উসমান রাঃ এর শাহাদাত – বিদ্রোহীরা মদীনায় এসে শহর অবরোধ করে। তারা মসজিদে নববীতে উসমান রা. কে নামাজ পড়াতে এবং খুৎবা দিতে বাঁধা দিতে লাগলো।

জুমার দিন হযরত উসমান রা. মসজিদে নববীতে খুৎবা দিতে উঠলেন। তখন বিদ্রোহীরা হাঙ্গামা শুরু করলো। তারা উসমান রা. এর দিকে পাথর মারতে লাগলো।

পাথরের আঘাতে তিনি অচেতন হয়ে পড়লেন। লোকেরা তাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেলেন। হযরত আলী, তালহা, যুবায়ের রা. উনার সেবা করার জন্য এগিয়ে গেলেন।

বিদ্রোহীরা উসমান রা. কে খেলাফত থেকে ইস্তফা দিতে চাপ প্রয়োগ করলে লাগলো। কিন্তু উসমান রা. তখন তাদেরকে বললেন,

আল্লাহ আমাকে যেই পোশাক পরিয়েছেন, তা আমি খুলে ফেলবো না।

এ ছাড়াও এটি উসমান রা. এর প্রতি রাসূল সা. এর অসিয়ত ছিল। তিনি একবার উসমান রা. কে একান্তে ডেকে বলেছিলেন,

যদি আল্লাহ তোমাকে এই পদ দান করেন আর মুনাফিকরা তা খুলে ফেলতে চায় তাহলে তুমি তা খুলে ফেলবে না।

বিদ্রোহীরা তখন খলিফাকে অবরোধ করে রাখলো। মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো এই মর্মান্তিক খবর। লোকেরা বিভিন্ন দেশ থেকে আসার প্রস্তুতি নিতে লাগলো।

কিন্তু তখনি বিদ্রোহীরা একটা ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে দিল যে, সন্ধি হয়ে গেছে। বিদ্রোহীরা সরে পড়েছে। অথচ এটি ছিল ভুল সংবাদ।

ইতিমধ্যেই গ্রীস্মের উত্তাপ বেড়ে গেল। সাথে সাথে বিদ্রোহীরাও অবরোধকে আরো কঠোর করে তুললো।

তারা উসমান রা. এর ঘরে খাবাপ পৌঁছার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো।

আলি রা. এই ঘটনা জানতে পেরে ক্ষোভের সাথে বললেন, তোমাদের আচরণ মুসলমানদের মতো নাকি কাফেরদের মতো?

এই মানুষটি তোমাদের কি ক্ষতি করেছে যে, তোমরা তাকে অবরোধ করে হত্যা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ?

ঘনিয়ে এলো হজের সময়

 এই অবরোধ থাকতে থাকতেই হজের সময় ঘনিয়ে এলো। খলিফা হযরত উসমান রা. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে আদেশ করলেন,

তুমি হাজীদের কাফেলা নিয়ে মক্কায় রওয়ানা হও। হযরত ‍ইবনে আব্বাস রা. বললেন, হে আমিরুল মুমিনীন! আল্লাহর কসম,

আমার নিকট এসব দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হজের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু উসমান রা. তাকে বুঝিয়ে হজে পাঠিয়ে দিলেন। উক্ত হজ কাফেলার সাথে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. হজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

কারণ, আয়েশা রা. চিন্তিত ছিলেন, বিদ্রোহীরা উসমান রা. এর পর উম্মুল মুমিনীনদের উপর হামলা করতে পারে।

কারণ, ইতিমধ্যেই তারা উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে হাবিবা রা. ও হযরত সাফিয়া রা. কে তারা জনসম্মুখে অপমান করেছিল।

এই সময়ে অনেক সাহাবী মদীনা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। মিসর বিজেতা হযরত আমর ইবনে আস রা. দুঃখে তার দুই পুত্রকে নিয়ে মদীনা ত্যাগ করে ফিলিস্তিন চলে যান।

হযরত হাসসান বিন সাবেত রা. ও মদীনা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তালহা রা. ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

হযরত ‍যুবায়ের রা. ও মদীনার বাহিরে চলে গিয়েছিলেন। কারণ, বিদ্রোহীরা এই প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছিল যে, যুবায়ের রা. হলো আমাদের নেতা। নাউযুবিল্লাহ!

