হায়দ্রাবাদ দখলের ইতিহাস

হায়দ্রাবাদ দখলের ইতিহাস – ইংরেজদের নিকট হতে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে হায়দ্রাবাদও স্বাধীন হয়ে যায়।

ভারত তখন হায়দারাবাদ দখলের চেষ্টা শুরু করে। হায়দারাবাদের যেসব হিন্দুরা ছিল এবং কংগ্রেস সমর্থকরা ছিল, তারা হায়দ্রাবাদে জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে।

তাদের এসব চক্রান্তের ফলে তখন একটি দল প্রয়োজন ছিল। তখন নবাব বাহাদুর ইয়ার জং ইত্তেহাদুল মুসলিমীন নামে একটি সংগঠনকে সামনে আনেন।

পূর্বে এটি অল ইন্ডিয়া ইত্তিহাদুল মুসলিমীন নামে পরিচিত ছিল। এটি ১৯২৭ সালে নবাব মুহাম্মাদ নওয়াজ খান প্রতিষ্ঠা করেন।

বাহাদুর ইয়ার জং এর নেতৃত্বে হায়দ্রাবাদের মুসলমানদের যেন প্রাণ ফিরে এসেছিল। কিন্তু ঠিক এমন মুহুর্তেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

শোকে স্তব্ধ হয়ে যায় হায়দ্রাবাদের সমস্ত মানুষ। হায়দ্রাবাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জানাযা সংগঠিত হয়েছিল ইয়ার জং এর মৃত্যুতে।

নবাব বাহাদুর ইয়ার জংয়ের মৃত্যুর পর ইত্তিহাদুল মুসলিমীন এর সভাপতি হন কাসেম রেজভী। হায়দ্রাবাদ তখন আস্তে আস্তে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।

তারা তখন ভারত ভুক্তির সমস্যা নিয়ে ভুগছে। সারা হায়দ্রাবাদের মুসলামানরা উত্তেজনায় টগবগ করছে, যে কোনো মূল্যে ভারতভুক্তি ঠেকাতে হবে।

এদিকে আবার হায়দ্রাবাদে থাকা গাদ্দার কংগ্রেস সমর্থকরা সমগ্র হায়দ্রাবাদে হামলা ও রাহাজানি শুরু করেছে।

এ ছাড়াও কংগ্রেসের চরেরা সীমান্ত পার হয়ে হায়দ্রাবাদে প্রবেশ করে ত্রাসের রাজত্ব শুরু করেছে।

এসব সন্ত্রাসরা ক্রমে ক্রমেই জোড়ালো আক্রমন শুরু করলো। তাদেরকে সম্পূর্ণ সাহায্য করতে লাগলো ভারত সরকার।

এসময়ে তারা বেশ কিছু এলাকা দখল করে তা ফ্রি জোন হিসেবে ঘোষণা দিল। কংগ্রেস এবং কমিউনিস্টরা একজোট হয়ে হায়দ্রাবাদে সশস্ত্র বিদ্রোহ করে বসলো।

পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেল যে, পুলিশ দিয়েও তা ঠেকানো সম্ভব হলো না।

বিদ্রোহীরা তখন ভারতের মদদে ভারি অস্ত্র ব্যবহার শুরু করলো।

তারা একের পর এক গ্রাম দখল করে মুসলমানদের উচ্ছেদ করতে লাগলো। সেই এলাকা থেকে তারা অত্যাধিক খাজনা উঠাতে লাগলো।

নিজামের বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা

দেশের এমন নাজুক পরিস্থিতিতে হায়দ্রাবাদের নিজাম সেনাবাহিনীকে ডাকলেন। সেখানে দেখা গেল, সেনাবাহিনীতে অস্ত্র সংকট আছে।

কারণ, বিদ্রোহীরা বিদেশী অস্ত্র ও ভারত থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র আনছিল। আর চতুর্দিকে ভারত বেষ্টনিতে পড়ে হায়দ্রাবাদ সম্পদ শূন্য হয়ে পড়ে।

দেশের এমন পরিস্থিতিতে ইত্তিহাদুল মুসলিমীনের প্রধান ঠিক করলেন, জনগণকে আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে গড়ে তুলতে হবে।

ইত্তিহাদুল মুসলিমীনের নেতারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে মানুষকে আত্মরক্ষা শেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন।

দেখতে দেখতে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি হলো। দেশের জনগণও তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত হতে লাগলো। সীমান্ত চৌকিগুলোতে তারা অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করতে লাগলো।

এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ছিলেন কাসেম রেজভী। তাদের সুনাম ও সফলতা আস্তে আস্তে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়লো।

ভারতের মাথায় তখন পড়লো হাত। এভাবে চলতে থাকলে তাদের হায়দ্রাবাদকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর সপ্ন ভেস্তে যাবে।

তাই তারা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা শুরু করলো। তারা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নামে মিথ্যা লুটপাট ও খুন-খারাপির গল্প শোনাতে লাগলো।

এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছিল হিন্দুস্থান টাইমস। তারা এভাবে প্রচার করতে লাগলো,

যদি হায়দ্রাবাদে স্বেচ্ছাসেবকরা আরো শক্তিশালী হয় তাহলে তারা হিন্দুদের মেরে ফেলবে। তাদের কাউকে বাঁচতে দেবে না।

