হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণ – মক্কার কাফেরদের অত্যাচারে একজন নির্যাতিত মুসলিম নারী নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করে দূরদেশে পাড়ি জমাচ্ছিল।

এই দুশ্য ওমর রা. এর অন্তরে ইসলামের আলো ছড়ায়। সেদিন তার বিবেকে প্রচন্ড নাড়া দিয়েছিল। তিনি ভাবতে লাগলেন,

তারা তো শুধু ধর্ম ত্যাগ করেছে। আর কিছু তো নয়। তাই তাদের সাথে এমন কঠোর আচরণ করা নিতান্তই অনুচিত।

তখন থেকে ওমর রা. মুসলমানদের সাথে নম্র আচরণ করতে লাগলেন। হযরত উম্মে আব্দুল্লাহ বিনতে হানতামা রা. হতে বর্ণিত,

আমরা যখন আবিসিনিয়ায় হিজরতের জন্য বের হয়ে গিয়েছিলাম তখন ওমর আমাদের সামনে এসে হাজির হলো। কি নির্দয়ভাবে সে আমাদের উপর অত্যাচার করতো!

ওমর তখন বললো, হে উম্মে আব্দুল্লাহ, তোমরা কি চলে যাচ্ছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। আপনি আমাদের উপর জুলুম করেছেন, নির্যাতন করেছেন।

আল্লাহর কসম! যতক্ষণ না আপনারা এটা বন্ধ না করবেন ততক্ষণ আমরা দেশে ফিরবো না। ‍উমর বললেন, আল্লাহ তোমাদের সহায় হোন।

উম্মে আব্দুল্লাহ তখন এই ঘটনা আমির ইবনে রাবিয়াকে বললেন। আমির বললো, তোমার কি মনে হয়, ওমর ইসলাম গ্রহণ করবে?

উম্মে আব্দুল্লাহ বললেন, হ্যাঁ।

ওমরের ইসলাম গ্রহণের জন্য রাসূল সা. এর দোয়া

মক্কার কাফেররা যখন নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল তখন ইসলামকে শক্তিশালী করার জন্য কিছু শক্তিশালী প্রভাবসম্পূন্ন ব্যক্তি প্রয়োজন ছিল।

তাই রাসূল সা. তখন দোয়া করেছিলেন যে, হে আল্লাহ! আবু জাহল কিংবা ওমর বিন খাত্তাবের মধ্য থেকে যাকে আপনি পছন্দ করেন তার মাধ্যমে ইসলামকে সাহায্য করুন।

এই দুইজনের মধ্য ওমর ছিলেন আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয়।

কুরাইশদের রাসূল সা. কে হত্যা চেষ্টা

একবার কুরাইশরা মুহাম্মাদকে নিয়ে আলোচনায় বসলো। যেহেতু আবু তালিব নবীজিকে ইসলাম প্রচার থেকে বাঁধা দিচ্ছিল না, তাই তারা তাকে হত্যা করার ইচ্ছা করলো।

কুরাইশরা তখন বললো, কে মুহাম্মাদকে হত্যা করতে পারবে? ওমর বললেন, আমি পারবো। তারা শুনে খুশি হয়ে ওমরকে উৎসাহ দিল।

সেদিন দুপুরবেলায় তরবারি নিয়ে রাসূল সা. ও তার সাহাবীদের খোঁজে ওমর বের হলেন। তখন নবীজি নিরাপত্তা দিতে আবু বকর, হামজা ও আলী রা. সর্বদা রাসূলের সাথে থাকতেন।

তারা অন্যদের সাথে আবিসিনিয়া হিজরত করেন নি। ওমর তখন জানতে পারেন যে, তারা সাফা পাহাড়ের পাশে দারুল আরকামে অবস্থান করছেন।

ওমর তখন সেখানে যাওয়ার জন্য হনহনিয়ে চলতে লাগলেন। পথিমধ্যে তার সাথে নুআইম ইবনে আব্দুল্লাহর সাথে দেখা হলো।

সে ওমরকে তরবারি হাতে নিয়ে যেতে দেখে বললো, কোথায় যাচ্ছ ওমর?

ওমর বললেন, আমি মুহাম্মাদকে খুঁজছি। সে কুরাইশদের বিভক্ত করে ফেলেছে। সে আমাদের দেব-দেবীকে তাচ্ছিল্য করে। আমি তাকে হত্যা করবো।

নুআইম বিন আব্দুল্লাহ তখন বললেন, ওমর, তুমি তো ভুল পথে যাচ্ছ? আল্লাহর কসম! তুমি বোকা হয়ে গেছ। নিজেকে বিপদে ফেলছো।

তোমার ভুলের কারণে বনু আদি ধ্বংস হয়ে যাবে। তুমি কি মনে করো যে, মুহাম্মাদকে হত্যা করার পর বনু আবদে মানাফ তোমাকে ছেড়ে দিবে?