আমিরুল মুমিনীনের উপদেশমূলক ভাষণ

বিদ্রোহীদের এই অবরোধকালে একদিন হযরত উসমান রা. তার বাড়ির প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন,

আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, তোমরা কি জান না যে, আমি নিজে বীরে রুমা নামক কূপটি ক্রয় করে মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছি?

উপস্থিত লোকেরা বললো, জি হ্যাঁ।

এরপর উসমান রা. বললেন, তাহলে এরপরও কেন তোমরা আমার জন্য এই কূপের পানি বন্ধ করে দিলে? তারপর তিনি বললেন,

তোমরা কি জান না যে, আমি মসজিদে নববীর জন্য আরো জমি ক্রয় করে মসজিদকে সম্প্রসারণ করেছি। তাহলে কেন তোমরা আমাকে মসজিদে যেতে বাধা দিচ্ছ?

আমিরুল মুমিনীনের কথাগুলো এতটাই মর্মস্পর্শী ছিল যে, বিদ্রোহীদের মধ্যেও কেউ কেউ বলে উঠলো, আমিরুল মুমিনীদের বিরুদ্ধাচরণ করা ঠিক হচ্ছে না।

হজের পরবর্তী সময়

হজের পর মদীনায় সংবাদ আসলো, হাজী সাহেবরা ফিরে আসছেন। এরইমধ্যে সংবাদ আসলো, কূফা ও বসরা থেকে সেনাবাহিনী আসছে।

এদিকে বিদ্রোহীরা উসমান রা. এর থেকে ইস্তফা গ্রহণে অক্ষম হয়ে পড়লো। তারা সিদ্ধান্ত নিল, হযরত উসমান রা. এর উপর অতর্কিত হামলা করে তাকে শহীদ করা হবে।

কিন্তু আশতার নাখায়ীর মতো প্রথম সারির বিদ্রোহীও এই ভয়ানক কাজের সাথে একমত ছিল না।

সে উম্মুল মুমিনীন উম্মে হাবিবা রা. কে পাঠিয়ে উসমান রা. কে অন্যত্র সরিয়ে নিতে চাইলো।

কিন্তু অন্যান্য বিদ্রোহী নেতারা আশতার নাখায়ীর এই চেষ্টা ব্যর্থ করে দিল। এরপর আসলো সেই মর্মান্তিক দিন।

দিনটি ছিল জিলহজ মাসের ১৮ তারিখ। হযরত উসমান রা. এদিন রোজা রেখেছিলেন। সেদিন তিনি ২০ জন গোলামকে আজাদ করেছিলেন।

এরপর তিনি কুরআন তেলওয়াতে মগ্ন হয়ে পড়েন। এদিকে উসমান রা. এর সুরক্ষার জন্য অনেক সাহাবী এবং তাবেয়ী তার ঘরের নিকট একত্রিত হন।

এর মধ্যে হযরত আবু হুরায়রা, হাসান, হোসাইন, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, সাঈদ ইবনে আস, মুহাম্মাদ বনি তালহা অন্যতম।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বর্ম পরিধান করে সেখানে অবস্থান করছিলেন। বিদ্রোহীরা উসমান রা. কে হত্যার সিদ্ধান্ত নিল।

তারা ঘরের দরজায় আক্রমণ করলো। তখন উপরোক্ত সাহাবীরা পূর্ণ শক্তিতে তা প্রতিহত করলেন। দেখতে দেখতে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়।

হযরত তালহা রা. আমিরুল মুমিনীনকে রক্ষা করতে ঢাল বর্ম নিয়ে এলেন। তিনি তীর নিক্ষেপ করতে লাগলেন শত্রুদের প্রতি।

উসমান রা. তখন নিরাপত্তায় নিয়োজিত সকলকে বললেন, আপনারা বাড়ি চলে যান। এই প্রহরা উঠিয়ে নিন।

তিনি সকলকে এটা বুঝাতে চাইলেন যে, খেলাফত কোনো বাদশাহী নয়। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্ব। তাই নিজ স্বার্থের জন্য রক্তপাত করা উচিৎ নয়।

