কুরআন নিয়ে চিন্তা ভাবনা

কুরআন নিয়ে চিন্তা ভাবনা – মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিপূর্ণ গ্রন্থ হলো আল কুরআনুল কারীম। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ১৪০০ বছর পূর্বে এই কিতাব নবীজি সা. এর উপর নাজিল করেছেন।

রুক্ষ আবহাওয়ায়, বৈরি পরিবেশে, পাষাণ হৃদয়ের মানুষদের উপর এই কুরআন নাজিল হয়েছিল। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই অশান্ত পরিবেশকে শান্ত করেছে এই কুরআন।

পাষাণ হৃদয়ের মানুষগুলো অন্তরে ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করলো এই কুরআন। সর্বদা তরবারি নিয়ে যুদ্ধে অভ্যস্ত জাতিকে সভ্যতা শেখালো এই কুরআন।

নবীজি সা. কে হত্যার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া উমরকে থামিয়ে দিল এই কুরআন। কুরআন একটি জীবন্ত মোজেজা, একটি জীবন্ত পথ।

পৃথিবীর বয়স যতই পুরাতন হোক না কেন, আল্লাহ এই বর্তমান এই সভ্যতাকে আরো কয়েকশত বছর বাঁচিয়ে রাখলেও কুরআনের মাধুর্যতা ও প্রয়োজনীয়তা শেষ হবে না।

প্রতিটি মুসলমান যখন এই কুরআনকে হাতে নেয়, এক স্বর্গীয় পৃথিবী দেখতে পায়। এক অনাবীল শান্তিময় স্থান অবলোকন করে।

আপনি যেই হোন না কেন, কুরআন নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেই। যত ছোট হোন কিংবা যত বড় হোন।

জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হোন কিংবা অশিক্ষিত হোন, আপনি কুরআনের মধ্যে আলো দেখতে পাবেন।

এই কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য হলো মানুষ কুরআন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। শুধুমাত্র তেলওয়াতেই ক্ষান্ত থাকবে না, বাস্তব জীবনে কুরআনকে জীবনের সাথে প্রয়োগ করবে। কুরআন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবে।

কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন

আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বর্ণনা করে সূরা সোয়াদের ২৯ নং আয়াতে বলেন,

کِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰهُ اِلَیۡکَ مُبٰرَکٌ لِّیَدَّبَّرُوۡۤا اٰیٰتِهٖ وَ لِیَتَذَکَّرَ اُولُوا الۡاَلۡبَابِ

আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে।

প্রতিটি মুসলমানের উচিৎ, কুরআন নিয়ে ভাবা। কুরআনে আল্লাহ কি বলেছেন, তা বুঝার চেষ্টা করা। সেটি অনুযায়ী আমল করার চেষ্টা করা।

কেউ যখন কুরআনের কোনো একটি আয়াত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করবে,তখন তার সামনে আস্তে আস্তে অনেক রহস্য উন্মোচিত হতে থাকবে।

হযরত হাসান বসরী রহ. বলেছেন, আল্লাহর কসম! মানুষ গভীরভাবে কুরআন নিয়ে চিন্তা করে না! (এটা বড়ই দুর্ভাগ্য)

অন্তরকে বিগলিত করা

মানুষ হলো সৃষ্টির সেরা জীব। এরপরও মানুষ ভুল করে। এরপরও মানুষ নফসের ফাঁদে ও শয়তানের ফাঁদে ফেঁসে যায়।

কুরআনুল কারীমের যতগুলো গুণ রয়েছে, ততগুলোর মধ্যে একটি হলো, এই কুরআন যেমন ভালো মানুষদের শান্তির পথ দেখায় তেমনি আশাহত ব্যক্তিদেরকেও সে মুক্তির পথ দেখায়।

যখন কোনো ব্যক্তি কুরআন তেলওয়াত করে, তখন তার অন্তর আস্তে আস্তে বিগলিত হতে থাকে। এই জিনিষটা সবচেয়ে বেশি কাজ করে, যারা কুরআন বুঝে তাদের উপর।

কেউ যখন কোনো ভুল কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়, কুরআন তখন তার সামনে লৌহবর্ম হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

কুরআন তার অন্তরের নেফাকী ঝেটিয়ে বিদায় করে দেয়।

ঈমান বৃদ্ধি

কুরআন মানুষের ঈমানকে মজবুত করে। মানুষকে শান্তির পথ নির্দেশ করে। কুরআন দিশাহীন মানুষকে সঠিক দিশা দেয়।

সাহাবীদের সময় তারা এতটা শক্তিশালী ছিল কিভাবে? কারণ, তারা কুরআনকে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিল। কুরআনকে তারা আঁকড়ে ধরেছিল।

কুরআন শুধুমাত্র তেলওয়াতের জন্য শিখলেই হবে না, তেলওয়াতের পাশাপাশি কুরআন অনুযায়ী আমল করাও একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য।

