ইজ্জউদ্দিন আল কাসসাম জীবনী

শায়েখ ইজ্জউদ্দিন আল কাসসাম কিংবা ইজ্জতউদ্দিন আল-কাসসাম রহ. ছিলেন বিংশ শতাব্দির একজন ‍মুজাহিদ ও সমাজ সংস্করক।

তিনি একাধারে ফরাসি এবং ইংরেজদের উপনিবেশিকতা ও জায়নিস্ট ইসরাইলের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন এবং মানুষকে জিহাদে উজ্জীবিত করেছিলেন।

জিহাদের ময়দানে তার অবিচলতা, উম্মাহর প্রতি দরদ থেকে কুফরি শক্তির নিকট একটা সময় আতঙ্কে পরিণত হন।

তিনি লিবিয়া, ফিলিস্তিনের সশস্ত্র জিহাদের জন্য আর্থিক অনুদান, জনসমর্থন ও সুযোগে ময়দানে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।

শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম রহ. এর মতো মহান মুজাহিদের জীবনী অধ্যয়ন শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির অভিজ্ঞতার ঐতিহাসিক পর্যালোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

বরং এটি এই মহান জাতির লক্ষ্য ও জিহাদ এবং তার অতীত এবং বর্তমান বাস্তবতার সাথে সংযুক্ত করছে।

শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম রহ. এর জন্ম

মহান শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম রহ. ১৮৮২ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ১৩০০ হিজরীতে সিরিয়ার লাতাকিয়া শহরের দক্ষিণে জাবালাহ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

তৎকালীন সময়ে এই ভূমি উসমানীয় খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। শায়েখ ইজ্জউদ্দিন আল-কাসসাম এর পিতার নাম আব্দুল কাদির এবং মায়ের নাম হালিমা কাসাব।

শায়েখের পিতা আব্দুল কাদির ছিলেন স্থানীয় এলাকার একজন সম্মানিত আলেম। তিনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় তালিবে ইলমদের দ্বীনি শিক্ষা দিতেন।

ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসামের বড় ভাইয়ের নাম হলো ফখরুদ্দিন। আর বোনের নাম নাবিহা। শায়েখের ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসামের পরিবার এবং শায়েখ ছিলেন হানাফি মাজহাবের অনুসারী।

শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম রহ. এর শৈশব ও পড়াশোনা

ছোট ইজ্জতউদ্দিন শৈশবে পিতার নিকট প্রাথমিক পড়াশোনা শিখেন। ১৪ বছর বয়সে তিনি তার ভাই ফখরুদ্দিনের সাথে মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান।

এখানেই তিনি উচ্চতর পড়াশোনা সম্পূর্ণ করেন। এসময় তিনি জামিয়া আল আজহার থেকে ইসলামী উচ্চতর বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেন।

আল-আজহারে ইজ্জতউদ্দিন সেই যুগের মহান আলেমদের সোহবতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।

যেমন শেখ মুহাম্মাদ আবদুহু এবং মুহাম্মাদ রশিদ রেদা এবং মুস্তফা কামেল এবং সাদ জাঘলুল প্রমুখ।

এরপর শায়েখ মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়াশোনা শেষ করে তিনি তার স্বদেশ সিরিয়ার জাবালাহতে ফিরে আসেন।

আল কাসসাম রহ. এর কর্মজীবন

শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন ১৯০৩ সালে জাবালাহতে ফিরে এসে এখানের স্থানীয় মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। সেসময় তিনি স্থানীয় মানুষের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।

তাদের সন্তানদেরকে মাদ্রাসায় পাঠানোর জন্য উদ্ভুদ্ধ করেন। উক্ত মাদ্রাসায় তিনি ফিকাহ্ শাস্ত্র, হাদীস শাস্ত্র সম্পর্কে পাঠদান করতেন।

এছাড়াও শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম এলাকাতে ব্যপক সংস্কারমূলক কাজ করেন।

তিনি মানুষদেরকে নামাজ (সালাত), রোজা (সওম) পালন এবং জুয়া ও মদপান বন্ধ করতে মানুষকে আহবান করেন।

এছাড়াও স্থানীয় উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসকদের সাথে তার সম্পর্ক ছিল। তিনি তাদেরকে এলাকাতে শরীয়াহ মোতাবেক শাসনকার্য পরিচালনা করতে উদ্ভুদ্ধ করতেন।

একটা সময় স্থানীয় কিছু পাপিষ্ঠরা শায়েখ ইজ্জতউদ্দিনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। তারা তার ব্যাপারে মানুষকে উসকানি দিতে থাকে।

