প্রতিবছরই ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ আসলে খৃস্টানরা বড়দিন বা ঈসা আ. এর জন্মদিন বলে উদযাপন করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ক্রিসমাস ডে কি বা বড়দিন আসলে কি? কোথা থেকেই বা এটির সূচনা ঘটলো?

মরিয়মের পুত্র হযরত ঈসা আ.  বা খৃস্টানদের নিকট যিনি যিশু হিসেবে পরিচিত, তিনি ছিলেন মহান আল্লাহর একজন মনোনীত নবী ও রাসূল।

যাকে আল্লাহ কুদরতীভাবে জন্মদান করেছেন। তিনিই পৃথিবীতে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি পিতার ঔরস ব্যতিত জন্মলাভ করেছিলেন।

হযরত ঈসা আ. যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তার মা মরিয়ম আ. এর উপর ইহুদিরা অনেক অপবাদ দেয়। কিন্তু মরিয়ম আ. ধৈর্য্যধারণ করেন।

আজকে আমরা এখানে আলোচনা করবো, এই শীতের মৌসুমে ২৫ ডিসেম্বর কি আদৌ হযরত ঈসা আ. জন্মলাভ করেছিলেন নাকি অন্যকিছু?

জিসাস ক্রাইস্ট বা যিশু কি ২৫ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন?

হযরত ঈসা আ. বা খৃস্টানদের ভাষ্যমতে জিসাস ক্রাইস্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন ফিলিস্তিনের বেথেলহেম শহরে। এছাড়াও ফিলিস্তিন অসংখ্য নবীদের পূন্যভূমি।

কিন্তু হযরত ঈসা আ. কবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এ বিষয়ে বাইবেলে বা কুরআনে সুষ্পষ্ট দিন-তারিখ উল্লেখ করা হয় নি।

তবে কিছু আলামত উল্লেখ করা হয়েছে। যেগুলোকে একত্রিত করলে আমরা ২য়ে ২য়ে ৪ দেখতে পাই।

বাইবেলের লূক অধ্যায়ে রয়েছে, “যিশু খৃস্টের জন্ম হয় বেথেলহেমে। সেই রাজ্যের রাজা তখন আদমশুমারির ডাক দেন। তখন সুদূর গালীল প্রদেশের নাসরত থেকে যিশুর বাগদত্তা পিতা জোসেফ, যিশুর মাতা মেরিকে নিয়ে বেথেলহেমে আসেন। মেরি তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। বেথেলহেমে আসার পরেই যিশু ভূমিষ্ঠ হয়।”

এখানে কিছু টার্নিং পয়েন্ট আছে। আমরা জানি, ফিলিস্তিন হলো মধ্যপ্রাচ্যের ভূমি।

এখানে গরমের সময় যেমন প্রচণ্ড গরম হয় তেমনি শীতের সময়ে তুষারপাত পর্যন্ত হয়।

ফিলিস্তিনে ডিসেম্বর মাস হলো পূর্ণ শীতকাল। এসময়ে সেখানে তুষারে রাস্তাঘাত ঢেকে যায়। প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে এ সময়টাতে।

এখন বাইবেলের উপরোক্ত বর্ণনা অনুসারে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেই দেশের রাজা আদমশুমারির ডাক দিয়েছিলেন। আর এই সময়ে যিশুর মা মেরি গালীল প্রদেশ থেকে বেথেলহেমে আসেন।

কয়েকটি প্রশ্ন খেয়াল করুন।

১. তুষারপাত হওয়া শীতে কি কোনো রাজা আদমশুমারি ডাকে?

২. একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলা কি তুষাতপাত হওয়া সময়ে ভ্রমণ করতে পারে?

প্রাচীন ফিলিস্তিনের গালীল প্রদেশ আসলে কোথায় ছিল, তা নিয়ে মতভেদ আছে। এর সীমানা নিয়েও মতভেদ আছে।

তবে বর্তমানে এটি লেবাননের কাছাকাছি এলাকা বলে ধারণা করা হয়। তাহলে সেখান থেকে একজন মহিলা শীতে এত দূর পথ পাড়ি দিয়ে বেথেলহেমে আসা অসম্ভব।

এছাড়াও কোনো রাজা শীতের মৌসুমে আদমশুমারি করেন না। সাধারণত আদমশুমারি হয় গরমের সময় বা শীত আসার আগে।

বাইবেলের লূকের আট নম্বর শ্লোকে বলা আছে, “যে রাতে যিশু জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই রাতে মেষপালকেরা মাঠে তাদের মেষ পাহারা দিচ্ছিলেন।”

এখানেও প্রশ্ন আসে, শীতকালের তুপারপাত হওয়া রাতে কি কেউ মেষ চড়ায়? সুতরাং বুঝা যাচ্ছে, আসলে যিশুর জন্ম শীতে হয় নি। বরং গরমের সিজনে হয়েছিল।

পবিত্র কুরআনে ঈসা আ. এর জন্ম সম্পর্কে কি বলা আছে?