সাহাবীদের কুরআন শেখা আর আমাদের কুরআন শেখার মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল তফাৎ। তারা যদি বলতেন, আমি কুরআনের অমুক আয়াত শিখেছি।

এর মানে হলো তিনি কুরআনের সেই আয়াতটির বিধান ও নির্দেশ জেনেছেন, তা বুঝেছেন, বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন, নিজের আমলে তা রূপান্তর করেছেন।

আল্লাহর তিরষ্কার থেকে রক্ষা

যেই ব্যক্তিরা শুধুমাত্র কুরআন তেলওয়াত করাকেই নিজের জন্য উত্তম মনে করে,

কুরআন বুঝার জন্য চেষ্টা করে না, আল্লাহর বলে দেওয়া আদেশ-নিষেধ নিয়ে ভাবে না, আল্লাহ তাদেরকে তিরষ্কার করেছেন।

আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনের সূরা মুহাম্মাদের ২৪ নং আয়াতে বলেন,

اَفَلَا یَتَدَبَّرُوۡنَ الۡقُرۡاٰنَ اَمۡ عَلٰی قُلُوۡبٍ اَقۡفَالُهَا

তারা কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে?

 কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুধুমাত্র আলেমদের কাজ নয়, সকল মুসলমান নর-নারীর কাজ। সকল মুসলমানের উপর এই দায়িত্ব বর্তায়।

তবে এখানে একটি জিনিষ বুঝার বিষয় আছে। যেই ব্যক্তির জ্ঞান যতুটুকু তাকে ততুটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে ফায়সালা প্রদান করতে হবে।

যখন কোনো একটা বিষয় বুঝে আসবে না, তখন নিজের চেয়েও অধিক জ্ঞানী ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করে সেটি জেনে নিতে হবে।

কোনো আলেমকে সেই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে হবে। তার থেকে জানতে হবে। বর্তমানে সবচেয়ে বড় যেই সমস্যাটা দেখা যায়, তা হলো,

আমরা সবাই মতামত দিতে চাই। সবাই ফায়সালা প্রদান করতে চাই। সবাই নিজেকে গবেষক দাবী করতে চাই। এজন্যই আমাদের ভুলগুলো আমরা ভুল মনে করি না।

এমন চিন্তাপ্রসুত ধারণা থেকে বের হয়ে আসা উচিৎ। কখনোই না বুঝে মতামত প্রদান করা উচিৎ নয়।

আমরা গবেষণা করবো, কুরআন নিয়ে ভাববো, যখন দেখবো বিষয়টা মিলছে না, তখন বিজ্ঞ কোনো আলেমকে জিজ্ঞাসা করবো।

তাহলেই কেবল এটি আমাদের জন্য উত্তম কাজ হবে। আমরা আল্লাহর তিরষ্কার থেকে বেঁচে থাকতে পারবো। কুরআন অনুাযায়ী জীবন পরিচালনা করতে পারবো।

আরবি ভাষা আয়ত্ব করা

নতুন একটা ভাষা শেখা কঠিন মনে হলেও লাগাতার চেষ্টা করলে একটা সময় তা সহজ হয়ে যায় এবং আয়ত্বে এসে যায়।

আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনকে আরবি ভাষায় নাজিল করেছেন। আরবি ভাষার মতো ব্যপ্তিময় ভাষা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা হয় না।

কুরআন বুঝার জন্য শুধুমাত্র তরজমার উপর নির্ভরশীল হওয়া উচিৎ নয়। কিষ্ণিৎ আরবি ভাষার জ্ঞান রাখা প্রতিটা মুসলমানের জন্য জরুরি।

বর্তমানে আরবি ভাষা শেখার অনেক মাধ্যম আছে। বিভিন্ন মাদ্রাসা চাকুরিজীবি, ছাত্র ও বয়ষ্কদের জন্য কুরআনের ভাষা শেখানোর আয়োজন করে থাকে।

অনেক অনলাইন প্রতিষ্ঠান আরবি ভাষার জন্য কোর্স করিয়ে থাকে। এছাড়াও সবচেয়ে উত্তম হলো নিকটস্থ কোনো সমবয়সী বা বয়সে বড় কোনো আলেমের নিকট হতে আরবি ভাষার জ্ঞান রপ্ত করা।

আরবি ভাষা শেখার জন্য “এসো আরবি শিখি”, “আত-তামরিনুল কিতাবি”, “এসো কুরআন শিখি ১-২” খুবই সমৃদ্ধ কিতাব।

এছাড়াও বর্তমানে শুধুমাত্র কুরআনের আরবিকে সামনে রেখেও অনেক বই বাজারে পাওয়া যাবে।

আমার কুরআন কারীম” বইটাও কুরআনের আরবি ভাষার শেখার জন্য আপনার পাথেয় হতে পারে।

অনেক জায়গায় অবশ্য “আল আরাবিয়্যাতু বাইনা ইয়া দাইক” বইটাও সাজেস্ট করা হয়। এটিও আরবি শেখার জন্য উপকারী কিতাব।

