বাংলায় ইসলামের আগমন

বাংলায় ইসলামের আগমন – বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ মুসলিম। কেউ বাবা-মা মুসলিম বিধায় সে নিজেও মুসলিম। কেউ ধর্ম পরিবর্তনের মাধ্যমে মুসলিম। কেউ বা সামাজিকভাবে মান রক্ষার জন্য মুসলিম।

বিশ্বের প্রতিটি ধর্মই সাম্যের দিকে আহবান করে। আমি প্রতিটি ধর্মকেই শ্রদ্ধা করি।

প্রাচীন বাংলা ও আর্যদের আগম

বাংলাদেশে একেবারে শুরুতে ছিল বেশ কিছু সভ্যতা। যেগুলো হলো, পুণ্ড্র, রাঢ়, হরিকেল, সমতট, বরেন্দ্র, গৌড় ও বঙ্গ। এরও আগে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০ শতকে হরপ্পা সভ্যতা না একটি সভ্যতা এই দেশে ছিল।

বাংলা অঞ্চলে সে সময় কিছু ধর্ম চর্চা হতো। যা স্পষ্টরূপে এখন আর জানা যায় না। এরপরে বাংলায় আগমণ ঘটে আর্যদের। তারা বাঙালী বা এ দেশের নাগরিদের তুলনা করেন অপবিত্র হিসেবে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থে পুণ্ড্র বা উত্তর বাংলার অধিবাসীদের বলা হয়েছে দস্যু।

আর্যদের ক্ষমতা দখল

আর্যরা একটা সময় বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করে নেয়। তারা বিভিন্ন সাম্রজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তারা মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে। মানুষকে উত্তম ও অধম হিসেবে ভাগ করে দেয়।

কাউকে তারা বানিয়ে রাখে, ব্রাহ্মণদের দাস। কাউকে বানিয়ে রাখে জমিদার। কাউকে বানিয়ে রাখে শূদ্র হিসেবে। তাদের নির্যাতনে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে নতুন কোনো সাম্যের জন্য অপেক্ষা করে।

মহান বুদ্ধের সাম্যের ডাক – বাংলায় ইসলামের আগমন

সে সময় মহান গৌতম বুদ্ধ সাম্যের ডাক দেন। রাজপুত্র হয়েও তিনি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ান। তিনি মানুষকে জীবন-যাপনে উত্তম হওয়ার জন্য “জীব হত্যা মহাপাপ”সহ আরো বেশ কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করেন।

আর্য সাম্রাজ্য বুদ্ধদের এই উত্থান এবং সামাজিক মুল্যবোধ সহ্য করতে পারলো না। কারণ, তারা যাদেরকে দাস বা সেবাদাস বানিয়ে রেখেছিল, তারা ক্রমে ক্রমেই বুদ্ধের সাম্যের বাণীতে সাড়া দিয়ে ধর্মত্যাগ করছে। ফলে বাহ্মণদের খাজানা খালি হতে থাকে।

সেনদের আধিপত্য ও বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার

সেনরা বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে দ্বিতীয় মহিপালের আমলে। সেনরা মূলত ভারতের দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট অঞ্চলের অধিবাসী। তারা ছিলেন ব্রহ্মক্ষত্রিয় অর্থাৎ তারা প্রথমে ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং পরে ব্রাহ্মণ বৃত্তি ত্যাগ করে ক্ষত্রিয় বৃত্তি গ্রহণ করেন।

তারা ও ক্ষমতায় এসে বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে। সেন, পাল, রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধদের নির্যাতনের মাধ্যমে বিনাস করতে চেয়েছিলেন।

প্রাচীন চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং (603–664 খ্রি.) সে সময় বাংলা বা বঙ্গ অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। পরবর্তীতে তিনি তার দিনলিপিতে লিখেছেন, শিবভক্ত শশাঙ্ক বুদ্ধগয়া, পাটলীপুত্র ও কুশীনগরের বৌদ্ধযাজকদের উপর নির্যাতনের স্ট্রীম রোলার চালাতেন। তিনি বৌদ্ধদের শিলালিপি বা কোনো কীর্তিকে সহ্য করতে পারতেন না। সেগুলো ধ্বংস করে দিতেন। এমনকি তিনি বুদ্ধদেবের মূর্তিও সরিয়ে ফেলার আদেশ দেন।

