বেলফোর ঘোষণা – সাল ১৯১৭। সময়টা তখন ২ নভেম্বর। আজ থেকে একশত সাত বছর আগে দিনটা ছিল ইতিহাসের জন্য এবং সভ্যতার জন্য কলঙ্কময় একটি দিন।
উম্মাহর খেলাফতের শক্তির ধ্বংস করে যখন তারা বুঝতে পেরেছিল, খেলাফত আর উঠে দাঁড়াতে পরবে না। তখন তারা মুসলিম ভূখন্ডে আঘাত হানলো।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিরা নিজস্ব একটি ভূমি দাবী করলো। আর এই দাবীর পক্ষে তারা ফিলিস্তিন ভূখন্ডকেই বেঁছে নিল।
অথচ এই ফিলিস্তিন ভূমি মুসলমানদের নিকট ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই লক্ষ্যে তারা পূর্বে সুলতান আবুল হামিদ রহ. এর নিকট ফিলিস্তিন ভূখন্ড দেওয়ার আবেদন করেছিল।
কিন্তু মহান এই সুলতান তাদের এই আবেদন দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তখন তারা এই ধৃত কাজের লক্ষ্যে তৎকালীন পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্র ইংল্যান্ডের সহায়তা চাইলো।
ইংল্যান্ডসহ পৃথিবীর অনেক কাফের রাষ্ট্রই ইহুদিদের এই দাবীর পক্ষে অন্ধভাবে সমর্থন করলো। তারা মুসলমানদের কথা ভেবে দেখারও প্রয়োজনবোধ করে নি।
জায়োনিস্ট কারা?
উনবিংশ শতাব্দিতে ইহুদিদের মাঝে এই জায়োনিজম চিন্তাধারার বিস্তার ঘটে।
কেতাবি ভাষায় জায়োনিস্ট বলা হয় তাদেরকে, যারা মনে করে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে বসবাস করা আবশ্যক এবং ফিলিস্তিন ইহুদি রাষ্ট্র হবে।
এই জায়োনিজম চিন্তাধারা শুধুমাত্র ইহুদিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ইহুদি লেখকদের লেখার মাধ্যমে এই চিন্তাধারা অন্যান্য ধর্মের ব্যক্তিদেরকেও গ্রাস করে।
তাই বলা হয়ে থাকে, জায়োনিস্ট হতে হলে তাকে ইহুদি হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আর সে নাস্তিক হলেও সমস্যা নেই।
জায়নিস্টরা বিশ্বাস করে যে, ফরাসি কিংবা জার্মান ও অন্যান্য জাতির যেমন যথাক্রমে ফ্রান্স ও জার্মানির মতো নিজস্ব রাষ্ট্রের প্রয়োজন।
তেমনি ইহুদিদেরও তাদের পূর্বপুরুষদের জন্মভূমিতে তাদের নিজস্ব দেশ গঠনের অধিকার রয়েছে। জায়নিস্টদের দাবি ছিল,
ভূমধ্যসাগর থেকে জর্ডান নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত জায়গাটি ইহুদিদের ঐতিহাসিক বাসভূমি এবং এখানে ইহুদিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দিতে হবে।
১৮৯৬ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাংবাদিক থিওডোর হার্জেল তার প্রকাশিত ‘দ্য জুইশ স্টেট’ বইয়ের মাধ্যমে ইহুদিদের এই অভিপ্রায়কে একটি আন্দোলনে রূপ দেন।
সেই সময়ে ইহুদিদের বিভিন্ন হঠকারিতা এবং ধোঁকার কারণে ইউরোপের প্রায় প্রতিটা দেশেই ইহুদিরা বেদম মার খাচ্ছিল।
কোনো কোনো দেশ ইহুদিদেরকে তাদের দেশ হতে বের করে দিয়েছিল। এই জন্য হার্জেল মনে করে, এভাবে চলতে থাকলে ইহুদি জাতির বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
তাই তাদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্র হওয়া দরকার। এই লক্ষ্যেই আস্তে আস্তে জায়োনিস্ট আন্দোলন শুরু হয় এবং পানি গড়াতে শুরু করে।
বেলফোর ঘোষণা এর আগের রূপ
থিওডোর হার্জেল সেসময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বসবাস করা উচ্চস্তরের ব্যক্তিবর্গের নিকট ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী যুক্তিসহ তুলে ধরে।
সেই সময় অনেক ধার্মিক ইহুদিও জায়নিজমের বিরোধীতা করতো। কিন্তু হার্জেল ইউরোপীয় ক্ষমতাসীন ইহুদিদের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়।
তার প্রচেষ্টায় ইউরোপে অনেকগুলো জায়নিস্ট সংগঠন গড়ে ওঠে। ইউরোপীয় দেশগুলোর বিভিন্ন জায়নিস্ট সংগঠন তৈরি হয়।
আর এই দাবীর সমর্থনে সেই দেশগুলোর প্রশাসনে শক্তিশালী লবি গঠন করে।
ইউরোপে ইহুদিরা অর্থনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে থাকায় তাদের এই প্রচেষ্টা সহজেই সফল হয়।