তবে মোটকথা হলো, যেটিই পড়ুন না কেন, অবশ্যই আপনাকে কোনো আলেমের তত্ত্বাবধানে থেকে বইগুলো পড়তে হবে।

তবেই তা উত্তম হবে। আমরা মুসলমান হয়ে এত এত জাগতিক শিক্ষা অর্জন করেও যদি কুরআনের ভাষা শিখতে না পারি, কুরআন সরাসরি বুঝতে না পারি তাহলে এটি আমাদের জন্য লজ্জার।

ইহুদিদের দিকে তাকান, তারা বিশ্বের যেই দেশেই থাকুক না কেন, যেই ভাষাতেই তার জন্ম হোক তাদের ধর্মীয় ভাষা হিব্রু অবশই তারা শিখে। তা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক।

অথচ আমরা………………। অধঃপতন থেকে আমাদের ফিরে আসা উচিৎ।

মুসলমানরা যদি কুরআনকে আঁকড়ে ধরে তাহলে আল্লাহ অবশ্যই আমাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে দিবেন ইনশাল্লাহ।

কুরআনের অনুবাদ বা তাফসীর পড়া

যদিও কুরআনের অর্থ ভালোভাবে বুঝার জন্য আরবি শেখার বিকল্প নেই,

তারপরও কুরআনের অনুবাদগুলোর মাধ্যমেও আমরা কখনো কখনো কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে আরেকটু অগ্রসর হতে পারি।

আমরা প্রতিনিয়্যত নামাজে যেসব সূরা ও মাসনূন দোয়াগুলো পড়ি, উচিৎ হলো এগুলোর অর্থগুলো সম্পূর্ণ মুখস্ত করে নেওয়া।

এছাড়াও আমরা বড় একটি জটিলতায় ভুগি। সেটি হলো, কোন তরজমা বা তাফসীরটি অধ্যয়ন করবো?

এ প্রসঙ্গে শায়েখ সালেহ আল মুনাজ্জিদ হাফিঃ বলেন, সহজ ও সরল অনুবাদকৃত গ্রন্থ প্রথমে পাঠ করা উচিৎ। এরপর চাইলে আস্তে আস্তে অ্যাডভান্স লেভেলে যাওয়া যায়।

তবে এই ক্ষেত্রে এসে অনেকে একটি ভুল করে বসেন। সেটি হলো, কুরআনের তাফসীর বা তরজমা পড়ে অনেক কিছু নিজের মতো ব্যাখ্যা করে নেওয়া।

যারা ইলমে অভিজ্ঞ, তারা বিভিন্ন আলোকে এটি করতে পারেন। কিন্তু একজন সাধারণ মুসলমানের জন্য এটি কাম্য নয়।

যখন কোনো সংশয় আসবে তখন নিকটস্থ কোনো আলেম বা বড় কোনো আলেমের নিকট জিজ্ঞাসা করে সেটির উত্তর জানার চেষ্টা করা উচিৎ।

কুরআন তেলওয়াত ভালোভাবে শেখার পর অর্থের দিকে মনোযোগী হওয়া উচিৎ। এটির জন্য বিভিন্ন তরজমা গ্রন্থ রয়েছে।

এছাড়াও যখন তাফসীর পড়তে যান কেউ কেউ তখনো উচিৎ সহজটিকে আগে প্রাধান্য দেওয়া।

তাফসীরে উসমানী বা তাওজিহুল কুরআন দিয়ে প্রাথমিকভাবে শুরু করতে পারেন।

এরপর শফী রহ. লিখিত মারেফুল কুরআন পড়তে পারেন। যখন মোটামুটি তরজমা ও তাফসীরের জ্ঞান খানিকটা হাসিল হবে, তখন তাফসীরে ইবনে কাসীর অধ্যয়ন করা যেতে পারে।

শুরুতেই এটি অধ্যয়ন করলে হিতে বিপরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, এটিতে প্রতিটি আয়াতের বিপরীতে হাদীস আনা হয়েছে ও ইমামদের বক্তব্য আনা হয়েছে।

গবেষকদের জন্য এটি খুবই উপকারী। তবে সাধারণরা পূর্বে অন্যান্য ছোট তাফসীর দিয়ে অধ্যয়ন শুরু করতে পারবেন।

পৃথিবীতে আল্লাহর রহমতে অসংখ্য তাফসীর গ্রন্থ রয়েছে। আপনি কখন কোনটা পড়বেন, তার জন্য আপনার নিকটস্থ কোনো আলেমকে জিজ্ঞাসা করুন।

তিনিই আপনাকে উত্তম পরামর্শ দিতে পারবেন ইনশাল্লাহ। এছাড়াও কুরআনকে আরো সহজ সরলভাবে বুঝার জন্য কুরআন নিয়ে লিখিত বিভিন্ন লেখকদের বইগুলো পড়তে পারেন।

আই লাভ কুরআন”, “সুইটহার্ট কুরআন”, “কুরআন বোঝার মজা” ইত্যাদি বইগুলো পড়তে পারেন।

Scroll to Top