এসময় তিনি খারাপ মানুষদের অসহ্য আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে তুরষ্কে ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি সংষ্কারমূলক কার্যক্রম শুরু করেন।

কিন্তু যেহেতু তিনি তুর্কি ভাষা পারতেন না, তাই স্থানীয় তুর্কিদের ভাষা তিনি বুঝতেন না। তিনি তাদেরকে আরবিতে বললে তারাও কিছু বুঝতো না।

একটা সময় শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম পূনরায় তার স্বদেশ সিরিয়ার জাবালাহতে ফিরে আসেন। তিনি এই সংকল্প করেন, মানুষকে তিনি অজ্ঞতা থেকে বের হওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।

শায়েখ ইজ্জউদ্দিন আল-কাসসাম রহ. ১৯২০ সালে ফিলিস্তিনে হিজরত করেন।

সেসময় তিনি ফিলিস্তিনে মাদ্রাসাতুল ইনাছিল ইসলামিয়্যা ও মাদ্রাসাতুল বুর্জ ইসলামিয়্যাতে শিক্ষকতা শুরু করেন।

এই দুইটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফিলিস্তিনের হাইফা অঞ্চলের ইসলামী সোসাইটি (বোর্ড) তত্ত্বাবধান করতো।

তিনি শিক্ষার্থীদেরকে ধর্মীয় পড়াশোনার পাশাপাশি কারিগরি দক্ষতা বাড়ানোর উপদেশ দিতেন।

শায়েখ ইজ্জউদ্দিন আল-কাসসাম সেসময় হাইফা অঞ্চলের আল ইস্তিকলাল মসজিদে ইমামতি এবং খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি মানুষকে যুগসচেতনতামূলক বক্তৃতা, জিহাদের প্রয়োজনীয়তা ও ব্রিটিশ প্রভাব থেকে স্বাধীনতা বিষয়ক আলোচনা করতেন।

ফিলিস্তিনের বাহিরে শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম এর জিহাদি প্রতিরোধ আন্দোলন

১৯১১ সালে শায়েখ আল কাসসাম ইতালি কর্তৃক উসমানীয় খেলাফতের অধীনে থাকা লিবিয়া আক্রমণ করলে তার নিজের এলাকা জাবালা থেকে তহবিল সংগ্রহ করেন।

সেসময় জাবালা এলাকার গভর্নর উক্ত তহবিল আত্মসাৎ করার তালে ছিল। তাই সে শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসামকে কারাগারে পাঠানোর চেষ্টা করে।

কিন্তু খেলাফতের সরকারি আদালত পূর্ণ তদন্তের পর ইজ্জতউদ্দিন আল-কাসসাম নির্দোষ প্রমাণিত হন।

সম্পদ আত্মসাৎ করার চেষ্টা করায় উক্ত গভর্নরকে বরখাস্ত করা হয়।

১৯১২ সালে শায়েখ এক জুমুআর খুতবাতে মানুষকে ইতালিয়ান দস্যুদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার আহবান করেন।

এসময় উসমানীয় খেলাফতের সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেককে ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সংগ্রহ করেন।

এছাড়াও স্বেচ্ছাসেবীদের অবর্তমানে তাদের পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য তিনি স্থানীয় জনগণ থেকে ফান্ড সংগ্রহ করেন।

এসময় প্রায় ২৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম মিসরের আলেকজান্দ্রিয়াতে আসেন।

এখান থেকে উসমানীয় খেলাফতের সহায়তায় তিনি যুদ্ধে যাওয়ার মনস্থ করেছিলেন।

কিন্তু খেলাফতের এমন ভঙ্গুর অবস্থায় ইস্তাম্বুলে তখন ক্ষমতা হাতবদল হয়।

নতুন সরকার লিবিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলকান যুদ্ধের দিকে আগ্রহী হয়েছিল।

তাই শায়েখকে তার এলাকা জাবালাতে ফিরে যেতে বলা হয়।

শেষ পর্যন্ত শায়েখ নিজ এলাকাতে ফিরে আসেন এবং সংগ্রহে থাকা তহবিলের একটি অংশ দিয়ে নতুন একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয়। বাকীটুকু ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেওয়া হয়।

পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয়দের পক্ষ হয়ে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দামেষ্কের একটি ঘাঁটিতে তিনি আক্রমণও করেছিলেন।

ফরাসিদের বিরুদ্ধে শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন

এসময় ফরাসিরা সিরিয়াতে হামলা করছিল। তাই শায়েখ কাসসাম ফরাসিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন।