ওমর তখন বললো, আমার মনে হয় তুমিও ধর্মত্যাগ করেছ। যদি আমি তোমার ধর্মত্যাগ করার ব্যাপারে জানতে পারি, তাহলে প্রথমে তোমাকে হত্যা করবো।

নুআইম বিন আব্দুল্লাহ রা. বুঝতে পারলেন যে, ওমরকে এভাবে থামানো যাবে না। তাই তিনি বললেন, তোমার বোন এবং তোমার ভগ্নিপতি মুসলমান হয়ে গেছে।

তারা তোমার দেবদেবীর উপসনা ছেড়ে আল্লাহর উপাসনা শুরু করেছে। তুমি তো ভুল পথে আছ।

বোনের বাড়িতে ওমরের হামলা

নুআইম রা. এর নিকট এই কথা শোনার পর উমর তার বোনের বাড়িতে হাজির হলেন। দরজায় করাঘাত করার পর ভেতর থেকে বললো, কে?

ওমর বললেন, আমি খাত্তাবের পুত্র। দরজা খোল।

তার বোন এবং ভগ্নিপতি একটি কাগজে কুরআন পড়ছিলেন। তারা যখন বুঝতে পারেন যে, ওমর এসেছে। তখন তারা উক্ত কাগজটি লুকিয়ে রাখলেন।

ওমর ঘরে প্রবেশের পরেই বললেন, তোমরা কি পড়ছিলে? আমি বাড়িতে প্রবেশের সময় শুনতে পেয়েছি।

তারা তখন বললেন, আমরা তো নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম। উমর তখন উত্তেজিত হয়ে বললেন, সম্ভবত তোমরা ধর্ম পরিবর্তন করেছ।

তখন উমরের ভগ্নিপতি বললেন, হে ওমর! যদি আপনার ধর্ম ব্যতিত অন্য ধর্মে সত্য লুকিয়ে থাকে তাহলে কি হবে?

ওমর তখন তার ভগ্নিপতি সাইদের উপর আক্রমণ করেন। উমর ছিলেন প্রচণ্ড শক্তিশালী। তিনি সাঈদকে ধরাশয়ী করে ফেললেন।

ওমরের বোন স্বামীর বেহাল অবস্থা দেখে স্বামীকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসলেন। কিন্তু ওমর তাকে ঢাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলেন।

আঘাত লেগে ফাতিমা বিন খাত্তাব রা. এর মুখ থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। ফাতিমা তখন রেগে চিৎকার করে বললেন, হে আল্লাহর শত্রু!

আমরা একমাত্র আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি বলে কি তুমি আমাদের উপর অত্যাচার করছো? ওমর বললেন, হ্যাঁ।

তখন ফাতিমা রা. বললেন, তাহলে তোমার যা ইচ্ছা করো। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনা ইলাহ নেই। আর মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল।

ওমর রা. এই কথা শুনে অনুতপ্ত হলেন। তিনি তার ভগ্নিপতিকে ছেড়ে দিলেন। তখন বললেন, তোমরা যেই কাগজ থেকে পড়ছিলে তা আমাকে দেখাও।

ফাতিমা বিন খাত্তাব রা. বললেন, তুমি অপবিত্র হয়ে আছ। যারা পাক-পবিত্র, তারাই সেটা ধরতে পারবে।

ওমরের কুরআন পড়া

ওমর রা. তখন বাহির থেকে হাত-মুখ ধুয়ে আসলেন। এরপর বোনের হাত থেকে কাগজটি নিয়ে পড়তে লাগলেন,

طٰهٰ. مَاۤ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکَ الۡقُرۡاٰنَ لِتَشۡقٰۤی.  اِلَّا تَذۡکِرَۃً لِّمَنۡ یَّخۡشٰی. تَنۡزِیۡلًا مِّمَّنۡ خَلَقَ الۡاَرۡضَ وَ السَّمٰوٰتِ الۡعُلٰی اَلرَّحۡمٰنُ عَلَی الۡعَرۡشِ اسۡتَوٰی. لَهٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَهُمَا وَ مَا تَحۡتَ الثَّرٰی.  وَ اِنۡ تَجۡهَرۡ بِالۡقَوۡلِ فَاِنَّهٗ یَعۡلَمُ السِّرَّ وَ اَخۡفٰی. اَللّٰهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ؕ لَهُ الۡاَسۡمَآءُ الۡحُسۡنٰی 

ত্ব-হা-। তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করিনি। বরং যে আল্লাহকে ভয় করে তার জন্য উপদেশ হিসেবে অবতীর্ণ করেছি। যিনি পৃথিবী ও সুউচ্চ আকাশ সৃষ্টি করেছেন তাঁর নিকট হতে এই কুরআন নাযিল হয়েছে। পরম দয়াময় আল্লাহ আরশে সমাসীন আছেন। যা অবস্থিত আসমানসমূহ ও যমীনের মধ্যবর্তী স্থানে ও ভূগর্ভে আর এই সকল কিছু শুধুমাত্র তা তাঁরই। আর যদি তুমি উচ্চস্বরে কথা বল তবে তিনি গোপন ও অতি গোপন বিষয় জানেন। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত সত্যিকারের কোন ইলাহ নেই। তার জন্য রয়েছে সুন্দর সুন্দর নামসমূহ।

