বাইয়াত কত প্রকার – বাইয়াতের গুরুত্ব ইসলামে অনেক বেশি। কালিমায়ে তাইয়্যেবা পড়ার মাধ্যমেই আল্লাহর আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে নেই।

আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে খালদুন রহ. (১৩৩২-১৪০৬ খ্রি./৭৩২-৮০৮ হি.) বলেন, বাইয়াত বা বাইআত মানে হলো আনুগত্যের উপর চুক্তি করা।

বাইয়াত বা বাইআত গ্রহণকারী তার আমীরের নিকট নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে ক্ষমতা সোপর্দ করবে। উক্ত বিষয়গুলোতে সে আমীরের বিরোধিতা করবে না।

কোনো বিষয়ে বাইয়াত করার পর আমির তাকে যা আদেশ করবে, তা বাইয়াতকারীর পালন করতে হবে। চাই তা পছন্দ হোক বা না হোক।

ইতিহাসের পাতায় বেশিরভাগ বাইয়াত দেখা যায় শাসনব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত থাকে। শাসক জনগণের থেকে শাসনকার্যের বাইয়াত নেয়।

কিন্তু ইসলামে এই বাইয়াতের নির্দিষ্ট প্রকারভেদ আছে। প্রতিটা প্রকার অনুযায়ী বাইয়াতের আনুগত্যও ভিন্ন ভিন্ন হয়।

ইসলামের উপর বাইয়াত

বাইয়াতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এটি। কাফের হওয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি এই বাইয়াত হতে মুক্ত হয়।

তবে অন্যান্য বাইয়াতগুলো কবিরা গুনাহ বা অবাধ্যতার কারণেও ভঙ্গ হতে পারে। সহীহ বুখারীর ২১৫৭ নং হাদীসে বর্ণিত আছে,

حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ عَبْدِ اللهِ حَدَّثَنَا سُفْيَانُ عَنْ إِسْمَاعِيلَ عَنْ قَيْسٍ سَمِعْتُ جَرِيرًا يَقُولُ بَايَعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَإِقَامِ الصَّلاَةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَالنُّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ

হযরত জারির ইবনে আবদিল্লাহ রা. হতে বর্ণিত, আমি রাসূল সা. এর হাতে এই মর্মে বাইয়াত গ্রহণ করেছি যে,

“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই আর মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল। এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমি নামাজ কায়েম করবো, প্রত্যেক মুসলমান ভাইয়ের কল্যান কামনা করবো।”

উপরোক্ত হাদীসে জারির রা. এর বাইয়াতটি দেখলেই ইসলাম উপর বাইয়াত সংক্রান্ত বিষয়টি পুরোপুরি বুঝে আসবে ইনশাল্লাহ।

সাহায্য করার উপর বাইয়াত

যেই বাইয়াতের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে সাহায্য করার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়, তাকে সাহায্য করার উপর বাইয়াত বলে।

এমন বাইয়াত হয়েছিল বাইয়াতে আকাবার ক্ষেত্রে। মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থের ১৫৭৯৮ নং হাদীসে সেই সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এ সময়ে রাসূল সা. মদীনার অধিবাসীদের থেকে এই মর্মে বাইয়াত নেন যে,

১. ভালোমন্দ সর্বাবস্থায় আমার কথা শুনবে এবং মানবে।

২. স্বচ্ছল-অস্বচ্ছল উভয় অবস্থাতেই ধন-সম্পদ ব্যয় করবে।

৩. সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে।

৪. আল্লাহর পথে উঠে দাঁড়াবে এবং আল্লাহর ব্যাপারে কারো ভয়-ভীতিতে পিছপা হবে না।

৫. তোমাদের নিকট গমনের পর আমাকে সাহায্য করবে এবং নিজেদের জীবন ও সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণের ন্যায় আমার রক্ষণাবেক্ষণ করবে। বিনিময়ে তোমাদের জন্য জান্নাত রয়েছে।