এদিকে সেন রাজারা ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদে বিশ্বাসী এবং এর কঠোর বাস্তবায়নে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারা তখন বৌদ্ধদের উপর এমন নির্যাতন করায় বৌদ্ধরা দেশত্যাগ করা শুরু করলো। কিন্তু এতে কোনো লাভ হলো না। কারণ, সনাতনীদের নিম্নস্থরের ব্যক্তিরা নিজেদের জাতভাইদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করতো।

সে সময়ের সনাতনীরা কতভাগে বিভক্ত ছিল, চলুন দেখি

1. ব্রাহ্মণ: সবার উপরে ছিল তাদের মর্যাদা। তাদের কাজ শুধু ইশ্বরের উপাসনা

2. ক্ষত্রিয়: তাদের কাজ শুধু যুদ্ধ করে দেশকে রক্ষা করা। এ ছাড়া তারা কোনো কাজ করতে পারবে না।

3. বৈষ্ণব: তাদের কাজ শুধু কৃষিকাজ করা

4. শূদ্র: তাদের কাজ কেবল উপরোক্ত তিন শ্রেণীর দাসত্বে মাথা পেতে দেয়া।

বাংলায় ইসলামের আগম

ইসলামের শুরুর দিকেই অবশ্য এ দেশে বণিকদের মাধ্যমে ইসলামের আলো এসেছিল। আরব বণিকরা এ দেশে এবং চীনে আসতো ব্যবসার উদ্দেশ্যে।

তারা এ দেশের চট্টগ্রাম সহ আরো অনেক স্থানে নোঙর করতো। স্থানীয়রা তাদের আচরণে মুগ্ধ হতো। কারণ, তারা মানুষকে বিভক্ত করতো না। তারা মানুষের মাঝে পার্থক্য করতো না। তাই স্থানীয়রা সহ অনেকেই মুসলমান হয়ে যেত।

ধারণা করা হয়, এ দেশে নবীজির ৫ জন সাহাবী তথা

1. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ উতবান রা.

2. আসিম ইবনে আমর তামিমী রা.

3. সুহার বিন আদি রা.

4. সুহাইল বিন আলী রা.

5. হাকাম বিন আবুল আস সাকাফি রা.

আগমণ করেছিলেন। তাদের প্রভাব এ দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ তাদের নিকট ইসলাম শিক্ষা করে। এ দেশে তাদের মাধ্যমে অনেক তাবেয়ীর উত্থান হয়। তারা মানুষকে আরো ভালোভাবে ইসলামের বার্তা তুলে ধরে।

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজি রহ. – বাংলায় ইসলামের আগমন

এখন আসি, এ দেশে ইসলাম প্রচারের মূল ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজি রহঃ এর বঙ্গ বিজয় নিয়ে

অনেকের মতে, মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গজয় ছিল আকস্মিক ব্যাপার। বখতিয়ার ছিলেন তুর্কি জাতির জলজি গোষ্ঠীভুক্ত।

তারা ও এককালে দেবদেবীর পূজা করতো। তারা ইসলাম গ্রহণ করে জিহাদে বের হয়ে পড়ে।

বখতিয়ারের ছেলে ইখতিয়ার মুহাম্মাদ ১১৯৫ সালে ভারতের গজনীতে চাকুুরি করতে আসে।

সে মুহাম্মাদ ঘুরির সেনাবাহিনীতে যোগদানের চেষ্টা করে। কিন্তু সে চাকুরি পায় নি।

এরপর সে বাদায়ুনের শাসনকর্তা মালিক হিজবুর উদ্দিনের নিকট গিয়ে চাকুরির আবেদন করেন। তিনি তাকে সাধারণ সৈন্য হিসেবে নিয়োগদান করেন।

একটা সময় বখতিয়ার চাকুরি ছেড়ে দিয়ে অযোধ্যায় আসেন। এখানে মালিক মোয়াজ্জামের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তখন মোয়াজ্জাম তাকে দুইটি জায়গির দান করেন।

এরপর বখতিয়ার তুর্কি ও খরীজ বংশের লোকদের নিয়ে সেনাবাহিনী গড়ে তুলেন।

তিনি তখন পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলোতে অভিযান চালিয়ে সাফল্য পান। ইতিমধ্যেই তিনি বীর হিসেবে বিখ্যাত হয়ে যান।

