ইসলাম গ্রহণের পরই নবীজির সাথে হযরত উসমান রা. এর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে। হযরত উসমান রা. ছিলেন কুরআশের অন্যতম সম্রান্ত যুবক।

নবীজি সা. তার সাথে নবীকন্যা রুকাইয়া রা. কে বিবাহ দেন। এরপর থেকে নবীজির সব কাজেই হযরত উসমান রা. থাকতেন একদম শীর্ষে।

উসমান রা. কুরআনী নীতির আলোকে শিক্ষালাভ করতে থাকেন। নবীজি ছিলেন তার দীক্ষাগুরু। কাফেরদের শত বাধা টলাতে পারে নি তাকে।

মদীনায় হিজরতের পর রাসূল সা. ইসলামী রাষ্ট্রের গোঁড়া সুদৃঢ় করার প্রতি মনোযোগ দেন।

তিনি প্রথমেই আনসার ও মুহাজির সাহাবীদেরকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দেন।

হযরত উসমান রা. ভাই হিসেবে পান হযরত আউস ইবনে সাবিত রা. কে। উসমান ছিলেন অত্যন্ত সম্পদশালী।

তিনি কখনো ইসলামের জন্য সম্পদ ব্যয় করতে কার্পণ্য করেন নি।

বদরযুদ্ধে উসমান রা.

২য় হিজরীতে মুসলমানরা যখন বদরের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন তখন উসমান রা. ও তাদের সাথে প্রস্তুত হলেন।

উসমান রা. এর স্ত্রী হযরত রুকাইয়া রা. ছিলেন তখন গুটিবসন্তে রোগে আক্রান্ত।

এ অবস্থায় নবীজি সা. উসমান রা. কে তার স্ত্রীর নিকট থাকতে আদেশ দেন।

এরপর রাসূল সা. মুজাহিদদের নিয়ে রওয়ানা হন। উসমান রা. মদীনায় স্ত্রীর নিকট রয়ে যান।

রুকাইয়া রা. এর অসুখ ক্রমে ক্রমেই বাড়তে থাকে।

একটা সময়ে রুকাইয়া রা. এর শেষ সময় চলে আসে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার বোন জায়নাব রা. কে দেখতে আকুল হয়ে উঠেন।

কিন্তু তিনি তখন মক্কায় ছিলেন। তাই উসমান রা. তার আবদার পূর্ণ করতে পারেন নি। এরপর কালিমায়ে তাইয়্যেবা পড়ে রুকাইয়া রা. নশ্বর পৃথিবীকে বিদায় জানান।

হযরত উসমান রা. এর জন্ম-পড়ুন

নবীজির মেয়ে রুকাইয়া রা. এর মৃত্যুর সময়ে নবীজি মদীনার বাহিরে জিহাদরত ছিলেন।

উসমান রা. ভ্রারক্রান্ত হৃদয়ে স্ত্রীকে জান্নাতুল বাকীতে দাফন করেন।

উপস্থিত সকলের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। যখন লোকজন রুকাইয়া রা. কে দাফন করে বাড়ির পথ ধরে তখন জায়েদ ইবনে হারিসা রা. বদরের বিজয়ের সংবাদ নিয়ে মদীনায় উপস্থিত হন।

বিজয়ের সংবাদ শুনে সকলের দুঃখ যেন চলে গেল। নবীজি মেয়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তার কবর জিয়ারত করলেন।

মুনাফিকরা বলতে থাকে, উসমান বদরে অংশ নেয় নি। নবীজি তাদের যুক্তি খন্ডনের জন্য তাকেও মুজাহিদদের মতো গণিমতের অংশ দেন।

এ জন্য উম্মাহর সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হলো, উসমান রা. বদরি সাহাবীদের একজন ছিলেন। কারণ তিনি নবীজি আদেশেই মদীনায় ছিলেন।

উহুদযুদ্ধে উসমান রা.