তিনি তখন একটি মিলিটারি বাহিনী তৈরি করেন এবং অস্ত্র সংগ্রহ করেন। শায়েখ কাসসাম তখন তার বাহিনীসহ ফরাসিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন।

এছাড়াও ফরাসিদের মদদপুষ্ট স্থানীয় নুসাইরি মিলিটারিদের সাথেও লড়াই করেন।

একটা সময় ফরাসিরা শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসামের প্রতিরোধের মুখে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছিল।

সেখানে তখন ফরাসিদের বিরুদ্ধে লড়াকু আরেক বীর মুজাহিদ উমর আল বিতার শহীদ হলে তার বাহিনীও শায়েখ ইজ্জতউদ্দিনের বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়।

শেষ পর্যন্ত ফরাসিরা লড়াই হওয়া এলাকার সাথে এই চুক্তিতে বাধ্য করা হয় যে, তারা শায়েখকে কোনো সাহায্য করবে না এবং ফরাসি সরকারকে তারা কর দিবে।

এর ফলে শায়েখ আল কাসসাম কোণঠাসা হয়ে পড়েন। কিন্তু তারপরও আত্মসমর্পন না করে কৌশলগতভাবে পিছু হটেন।

এরপর তিনি তার বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার আলেপ্পো অঞ্চলের জাবাল আল আকরাদে চলে যান। সেখানে আরেক মুজাহিদ ইব্রহিম হানানুর সাথে বাহিনী নিয়ে যুক্ত হন।

এভাবে উভয়দল মিলে ফরাসিদের বিরুদ্ধে জিহাদি কার্যক্রম চালিয়ে যান।

কিন্তু সংখ্যা স্বল্পতার কারণে ফরাসিরা বিজয়ী হলে শায়েখ তার বাহিনীসহ অন্যত্র সরে পড়েন।

শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসামের ফিলিস্তিনে জিহাদি কার্যক্রম

ফিলিস্তিনের হাইফা শহরে হিজরতের পর সেখানে আস্তে আস্তে শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। তিনি জুমুআর খুতবাতে মানুষকে ইসলামের পথে আহবান করতেন। পূর্ববর্তীদের সাহসের গল্প শোনাতেন।

স্থানীয় শ্রমিক, কৃষকরা আস্তে আস্তে শায়েখের অনুসারী হয়ে উঠে। তিনি তাদেরকে পানশালা, আড্ডাখানা, পতিতালয় থেকে নিয়ে এসে ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন।

বয়ঙ্কদের জন্য তিনি হাইফাতে ইলমী কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। স্থানীয় ওয়াজের মসলিসগুলোতে তিনি মানুষকে সৎপথে আহবান করতেন।

১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার পর ইহুদিদের ফিলিস্তিন অভিমুখে যাত্রা এবং বৃটিশদের সহায়তাকে মোটেও পছন্দ করতেন না।

তিনি পূনরায় আবার জিহাদি কার্যক্রম পরিচলনার জন্য কাজ শুরু করেন।

তিনি দামেষ্কের মুফতি শায়েখ বদরুদ্দিন আল তাজি রহ. এর নিকট হতে ইংরেজ ও ইহুদিদের বিরুদ্ধে জিহাদের ফাতওয়া নিয়ে এসেছিলেন।

শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম জনগণকে মসজিদ নির্মান এবং বাসস্থান নির্মাণের পরিবর্তে অস্ত্র ক্রয় এবং জিহাদে অর্থ স্থানান্তর করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার আহবান জানান।

তিনি একবার হজের সফরকে স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন, এবং সফরের খরচ দিয়ে অস্ত্র কেনার জন্য জনগণকে বলেন।

হাইফার ইস্তিকলাল মসজিদে তার একটি বিখ্যাত খুতবাতে তিনি বলেছিলেন, “যদি তোমরা মুমিন হও, তাহলে তোমাদের কেউ যেন অস্ত্র ও জিহাদ ছাড়া বসে না থাকে।”

এই খুতবা দখলদার ইংরেজ শুনে পেরেশান হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে তারা আল-কাসসামকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে বিক্ষুব্ধ জনতার চাপে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৯২৬ সালে শায়েখ ইজ্জদ্দিন আল-কাসসাম মুসলিম যুব সমিতির প্রধান নির্বাচিত হন। সেসময় শায়েখ প্রতি শুক্রবার সন্ধায় স্থানীয়দের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিতেন।

তিনি তার ছাত্র ও অনুসারীদের দিয়ে গ্রামে গ্রামে, এলাকার দূর-দূরান্তে মানুষের নিকট যেতেন।

