স্বাধীনতার কথা – আমি গত শুক্রবারেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বসে আড্ডাবাজি করেছি। কিন্তু আজ থমথমে পরিবেশ। পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। একেবারে হঠাৎ করেই ঘটেছে সব।
৭ ই মার্চে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দিলেন, আমাদের মধ্যে তখন শিহরণ বয়ে গিয়েছিল।
আমরা চারজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষণ শুনতে গিয়েছিলাম। ও আমার বন্ধুদের সাথে তো আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেই নি। আমি সাকিব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়ি।
আমার বন্ধু শাহাদাত পড়ে আইন বিভাগে। মিকদাম পড়ে ইংলিশ মিডিয়ামে আর আবির পড়ে অনার্সে। একসাথেই আমরা চলাফেরা করি। ৭ ই মার্চের রবিরারের কথা আমার এখনো মনে আছে।
আমরা ফজরের পর পর গিয়েছিলাম মাঠে। তারপরও সামনে জায়গা পাই নি। সেদিন সকালে নাস্তাও করি নি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেদিন ক্ষুধাও লাগে নি।
আমরা চারজন সকাল নয়টা পর্যন্ত একসাথেই ছিলাম। কিন্তু মিকদাম হঠাৎ করেই দলচ্যুত হয়ে গেল। গেল তো গেল। একেবারে লাপাত্তা।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে আমরা যখন ফিরে আসি, তখন দেখতে পাই মিকদাম শহীদ মিনারের সামনে বসে আছে। পাশে গিয়ে বসলাম আমি।
আমাদের দেখেই বললো, আজকের দিনটা আমার মাটি মাটি হয়ে গেছে। কেন মাটি মাটি হলো, বুঝলাম না। জিজ্ঞাসাও করছি না।
কারণ, তাকে খুবই বিমর্ষ দেখাচ্ছে। শান্তনার সূরেই বলি, আচ্ছা। যা হওয়ার হয়ে গেছে।
এখানে বসে থেকে লাভ নেই। চল হলে ফিরে যাই। মিকদাম রাজি হলো। আমরা একত্রেই হলে আসলাম।
আজকে যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্ডেনে বসি আছি তখন আমার চোখের সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখছি না। আমার বন্ধুরাও কেউ পাশে নেই। – স্বাধীনতার কথা ।
কেউ কেউ চলে গেছে না ফেরার দেশে। কেউ বা লাপাত্তা। আমার নিজের প্রতি প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে, কেনই বা আমি বেঁচে আছি! আমিও মরে যেতাম।
হয়তো আজকের এই দুঃখের দিনটি তাহলে আমার আর দেখা লাগতো না। শুরু থেকেই বলি।
২৪ তারিখ বুধবারেই আমরা শুনেছিলাম, পূর্ব পাকিস্তান থেকে অনেক সেনা পশ্চিম পাকিস্তানে এসেছে। তারা একটা মরণঘাতী হামলা করবে। আমি এই কথাটা তেমন আমলে নেই নি।
সেনারা কেন হামলা করবে? দেশের সেনারা কি কখনো দেশের জনগনের উপর অস্ত্র ধরে? আমার মনে হয়েছিল, হয়তো সরকার হরতাল বা নিষেধাজ্ঞা জারি করবে।
২৫ শে মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে আবিরের সাথে বসে গল্প করছি। হঠাৎ করেই দূরে কোথাও গুলির শব্দ শুনতে পাই।
আমরা ভাবলাম, হয়তো কেউ মিছিল করছে বিধায় পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুঁড়ছে। এটা ভেবেই আগের মতোই গল্প করছিলাম। হঠাৎ করে শাহেদ ভাই দৌঁড়িয়ে আসলো।
শাহেদ ভাই ঢাবিতে বাংলা সাহিত্য বিভাগে পড়েন। মিছিল-মিটিংয়ে তিনি থাকেন সর্বাগ্রে।
শাহেদ ভাই দরজাটা ঠাস করে ঢাক্কা দিয়ে ভেতরে ডুকেই বললো, জলদি পালিয়ে যা। নইলে মারা পড়বি। কিছুই বুঝলাম না আমরা।
আমরা পরস্পরের মুখে চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। সাকিব বললো, চল তো বাহিরে গিয়ে দেখি, কি হচ্ছে?