মিডিয়ার মাধ্যমে আস্তে আস্তে তারা মিথ্যা কথা ছড়িয়ে হায়দ্রাবাদকে সন্ত্রাসদের আস্তানা বানিয়ে ফেললো।

স্বাধীন হায়দ্রাবাদে ভারতের হামলা

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিকে নিউ দিল্লির এক সেনা ছাউনিতে সভাব ডেকে হায়দ্রাবাদে সেনা অভিযান চালানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

স্বাভাবিকভাবেই হায়দ্রাবাদের বহির্বিশ্ব থেকে কোনো শক্তি আসে নি। আর তাদের নিজেদের শক্তির অবস্থাও ছিল টালমাটাল।

বিপরীতে ভারত অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও বিপুল শক্তি নিয়ে হায়দ্রাবাদের উপর আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়।

ভারত এত বিপুল সেনা সমাবেশ ঘটানোর পর প্রধানমন্ত্রী নেহেরু দম্ভের সাথে ঘোষণা করলেন, হায়দ্রাবাদের কাছে দুইটি পথ খোলা আছে। হয় ভারতে যুক্ত হও অথবা যুদ্ধ।

১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরেই হায়দ্রাবাদ আক্রমণের সব পরিকল্পনা চুড়ান্ত হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত হায়দ্রাবাদে আক্রমণ শুরু করে।

ভারতীয় বাহিনী এই সেনা অভিযানের নাম দিল অপারেশন পোলো। প্রথমে তারা পশ্চিমের নলদূর্গ এলাকা দিয়ে অপারেশন শুরু করে।

অন্য আরেকটি বাহিনী তালমুদ এলাকা দিয়ে হায়দ্রাবাদে প্রবেশ করে। প্রথম দিনের যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর ৭ জন মারা যায় ও ৯ জন আহত হয়।

কিন্তু হায়দ্রাবাদের সৈন্যদের মধ্যে ৬৩২ জন মারা যায় ও ১৪ জন আহত হন এবং ২০০ জন ভারতের হাতে বন্দি হয়।

দেখতে দেখতে ভারতের সৈন্যরা আরো বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ শুরু করলো। যুদ্ধের এমন বেহাল দশা দেখে হায়দ্রাবাদের প্রধানমন্ত্রী মীর লায়েক আলী নিজেই যুদ্ধের তদারকির দায়িত্ব নেন।

তখন হায়দ্রাবাদ প্রায় ধ্বংস হওয়ার পথে। তিনি আর্মি কন্ট্রোলরুমে বসে জানতে পারলেন,

হায়দ্রাবাদের সেনাদের মধ্যে প্রচলিত কোড এত পুরাতন যে, ভারতীয়রা আগে ভাগেই তথ্য জেনে যাচ্ছে।

আস্তে আস্তে ভারতীয় সেনাবাহিনী শহরে প্রবেশ শুরু করলো। প্রধানমন্ত্রী কি করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না।

হায়দ্রাবাদের পরাজয়

১৯৪৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ধায় প্রধানমন্ত্রী মীর লায়েক আলি হায়দ্রাবাদের নিজাম মীর উসমান আলি খানের সাথে দেখা করেন।

নিজাম হতাশা সূরে প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, আমাদের সকল চেষ্টা তো ব্যর্থ হলো। পাকিস্তান নিরব। কোনো মুসলিম দেশও এগিয়ে আসলো না।

সেনাবাহিনীর উপর আমার কোনো ভরসা নেই। ভারতের বাহিনী ক্রমশ রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসছে। এই মুহুর্তে আমাদের করণীয় কি?

প্রধানমন্ত্রী তখন উত্তরে বললেন, আত্মসমর্থনের চাইতে মৃত্যু শ্রেয়। স্বাধীনতার জন্য মৃত্যুকে স্বাগত জানাবো।

নিজাম শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পনের পথ বেছে নিলেন। ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি এক বেতার ভাষণে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বললেন,

ভারতীয় আগ্রাসন ক্রমে প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ায় তার সরকার পদত্যাগ করছে। এর পাশাপাশি তিনি ভারতীয় প্রতিনিধি কে এম মুন্সির পরামর্শে ভারতের আনুগত্য স্বীকার করে নিলেন।

১৯৪৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর হায়দ্রাবাদের সেনাপতি মেজর জেনারেল আল ইদরুস রাজধানীর বাহিরে ভারতীয় বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জে এন চৌধুরীর কাছে অস্ত্র সমর্পন করেন।

এরপর ভারতের নির্দেশে জেনারেল জে এন চৌধুরীকে সামরিক গভর্নর ও আরো পাচঁজনকে সামরিক সদস্য মিলে মন্ত্রীসভা গঠন করে হায়দ্রাবাদের শাসনভার গ্রহণ করলো।

নতুন এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুসলমানদের উপর শুরু হলো নির্যাতনের স্টীম রোলার। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে ধরে ধরে নির্মূল করা হলো।

তথ্যসুত্র

হায়দারাবাদ ট্রাজেডী ও আজকের বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ৩৩-৪৬

Scroll to Top