ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রাঃ এর মৃত্যু ছিল শাহাদাতের মৃত্যু। ৬৩ বছর বয়সে যখন হযরত আলী রাঃ উপনীত হলেন তখন ছিলেন আল্লাহর পক্ষ হতে বড় বড় পরীক্ষার মধ্যে ছিলেন।

হযরত উসমান রাঃ এর শাহাদাতের পর ফিতনার যেই বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে, তা তখনো নির্মূল হয় নি। হযরত আলী রাঃ বুঝতে পারছিলেন, অভ্যন্তরীণ শত্রুরা এখনো সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তারা যেকোনো মূহুর্তে হামলা করতে পারে।

এমন এক সংকটময় মূহুর্তে একদিন বনু মুরাদ গোত্রের জনৈক হিতাকাঙ্খী ব্যক্তি হযরত আলীকে বললেন,

আপনি নিজের জন্য পাহারাদার রাখুন। কেননা বনু মুরাদের লোকেরা আপনাকে হত্যার সুযোগ খুঁজছে।

এটি শুনে হযরত আলী রাঃ নির্ভীকভাবে বলেছিলেন, আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের সাথে দুইজন নিরাপত্তাদানকারী ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন। তারাই আমার জন্য যথেষ্ঠ।

আলী রাঃ এর শাহাদাতের তামান্না

জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি দুনিয়া থেকে আরো বেশি বিচ্ছিন্ন হতে লাগলেন। তিনি জুমুআর খুতবাতে বলতেন,

হে আল্লাহ! আমি এই লোকদের প্রতি বিরক্ত, এরাও আমার প্রতি বিরক্ত। আমি এদের আচরণে অতিষ্ঠ, এরাও আমার আচরণে অতিষ্ঠ। আমাকে এদের থেকে মুক্ত করে দিন।

এরপর আলী রা. উপস্থিত লোকদের বললেন, তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ভাগা ব্যক্তিকে কেউ বাধা দিও নাা, যখন সে আমার দাঁড়ি রক্তে রঞ্জিত করবে।

কিছুদিন পর আলী রাঃ এর সভাসদরা ও বিশিষ্ট সাহাবারা সিদ্ধান্ত নিলেন, আলী রাঃ পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করে যাবেন।

কিন্তু হযরত আলী রাঃ বললেন, না। বরং আল্লাহর নবী যেভাবে উম্মাহকে প্রতিনিধি ছাড়া রেখে গেছেন আমিও সেভাবে রেখে যাব।

সাহাবারা তখন বললেন, যদি এতে বিশৃঙ্খলা আরো বৃদ্ধি পায় তখন আপনি আল্লাহর নিকট কি জবাব দিবেন?

আলী রাঃ বললেন, আমি বলবো, হে আল্লাহ! যতদিন আপনি ভালো মনে করেছিলেন ততদিন আপনি আমাকে তাদের মাঝে রেখেছেন। যখন আপনি চেয়েছেন তখন আমাকে উঠিয়ে নিয়েছেন। আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে শুধরে দিতে পারেন আবার ইচ্ছা করলে আমাকে বিপদগামী করতে পারেন।

খারেজিদের আলী রাঃ এর বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র

খারেজিদের বিরুদ্ধে সংগঠিত নাহরাওয়ানের যুদ্ধে আলী রাঃ তাদের সামরিক শক্তি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই খারেজি চিন্তা-চেতনা বহু মানুষ গ্রহণ করে নেয়।

এই খারেজিরা হযরত আলী রাঃ ও হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এবং অন্যান্য বড় বড় সাহাবীদেরকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতো।

তারা ধারণা করতো, এই সাহাবীরাই হচ্ছে উম্মাহর মধ্যে গৃহযুদ্ধের প্রধান কারণ।

তাই খারেজিরা চিন্তা করলো, এদেরকে হত্যার মাধ্যমেই উম্মাহর মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

এই চিন্তা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে খারেজিদের ৩ সদস্য আব্দুর রহমান বিন মুলজিম মুরাদি, বারক বিন আব্দুল্লাহ তামিমি  ও আমর বিন বকর সিদ্ধান্ত নিল,

বর্তমান ইসলামী রাজনীতির তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে একই সময়ে হত্যা করা হবে।

এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য তারা নিজ নিজ তরবারিতে বিষ মিশিয়ে ১৭ রমজান তিন মহান সাহাবীর উপর আক্রমণ করার দিনক্ষণ ধার্য করে।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী –

আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী রাঃ কে শহীদ করার জন্য আব্দুর রহমান বিন মুলজিম [1] কুফা শহরের দিকে রওয়ানা দেয়।

শামের গভর্নর হযরত মুয়াবিয়া রা. কে হত্যার জন্য বারক বিন আব্দুল্লাহ শামের দিকে রওয়ানা দেয়।

মিসরের গভর্নর হযরত আমর ইবনে আস রা. কে হত্যার জন্য আমর বিন বকর মিসরের দিকে রওয়ানা দেয়।

তারা ১৭ রমজানে নিজ নিজ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য তৈরি হয়। কিন্তু ৩ জায়গায় তিন রকম ফলাফল হয়।

শামে হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর উপর আক্রমণ হলেও তিনি বেঁচে যান। সামান্য আহত হন তিনি।

হামলাকারী বারক বিন আব্দুল্লাহকে আঁটক করে হত্যা করা হয়।

মিসরে হযরত আমর বিন আস রা. সেদিন অসুস্থতার কারণে ফজরের নামাজে আসেন নি। তিনি নামাজের ইমামতির জন্য খারিজা বিন হুযাফা রা. কে পাঠিয়েছিলেন।