এখন আমরা দেখি, পবিত্র কুরআনে হযরত ঈসা আ. এর জন্মের ব্যাপারে কোনো তথ্য আছে কিনা? বাইলের মতো এখানেও দিন-তারিখ উল্লেখ করা হয় নি।

তবে কুরআনে আরেকটু বিস্তারিত তথ্য আছে। সেটা সূরা মারয়ামে বর্ণিত আছে। হযরত ঈসা আ. এর মা ছিলেন পূত-পবিত্র একজন নারী।

যাকে কোনো পুরুষ কোনোদিন স্পর্শ করে নি। সুতরাং এমন সময়ে যখন তিনি গর্ভবতী হলেন তখন তিনি কওমের ভয়ে সে সময়ে কিছু কথা বলেন। যা কুরআনে বর্ণিত আছে।

সূরা মারইয়ামের ২২-২৫ নং আয়াতে বলা হচ্ছে,

فَحَمَلَتۡهُ فَانۡتَبَذَتۡ بِهٖ مَکَانًا قَصِیًّا.  فَاَجَآءَهَا الۡمَخَاضُ اِلٰی جِذۡعِ النَّخۡلَۃِ ۚ قَالَتۡ یٰلَیۡتَنِیۡ مِتُّ قَبۡلَ هٰذَا وَ کُنۡتُ نَسۡیًا مَّنۡسِیًّا . فَنَادٰىهَا مِنۡ تَحۡتِهَاۤ اَلَّا تَحۡزَنِیۡ قَدۡ جَعَلَ رَبُّکِ تَحۡتَکِ سَرِیًّا .  وَ هُزِّیۡۤ اِلَیۡکِ بِجِذۡعِ النَّخۡلَۃِ تُسٰقِطۡ عَلَیۡکِ رُطَبًا جَنِیًّا

তারপর মারইয়াম ঈসাকে গর্ভে ধারণ করল এবং তা নিয়ে দূরবর্তী একটি স্থানে চলে গেল। প্রসব বেদনা তাকে এক খেজুর গাছের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। সে বললো, হায়! এর পূর্বে আমি যদি মরে যেতাম এবং লোকের স্মৃতি হতে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতাম! তখন আড়াল থেকে তাকে ডাক দেয়া হল, ‘তুমি দুঃখ করো না, তোমার প্রতিপালক তোমার পাশ দিয়ে এক ঝর্ণা প্রবাহিত করে দিয়েছেন। আর এই খেজুর গাছের কান্ড ধরে তুমি নাড়া দাও। তা তোমার উপর তাজা পরিপক্ক খেজুর পতিত করবে।

কুরআনের উপরোক্ত আয়াতেও আমরা কিছু তথ্য পাই। যেমন,

১. মারইয়াম একটি লোকালয়ের বাহিরে চলে গেল।

২. একটি খেজুর গাছের নিচে বসলো এবং তাতে পাকা খেজুর ছিল।

৩. পাশ দিয়ে ঝর্ণা প্রবাহিত হলো।

এখন ঘটনাটি যদি আদৌ শীতকালে ঘটতো তাহলে কি কোনো অন্তঃসত্ত্বা নারী এই তুষারপাত হওয়া শীতে লোকালয়ে ছেড়ে একটি খেজুর গাছের নিচে বসে থাকবে?

উত্তরটি খুব সহজ। তা কখনোই না। এছাড়াও কুরআনের আয়াতে দেখতে পাই গাছে পাকা খেজুর ছিল। সকলেই এটা জানে যে, খেজুর শীতকালে পাকে না। বরং গরমের সময়ে খেজুর পাকে।

আর তুষারপাত হওয়া শীতে ঝর্ণার পানি প্রচণ্ড ঠান্ডা থাকে। অনেক সময়ে তা বরফে পরিণত হয়।

সুতরাং কুরআনের এই তথ্য দ্বারা আমরা বুঝতে পারি, ঈসা আ. এর জন্ম হয়েছিল গরমের কোনো সিজনে।

এখন কথা হলো, বাইবেল, কুরআনের তথ্যের বিপরীতে এত বড় একটি ভুল কাজ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কেন খৃস্টানরা পালন করে আসছে?

ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে আসলে কার জন্মদিন ছিল?

বর্তমানে ক্রিসমাস ডে বা বড়দিনে আমরা দেখি, খৃস্টানরা গাছে কেঁটে এনে ঘর সাজায়। এছাড়াও আরো বিভিন্ন উৎসব পালন করে।

আমরা একটু পিছনে ফিরে যাই। খৃস্টানদের মধ্যে ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ উৎসবটি এসেছে প্যাগানদের থেকে।

যিশুর জন্মেরও বহু আগে থেকেই ইউরোপে প্যাগানরা রাজত্ব করতো।

সে সময়ে প্যাগানরা ‘স্যাটারন্যালিয়া’ নামক একটি উৎসব পালন করতো।

দেবতা ‘স্যাটার্ন’ এর পূজোই এই উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। দেবতা স্যাটার্ন ছিল তাদের ভাষ্যনুযায়ী ফসলের দেবতা।

