নাহরাওয়ানের যুদ্ধ – আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালেব রা. খারেজিদের কিছু শর্তে কুফায় থাকতে দিয়েছিলেন। যেগুলো হলো,
১. অন্যায়ভাবে কারো রক্ত ঝরাবে না।
২. সাধারণ জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করবে না।
৩. কোনো মুসাফিরের পথ আটকাবে না।
পড়ুন: খারেজিদের কুফায় ফিরে আসা
আর যদি খারেজিরা এসব শর্ত মান্য না করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধই হবে এর সমাধান। কিন্তু খারেজিরা তাদের প্রতিপক্ষকে কাফের আখ্যা দিয়ে তাদের সম্পদকে নিজেদের জন্য হালাল ভাবতে লাগলো।
খারেজিদের হাতে আব্দুল্লাহ বিন খাব্বাব রা. কে হত্যা
বসরার নিকটবর্তী একটি গ্রামে হযরত খাব্বাব ইবনুল আরাত রা. এর পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ রহ. বসবাস করতেন।
তিনি ছিলেন একজন আলেম ও মর্যাদাবান ব্যক্তিত্বের অধিকারী। খারেজিরা তাকে আটক করে কর্কশ ভাষায় জানতে চাইলো, কে তুমি?
তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রাসূলের সাহাবী হযরত খাব্বাবের পুত্র আব্দুল্লাহ।
খারেজিদের সরদার বললো, মনে হচ্ছে আমরা আপনার মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছি? তিনি বললেন, হ্যাঁ সত্যিই।
খারেজিরা বললো, ভয়ের কিছু নেই। আমাদেরকে শুধু আল্লাহর রাসূলের কোনো একটি হাদীস শুনিয়ে দিন। আব্দুল্লাহ রহ. বললেন,
আমি আমার পিতার নিকট হতে শুনেছি, রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, এমন একটি ফেতনা আসছে, যাতে বসে থাকা ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির থেকে উত্তম হবে।
আর দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি হেঁটে চলা ব্যক্তির চেয়ে উত্তম হবে। যখন সেই ফেতনায় লিপ্ত লোকদের সম্মুখে পড়বে, তখন আল্লাহর নিহত বান্দা হয়ো, হত্যাকারী হয়া না।
খারেজিরা তখন বললো, আমরা এই হাদীসের ব্যাপারেই জানতে চেয়েছিলাম। আচ্ছা, আপনি আবু বকর ও ওমর রা. সম্পর্কে কি বলেন?
আব্দুল্লাহ ইবনে খাব্বাব রহ. তাদের প্রশংসা করলেন। খারেজিরা তখন বললো, উসমান রা. এর শাসনামলের প্রথম দিকের দিনগুলো কেমন ছিল?
তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে খাব্বাব রহ. বললেন, তিনি শুরুতেও সত্যের উপর ছিলেন এবং শেষেও সত্যের উপর ছিলেন। খারেজিরা তখন বললো, আলীর ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?
আব্দুল্লাহ ইবনে খাব্বাব রহ. বললেন, আলী রা. দ্বীন সম্পর্কে অধিক অবগত। তিনি দ্বীনের ব্যাপারে অধিক সতর্ক ও দ্বীনের বাস্তবায়নকারী।
এ কথা শুনে খারেজিরা ক্ষেপে গেল। তারা বলতে লাগলো, আরে তুমি তো নফসের গোলাম হয়ে গেছ। তুমি বিভিন্ন ব্যক্তির নামকে মাপকাঠি বানিয়ে নিয়েছ।
আল্লাহর কসম! তোমাকে এমনভাবে হত্যা করবো, যেভাবে আজ পর্যন্ত হয়তো কাউকে হত্যা করা হয় নি। এরপর খারেজিরা আব্দুল্লাহ রহ. ও তার স্ত্রীকে নদীর তীর ধরে নিয়ে যেতে থাকে।
খারেজিদের লৌকিকতা ১ – নাহরাওয়ানের যুদ্ধ
যখন খারেজিরা আব্দুল্লাহ বিন খাব্বাব রহ. ও তার স্ত্রীকে নিয়ে যেতে থাকে তখন তাদের সাথে করে এক অমুসলিমের শূকর যাচ্ছিল।
এক খারেজি তরবারি দিয়ে সেটিকে মেরে ফেলে। এই দৃশ্য দেখে তার সাথে থাকা এক খারেজি রেগে গিয়ে বলতে লাগলো,
তুমি অমুসলিম অধিবাসীর শূকর হত্যা করেছ কেন? যখন সেখানে শূকরের মালিক আসলো। তারা তখন তাকে শূকরের মূল্য দিয়ে আপদ বিদায় করলো।
হযরত আব্দুল্লাহ রহ. এই ঘটনা দেখে ভাবলেন, তাদের মধ্যে হয়তো কিছুটা মানবতাবোধ আছে। তাই তিনি তাদেরকে বললেন,
পড়ুন: খারেজিদের সাথে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর বিতর্ক
তোমাদেরকে আমি এই শূকরের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিষের নাম বলবো?