নিজের জমি ইহুদিদের নিকট না দেওয়ার এবং ইসলামী নীতিমালা মান্য করার তাগিদ দিতেন।

ইহুদি-খৃস্টানদের বিরুদ্ধে শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসামের সশস্ত্র জিহাদ

১৯২১ সাল থেকেই শায়েখ আল কাসসাম ফিলিস্তিনের মানুষদেরকে জিহাদের উপদেশ দিতেন। তাদেরকে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য আহবান করতেন।

১৯৩০ বা ১৯৩১ সালের দিকে শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম অনেক স্বেচ্ছাসেবী মুজাহিদদের সংগ্রহ করেন।

তিনি তাদেরকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে বিভিন্ন অভিযান ও দায়িত্ব দিতেন।

একদল অন্য দল সম্পর্কে জানতো না। তার মুজাহিদদের বেশিরভাগই ছিল গ্রামের কৃষক ও যুবকরা। প্রতিটা দলে ৫/৬ জন করে সদস্য থাকতো।

তিনি সময়ের অপেক্ষা করছিলেন এবং আরো মুজাহিদ সংগ্রহ করছিলেন।

পাশপাশি সামরিক প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা কার্যক্রম, সংষ্কারমূলক কাজ ও ইলম চর্চায় মানুষকে আহবান করছিলেন তিনি।

১৯৩১ সালে শায়েখের স্বেচ্ছাসেবী মুজাহিদরা গেরিলা আক্রমণ শুরু করে। তারা হাইফা শহরের উপকণ্ঠে ইহুদি বসতি এবং সামরিক স্থানগুলোতে গেরিলা আক্রমণ করতো।

তাদের মূল লক্ষ্য ছিল, বৃটিশদের ‍উপনিবেশ সীমিত করা, ইহুদিদের অভিবাসন রোধ করা এবং ফিলিস্তিনে থাকা বৃটিশদের দালাল ও গুপ্তচরদের শায়েস্তা করা।

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল তিনজন ইয়াগুর (ইহুদিদের গুপ্ত সংগঠন) সদস্যকে হত্যা ও ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমদিকে হাইফার ইহুদি বসতিতে বোমা হামলা করে গেরিলারা।

একটা সময় বৃটিশরা শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম রহ. এর এই দল সম্পর্কে আবছা আবছা খবর পেলে গেরিলা কার্যক্রম সীমিত করা হয়।

১৯৩২ সালে শায়েখ কাসসাম হাইফা থেকে জিহাদের জন্য স্থানীয়দের থেকে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেন।

তিনি নবীজির জীবনী এবং পূর্ববর্তী মুসলিম মনিষীদের ইতিহাস থেকে শিক্ষালাভ করতেন এবং একটি নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা করতেন।

শায়েখ কাসসামের সর্বাত্মক জিহাদের ঘোষণা

১৯৩৫ সালের নভেম্বরে শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম সামরিক প্রস্তুতি কম থাকা সত্ত্বেও ওপনিবেশিক ও ইহুদিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জিহাদের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন।

ফিলিস্তিনে সেসময় ইহুদিরা অতিমাত্রায় ভূমি দখল করছিল।

১৯৩৫ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল ৬২,০০০ এর মতো। তারা তখন প্রায় ৭৩,০০০ একক জমির মালিক ছিল।

ব্রিটিশরা তখন শায়েখের গতিবিধির উপর নজর রাখতে শুরু করে।

এছাড়াও তাকে নানান কাজে বাধা দিতে থাকে। ফলে তিনি হাইফা ছেড়ে জেনিন জেলাতে চলে যেতে বাধ্য হন।

আস্তে আস্তে সেখানেও খুব অল্পদিনে জিহাদের আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়ে গেল। মুক্তিকামী ফিলিস্তিনিরা স্বদেশের জন্য, পবিত্র ভূমির জন্য রক্ত দিতে প্রস্তুত ছিল।

৮ নভেম্বর ব্রিটিশ কনস্টেবল মোশে রোসেনফেল্ডের লাশ আইন হারুদে খুজে পাওয়া যায়।

আল-কাসসাম ও তার অনুসারীদেরকে এর জন্য দায়ী করা হয়।

১৫ নভেম্বর ১৯৩৫ সালে প্রথম ফিলিস্তিনে বিপ্লবের সূচনা করেন। ব্রিটিশরা তখন তাকে মোস্ট ওয়ান্টেড হিসেবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

কিন্তু ব্রিটিশরা আল কাসসাম রহ. এর গেলিরাদের আক্রমণে এবং স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে তাকে আঁটক করতে সমর্থ হয় নি।