তিনি দিল্লির প্রশাসক কুতুবউদ্দিনের অধীনতা স্বীকার করে সর্বপ্রথম পূর্ব ভারতের বিহারে অভিযান চালান। সহজেই তিনি তা দখল করে নেন। গড়ে তোলেন বিশাল বাহিনী।

ইখতিয়ারের বাংলা দখল – বাংলায় ইসলামের আগমন

বাংলায় তখন সৈরাচার সেন রাজা লক্ষ্মণ সেন নাদিয়ায় অবস্থান করছিলেন। ১২০৩ সালে বখতিয়ার নাদিয়ায় আক্রমণ করেন।

তিনি এসেছিলেন ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে। রাজপ্রাসাদে মাত্র ১৭ জন সৈন্য নিয়ে প্রবেশ করে পুরো রাজপ্রাসাদ দখল করে নেন।

যখনই লক্ষণ সেনের সৈন্যরা বুঝতে পারলো তখন তাদের সামনে ইখতিয়ারের মুত্যুঞ্জয়ী ১৭ জন সেনা আর পেছনে ইখতিয়ারের পুরো সেনা ইউনিট।

তারা তখন ভীত হয়ে নদীর পাড়ের নৌকা দিয়ে বিক্রমপুরে (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ) পালিয়ে যায়।

এরপর ইখতিয়ারের বাংলায় গড়ে তুলেন ন্যায়ের সাম্রাজ্য। তিনি মানুষের বিভেদ তুলে দেন।

সকলকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দেন। নিম্নবর্ণের হিন্দুরাসহ আরো অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।

তবে সবচেয়ে বেশি মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের থেকে।

কারণ, তারা বুদ্ধের সাম্যের বাণীর থেকেও উৎকৃষ্ট সাম্যেরে বাণী শুনতে পেয়েছিল মুসলমানদের মধ্যে।

আমি হতে পারি একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু আমার শেকড় অনেক গভীরে। আমি হতে পারি, বাংলায় আগমণ করা কোনো সাহাবীর বংশধর।

অথবা আমি হতে পারি, নিম্নস্থরের হিন্দুদের বংশধর। অথবা আমি হতে পারি কোনো বৌদ্ধধর্মের অনুসারীর বংশধর।

আমার পূর্বপুরুষদের উপর যারা নির্যাতন করেছিল, আমার প্রপিতামহের উপর যারা নির্যাতন চালিয়ে ছিল,

যারা আমাদের পূর্বপুরুষদের স্ত্রীদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করতো তাদেরকে কেন আমি ভালো বলতে পারি? ইতিহাস কখনো অন্ধ হয় না।

আমি মুসলিম। এটাই আমার পরিচয়। আমার এই পরিচয় দুনিয়ার সকল পরিচয়ের চেয়ে বড়। আলহামদুলিল্লাহ।

তথ্যসুত্র:

বাংলাদেশ ও ইসলামমুসা আল হাফিজ

প্রাগুক্ত বইয়ের রেফারেন্স অনুযায়ী,

১. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস। খন্ড ১। সুকুমার সেন।

২.  বাঙালীর ইতিহাস। সুভাষ মুখোপাধ্যায়

৩. বাংলার ইতিহাস। রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়

৪. বাঙালির ইতিহাস, আদি পর্ব। ড. নীহাররঞ্জন রায়

৫. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস। নগেন্দ্রনাথ বসু

৬. বাংলা দেশের ইতিহাস। রমেষচন্দ্র মজুমদার

৭. প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান। দীনেশচন্দ্র সেন

৮. বৌদ্ধধর্ম ও চর্যাগীতি। শশিবূষণ দাশগুপ্ত

৯. প্রাচীন বাংলার সামাজিক ইতিহাস। ড. এস এম রফিকুল ইসলাম

১০. বাংলা বিশ্বকোষ। খন্ড ৪। খান বাহাদুর আব্দুল হাকিম সম্পাদিত

১১. মুসলিম আমল বাংলার মাসনকর্তা। ড. আসকার ইবনে শাইখ

১২. বঙ্গদেশের ইতিহাস। ড. সুশীলা মন্ডল

১৩. ইসলামের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশ। হাসান শরীফ অনূদিত

১৪. বাৎস্যায়নের কামসূত্র। মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

Abdur Rahman Al Hasan
Scroll to Top