খারেজিরা বললো, তা কি?
তিনি তখন বললেন, আমার জীবন। আমি কখনো নামাজ কাজা করি নি। কখনো কোনো গুনাহ করি নি।
খারেজিদের লৌকিকতা ২
খারেজিরা তা শুনে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলো। একটু সামনে যাওয়ার পর একটি খেজুর গাছ চোখে পড়লো। তারা তখন আব্দুল্লাহ রহ. কে সেটার সাথে বাঁধলো।
তখন সেই গাছ থেকে পড়ে যাওয়া খেজুর একজন খারেজি মুখে নিল। তখন সাথে সাথে অন্য খারেজি ব্যক্তি রেগে গিয়ে বললো,
তুমি জিম্মি ব্যক্তির খেজুর কেন মুখে নিলে? মূল্য না দিয়ে তুমি এটা কি করে হালাল মনে করলে? শেষে বাধ্য হয়ে লোকটি মুখ থেকে খেজুর ফেলে দিল।
আব্দুল্লাহ রহ. এই দৃশ্য দেখে বলতে লাগলেন, যদি তোমরা বাস্তবেই এতটা পরহেজগার হয়ে থাক, তাহলে তোমাদের থেকে আমার কোনো ভয় নেই।
কিন্তু খারেজিরা তাদের ইচ্ছা পরিবর্তন করলো না। তারা আরো অগ্রসর হয়ে হযরত আব্দুল্লাহ বিন খাব্বাব রা. কে নদীর তীরে তরবারি দিয়ে হত্যা করলো।
ফিনকি দিয়ে তার রক্তের ধারা নদীর বুকে ছিটকে পড়লো। কিছুক্ষণ পর সেখানে রক্তের একটি বৃত্তের মতো হয়ে থাকলো।
আব্দুল্লাহ রহ. কে হত্যার পর খারেজিরা তার স্ত্রীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তিনি তখন চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলেন,
“তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আমি তো একজন নারী!” কিন্তু খারেজিদের পাষাণ হৃদয় গলনো না। তারা নির্মমভাবে তার পেট চিঁড়ে হত্যা করলো।
পড়ুন: আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিৎ?
এরপর পাষণ্ড খারেজিরা তাদের লাশ আগুনে পুড়িয়ে ফেললো। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখে এক খারেজি তওবা করে মুসলমানদের এই ঘটনা জানিয়ে দিল।
আলী রা. এর কিসাস দাবী
এত ভয়ংকর কাজ করার পরও হযরত আলী রা. তাদেরকে সমূলে নির্মূল করেন নি। তিনি তাদের নিকট প্রতিনিধি পাঠিয়ে বললেন,
কিসাস নেয়ার জন্য উক্ত হত্যাকারীদের আমার নিকট সোপর্দ করো।
কিন্তু খারেজিরা ঔদ্ধত্য ও ধৃষ্টতা দেখায়। তারা বললো, আমরা সবাই হত্যাকারী। এরপর হযরত আলী রা. তাদের ফেতনায় যাতে আর কেউ ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, সে জন্য ৩৮ হিজরী সনে বাহিনী নিয়ে খারেজিদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

খারেজিদের বিরুদ্ধে নাহরাওয়ানের যুদ্ধ
খারেজিরা তাদের নেতা আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহহাব রাসেবির নেতৃত্বে তাবু থেকে বের হয়ে নদীর উপর দিয়ে নির্মিত ‘দিযাজান’ নামক সেতুর নিকট এলো।
খারেজিরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, আর কোনো আলাপ-আলোচনা হবে না। এবার তরবারী দিয়েই ফায়সালা হবে।
তা সত্ত্বেও আলী রা. বার্তাবাহক পাঠিয়ে তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা তা তো মানলোই না, উল্টো দূতকে হত্যা করে ফেললো।
তখন আলী রা. তার বাহিনীকে খারেজিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার অনুমতি দিলেন।
উভয় দল যখন মুখোমুখি হলো, তখন আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহহাব চিৎকার করে বলতে লাগলো,
বর্শা ছুঁড়ে মারো। তরবারী উঁচু করো।
পড়ুন: কুরআনে কি বৈপরীত্য আয়াত আছে?
