ফিলিস্তিনের আসল অধিবাসী কারা

ফিলিস্তিনের আসল অধিবাসী কারা ? – কারা দ্যার্থহীনভাবে বলতে পারে, “ফিলিস্তিন আমাদের। অন্যরা দখলদার। এই ভূমি তাদের নয়”।

যেহেতু প্রধান তিনটি ধর্মের নিকটই ফিলিস্তিনভূমি মর্যাদাপূর্ণ, তাই আজকে আমরা নিরপেক্ষভাবে এই বিষয়টা আলোকপাত করবো ইনশাল্লাহ।

ইহুদিদের নিকট ফিলিস্তিন ভূমি পবিত্র হওয়ার কারণ হলো, তাদের মতে ফিলিস্তিন ছিল রাজা ডেভিডের তথা নবী দাউদ আ. এর রাজধানী।

খৃস্টানদের নিকট ফিলিস্তিন ভূমি পবিত্র হওয়ার কারণ হলো, তাদের মতে ফিলিস্তিন হলো যিশু খৃস্টের তথা হযরত ঈসা আ. এর জন্মভূমি।

মুসলমানদের নিকট ফিলিস্তিন ভূমি পবিত্র হওয়ার কারণ হলো,

কুরআন বলেছে আকসা এবং তার আশেপাশের ভূমিকে বরকতপূর্ণ করা হয়েছে। এছাড়াও মুসলমানদের প্রথম কিবলা এটি।

আমরা এখন ইতিহাসের একটু গভীরে ডুব দিয়ে দেখবো, কারা আদি ফিলিস্তিনি আর কারা পরবর্তীতে উক্ত ভূমিতে বসতি স্থাপন করে নিজেদের ভূমি দাবী করছে।

বাইতুল মাসদিস বা জেরুসালেম (জেরুজালেম ভুল উচ্চারণ) প্রাচীনকালে শাম অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর এই শামের বিশালতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।

পরবর্তীতে উসমানীয় খেলাফত ধ্বংসের পরে পশ্চিমারা এই আরব ভূমিগুলোকে বিভিন্ন সীমানায় ভাগ করে দিয়ে আবদ্ধ করে ফেলে।

প্রতিটি ধর্মের লোকদের দাবীর অসারতা এবং প্রামাণ্য

প্রধান তিনটি ধর্মের সকলেই চায়, রক্তের বিনিময়ে হলেও এই ভূমি নিজেদের কবজায় রাখতে। অন্যান্য দখলদারদেরকে এই ভূমিতে প্রবেশ হতে বিরত রাখতে।

এখানে পূর্বের যেই দুটি ধর্ম তথা ইহুদি এবং খৃস্টান, তারা এখানেই একটি হোঁচট খায়। কারণ তাদের দাবীর পক্ষে তাদের ধর্মগ্রন্থের কোনো বক্তব্য নেই।

বর্তমানে যেটিকে তারা তাদের ধর্মগ্রন্থ বলা হয়, এটি বহু বৈপরীত্যপূর্ণ কথাবার্তায় পূর্ণ এবং এটিতে তারাই বহুবার বিকৃত করেছে।

মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ মসজিদে আকসা এবং এর আশেপাশের ভূমিকে বরকতপূর্ণ বলেছেন। দশস্থানের বেশি জায়গায় এটি বলা হয়েছে।

এছাড়াও এটি ছিল মুসলমানদের প্রথম কিবলা। আর কুরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে মুসলমানদের আকিদা বিশ্বাস হলো মানব জাতির উদ্ভব ঘটেছে মক্কা ভূমি থেকে।

তাই এই অঞ্চলকে বলা হয় উম্মুল কোরা। আর শামের এই ভূমি হবে পরকালীন বিচারের সময় সকলের সমবেত হওয়ার স্থান।

তাই এই স্থানকে বলা হয় ‘আরদুল মাশহার”।

এছাড়াও হাদীসের বর্ণনামতে আখেরী যামানায় শামের যমীনেই কায়েম হবে ইসলামের খেলাফত।

ইমাম আহমদ ও আবু দাউদে বর্ণিত আছে। নবীজি ইরশাদ করেন,

‘আমার উম্মতের একটি জামাত সর্বদা হকের উপর অবিচল থাকবে এবং শত্রুদের দমনকারী হবে। তাদের বিরোধিতাকারিরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

