাবে ভেঙ্গে পড়লেন। সকলের নিকট মনে হচ্ছিল, এই বুঝি পৃথিবী থমকে গেছে।

কয়েকজন সাহাবী মুসলমানদের ভবিষ্যৎ কিভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তারা মদীনার বিখ্যাত গোত্রপতি সা’দ বিন আবু উবাদা রাঃ এর বাড়ির বৈঠকখানায় একত্রিত হলেন।

মুসলমানদের ভবিষ্যৎ প্রধান কে হবে, সেটা তাদের আলোচনায় চলে আসে। সকলেই চাচ্ছিলেন, এমন একজন দায়িত্ব গ্রহণ করুক, যিনি এর যোগ্য।

বনু সাকিফার বৈঠকখানা – আবু বকর রাঃ খেলাফত

পূর্বে আরবদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে ক্ষমতালাভ করা প্রচলিত ছিল। আর মদীনায় যেহেতু আনসার সাহাবীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন, তাই তারা নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনায় বসলেন।

সে সময় জনৈক আনসার সাহাবী বললেন, যদি  মুহাজিররা আমাদের প্রস্তাব না মানে তাহলে আমরা প্রস্তাব দিব, আমীর দুইজন হবে।

এই প্রস্তাব শুনে খাযরাজ গোত্রের সরদার সা’দ বিন উবাদা রাঃ বললেন, এখান থেকেই তাহলে মুসলিম উম্মাহর মাঝে ফাঁটল সৃষ্টি হবে। এমন প্রস্তাব মানা অসম্ভব।

হযরত আবু বকর রাঃ তখন মসজিদে নববীতে বসে ছিলেন। তখন তার নিকট সংবাদ পৌঁছালো যে, বনু সাকিফার বৈঠকখানায় আনসার সাহাবারা একত্রিত হয়ে আলোচনায় বসেছেন।

তিনি বুঝতে পারলেন, এ সময় যদি ‍মুসলিম উম্মাহর মাঝে ফাঁটল সৃষ্টি হয় তাহলে উম্মাহর বিভক্তি সৃষ্টি হতে বিলম্ব হবে না।

তাই তিনি ওমর রাঃ ও আবু উবায়দা উবনে জাররাহ রাঃ কে নিয়ে বনু সাকিফার বৈঠকখানায় উপস্থিত হলেন। তিনি দেখতে পেলেন,

আনসার সাহাবারা জাহেলিয়্যাতের যুগের ন্যায় গোত্রের শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা দিচ্ছেন। আবু বকর রাঃ তাদেরকে এমন বক্তৃতা দিতে নিষেধ করলেন।

তারপর তিনি সেখানে নবীজির ইসলাম প্রচার, হিজরত ও মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের ভ্রাতৃত্ববোধসহ আরো অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেন।

যেহেতু উক্ত মসলিস ছিল উন্মুক্ত পরামর্শসভা, তাই তারা একে অন্যের কথাবার্তা শুনছিলেন। সকলেই এই কামনা করছিলেন,

যেন নবীজির অবর্তমানে মুসলমানদের এই ভ্রাতৃত্ববোধ ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। নবীজি সাঃ এর পর এটাই ছিল সর্ববৃহৎ পরামর্শসভা, সেখানে শুরাভিত্তিক ব্যবস্থাপনাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে অথবা শুরাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার প্রধান ভিত্তি এটি।

কে আমীর বা রাষ্ট্রপ্রধান হবেন – আবু বকর রাঃ খেলাফত

মদীনায় তখন অনেক বড় বড় আনসার সাহাবী ছিলেন। যারা সকলেই নেতৃত্বের জন্য যোগ্য ব্যক্তি। যেহেতু আনসাররা পূর্বের আরবের নীতির ন্যায় নিজেরা শাসনব্যবস্থার সাথে যুক্ত হতে চাচ্ছিলেন,

তাই তাদের মধ্য থেকে কে আমীর হবে, এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলতে থাকে। কিন্তু তারা কোনো ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারছিলেন না।