যুক্তরাজ্যে ও ইউরোপব্যপী রথসচাইল্ড পরিবারের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ অনেকাংশে সহজ করে দিয়েছে।
বেলফোর ঘোষণা এর দিনক্ষণ
১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর, তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর যুক্তরাজ্যের ইহুদি কমিউনিটির নেতা লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডের কাছে এক চিঠি লেখেন।
এই চিঠিটি যুক্তরাজ্যের জায়নিস্ট ফেডারেশনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানান।
এটাকেই ঐতিহাসিক বেলফোর ডিক্লারেশন বা বেলফোর ঘোষণা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
১৯১৭ সালের ৯ নভেম্বর বেলফোর ঘোষণাটি স্বনামধন্য পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত হয়। মূল ঘোষণা ছিল মাত্র ৬৭ শব্দের।
এই ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইহুদিদের জন্য একটি ‘জাতীয় আবাসভূমি’ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
সেই সঙ্গে বলা হয় যে, সেখানে বসবাসরত অন্যান্য জাতির ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন করা হবে না।
বেলফোর ঘোষণার ভাষা খুবই অস্পষ্ট।
বলা হয়ে থাকে, ইচ্ছাকৃতভাবেই এর ভাষাকে অস্পষ্ট রাখা হয়েছিল। এতে স্পষ্ট করে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয় নি।
বরং ‘জাতীয় আবাসভূমি’ শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এই বেলফোর ঘোষণার মধ্য দিয়েই প্রথম ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভাবনাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
বেলফোর ঘোষণার বঙ্গানুবাদ হলো এই,
“মহামান্য সরকার ইহুদি জনগণের জন্য ফিলিস্তিনে জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে এবং এ উদ্দেশ্য পূরণে তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ব্যবহার করবে। এটি নিশ্চিত করা হচ্ছে যে, এমন কিছু করা হবে না যার ফলে ফিলিস্তিনে অবস্থানরত অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার অথবা অন্য কোনো দেশে ইহুদিরা যে অধিকার ও রাজনৈতিক মর্যাদা ভোগ করছে, তার কোনো হানি হয়।”
ফিরে দেখা
ইংরেজজাতির শঠতা, ধূর্ততা, হিংস্রতা ও নৃশংসতার কথা বহু স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তি উল্লেখ করেছেন, যে যেভাবে এবং যত দূর চিনেছেন।
বাস্তবতার সবচে’ কাছের মন্তব্য যিনি করেছেন, তিনি আমাদের পাকভারত উপমহাদেশের চিরস্মরণীয়, চিরবরণীয়, চিরশ্রদ্ধার পাত্র শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদুল হাসান রহ.।
কারণ বৃটিশজাতি ও বৃটিশসাম্রাজ্যবাদকে তিনি যেমন চিনেছেন তেমনটা আর কেউ চিনতে পারে নি। তিনি বলেছিলেন,
সাগরের তলদেশে মাছেদের মধ্যে যদি বিভেদ-লড়াই শুরু হয়, বুঝতে হবে, এর পিছনে ইংরেজের হাত রয়েছে, দেমাগ রয়েছে! রয়েছে ইংরেজের কূট চাল ও চক্রান্ত!!
তিনি মনে করতেন, জঙ্গলের হিংস্র জানোয়ারের ওয়াদা বিশ্বাস করা যায়, ইংরেজের ওয়াদা বিশ্বাস করা যায় না! কখনোই না।
এ ভুলটাই মুসলিম উম্মাহ করেছে বারবার! এবং উম্মাহর অসহায় কায়েদ ও রাহবার শায়খুল হিন্দ রহ.-এর চোখের সামনে!!
হিন্দুস্তানের মসুলমান! বিশেষ করে কাশ্মীরের মুসলমান!
বৃটিশ, শৃগালের চেহারার ‘সরলতা’ নিয়ে বারবার ওয়াদা করেছে, আমরা বিশ্বাস করেছি; আর তারা ওয়াদা ভঙ্গ করেছে শৃগালের ধূর্ত হাসি মুখে নিয়ে!
তথ্যসুত্র
রোর বাংলা মিডিয়া, বেলফোর ঘোষণা আর্টিকেল
জায়োনিস্ট কারা ?
যারা মনে করে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে বসবাস করা আবশ্যক এবং ফিলিস্তিন ইহুদি রাষ্ট্র হবে, তারাই জায়োনিস্ট। জায়োনিস্ট হওয়ার জন্য ইহুদি হওয়া জরুরি নয়
বেলফোর ঘোষণা কবে করা হয় ?
১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর। এটি প্রকাশ করা হয় ৯ নভেম্বর