এমনকি তাদের এ অবস্থার মধ্যে আল্লাহর ফায়সালা (কেয়ামত) এসে যাবে।

তারা হকের পক্ষে লড়াই করবে দামেস্ক ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলের প্রবশেদ্বারগুলোর সামনে এবং বাইতুল মাকদিস ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলের প্রবেশদ্বারগুলোর সামনে।

এমনকি তাদের শেষ অংশটি (মাহদীর অনুগামী হয়ে) দাজ্জালের বিরুদ্ধে লড়াই করবে।’ আর দাজ্জাল হবে ইহুদীসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।

আরেক বর্ণনামতে, ‘জিজ্ঞাসা করা হলো, তারা কোথায় অবস্থান করবে? তিনি বলেন, বাইতুল মাকদিসের আশপাশের অঞ্চলে।

মসজিদুল আকছা সম্পর্কে ইসলামের নবী বলেছেন, ‘পৃথিবীতে প্রথম মসজিদ হচ্ছে মাসজিদুল হারাম, দ্বিতীয়টি হচ্ছে আলমাসজিদুল আকছা।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘মাসজিদুল আকছার নামায অন্য মসজিদের নামায হতে পাঁচশগুণ বেশি উত্তম!

এবার আমরা আলোচনা করবো ইতিহাসের আলোকে এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের আলোকে ফিলিস্তিন ভূমির আসল আদিবাসী কারা ছিল।

ফিলিস্তিনের আদিবাসী কারা?

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে, ফিলিস্তিন হচ্ছে সেই ভূখন্ড যেখানে মানুষ প্রথম কৃষিকাজ করে ব্যাপক সফলতা পেয়েছিল।

এটি হলো খৃস্টপূর্ব ৯ হাজার বছর পূর্বের কথা। এই ফিলিস্তিন ভূখন্ডে প্রাচীন সমৃদ্ধশীল শহর ‘আরিহা’ গড়ে উঠেছে ৮ হাজার বছর আগে।

সেমিটিক আরবগোষ্ঠী খৃস্টের জন্মের ছয় হাজার বছর পূর্ব থেকেই ফিলিস্তিনের ভূমিতে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছিল।

একইভাবে কানআনী আরবগোষ্ঠী সেখানে বসতি গড়ে তুলেছে খৃস্টপূর্ব তিন হাজার সালে।

ফলে আরদে কান‘আন বা কানাআনভূমি নামে সেটি পরিচিতি লাভ করেছে। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতি ও জনগোষ্ঠীর দখলে ছিলো এ ভূখন্ড।

সেখানে হয় তারা বসতি গড়েছে, নতুবা নিজেদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর মধ্যে বনী ইসরাইল তা দখলে নিয়েছিলো খৃস্টপূর্ব ১২২০ সালে।

ব্যাবিলনীয়গণ ফিলিস্তিন দখলে নিয়েছিল খৃস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে।

সবার শেষে উমর রা. এর খেলাফতকালে আরব মুসলিমগণ ১৫ হিজরীতে এই পবিত্র ভূমি নিজেদের শাসনের অন্তর্ভুক্ত করে। (৬৩৬ খৃ.)।

ইহুদিরা কেন ফিলিস্তিন দখল করতে চায়?

ফিলিস্তিন ভূখন্ডের উপর ইহুদিদের ঐতিহাসিক দাবীর কি কোনো ভিত্তি আছে? আপন ভূমির উপর আরব মুসলিমদের দাবীর সামনে তাদের দাবী ইতিহাসের বিচারেও একেবারে মূল্যহীন।

ফিলিস্তিনের ভূমিপুত্ররা এই ভূখন্ডকে আবাদ করেছে ইহুদিদের রাজ্য ও বসতি প্রতিষ্ঠারও ১ হাজার ৫০০ বছর আগে।

তখন থেকে আজ পর্যন্ত তাদের বসতি ছিলো বিচ্ছিন্ন। পক্ষান্তরে ইহুদীরা তাদের দখল প্রতিষ্ঠা করেছিলো ফিলিস্তিনের কিছু অংশে, পুরো অংশে নয়।

আর তা স্থায়ী হয়েছিলো মাত্র চারশ বছর (খৃস্টপূর্ব ১০০০ থেকে ৫৮৬) তারপর তাদের রাজত্ব বিলুপ্ত হয়েছে যেমন বিলুপ্ত হয়েছে অন্যান্য জাতির দখলদারি ও রাজত্ব।

