প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে – পৃথিবীতে সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে কত রকম প্রাণীকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীতে মানব সৃষ্টির বয়স ৩০ লাখ বছর। আল্লাহ শুরুতে আদম আ. কে পাঠিয়েছিলেন। এরপর একে একে আরো কত মানুষ পাঠিয়েছেন।
মানুষ পাঠানোর এই ধারাবাহিকতা কখনোই শেষ হয় নি। মানুষ আল্লাহর অবাধ্যতা করেছে। হঠকারিতায় লিপ্ত হয়েছে।
তারপরও আল্লাহ মানুষ পাঠানো বন্ধ করেন নি। ফেরআউনের মতো মানুষ, নমরূতের মতো মানুষ খোদা দাবী করেছে, তাও আল্লাহ মানব সৃষ্টিতে থমকে দেন নি।
মানুষকে তিনি পাঠিয়েছেন। মানুষ পৃথিবীতে তার প্রতাব দেখিয়েছে। তার কর্তৃত্বে দেশ-মহাদেশ জয় করেছে। তার বুদ্ধিতে সৌরজগত ছাড়িয়ে গ্যালাক্সির অপর প্রান্তে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এত কিছুর পরও কি কোনো মানুষ বা কোনো প্রাণ আজীবন বেঁচে থাকতে পেরেছে? কেউ কি মৃত্যুকে জয় করতে পেরেছে?
কেউ কি আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখাকে পরিবর্তন করতে পেরেছে? একটাই উত্তর আসবে, না। কেউ তা পারে নি। কেউ তা পারবেও না।
2
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ সূরা আলে ইমরানের ১৮৫ নং আয়াতে ইরশাদ করছেন,
کُلُّ نَفۡسٍ ذَآئِقَۃُ الۡمَوۡتِ ؕ وَ اِنَّمَا تُوَفَّوۡنَ اُجُوۡرَکُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ فَمَنۡ زُحۡزِحَ عَنِ النَّارِ وَ اُدۡخِلَ الۡجَنَّۃَ فَقَدۡ فَازَ ؕ وَ مَا الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَاۤ اِلَّا مَتَاعُ الۡغُرُوۡرِ
প্রতিটি প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর ‘অবশ্যই কিয়ামতের দিনে তাদের প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে দেয়া হবে। সুতরাং যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে-ই সফলতা লাভ করবে। আর দুনিয়ার জীবন তো শুধু ধোঁকার সামগ্রী মাত্র।
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ বলে দিচ্ছেন, তোমাদের কিন্তু মৃত্যু হবে। আর মৃত্যুর পর তোমাদেরকে আবার জীবিত করা হবে।
এই দুনিয়াতে জীবিত থাকাকালীন তুমি যেটা ইচ্ছা করতে পার। তুমি স্বাধীন। আল্লাহ তোমাকে এখন এই কাজের জন্য কিছুই বলবে না।
নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আল্লাহ অবকাশ দিয়েছেন। তুমি ঘুষ খাইবা। খাও। তুমি সুদ খাইবা। খাও। তুমি হারাম রিলেশনের যাইবা। যাও।
যেটা ইচ্ছা করো। যেখানে ইচ্ছা যাও। যা খুশী বলো। যা মন চায়, তা খাও। শুধু মনে রেখো, তোমারও মৃত্যু হবে। তোমারও জীবন প্রদীপ একদিন নিভে যাবে।
আল্লাহ তা’আলা একদিন আবার সকল প্রাণকে জীবিত করবেন। সেদিনটাকে বলা হয়, হাশর বা শেষ বিচারের দিন।
যেদিন যাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত রাখা হবে, সে হবে সফলকাম। যেদিন যাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, সেই হবে হতভাগা।
দুনিয়াতে থাকাকালীন তুমি যত বড় ব্যক্তিই হও না কেন, যত সম্পদশালী হও না কেন, যত বড় আবিষ্কারক হও না কেন, নোবেল প্রাইজ তোমার একটা নয়, দশটা থাকুক তাতে কিছু যায় আসে না। শুধু দেখা হবে, তোমার হিসাবের খাতায় পূণ্য কতুটুকু আছে!
যদি তুমি সেদিন জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করো, দুনিয়াতে তুমি যত বড় হতভাগা হও না কেন, তুমিই প্রকৃত সফলকাম।
আর তুমি যেদিন যদি জাহান্নামের ইন্ধন হও, তাহলে তোমার যশ-খ্যাতি, সম্পদ, উপহার সামগ্রী, লোকবল কোনো কাজে আসবে না। তুমিই প্রকৃত হতভাগা।
3
আল্লাহ সূরা যিলযালের ৭-৮ নং আয়াতে বলছেন,
فَمَنۡ یَّعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّۃٍ خَیۡرًا یَّرَهٗ ؕ. وَ مَنۡ یَّعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّۃٍ شَرًّا یَّرَهٗ
কেয়ামতের দিন কেউ অণু পরিমাণ ভালকাজ করলে তা সে দেখবে। আর কেউ অণু পরিমাণ খারাপ কাজ করলে তাও সে দেখবে।
মানুষ বুঝে না, দুনিয়া তো শুধুমাত্র ধোঁকার বস্তু। এই দুনিয়ার চাকচিক্য দেখে মানুষ তা অর্জনের পেছনে ছুটে।
এই দুনিয়ার অত্যাধুনিক গ্যাজেট দেখে তা ক্রয় করাকেই সফলতা মনে করে। অথচ এই দুনিয়া হলো ধোঁকার সামগ্রী।
যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমার আসল ঠিকানা কি? অনেকে বলবে, দুনিয়াই হতো হবে হয়তো। বর্তমান আধুনিক পৃথিবীতে নাস্তিকতার নামে মানুষকে ধর্ম থেকে দিন দিন দূরে সরানো হচ্ছে।
তাদের মাথায় এই বার্তা দেওয়া হচ্ছে, এই দুনিয়াই হলো আসল। এর পরে কেয়ামত হলো হুজুরদের ব্যবসার ধান্দা আরকি!