ফসল কাটার মৌসুম শেষে যখন সবার ঘরে ঘরে খাবার ও ফসল মজুদ হয়ে যেত, তখনই এই উৎসব তারা ধুমধাম করে পালন করতো।

সে সময় এই উৎসবটি তারা ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে তারা পালন করতো। কিন্তু প্যাগানদের মধ্যে আরো একটি উৎসব প্রচলিত ছিল।

সেটি হলে, দেবতা মিথ্রাসের জন্মদিন। এটিকে মিথ্রাইজমও বলা হয়। মিথ্রাস ছিল তাদের ভাষ্যনুযায়ী আলোর প্রতীক।

যিশুর জন্মের ২ হাজার বছর আগ থেকেই এই পূজোর প্রচলন ছিল। আর প্যাগানরা এই মিথ্রাস দেবতার জন্মদিন পালন করতো ২৫ ডিসেম্বরে।

তারা এটিকে বলতো, Dies Natalis Solis Invicti. এর মানে হলো, ‘birthday of the Invincible Sun’.

পরবর্তীতে ইউরোপে যখন খৃস্টধর্ম প্রবেশ করা শুরু করে তখন বহু মানুষ প্যাগান ধর্ম ছেলে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করে। সে সময় রাজা কনস্ট্যানটাইন প্যাগান ধর্ম থেকে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেন।

কিন্তু ধর্ম পরিবর্তন করলেও তিনি প্যাগানদের আচার-অনুষ্ঠান ভুলে যান নি। তাই তিনি ক্রিশ্চিয়ানিটি ও প্যাগানিজমের মধ্যে একটি মেলবন্ধন তৈরির চেষ্টা করেন।

যেহেতু যিশু আদৌ কবে জন্মগ্রহণ করেছেন, এটি নিয়ে খৃস্টানদের নিকট কোনো প্রমাণ ছিল না।

তাই উক্ত রাজা দেবতা মিথ্রাসের জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বরকে যিশু খৃস্টের জন্মদিন বলে ফলাও করে প্রচার করতে থাকেন।

তখন থেকে খৃস্টানরা ও প্যাগানরা একইদিনে উৎসব শুরু করে। এরপর আস্তে আস্তে প্যাগানদের আরো কিছু রীতি খৃস্টানদের মধ্যে প্রবেশ করে।

যেমন, ক্রিসমাস ট্রি। যেটিকে সাজ-সজ্জা করে আনন্দ ফূর্তি করা হয়। আসলে প্যাগানরা মনে করতো সবুজ বৃক্ষ হলো প্রাণ তথা জীবনের প্রতীক।

তাই তাদের পূজো ও উৎসবের দিনে ঘরে ও ঘরের আশপাশে এই গাছ সাজিয়ে রাখতো।

এছাড়াও

এরপর আছে সান্তা ক্লজ। যেটিকে বর্তমান খৃস্টানদের এই ক্রিসমাস উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেটি এসছিল জার্মান মিথোলজি থেকে।

সান্তা ক্লজ ক্রিসমাসের আগের রাতে এসে বাচ্চাদের উপহার দিয়ে যায়, সেটি মিথোলজির দেবতা Odin এর কাহিনী থেকে আসা।

এখন কথা হলো, রাজা কনস্ট্যানটাইন যখন খৃস্টানধর্মে প্যাগানদের রীতি আমদানি করলো তখন খৃস্টান পাদ্রিরা প্রতিবাদ করে নি কেন?

এর কারণটি হলো, পাদ্রিরা দেখতে পাচ্ছিল, মানুষ দলে দলে খৃস্টানধর্ম গ্রহণ করছে।

এছাড়াও যেহেতু যিশুর জন্ম আসল তারিখ কোথাও লেখা নাই, তাই তারা চুপ করে ছিল।

তথ্যসুত্র

প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ ২, আরিফ আজাদ, পৃস্ঠা ১৬১-১৭৮

সান্তা ক্লজ কে

সান্তা ক্লজ হলো বর্তমান খৃস্টানদের এই ক্রিসমাস উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেটি এসছিল জার্মান মিথোলজি থেকে। সান্তা ক্লজ ক্রিসমাসের আগের রাতে এসে বাচ্চাদের উপহার দিয়ে যায়, সেটি মিথোলজির দেবতা Odin এর কাহিনী থেকে আসা।

ক্রিসমাস ট্রি কি

ক্রিসমাস ট্রি ছিল প্যাগানদের উৎসবের প্রতীক। আসলে প্যাগানরা মনে করতো সবুজ বৃক্ষ হলো প্রাণ তথা জীবনের প্রতীক। তাই তাদের পূজো ও উৎসবের দিনে ঘরে ও ঘরের আশপাশে এই গাছ সাজিয়ে রাখতো। পরবর্তীতে এটিকে খৃস্টানদের উৎসবে প্রবেশ করে।

Scroll to Top