উহুদযুদ্ধের শুরুতে মুসলমানরা বিজয়ী হয়। কিন্তু একটি ভুলের কারণে তারা পরাজিত হওয়ার ধারপ্রান্তে চলে যায়।

যখন কাফেররা হঠাৎ পাহাড়ের পেছন থেকে তীব্র আক্রমণ করে তখন অনেকেই দিশেহারা হয়ে মদীনা অভিমুখে পালিয়ে যান।

হযরত উসমান রা. ছিলেন তাদের একজন। তারা যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফিরে আসে নি।

আরেকদল নবীজির মিথ্যা শাহাদাতের সংবাদ শুনে অস্থির হয়ে যান।

আরেকদল ময়দানে দৃঢ়পদ থাকেন। কুরআনে আল্লাহ এই তিনদলের কথা উল্লেখ করে সকলকে ক্ষমার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

اِنَّ الَّذِیۡنَ تَوَلَّوۡا مِنۡکُمۡ یَوۡمَ الۡتَقَی الۡجَمۡعٰنِ ۙ اِنَّمَا اسۡتَزَلَّهُمُ الشَّیۡطٰنُ بِبَعۡضِ مَا کَسَبُوۡا ۚ وَ لَقَدۡ عَفَا اللّٰهُ عَنۡهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ حَلِیۡمٌ

নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্য থেকে যারা পিছু হটে গিয়েছিল সেদিন, যেদিন দু’দল মুখোমুখি হয়েছিল, শয়তানই তাদের কিছু কৃতকর্মের ফলে তাদেরকে পদস্খলিত করেছিল। আর অবশ্যই আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করেছেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, সহনশীল।

(সূরা আলে ইমরান ১৫৫ নং আয়াত)

গাফতান যুদ্ধে উসমান রা.

নবীজি সা. মুসলমানদেরকে গাফতানিদের উপর চড়াও হওয়ার নির্দেশ দিলে ৪০০ জন মুজাহিদ সাহাবী বের হন। তার সাথে ছিল কয়েকটি ঘোড়া।

উসমান রা. কে তখন নবীজি মদীনায় স্থলাভিষিক্ত হিসেবে রেখে যান। নবীজি যখন গাফতানিদের নিকট গেলেন তখন তারা বিনা যুদ্ধেই আত্মসমর্পন করে।

নবীজি এ সময়ে প্রায় ১১ দিন মদীনার বাহিরে অবস্থান করেন।

বাইয়াতে রেদওয়ানে উসমান রা.

হুদাইবিয়ার সময়ে যখন নবীজি মক্কার নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছলেন তখন উসমান রা. কে দূত হিসেবে মক্কায় প্রেরণ করেন।

উসমান রা. বের হওয়ার পর বালদা নামক স্থানে কুরাইশদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। তারা জিজ্ঞাসা করে, কোথায় যাচ্ছ তুমি?

উসমান রা. বলেন, আমাকে নবীজি প্রতিনিধি বানিয়ে তোমাদের নিকট পাঠিয়েছেন।

তিনি তোমাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান জানাচ্ছেন, নিশ্চয় তার দ্বীন আল্লাহ বিজয়ী করবেন।

উসমান রা. এর হাবশায় হিজরতের সময়কাল পড়ুন

কাফেররা উসমান রা. এর কথাগুলো হজম করতে পারছিল না। তাই তারা বললো, আপনার কথাগুলো শোনার জন্য আমরা প্রস্তুত নই।

কিন্তু মুহাম্মাদ জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করতে পারবেন না। আপনি ফিরে গিয়ে তাকে বলুন, তিনি চাইলেও এখানে আসতে পারবেন না।

এদিকে আবান ইবনে সায়্যিদ নামে জনৈক ব্যক্তি উসমান রা. কে স্বাগত জানিয়ে মক্কায় নিয়ে যায়।

এরপর মক্কার প্রত্যেক নেতার সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করা হয়।

তারা সকলেই উসমান রা. এর কথায় এড়িয়ে যায়। তারা বলে, মুহাম্মাদ কখনো মক্কায় প্রবেশ করতে পারবেন না। আর আপনি যেহেতু এসেছেন, তাই আপনি তাওয়াফ করে যান।

কিন্তু উসমান রা. তাদের প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়ে বলেন, আমি কখনো মুহাম্মাদ সা. কে ছাড়া কাবা তাওয়াফ করবো না।

উসমান রা. যখন মক্কায় তার কর্মতৎপরতা চালাচ্ছিলেন তখন মুসলমানদের নিকট ‍গুজব ছড়িয়ে পড়লো, উসমান রা. কে হত্যা করা হয়েছে।