হযরত উসমান রা. এর আদেশ পালন করে সবাই চলে গেলেন। তবে হযরত হাসান রা. রয়ে গেলেন। তিনি উঠলেন না।

উসমান রা. তখন কুরআন তেলওয়াত করছিলেন। একটুপর তিনি বললেন, আল্লাহর কসম করে বলছি, তুমি চলে যাও।

তারপর তিনি দুইজনকে ডেকে এনে বাইতুল মালের সংরক্ষণের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন।

উসমান রাঃ এর মৃত্যু

বিদ্রোহীরা যখন দেখলো কোনো প্রহরা নেই তখন তারা একজনকে পাঠালো ভেতরের অবস্থা দেখতে।

এরপর সে এসে বললো, ভেতরে পুরো খালি। তখন একজনকে পাঠানো হলো উসমান রা. কে হত্যা করতে।

কিন্তু সে উসমান রা. কে দেখে হত্যার সাহস করলো না।

শুধু বললো, আপনি খেলাফত ছেড়ে দিন। উসমান রা. বললেন, আল্লাহ আমাকে যেই পোশাক পরিয়েছেন তা আমি খুলতে পারি না।

তখন উক্ত ব্যক্তি বাহিরে এসে বললো, এই ব্যক্তিকে হত্যা করা আমাদের জন্য হালাল নয়। এরপর অন্য একজন গেল।

তাকে উসমান রা. বললেন, তোমার মাঝে এবং আমার মাঝে আল্লাহর কালাম বিদ্যমান। সেও তখন বিচলিত হয়ে চলে গেল।

এভাবে বিদ্রোহীরা এক এক করে লোক পাঠাতে লাগলো। কিন্তু প্রত্যেকেই অনুতপ্ত হয়ে ফিরে গেল।

হযরত আবু বকর রা. এর পুত্রও ভুলের শিকার হয়ে বিদ্রোহীদের সাথে ছিল।

এবার তাকে পাঠানো হলো। উসমান রা. তাকে দেখে বললেন, তোমার এই রাগ-ক্ষোভ আল্লাহর দানের বিপরীত তো নয়?

তারপর তাকে বললেন, তুমি আমার হত্যাকারী হতে পার না। তোমার পিতা যদি যদি এটা দেখতেন তাহলে কখনোই এটি পছন্দ করতেন না।

এ কথা শুনে মুহাম্মাদ বিন আবু বকর ও লজ্জা ও অনুতাপে ফিরে গেল। এরপর বিদ্রোহী নেতারা উসমান রা. এর ঘরে প্রবেশ করে।

আমিরুল মুমিনীন আগের মতোই কুরআন তেলওয়াত করছিলেন।

এ সময় বিদ্রোহীদের মধ্য থেকে রোমান নামক একজন লোহার লাঠি দিয়ে উসমান রা. কে আঘাত করলো।

এরপর আব্দুর রহমান বিন গাফেকি নামে আরেকজনও লোহার অস্ত্র দিয়ে আঘাত করলো।

হযরত উসমান রাঃ এর হত্যাকারীর নাম কি

এরপর “কৃষ্ণযম” নামে এক ব্যক্তি অগ্রসর হয়ে পূর্ণ শক্তিতে উসমান রা. এর গলা চেপে ধরে। উসমান রা. ছটফট করতে থাকেন।

তারপর সে খাপ থেকে তরবারি বের করে উসমান রা. এর উপর আঘাত হানে। সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে রক্তের ধারা ছিটকে কুরআনের উপর পড়ে।

এরপর আরেক হতভাগা বর্শা দিয়ে উসমান রা. এর উপর আঘাত হানে।

তখন উসমান রা. উচ্চারণ করেন, আল্লাহর নামে চললাম এবং আল্লাহর উপরই ভরসা করলাম।

এদিকে শোরগোলের আওয়াজ ঘরের নারীদের অংশে পৌছে যায়। তখন উসমান রা. এর স্ত্রী নায়লা এবং তার কন্যারা তাকে বাঁচাতে চিৎকার করে ছুটে আসেন।

এ সময় সুদান বিন হুমরান নামক জনৈক অভিশপ্ত নায়লার উপর আক্রমণ করে। এতে তার হাতের কয়েকটি আঙ্গুল কেটে যায়।