১৮ নভেম্বর ১৯৩৫ খৃস্টাব্দে অন্য এক এলাকায় আত্মগোপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে রওয়ানা হয়েছিল। কিন্তু পথে তারা বুঝতে পারে, কেউ তাদের অনুসরণ করছে।

ফলে তারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে একটি দল উত্তর ফিলিস্তিনে আর অপর দল হাইফা এলাকাতে চলে যায়।

এখানে তারা ব্রিটিশদের রেলপথে গেরিলা আক্রমণ করে এবং টেলিফোনের তাঁর কেঁটে দেয়।

এরপর নাবলুস শহরে উভয়দল পূনরায় মিলিত হয়। এখানে শায়েখ ইজ্জউদ্দিন আল-কাসসাম গেলিরা মুজাহিদদের সাথে মিলিত হন।

১৯ নভেম্বর ১৯৩৫ তারিখে ব্রিটিশ পুলিশরা কোনোভাবে মুজাহিদদের অবস্থান জেনে চারিদিক থেকে আক্রমণ শুরু করে।

শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম রহ. এর মৃত্যু

ব্রিটিশ পুলিশরা ও সাথে আরব পুলিশরা আক্রমণ করার পর মুজাহিদরা পিছু হটে জঙ্গলের মধ্যে পাথরের আড়ালে আশ্রয় নেয়।

শায়েখের সাথে তখন মুজাহিদ ছিল সব মিলিয়ে ৯ জন। আর পুলিশদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০ এর মতো। মুজাহিদদেরকে তখন আত্মসমর্পনের জন্য ডেকে বলা হচ্ছিল।

কিন্তু শায়েখ ইজ্জউদ্দিন আল-কাসসাম দৃঢ়চিত্তে বজ্রকণ্ঠে বললেন, আমরা কখনোই আত্মসমর্পন করবো না। এটি জিহাদ। হয় আমরা শহীদ হবো অথবা গাজী হবো।

টানা ছয় ঘন্টা উভয় বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের পর ২০ নভেম্বর ১৯৩৫ খৃস্টাব্দে শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম রহ. শহীদ হন। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফিসদাউস দান করুন।

ইজ্জউদ্দিন আল কাসসাম
ফাইল ছবি: শায়েখ ইজ্জউদ্দিন আল কাসসাম রহ.

ব্রিটিশরা শায়েখ ইজ আল-দ্বীন আল-কাসসামের কাছে একটি কোরআন, একটি রাইফেল, একটি পিস্তল এবং চৌদ্দ পাউন্ড (স্থানীয় মুদ্রা) পেয়েছিল।

সাথে থাকা নয় মুজাহিদদের মধ্যে শায়েখ ইজ্জতউদ্দিনসহ তিনজন শহীদ হন। আর বাকী পাঁচজনকে বন্দি করে পুলিশরা।

২১ নভেম্বর ১৯৩৫ তারিখে ফিলিস্তিনের হাইফা শহরের জেরিনি মসজিদে শায়েখ ইজ্জতউদ্দিন আল কাসসাম রহ. এর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

প্রায় ৩,০০০ মানুষ উক্ত জানাযাতে অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও হাইফা শহরে শায়েখের মৃত্যুর খবর আসার পর শহরের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়।

পরদিন সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে ব্যাপক ধর্মঘট পালিত হয়। শাইখকে ফিলিস্তিনের হাইফা অঞ্চলের এক মুসলিম কবরস্থানে দাফন করা হয়।

আল-কাসসামের গেরিলা সদস্যরা “কাসসামিয়ুন” নামে ফিলিস্তিনে পরিচিত ছিল।

তার মৃত্যুর প্রায় পাঁচ মাস পরে তার এক শিষ্য ফারহান আল-সাদির নেতৃত্বে দুইজন ইহুদি বাসযাত্রীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

কাসসামিয়ুনদের নেতৃত্বে কৃষক ও শহুরে গেরিলারা দেশজুড়ে বিদ্রোহ শুরু করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বিদ্রোহের শুরুতে আল-কাসসামের ঘনিষ্ঠ অনুসারী আল-সাদি, আবু ইবরাহিম আল-কবির ও আতিয়াহ আহমাদ আওয়াদ ফাসাইলদেরকে যথাক্রমে জেনিন, উচ্চ গ্যালিলি ও বালাদ আল-শাইখ অঞ্চলে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

তথ্যসুত্র

আল সাল্লাবি ডট কম, ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি লিখিত ওয়েব আর্টিকেল

ইজ্জউদ্দিন আল-কাসসাম, বাংলা উইকিপিডিয়া

ইন্টারঅ্যাকটিভ এনসাইক্লোপিডিয়া আরবি ওয়েবসাইট

Scroll to Top