হামলাকারী আমর বিন বকর না চেনার কারণে উক্ত সাহাবীর উপর আক্রমণ করেন। তিনি সেখানেই শহীদ হন। হামলাকারী আমরকে সেখানেই আঁটক করে হত্যা করা হয়।

হযরত আলী রাঃ এর শাহাদাত

তৎকালীন খেলাফতের রাজধানী ছিলেন কূফা শহর। আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী রাঃ সেহরি শেষ করে ফজরের নামাজের জন্য মসজিদে আসলেন।

সময়টা ছিল জানুয়ারী মাস। কূফায় তখন প্রচণ্ড ঠান্ডা। অভ্যাস অনুযায়ী তিনি মানুষকে ফজরের নামাজের জন্য ডাক দিতে দিতে আসছিলেন।

বারবার বলছিলেন, নামাজ…. নামাজ……।

মসজিদের বারান্দায় যখন প্রবেশ করলেন তখনই আব্দুর রহমান বিন মুজলিম ও তার আরেক সঙ্গী শাবিব বিন বাজরা তরবারি উত্তোলন করে আলী রাঃ এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।

তারা আঘাত করতে করতে বলতে লাগলো, “হুকুম শুধুমাত্র আল্লাহর! এটির আলীর নয় এবং তোমার সাথীদেরও নয়”।

হযরত আলী রাঃ প্রথম আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিলেন।

এই সময়ে অতর্কিতভাবে আব্দুর রহমান বিন মুজলিম আলী রাঃ এর মাথা লক্ষ্য করে তরবারি চালায়।

এই আঘাত আলী রাঃ এর কপালে গেঁথে যায়। হযরত আলী রাঃ রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়েন। চারদিক থেকে লোকজন চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ছুটে এলো।

আব্দুর রহমান ইবনে মুজলিম ও শাবিব সাধারণ জনগণের উপর আক্রমণ করে।

কিন্তু সাধারণ জনতা আব্দুর রহমানকে ধরে ফেলে আর শাবিব পালিয়ে যায়।

এই পাপিষ্ঠকে বন্দী করে আলী রা. এর নিকট আনা হলে হযরত আলী তাকে বলেন,

কিসে তোমাকে এই কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করলো?

সে এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অহঙ্কার করে বললো, আমি হাজার মূল্যের তরবারি ক্রয় করে তাকে হাজার মূল্যের বিষ মিশিয়েছি।

আর চল্লিশদিন ধরে তাতে ধার দিয়েছি। যদি শহরের লোকেরা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসতো তাহলে কেউই বাঁচতে পারতো না।

লোকেরা কিসাস স্বরূপ ইবনে মুজলিমকে হত্যা করতে চাচ্ছিল। কিন্তু আলী রা. বিষয়টি স্থগিত করে বললেন,

তার জন্য সুন্দর পানাহারের ব্যবস্থা করো। তাকে আরামদায়ক বিছানা দাও। সুন্দরভাবে কারাগারে রাখ। যদি আমি সুস্থ হই তাহলে তাকে ক্ষমা করতে পারি অথবা বদলা নিতে পারি। আর যদি আমি মারা যাই তাহলে তরবারির এক আঘাতে তাকে হত্যা করবে। তার লাশ বিকৃত করবে না। তার বিরুদ্ধে আমি আল্লাহর নিকট অভিযোগ দায়ের করবো।

এরপর তিনি যিকির করতে থাকেন। একটা সময় তার আত্মা দেহ ছেড়ে চলে যায়।

৪০ হিজরীর ১৭ রমজানের সূর্য উদিত হওয়ার আগেই হযরত আলী রাঃ সুসংবাদপ্রাপ্ত জান্নাতের বাসিন্দা হলেন।

হযরত আলী রাঃ এর মৃত্যু এর মাধ্যমে উম্মাহ এক নক্ষত্র হারায়।

তার জানাযার নামাজ পড়ান হযরত আলী রাঃ এর বড় ছেলে হযরত হাসান রাঃ। আলী রাঃ এর খেলাফতকাল ছিল ৪ বছর ৯ মাস।

তথ্যসুত্র

মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ১১৪-১২০


[1] আব্দুর রহমান ইবনে মুজলিম ছিল অত্যন্ত ইবাদতগুজার ও কুরআনের হাফেজ। কিন্তু সে পথভ্রষ্ট হয়ে খারেজিদের নেতায় পরিণত হয়েছিল। আর সে ছিল ইয়ামানী গোত্র হিময়ার এর শাখা গোত্র বনু মুরাদের সদস্য।

হযরত আলীর জন্ম কোথায়

পবিত্র মক্কা নগরীতে হযরত আলী রাঃ জন্মগ্রহণ করেন

হযরত আলী রাঃ কতজন স্ত্রী

৭ জন স্ত্রীর কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। তবে তা এত বেশি নির্ভরযোগ্য নয়

হযরত আলী রাঃ এর কবর কোথায়

ইরাকের কূফা নগরীতে হযরত আলী রাঃ এর কবর অবস্থিত

হযরত আলী রাঃ এর উপাধি কী ছিল

আসাদুল্লাহ বা আল্লাহর সিংহ। এই উপাধী পাওয়ার কারণ ছিল, আলী রাঃ এর অবিশ্বাস্য শক্তি আরবরা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি তার তরোয়ালটির প্রবল আঘাতের দ্বারা মাহরবকে হত্যা করেছিলেন

হযরত আলীর পিতার নাম কি

আবু তালেব (নবীজির চাচা)

লেখাটি শেয়ার করতে সর্ট লিংক কপি করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top