এদিকে আলী রা. এর এক অশ্বারোহী বাহিনী বর্শা তাক করে খারেজিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। খারেজিরা অত্যন্ত কঠিনভাবে লড়াই করে।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে যায়। প্রায় সকল খারেজি সেখানে নিহত হয়। হযরত আলী রা. এর বাহিনীর মাত্র ২ জন শহীদ হন।
নিহত খারেজিদের মধ্যে অনেকেই উসমান রা. এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জড়িত ছিল। যেমন, হুরকুস বিন যুহাইর।
ফলে এই যুদ্ধের মাধ্যমে আলী রা. উসমান রা. এর হত্যাকারী ও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীদেরকেও শাস্তি দিতে পেরেছেন।
নাহরাওয়ানের যুদ্ধ এ হাদীসে ভবিষ্যদ্বানী ব্যক্তির অনুসন্ধান
যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর আলী রা. ঘোষণা দিলেন, হে লোকসকল! নবীজি সা. আমাদেরকে এমন একটি দলের সংবাদ দিয়েছিলেন, যারা দ্বীন থেকে সেভাবেই বেরিয়ে যাবে, যেভাবে তীর লক্ষ্যভেদ করে বেরিয়ে যায়।
আর এ দলের একটি নিদর্শন বলেছেন যে, এদের মধ্যে একজন কষ্ণাঙ্গ লোক থাকবে, যার হাতের অগ্রভাগ ওলানের মতো স্ফীত থাকবে।
তোমরা তাকে খুঁজে বের করো। নিশ্চয়ই সে এদের মধ্যে রয়েছে। হযরত আলী রা. আরো বলেন,
এই লোকটা আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসে নিহত হবে, এমনটাই নবীজি বলেছেন।
লোকেরা ওইরকম ব্যক্তির তালাশ করতে লাগলো। কিন্তু কাউকে পাওয়া গেল না। তখন কতিপয় ব্যক্তি বলতে লাগলো,
আলী আমাদেরকে আমাদের ভাইদের ব্যাপারে ধোঁকা দিয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত আমরা তাদেরকে মেরেই ফেললাম।
এ কথা শুনে আলী রা. কাঁদতে লাগলেন। তারপর বললেন, তোমরা আবার খোঁজো। আল্লাহর কসম! আমি মিথ্যা বলি নি। আর আমাকেও মিথ্যা বলা হয় নি।
লোকেরা আবার তালাশ করলো। কিন্তু এমন কাউকে পাওয়া গেল না। অবশেষে আলী রা. নিজে সেই ব্যক্তিকে খোঁজতে বের হলেন।
দেখা গেল, নদীর তীরে একটি গর্তের মধ্যে খেজুর গাছের নিচে লাশের স্তুপ পড়ে আছে।
মহাবিশ্ব কি স্রষ্টা বানিয়েছে নাকি এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে বিস্ফোরণের মাধ্যমে?
আলী রা. সেখানে গিয়ে নিজহাতে লাশ উল্টিয়ে দেখতে লাগলেন।
শেষ পর্যন্ত সেখানেই সেই ব্যক্তির লাশ পাওয়া গেল। তাকে দেখেই আলী রা. চিৎকার করে বলে উঠলেন, আল্লাহু আকবার! আল্লাহ ও তার রাসূল সত্য বলেছেন।
তথ্যসুত্র
খারেজি। ড. আলী সাল্লাবী। পৃষ্ঠা ৩২-৫০
মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খন্ড ৫। পৃষ্ঠা ৭৯-৯৭
নাহরাওয়ানের যুদ্ধ এর ইতিহাসের বিপরীতমুখী ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে
খারেজী কারা ?
খারেজী হলো, যারা আলী রা. এর বিরুদ্ধে “আল্লাহ ব্যতিত কারো হুকুম মানি না” বলে যুদ্ধ করেছে
আব্দুল্লাহ বিন খাব্বাব রা. কে কেন হত্যা করা হয় ?
তিনি ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন বলে খারেজীরা তা সহ্য করতে পারে নি। তাই তাকে ও তার স্ত্রীকে হত্যা করে খারেজীরা