তাই অবস্থার প্রেক্ষিতে নবীজি কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শপথ গ্রহণ করেন। সাহাবীগণ নবীজির ডাকে সাড়া দেন।

সর্বপ্রথম আবু সিনান আব্দুল্লাহ রা. নবীজির হাতে বায়আত গ্রহণ করেন।  সালামা ইবনে আকওয়া তিনবার নবীজির হাতে বায়আত গ্রহণ করেন।

বাইয়াত শেষে নবীজি তার ডান হাত সম্পর্কে বলেন, এটি উসমানের হাত। এরপর ওই হাতটি তার অন্য হাতে রেখে উসমানের বায়আত গ্রহণ করেন।

এই সাহাবীদেরকেই বাইয়াতের রেদওয়ানের সাহাবী বলা হয়। তার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪০০  জন।

নবীজির সাথে উসমান রা.

তাবুকযুদ্ধে উসমান রা.

নবম হিজরীতে রোমসম্রাট হিরাক্লিয়াস আরব অঞ্চল জবরদখলের পায়তারা করে। সে তার বাহিনীকে নিয়ে যুদ্ধের জন্য আরব অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

নবীজি এই সংবাদ জানার পর তিনি সাহাবীদেরকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বলেন। সময়টা ছিল প্রচন্ড গরমের।

তা ছাড়া তখন সবেমাত্র ফল পেকেছে।

এই মুহুর্তে সবকিছু ফেলে যুদ্ধে যাওয়াটা ছিল বিরাট কষ্টের। তা ছাড়া দুর্ভিক্ষের কারণে অর্থকড়িও ছিল কম।

তাই নবীজি সাহাবীদেরকে যুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহের আহবান জানান।

সাহাবীরা সামর্থ্য অনুযায়ী সম্পদ নিয়ে আসতে থাকে। নারীরা অলঙ্কার বিক্রি করে যুদ্ধের জন্য অর্থকড়ি পাঠায়। কিন্তু তারপরও তা যুদ্ধের জন্য যথেষ্ঠ ছিল না।

তাই নবীজি তখন বলেন, কেউ কি আছ, যে যুদ্ধের প্রয়োজনীয় জিনিষ সংগ্রহ করে দিবে? আর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন।

উসমান রা. আল্লাহর এই সন্তুষ্টির কথা শুনে এগিয়ে আসেন। তিনি তাবুক যুদ্ধের জন্য ৯৪০ টি উট এবং ৬০ টি ঘোড়া দান করেন।

এভাবে উট ও ঘোড়া মিলিয়ে তিনি হাজার সংখ্যক বাহনের ব্যবস্থা করে দেন। এ ছাড়া নবীজি দরবারে ১০ হাজার দিনার (প্রায় 36,893,475৳ টাকা সমপরিমাণ মূল্য) উপস্থিত করেন।

নাস্তিকদের প্রশ্নের জবাব: আল্লাহ কি কখনো মিথ্যা বলেন?

রাসূল সা. উসমান রা. এর দান করা সম্পদ দেখছিলেন আর বলছিলেন, আজকের পর থেকে উসমান যাই করুক, কিছুতেই তার ক্ষতি হবে না।

রাসূল সা. সাহাবীদেরকে নিয়ে দামেষ্ক ও মদীনার নিকটবর্তী অঞ্চল তাবুক নামক স্থানে পৌছেন।

এখানে এসে নবীজি জানতে পারেন, হিরাক্লিয়াস ভয়ে পিছু হটেছে।

মুসলিম বাহিনী উসমান রা. এর দেয়া যাবতীয় যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন।

নবীজির সাথে উসমান রা. এর সম্পর্ক ছিল খুব নিবীড়। উসমান রা. যে কোনো প্রয়োজনে সর্বদা রাসূলের পাশে দাঁড়াতেন।

তথ্যসুত্র

উসমান বিন আফফান রা.। পৃষ্ঠা ৫৩-৬৭

নাস্তিকদের প্রশ্নের জবাব: মহাবশ্বের জন্ম তো এমনে এমনিতেই হয়েছে। এর প্রমাণ কোথায়?

Scroll to Top