এর মধ্যে মিসরের এক বিদ্রোহী উসমান রা. এর বুকে তরবারি রেখে দেহের পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করে। সঙ্গে সঙ্গে তার দেহ এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়।

ইসলামের এই মহান খলিফা এবং নবীজির জামাতা হযরত উসমান রা. ৩৫ হিজরীর ১৮ জিলহজ সুর্যাস্তের আগে শহীদ হন।

কতক বিদ্রোহীকে হত্যা

উসমান রা. সেদিন কয়েকজন গোলামকে এই শর্তে মুক্ত করে দিয়েছিলেন যে, তারা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে না।

তারা হাঙ্গামার খবর শুনে যখন ঘটনাস্থলে আসে তখন তারা জানতে পারে হযরত উসমান রা. কে শহীদ করা হয়েছে।

তারপর তারা বিদ্রোহীদের উপর আক্রমণ করে। তাদের একজন পাপিষ্ঠ সুদান বিন হুমরানের মাথা দেহ থেকে আলাদা করে দেয়।

অরপর একজন কুতাইরা নামক আরেকজন বিদ্রোহীকে জাহান্নামে পাঠায়। এখানে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে দুইজন গোলাম শহীদ হন।

এরমধ্যেই হযরত হাসান রা. ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা. এবং মারওয়ান বিন হাকাম রহ. হাঙ্গামার শব্দ শুনে ফিরে আসেন।

তারা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। তারা তিনজনই ভীষণ আহত হন। মদীনার লোকজন পরে তাদেরকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে।

বিদ্রোহীরা শেষে উসমান রা. এর ঘরে লুটপাট করে। ঘরের সমস্ত কিছু লুটপাটের পর তারা বাইতুল মালের দিকে অগ্রসর হয়।

সেখানেও তারা লুটপাট করে। এর ফলে বুঝা যায়, তারা ছিল দুনিয়া পুজারি এবং দাঙ্গাবাজ।

জানাযা ও দাফন

উসমান রা. এর শাহাদাতের পর এই সংবাদ মূহুর্তের মধ্যেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

সেই রাতে হযরত আলী, হযরত তালহা, হযরত হাসান, হযরত যায়েদ বিন সাবেত রা. সহ অন্যান্য সাহাবীরা উসমান রা. এর ঘটে ছুটে আসেন।

জানাযায় অংশগ্রহণের জন্য মদীনায় নারী শিশুরা পর্যন্ত উপস্থিত হয়। উসমান রা. এর খাটিয়া তার ঘরের মধ্যেই রাখা হলো।

মানুষ দলে দলে গিয়ে তা যিয়ারত করে আসছিল। শহীদ হওয়ায় উসমান রা. কে গোসল দেওয়া হয় নি। রক্তাক্ত জামাকেই কাফন হিসেবে রাখা হলো।

এরপর মারওয়ান বিন হাকাম রহ. জানাযার নামাজ পড়ালেন। তারপর হযরত উসমান রা. এর খাটিয়াকে জান্নাতুল বাকিতে নিয়ে যাওয়া হলো।

জান্নাতুল বাকিতেই ইসলামের এই ‍উদীয়মান সূর্য এবং জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী হযরত উসমান রা. চিরতরে হারিয়ে যান।

তথ্যসুত্র

মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ২১৫-২২৬

কৃষ্ণজম নামক লোকটি কে, এটি এত শত বছর পর নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও, আমরা ধারণা করতে পারি। নিশ্চয় এটি ছদ্মনাম ছিল।

উক্ত লোকটি মিসর থেকে এসেছিল। তার দুইটি উপাধী ছিল, ১. কৃষ্ণজম ২. জাবালা (অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গ)। সে ছিল বনু সাদুসের লোক।

একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়, এই ছিল পাপিষ্ঠ আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা। কারণ, সে ছিল কালোবর্ণের। আর সে পূর্বে মিসরে ছিল।

আর জাবালা নামটাও ইয়ামেনের ইহুদিরা রাখতো। আব্দুল্লাহ ইবনে সাবার মূল ভূমি ছিল ইয়ামেন।

Scroll to Top