কারণ, আওস গোত্রের কাউকে আমির নিযুক্ত করলে খাযরাজ গোত্রের লোকেরা নারাজ আর খাযরাজ গোত্রের কাউকে আমীর নিযুক্ত করলে আওস গোত্রের লোকেরা নারাজ।

নবীজি জীবদ্দশাতেই এই সমস্যার সমাধান করে গিয়েছিলেন। সে সময় হয়তো তাদের হাদীসগুলো মনে ছিল না বা পৌঁছায় নি।

তখন আবু বকর রাঃ কুরাইশদের নেতৃত্ব বিষয়ক হাদীসগুলো বর্ণনা করলেন। যেখানে নবীজি বলেছিলেন, কুরাইশরাই নেতৃত্বের অধিক হকদার।

এরপর তিনি আনসারী সাহাবীদের দ্বীনি কার্যক্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অবদানের কথা উল্লেখ করেন এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এরপর আবু বকর রাঃ নেতৃত্ব বিষয়ক আলোচনা করেন। যেখানে নবীজি বলেছিলেন, কুরাইশরাই ক্ষমতার হকদার। এরপর আবু বকর রাঃ সাদ বিন উবাদা রাঃ কে লক্ষ্য করে বলেন,

নবীজি আপনার সামনেই বলেছিলেন, নেতা হবে কুরাইশদের মধ্য থেকে আর মন্ত্রী হবে আনসারদের মধ্য থেকে।

(আস সুনানুল কুবরা। ইমাম বাইহাকি রহ.। হাদীস নং ১১৯২৩)

সা’দ বিন উবাদা রাঃ এর মনে পড়ে যায় সেই কথা। তখন তিনি বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা মন্ত্রী হবো আর নেতৃত্ব আপনাদেরই থাকবে।

বশির রাঃ এর ভাষণ ও আনসারদের ক্ষমতা গ্রহণে অনাগ্রহ

আনসার সাহাবীদের মধ্যে হযরত বশির বিন সা’দ রাঃ দাঁড়িয়ে গেলেন। নিজ গোত্রের লোকদেরকে সম্মোধন করে বললেন,

হে আনসার সম্প্রদায়! নিঃসন্দেহে আমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। যার পেছনে আমাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।

এটা আমাদের জন্য মোটেও শোভনীয় হবে না যে, আমরা আমাদের ধর্মীয় কর্মকান্ডের বিনিময়ে দুনিয়ার তুচ্ছ ক্ষমতা গ্রহণ করবো।

এটা আমাদের জন্য মোটেও শোভনীয় হবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূল কুরাইশ বংশের ছিলেন।

তাই তারা প্রতিনিধি তথা আমাদের আমীর ও কুরাইশদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবে।

গোটা আনসার সম্প্রদায় এই আহ্বানে লাব্বাইক বলে সাড়া দেয়। তখন উক্ত মজলিসে দুইটি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। এক: খলিফা একজন হবেন। দুই: খলিফা কুরাইশদের মধ্য থেকে হবেন।

এরপর আবু বকর রাঃ উপস্থিত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তাহলে তোমরা উমর ফারুক অথবা আবু উবায়দার হাতে বাইয়াত হয়ে যাও।

ওমর রাঃ ও আবু উবাইদা রাঃ এর খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণে অনাগ্রহ প্রকাশ

হযরত ওমর রাঃ ও আবু উবাইদা রাঃ উভয়েই ছিলেন সম্মানিত ব্যক্তি। তারা দুজনেই আশারায়ে ‍মুবাশশারার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

আবু উবাইদা রাঃ আবু বকর রাঃ এর প্রস্তাব থেকে স্ববিনয়ে সরে আনেন। তিনি নিজের অক্ষমতা জানান।

হযরত ওমর রাঃ তখন লোকদের বললেন, তোমরা তো জানো যে, রাসূল সা. এর জীবদ্দশায় আবু বকর রাঃ ইমমতি করেছেন। নবীজি তাকে আগে বাড়িয়ে দিয়েছেন।

লোকেরা বললো, আপনি ঠিক বলেছেন। রাসূল এমনটা করেছেন।

এরপর ওমর রাঃ বললেন, তাহলে তোমাদের মধ্য থেকে কে আছে, যে আবু বকর রাঃ এর বর্তমানে তার চাইতেও বড় হতে চায়?