সুতরাং তারাও ফিলিস্তিনের জন্য অন্যান্য জাতির মত  হয়ে পড়েছে অতীত এবং ইতিহাসের পাঠ্য।

তাছাড়া ইহুদীরা ফিলিস্তিন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো দীর্ঘ একহাজার আটশ বছর (১৩৫ খৃস্টাব্দ থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত)।

এ সময় ফিলিস্তিনের সঙ্গে তাদের কার্যত কোন সম্পর্কই ছিলো না, না শাসনের দিক থেকে, না সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে, না কোন প্রকার ভূমিকা ও অবদানের দিক থেকে।

তো এত দীর্ঘ সময়ের এত গভীর সর্বমুখী বিচ্ছন্নতার  পর অতীতের পর্দা থেকে উঁকি দিয়ে বলতে চাও কি মানায় যে, ফিলিস্তিন আমাদের? নাহ!

কথা আরো আছে, ইহুদিদের ধর্মীয় বিধানমতেই ফিলিস্তিনের ভূমিতে ফিরে আসা তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিলো।

আরো একটা বড় কথা, স্বয়ং ইহুদী গবেষকদের গবেষণা-মতে সমকালীন ইহুদী জনগোষ্ঠীর আশিভাগই ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনের ভূমির সঙ্গে কোনভাবেই সম্পৃক্ত নয়।

বর্তমান জায়োনিস্ট ইহুদিরা কি প্রাচীন ইহুদি বনী ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত?

বংশ ও রক্তসম্পর্কেও বর্তমান ইহুদিরা বনী ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত নয়।

আজকের ইহুদীদের সিংহভাগই উত্তর ককেশাসে বসবাসকারী প্রাচীন তাতারী তুর্কী জনগোষ্ঠী থেকে আগত, যারা অষ্টম খৃস্টাব্দে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করেছে।

সুতরাং যদি কোন ভূখন্ডে আজকের ইহুদীদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার থাকে তাহলে সেটা হতে পারে দক্ষিণ রাশিয়া, ফিলিস্তিন নয়।

যদি বলে ফিলিস্তিন হচ্ছে তাদের প্রতিশ্রুত ভূমি তাহলে প্রশ্ন হবে, বনী ইসরাইলের সিংহভাগ মানুষ তো হযরত মূসা আ. এর সঙ্গে আরদে মুকাদ্দাসা অভিযানের অংশ হতে অস্বীকার করেছিলো!

কোরআনের ভাষায় তো তাদের মুখে এমন আস্পর্ধাপূর্ণ বক্তব্য এসেছে, ‘যাও তুমি এবং তোমার রব, আর লাড়াই করো। আমরা তো এই এখানে বসলাম।’

ক্ষোভে হতাশায় আল্লাহর নবী হযরত মূসা আ. বলতে বাধ্য হয়েছেন,

হে রব্ব, আমি অধিকার রাখি শুধু আমার এবং আমার ভাইয়ের উপর, সুতরাং আপনি আমার ও পাপাচারী কাউমের মধ্যে পৃথকীয়-রেখা টেনে দিন।

এমনকি ইরানী সম্রাট যখন তাদের প্রস্তাব দিলেন ব্যাবিলন থেকে আরদে মোকাদ্দাসে গমনের তখন তারা পরিষ্কারভাষায় তা প্রত্যাখ্যান করেছিলো।

ইহুদিদের সর্বশেষ যুক্তি হলো উত্তরাধিকার। জেরুসালেম তাদের জাতীয় ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এটি তাদের নবীদের সমাধিস্থল।

আর তারা হলো আবরাহাম থেকে নিয়ে বনী ইসরাইলের সকল নবীর উত্তরাধিকারী। কিন্তু এখানেও ধোপে টিকে নি তাদের যুক্তি।

কারণ, সর্বশেষ আসমানি কিতাব আলকোরআন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে, ইবরাহীম ইহুদি বা খৃস্টান ছিলেন না।

বরং তিনি তাওহীদের অনুসারী মুসলিম ছিলেন। সুতরাং মুসলিমগণই হবে তাঁর উত্তরাধিকারী, ইহুদী বা খৃস্টানরা নয়।