প্রিয় ভাই! যেদিন চোখের সামনে কেয়ামতকে তুমি দেখবে, যেদিন তোমার মতো হতভাগা আর কেউ থাকবে না। কেউ তোমাকে তখন সাহায্য করবে না।
এই দুনিয়াতে দেখতে পাচ্ছ যে, অনেক মানুষ তোমার পেছনে ঘুরে। অনেক ব্যক্তি তোমার সাক্ষাৎলাভে ধন্য হয়। এই সবই ধোঁকা।
যখন মৃত্যু হবে, তখন তাদের কেউ তোমার সাথে যাবে না। তোমার সম্পদ রেখে যাবে রাস্তার পার্শ্বে। পড়ে থাকবে নিথর দেহটা বাঁশবাগানের নিচে।
ইস্রাফিল আ. শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার পর যখন জেগে উঠবা তখন চারিদিকে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই তুমি দেখতে পাবে না।
হায় আফসোস! তুমি রবকে ভুলে যাও। যেই রব তোমাকে জীবন দিয়েছেন। তুমি রবকে মিথ্যা সাব্যস্ত করো, অথচ যেই রব পৃথিবীকে সুন্দরভাবে সাজিয়েছেন।
4
আল্লাহ সূরা আ’লা এর ১৬-১৭ নং আয়াতে বলেছেন,
بَلۡ تُؤۡثِرُوۡنَ الۡحَیٰوۃَ الدُّنۡیَا. وَ الۡاٰخِرَۃُ خَیۡرٌ وَّ اَبۡقٰی
তোমরা দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছ? অথচ আখিরাতই অধিক উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী।
দুনিয়ার এই জীবন হলো পরীক্ষার জীবন। আমরা ক্লাসে পরীক্ষার হলে পরীক্ষা দেই। সেটা আমাদের জীবনের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ।
মানুষের জীবন আরো বড় পরীক্ষার। আল্লাহ মানুষকে প্রতিটা মুহুর্তে পরীক্ষা করেন। কখনো সম্পদ দিয়ে আবার কখনো সম্পদ না দিয়ে।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ সূরা বাকারার ১৫৫ নং আয়াতে বলছেন,
وَ لَنَبۡلُوَنَّکُمۡ بِشَیۡءٍ مِّنَ الۡخَوۡفِ وَ الۡجُوۡعِ وَ نَقۡصٍ مِّنَ الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَنۡفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ ؕ وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیۡنَ
আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।
যালিমের জুলুমও পরীক্ষা বিশেষ। আল্লাহ উভয়কে পরীক্ষা করেন। যালিমকে পরীক্ষা করেন, ক্ষমতা থাকার পর তুমি জনগণকে কষ্ট দাও নাকি?
সে কষ্ট দিলে আল্লাহ পুরোপুরি তার হিসাব নিবেন। মাজলুমকে পরীক্ষা করেন ভয় ও জুলুমের মাধ্যমে। মাজলূম যদি কখনো ভাগ্যকে গালি দেয়, আল্লাহকে দোষারোপ করে বা অস্বীকার করে, তাহলে সেও তখন হয়ে যাবে অকৃতকার্য।
আল্লাহ গরীবদেরক খাবার না দিয়ে পরীক্ষা করেন, আবার ধনীদেরকে খাবার দিয়ে পরীক্ষা করেন। আল্লাহর পরীক্ষায় ধৈর্য্যধারণ করাই হলো মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
5
সুনানে তিরমিযি শরীফের ২২৫৪ নং হাদীসে নবীজি সা. বলছেন,
عَنْ حُذَيْفَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” لاَ يَنْبَغِي لِلْمُؤْمِنِ أَنْ يُذِلَّ نَفْسَهُ ” . قَالُوا وَكَيْفَ يُذِلُّ نَفْسَهُ . قَالَ ” يَتَعَرَّضُ مِنَ الْبَلاَءِ لِمَا لاَ يُطِيقُ ”
হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন মু’মিন ব্যক্তির জন্য নিজেকে অপমানিত করাটা শোভনীয় নয়। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন, সে নিজেকে কিভাবে অপমানিত করে? তিনি বললেনঃ এমন কোন বালা-মুসিবতের সম্মুখীন হওয়া যা সহ্য করার সামর্থ্য তার নেই।
এ জন্য মুমিন ব্যক্তির উচিৎ আল্লাহর নিকট বালা মুসিবত থেকে রক্ষার দোয়া করা। আল্লাহর নিকট সবরের দোয়া করা।
মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর নিকট চাইবে আর আল্লাহ দিবেন না, এমনটা কখনোই হয় না। আল্লাহ তো বান্দাকে দেওয়ার জন্যই সদা প্রস্তুত।
তাহলে আমাদের আল্লাহর নিকট চাইতে সমস্যা কোথায়?