সকলেই তখন বলে উঠলো, আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। আমাদের নিকট এটা ভালো লাগবে না যে,

আবু বকরের বর্তমানে তার থেকে কেউ বড় হতে চায়।

আবু বকর রাঃ এর হাতে বাইয়াত সম্পন্ন

হযরত ওমর রাঃ এরপর আবু বকর রাঃ কে সম্মোধন করে বললেন, সকলেই আপনার নিকট বাইয়াত গ্রহণে ইচ্ছুক।

আমরা আপনার হাতে বাইয়াত হবো।

আবু বকর রাঃ অসম্মতি জানালেন। কিন্তু ওমর রাঃ পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন।

তখন বশির বিন সা’দ রা. সর্বাগ্রে এসে আবু বকর রাঃ এর হাতে হাত রেখে বাইয়াত গ্রহণ করলেন।

এরপর সকলেই এক এক করে আবু বকর রাঃ এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করলো।

এভাবে আবু বকর রাঃ প্রথম খলিফা হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

তথ্যসুত্র

মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খন্ড ২। পৃষ্ঠা ৩৩৬-৩৪৫

উপরোক্ত বইয়ের রেফারেন্স ‍অনুযায়ী, সহিহ বুখারী। হাদীস নং ৪৪৪৭

তারিখুত তাবারী। খন্ড ২। পৃষ্ঠা ৪৫৫

আসসুনানুল কুবরা লিল বাইহাকি। হাদীস নং ১১৯২৩

মুসনাদে আহমাদ। হাদীস নং ৩৯১

মুসনাদে আহমাদ। হাদীস নং ১৮

আসসুনানুল কুবরা। ইমাম বাইহাকি। হাদীস নং ১১৯২৩

মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ। হাদীস নং ৩৭০৪৩

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া।

আরো পড়ুন

আবু বকর রাঃ এর খেলাফতে আরোহন: বিস্তারিত পড়ুন

মুরতাদদের উত্থান ও আবু বকরের প্রতিরোধ

পারস্যে ইসলাম প্রচার ও আবু বকরের খেলাফতকাল

আবু বকর রা. এর মৃত্যু

রাসূলের ইন্তিকালের সময় উমর রাঃ

বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ও বামপন্থিদের মিথ্যাচার

হুদাইবিয়ার সন্ধি

বাহ্যিক লিংক থেকে আরো পড়ুন

অমুসলিমদের সাথে কি বন্ধুত্ব করা যাবে?

কুরবানী কি অমানবিক আচরণ?

স্রষ্টার অস্তিত্বের কি কোনো প্রমাণ আছে

আল্লাহর কি মানুষের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে?

চার্চ ও বিশ্বাসের বিবর্তন পড়ুন

ইহরাম অবস্থায় কি বিয়ে করা যায়

আবু বকর রাঃ ওমর রাঃ কে খলিফা হতে অনুরোধ করেছিলেন কেন?

ওমর রাঃ ছিলেন আরবের সম্মানিত গোত্র কুরাইশদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

আবু বকর রাঃ কোন কোন সাহাবীকে খলিফা হতে অনুরোধ করেন?

ওমর রাঃ ও আবু উবাইদা রাঃ

গাজ্জার জন্য অনুদান

৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে তুফানুল আকসা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ফিলিস্তিনের গাজ্জায় অসংখ্য মানুষ আহত ও শহীদ হয়েছে। বহু মানুষ নিজেদের ঘর-বাড়ী হারিয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে গাজ্জার ৯৮% মানুষ অনাহারে জীবন-যাপন করছে। গাজ্জার মানুষের এই দুঃসময়ে আমরা যদি তাদের পাশে না দাঁড়াই তাহলে কে দাঁড়াবে?

আর-রিহলাহ ফাউন্ডেশন তুফানুল আকসা যুদ্ধের শুরু থেকেই ফিলিস্তিনের গাজ্জার জন্য ডোনেশন সংগ্রহ করে আসছে। এই মহান কাজে আপনিও আমাদের সাথে যুক্ত হতে পারেন।

অনুদান দিন

Scroll to Top