ফার্স্ট টেম্পল বা হাইকালে সোলায়মানির মিথ্যা দাবী

তাদের একটি দাবী হলো, ইহুদিদের ফার্স্ট টেম্পল ছিলো ঠিক ঐ স্থানে যেখানে বর্তমানে মসজিদুল আকছা অবস্থিত।

আর ফার্স্ট টেম্পল নির্মাণ করেছিলেন রাজা সলোমন (সোলায়মান আ)।

দ্বিতীয় টেম্পল ধ্বংস হয়ে গেলেও একটি দেয়াল এখনো অবশিষ্ট রয়েছে, যেটাকে তারা বলে ক্রন্দন প্রাচীর। তো তারা চায়,

মসজিদুল আকছা যে কোনভাবে ধ্বসিয়ে তার স্থলে টেম্পল বা হায়কালে সোলায়মানি নির্মাণ করতে।

প্রথম কথা হলো, সোলায়মান আ. সম্পর্কে তারা শিরক ও মূর্তিপূজার যে অপবাদ আরোপ করেছে তারপর তার উত্তরাধিকার দাবী করা লজ্জাজনক বইকি।

তাছাড়া এ দাবীর স্বপক্ষে ঐতিহাসিক কোন তথ্য তাদের হাতে নেই। প্রমাণহীন দাবী কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

দ্বিতীয় কথা হলো তাদের হায়কালে সোলায়মানি মুসলিম আমলে মুসলিমদের দ্বারা তো ধ্বংস হয়নি। সুতরাং মুসলিমদের ইবাদতখানায় ‘হাত দেয়া হবে কেন?

মুসলমানদের কি অধিকার আছে ফিলিস্তিন ভূমিতে?

ফিলিস্তিনের  আরব জনগোষ্ঠী শেকড়শুদ্ধ টিকেছিলো তাদের পিতৃ-ভূমিতে। তারপর যখন ইসলাম এলো,

ইসলামকে তার স্বাগত জানালো এবং ঈমান, বিশ্বাস ও ধর্মরূপে এমন আপন করে নিলো যে, না ধর্মকে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব, আর না তাদেরকে ধর্ম থেকে।

পক্ষান্তরে জীবন, সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং ভূমিকা ও অবদানের কথা যদি নাও বলি, যদি শুধু শাসনক্ষমতার কথা বলি তাহলে ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইসলামের শাসন ছিলো দীর্ঘতম সময় ধরে।

অর্থাৎ ৬৩৬ থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত প্রায় ১২০০ বছর (শুধু ক্রুশেড আগ্রাসনের নব্বই বছর বাদ দিয়ে)।

বর্তমান ফিলিস্তিনের যারা মুসলিম অধিবাসী, তারা বেশিরভাগই হিযায বা নজদ অথবা মিসর, ইয়ামান থেকে এসে বসতি স্থাপন করেন নি।

তারা ছিল এখানকার স্থানীয়। বহুকাল যাবৎ। ইসলাম এই ভূমিতে আসার আগে তারা খৃস্টান ধর্মের অনুসারী ছিল।

হযরত উমর রা. এর সময়ে তার মহানুভবতায় ফিলিস্তিন মুসলমানদের হাতে জয়ী হলে তারা ইসলামের সৌন্দর্য দেখে ইসলাম গ্রহণ করে।

এভাবেই মুসলমানদের রক্তে মিশে আছে ফিলিস্তিন ভূমি। আল আকসা ভূমি। মর্যাদার দিক থেকে তৃতীয় মসজিদ মসজিদে আকসা।

আমাদের শেষ কথা, আমরা জানি, যুক্তির দ্বারা কিছু হয় না, যা হয় শক্তি দ্বারা হয়। আর মুসলিম উম্মাহ এখন শক্তিহীন।

তবে সময় পরিবর্তনশীল। আমরা অপেক্ষা করবো সেই সময়ের জন্য, যা আমাদের নবী ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছে।  তখন ইনশাআল্লাহ দেখা হবে।

এর আগ পর্যন্ত আমাদের শুধু প্রস্তুতি গ্রহণের পালা। তবে আমাদের প্রতিশ্রুতি এই যে, আগেও আমরা অত্যাচারী ছিলাম না, ভবিষ্যতেও আমরা কোন প্রকার অত্যাচার করবো না।

তথ্যসুত্র

আল কলম পুষ্প পত্রিকার ৩য় প্রকাশনার ২য় সংখ্যা আল কুদুস এর সহায়তায় লিখিত

Scroll to Top