সূরা তহা। আয়াত ১-৯

ওমর রা. এর ইসলাম সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ

হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণ – উপরোক্ত আয়াত তেলওয়াত করার পর ওমর বললেন, এই জিনিষ থেকেই কি কুরাইশরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে? এরপর তিনি আরো তেলওয়াত করলেন,

اِنَّنِیۡۤ اَنَا اللّٰهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنَا فَاعۡبُدۡنِیۡ ۙ وَ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ لِذِکۡرِیۡ. اِنَّ السَّاعَۃَ اٰتِیَۃٌ اَکَادُ اُخۡفِیۡهَا لِتُجۡزٰی کُلُّ نَفۡسٍۭ بِمَا تَسۡعٰی. فَلَا یَصُدَّنَّکَ عَنۡهَا مَنۡ لَّا یُؤۡمِنُ بِهَا وَ اتَّبَعَ هَوٰىهُ فَتَرۡدٰی

‘নিশ্চয় আমি আল্লাহ, আমি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই; সুতরাং আমার ইবাদাত কর এবং আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর’। ‘নিশ্চয় কিয়ামত আসবে; আমি তা গোপন রাখতে চাই যাতে প্রত্যেককে স্বীয় চেষ্টা-সাধনা অনুযায়ী প্রতিদান দেয়া যায়’। অতএব যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান রাখে না এবং স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ করে সে যেন কিছুতেই ঈমান আনয়নে তোমাকে বাধা দিতে না পারে; অন্যথায় তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।

ওমর রা. এই আয়াত পড়ার পর মুহাম্মাদ সা. এর নিকট যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন।

নবীজির নিকট ওমরের আগমন

হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণ – ওমর রা. তখন নবীজির নিকট দারুল আরকামে উপস্থিত হলেন। তার হাতে তখনো তলোয়ার ছিল। ওমর রা. দরজায় করাঘাত করার পর সাহাবারা দরজা খুলতে ইতস্ততবোধ করছিল।

তখন হামজা রা. বললেন, তোমাদের কি হয়েছে? তাকে আসতে দাও। যদি ভালো উদ্দেশ্যে আসে, তাহলে তো ভালোই। অন্যথায় তার তরবারি দিয়ে তাকেই হত্যা করা হবে।

রাসূল সা. তখন ওমরকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, হে খাত্তাবের পুত্র! কোন জিনিষ তোমাকে এখানে টেনে আনলো? আল্লাহর কসম! তোমার উপর গজব পতিত না হওয়া পর্যন্ত মনে হয় তুমি থামবে না।

ওমর রা. তখন বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি আপনার প্রতি ঈমান এনেছি। আর আপনি যা এনেছেন, তার প্রতিও ঈমান এনেছি। রাসূল সা. তখন খুশীতে আল্লাহু  আকবার বলে তাকবীর দিলেন।

সাহাবরাও অত্যন্ত খুশী হলেন। রাসূল সা. এর দোয়া ওমর রা. এর উপর কবুল হলো।

তথ্যসুত্র

জীবন ও কর্ম: ওমর রা.। পৃষ্ঠা ৪৩-৪৬

হাদীস বিডি ডট কম

আর রাহিকুল মাখতুম। পৃষ্ঠা ১১০-১১৪

আরো পড়ুন

শিয়াদের আকিদা কেন অন্যান্য মুসলমানদের মতো নয়, পড়ুন

মদীনায় আবু বকর রা. এর হিজরত

মহানবীর সিরিয়া সফর

আসওয়াদ আনাসির ফেতনা কিভাবে ছড়িয়েছে, পড়ুন

শিক্ষক হত্যা আমাদের কি বার্তা দেয়, পড়ুন

বাহ্যিক লিংক থেকে পড়ুন

১. ঈসা আ. এর মা মারইয়াম আ. কি হারুনের বোন? পড়ুন

২. মক্কা-মদীনায় কি মহামারি হতে পারে? পড়ুন

৩. কিসরার সম্রাটের পর আর কোনো কিসরা নেই , কথাটি দ্বারা নবীজি কি বুঝিয়েছেন?

৪. আল্লাহর কি মানুষের মতো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আছে? পড়ুন

৫. ইসলামের যুদ্ধনীতি ও প্রশ্ন, পড়ুন

ওমর রা. এর বোনের নাম কি

ফাতেমা বিনতে খাত্তাব রা.

ওমর রা. এর ভগ্নিপতির নাম কি

সাঈদ রা.। তিনি ফাতেমা বিনতে খাত্তাবের স্বামী ছিলেন

Scroll to Top