আমরা বের হলাম। তেমন আতঙ্কিত হচ্ছি না আমরা। কারণ, এখনো মূল ঘটনা আমরা জানতাম না।
কার্জন হলের গেটের সামনেই আরেক বড় ভাইকে দেখা।
তিনিও মিছিলের নিত্যদিনকার সাথী। আমাদের দেখে বললেন, গুলিস্তানের দিকে যেও না।
মিলিটারিরা হামলা করছে। কাউকে জীবিত রাখছে না তারা। তোমরা তাড়াতাড়ি ক্যাম্পাস ছেড়ে পালাও।
আমি বড় ভাইকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করলাম যে, মূলত কি হয়েছে।
তিনি সংক্ষেপে কথা শেষ করলেন। মিলিটারির হামলা শুনে মিকদাম আতঙ্কিত হয়ে পড়লো।
ঠিক এই মূহুর্তেই মিলিটারিদের একটা দল এগিয়ে আসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।
তারা এলোথোপাথারি গুলি ছুঁড়ছিল। হঠাৎ করে মিকদাম জোরে চিৎকার দিয়ে বসে পড়ে।
তাকিয়ে দেখি, তার বাম পাজরে গুলি লেগেছে। খানিকক্ষণের জন্য আমরা স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম।
জীবনেও চোখের সামনে গুলিবৃদ্ধ মানুষ দেখি নি। এই মূহুর্তে আমাদের কি করণীয়, আমরা ঠাহর করতে পারছিলাম না।
চোখের সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখছি না।
শাহেদ ভাই কোথা থেকে যেন ছুটে আসলেন। মিকদামের এই অবস্থা দেখে বললেন, ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার চেষ্টা করো না।
সেখানে মিলিটারিরা কোনো গুলিবৃদ্ধ লোকজনকে ডুকতে দিচ্ছে না।
হলে নিয়ে চল। দেখি কিছু করা যায় নাকি। আমরা মিকদামকে ধরাধরি করে হলে নিয়ে গেলাম।
তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমার হাতে রক্ত লেগে লাল হয়ে গেছে।
আমাদের তেমন মেডিক্যাল জ্ঞান নেই। শাহেদ ভাইয়ের খানিকটা জ্ঞান ছিল।
তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছেন রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে। কিন্তু তা আর হলো না।
দশ মিনিটের মাথায় মিকদাম আমার উরুতে মাথা রেখে জান্নাতে চলে গেল।
চোখের সামনে এমন মৃত্যু দেখে আমরা আর ঠিক থাকতে পারলাম না।
হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আমরা। শাহাদাত কি করবে ভেবে না পেয়ে রুমের কোণ থেকে একটা হকিস্টিক নিয়ে বললো,
যেই মিলিটারিরা আমার ভাইকে মেরেছে, আমি তাকে মেরে ফেলবো।
এই বলে সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমরা তাকে থামানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম।
৭২ কেজি ওজনের একজন মানুষের সাথে আমরা ৬০ কেজির নিচের ছেলেরা পেরে উঠি কি করে। সে বেরিয়ে গেল। আমরা ঝিম মেরে মিকদামের লাশের সামনে বসা।
কারো মুখ দিয়ে কোনো কথা নেই। আমরা যেন সবাই বোবা হয়ে গেছি।
কিছুক্ষণ পর হলের বাহিরে ছাত্রদের চিৎকার শুনতে পাই, বেগম রোকেয়া হলে ছাত্রীদের উপর মিলিটারিরা হামলা করছে।
এটা শুনে আবির আর স্থির থাকতে পারলো না।
আমাকে বললো, তুই এখানে থাক্। আমি যাচ্ছি। দেখি, দু-একটা মিলিটারিকে জবাই করতে পারি নাকি।
আবির রুম থেকে ধারালো দুইটা ছুরি নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি একা মিকদামের লাশের সামনে বসে আছি।
পুরোনো স্মৃতিগুলো এক এক করে চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। – স্বাধীনতার কথা
কত আনন্দই না করেছি আমরা। একসাথে ঢাকার বাহিরে ঘুরাঘুরি করেছি।
আজ একজন মারা গেছে। দুইজন জীবন বাজি রেখে লড়াইয়ের ময়দানে।
আমি বসে আছি অপরাজিত সেনার মতো। ভাবলাম, সবাই তো জীবন বাজি রেখেছে। আমিও না হয়, লড়াইয়ে নামি।
রুম থেকে বের হতেই দেখি, কার্জন হলের সামনে একের পর এক লাশ আসছে।
সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের। হঠাৎ দেখি, শাহাদাত লাশ হয়ে আমার সামনে।
আমি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলাম। আমাদের চারজন বন্ধুদের মধ্য থেকে দুইজন বিদায় নিয়ে চলে গেল।
তারা জান্নাতের পাখি হয়ে গেল। আমি আবিরের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে শহীদ মিনারের সামনে চলে আসি। এখানে মিলিটারিরা দূরে বেরিক্যাড দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে পুলিশও আছে।
ছাত্ররা ব্যারিক্যাড ভাঙ্গার চেষ্টা করছে। কিন্তু যে ই সামনে আগানোর চেষ্টা করে মিলিটারির গুলির আঘাতে সাথে সাথে লুটিয়ে পড়ে। আমি আস্তে আস্তে সামনে এগুতে লাগলাম।
হঠাৎ দেখি, আবির দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা ছুরি ও ক্রিকেট ব্যাট।
আমি তার দিকে এগুনোর আগেই সে জয় বাংলা বলে ব্যাটটা উচিঁয়ে ধরে মিলিটারিদের দিকে লাগলো। – স্বাধীনতার কথা ।
হঠাৎ একটা বুলেট এসে তার পায়ে লাগে। তারপরও সে থামে নি।
উঠে দাঁড়িয়ে আবারও আগানোর চেষ্টা করলো। এবার একটা বুলেট এসে সরাসরি তার বুকে এসে লাগলো।
মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে। আবিরের নিথর দেহটা হেচড়িয়ে সরিয়ে ফেললো ছাত্ররা।
এ দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আমি। কতক্ষণ ধরে অজ্ঞান ছিলাম জানি না।
জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি শহীদ মিনারের পেছনে শুয়ে আছি।
আমার ডান পাশ দিয়ে নতুন সূর্য উদিত হচ্ছে। একটা রক্তাক্ত সূর্য। গোগ্রাসে গিলে ফেলতে চাচ্ছে সকলকে। খানিক্ষণ পরই নিস্তব্ধ হয়ে সোনালী সৌরভ ছড়াতে থাকে সূর্যটি। – স্বাধীনতার কথা ।
মাথার একপাশ প্রচণ্ড ব্যাথা করছে। দূর থেকে কার যেন কণ্ঠসুর শুনতে পাই,
“মেজর জিয়া রেডিওতে স্বাধীনতার ডাক দিতাছে। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য তারা প্রচার করতাছে। বলেছে, যে যেখানেই আছ অস্ত্র তুলে নাও। দেশ পাকিস্তানি হানাদারদের থেকে স্বাধীন করতে হইবো।”