শিরকুহ এর মিশর অভিযান – সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী রহ. এর চাচা আসাদুদ্দীন শিরকুহ ছিলেন সুলতান নূরুদ্দিন জিনকি রহ. এর একজন বিশ্বস্ত সেনাপতি।

৫৫৯ হিজরী মোতাবেক ১১৬৪ খৃস্টাব্দে মিসরে একটি সমস্যা দেখা দেয়। তৎকালীন সময়ে মিসরের প্রধানমন্ত্রী ছিল সাওর নামক একজন ব্যক্তি।

মিসর সেসময়ে ছিল ফাতেমী সাম্রাজ্য বা উবায়দি সাম্রাজ্যের এলাকা। রাষ্ট্রীয়ভাবে যদিও মিসরের প্রধান ছিল উবায়দি একজন শাসক। কিন্তু ক্ষমতা মূলত ছিল প্রধানমন্ত্রীর হাতে।

 কিন্তু হঠাৎ করেই এই সাওরকে উৎখাত করে নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়ে যায় জাগরাম। তখন সে উবায়দি সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের অনেককে হত্যা করে।

সাওর তখন সুলতান নুরুদ্দিন জিনকি রহ. এর নিকট এসে আবেদন করে, মিসরে তার মন্ত্রীত্ব ফিরিয়ে দিতে।

এছাড়াও এই সামরিক অভিযানে যত খরচ হবে, পুরোটা সাওর বহন করবে। পরবর্তীতে সুলতানকে সে মিসরের বার্ষিক আয়ের এক-চতুর্থাংশ প্রদান করবে।

যেহেতু মিসর তখন শিয়াদের দখলে ছিল, তাই সুলতান অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এদিকে জাগরাম এই খবর জানতে পেরে খৃস্টান ক্রুসেডারদের সাথে গোপন চুক্তি করে।

এই ষড়যন্ত্রের খবর জানতে পেরে সুলতান নুরুদ্দিন জিনকি রহ. তার বিশ্বস্ত জেনারেল আসাদুদ্দীন শিরকুহকে একটি সেনাদলসহ মিসরে অভিযানে প্রেরণ করেন।

আসাদুদ্দীন শিরকুহ এর মিসরে অভিযান

সুলতানের আদেশে তিনি মিসরের উদ্দেশ্যে বাহিনী নিয়ে রওয়ানা হন। প্রথমে তিনি বিলবেস শহরে আসেন। এখানে মিসরের প্রধানমন্ত্রী জাগরামের ভাই নাসিরুদ্দিন বাহিনী নিয়ে অপেক্ষায় ছিল।

কিন্তু যুদ্ধে সে টিকে থাকতে পারে নি। কোনোমতে জান নিয়ে কায়রোতে পালিয়ে চলে যায়।

১১৬৪ খৃস্টাব্দের এপ্রিলে আসাদুদ্দীন কায়রো শহরের উপকণ্ঠে আসেন।

জাগরাম তখন তার বাহিনী নিয়ে শহরের বাহিরে বের হয়ে আসে। কিন্তু প্রাথমিক লড়াই হওয়ার মধ্যেই জাগরাম নিহত হয়।

যুদ্ধে আসাদুদ্দীন জয়লাভ করেন। এরপর পুনরায় সাওরকে মিসরের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

আসাদুদ্দিন তখন শহরের বাহিরে ছাউনি স্থাপন করে অবস্থান করছিলেন।

সুলতান ‍নুরুদ্দিন জিনকি রহ. এর সাথে চুক্তি মোতাবেক বার্ষিক কর দেওয়ার সময় আসলে আসাদুদ্দিন সাওরকে কর দেওয়ার জন্য তাগাদা দেন।

কিন্তু সে আগের উপকারের কথা ভুলে গিয়ে চুক্তিভঙ্গ করে বসে। গোপনে সে তখন ক্রুসেডারদের সাথে যোগাযোগ করে।

তার ষড়যন্ত্রে ক্রুসেডারদের জেরুসালেম দখল করা বাদশাহ একটি বড় বাহিনী নিয়ে মিসরের দিকে অগ্রসর হন।

আসাদুদ্দিন শিরকুহ এই সংবাদ পাওয়ার পর কায়রো থেকে ছাউনি উঠিয়ে বিলবেস দুর্গে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। জেরুসালেমের ক্রুসেডার বাদশাহ এই দুর্গ ঘেরাও করে।

সুলতান জিনকি রহ. এর ভিন্ন পন্থা অবলম্বন

এই সংবাদ সুলতান নূরুদ্দিন জিনকি রহ. এর নিকট যাওয়ার পর তিনি ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন।

তিনি কুটনৈতিকভাবে মিসরের দিকে অগ্রসর না হয়ে সিরিয়াতে ক্রুসেডারদের শহরে আক্রমণ করে বসেন।

এই সংবাদ ক্রুসেডাররা পাওয়ার পর মিসর থেকে সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার মনস্থ করে। সুলতান সিরিয়ার হারেম শহর বিজয় করেন। এখানে প্রায় ১০ হাজার ক্রুসেডার নিহত হয়।

এরপর সুলতান ক্রুসেডারদের অন্যতম শহর, বিলবেস শহর অবরোধ করেন।

এই সংবাদ পেয়ে মিসরে তখনো অবশিষ্ট থাকা ক্রুসেডাররা আসাদুদ্দিনের সাথে সন্ধি সাক্ষর করে সিরিয়ার দিকে রওয়ানা হয়।

আসাদুদ্দিনও তখন মিসরের কাজ শেষ হওয়ায় সুলতানের সাহায্যে সিরিয়ার পথ ধরেন। ক্রুসেডার বাহিনী ও মুসলিম বাহিনী পাশাপাশি পথ চলছিল।

তাই এ সময়ে এক ইউরোপীয় অফিসার আসাদুদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করে,

ক্রুসেডারদের চুক্তিভঙ্গ করে তো আপনাদের বাহিনীর উপর আক্রমণ করতে পারে। আপনার কি ভয় লাগছে না?

আসাদুদ্দিন তখন এটি শুনে দৃঢ়চিত্তে জবাব দেন, এমনটা হলে তো ভালোই হয়। চুক্তিভঙ্গ করলে আমি এর সাজা খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতাম।

আল্লাহর কসম! আমার সেনারা যদি আমাকে বিরত না রাখতো তাহলে আমি প্রথমদিনই সকলের সাথে লড়াই করে সব ক্রুসেডারদের জাহান্নামে পাঠাতাম।

তথ্যসুত্র

মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস, খন্ড ১২, পৃষ্ঠা ১২০-১২২

Scroll to Top