এ কথা শুনে কা’ব ইবনে মারুর নবীজি সা. এর হাত ধরে বললেন, ঠিক আছে। ওই সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য ধর্ম দিয়ে পাঠিয়েছেন।

আমরা অতি অবশ্যিই আপনাকে রক্ষা করবে ওই সকল অপছন্দনীয় বিষয় থেকে, যা থেকে আমরা নিজেদের রক্ষা করি।

জিহাদের উপর বাইয়াত

যখন শত্রুপক্ষ মুসলমানদের উপর আক্রমণ করে, তখন শত্রুদের মোকাবেলার জন্য মুসলমানদের থেকে যেই বাইয়াত নেওয়া হয়, তাকে জিহাদের উপর বাইয়াত বলে।

জিহাদের উপর নবীজির জীবনে বাইয়াত ঘটেছিল হুদাইবিয়ার সময়ে। যা বাইয়াতে রেদওয়াত নামে পরিচিত। বিস্তারিত বিবরণ সীরাতের কিতাবে আছে।

হিজরতের উপর বাইয়াত

ইসলামের প্রথম যুগে হিজরত জন্য বাইয়াত করা হতো। যেমনটা সহীহ বুখারীর ৪৩০৫ নং হাদীসে রয়েছে।

عَمْرُوْ بْنُ خَالِدٍ حَدَّثَنَا زُهَيْرٌ حَدَّثَنَا عَاصِمٌ عَنْ أَبِيْ عُثْمَانَ قَالَ حَدَّثَنِيْ مُجَاشِعٌ قَالَ أَتَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم بِأَخِيْ بَعْدَ الْفَتْحِ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ جِئْتُكَ بِأَخِيْ لِتُبَايِعَهُ عَلَى الْهِجْرَةِ قَالَ ذَهَبَ أَهْلُ الْهِجْرَةِ بِمَا فِيْهَا فَقُلْتُ عَلَى أَيِّ شَيْءٍ تُبَايِعُهُ قَالَ أُبَايِعُهُ عَلَى الإِسْلَامِ وَالإِيْمَانِ وَالْجِهَادِ فَلَقِيْتُ مَعْبَدًا بَعْدُ وَكَانَ أَكْبَرَهُمَا فَسَأَلْتُهُ فَقَالَ صَدَقَ مُجَاشِعٌ.

মুজাশি‘ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের পর আমি আমার ভাই (মুজালিদ)-কে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বললাম,

হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার ভাইকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি যেন আপনি তার নিকট হতে হিজরত করার ব্যাপারে বাই‘আত গ্রহণ করেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (মক্কা বিজয়ের পূর্বে মক্কা থেকে মদিনা্য়) হিজরতকারীরা হিজরতের সমুদয় বারাকাত নিয়ে গেছে।

আমি বললাম, তা হলে কোন্ বিষয়ের উপর আপনি তার নিকট হতে বাই‘আত গ্রহণ করবেন? তিনি বললেন, আমি তাঁর নিকট হতে বাই‘আত গ্রহণ করব ইসলাম, ঈমান ও জিহাদের উপর।

[বর্ণনাকারী আবূ ‘উসমান (রাঃ) বলেছেন] পরে আমি আবূ মা‘বাদ (রাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি ছিলেন তাঁদের দু’ভাইয়ের মধ্যে বড়।

আমি তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, মুজাশি‘ (রাঃ) সত্যই বলেছেন।

আনুগত্যের উপর বাইয়াত

যখন কোনে ব্যক্তিকে মান্য করার উপর বাইয়াত করা হয়, তখন তাকে আনুগত্যের উপর বাইয়াত বলা হয়। খলিফা নির্বাচনের পর তার প্রতি এই বাইয়াতই করা হয়।

এ বিষয়ে সহীহ মুসলিমের ১৭০৯ নং হাদীসে বর্ণিত আছে।

حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ إِدْرِيسَ، عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيدٍ، وَعُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الْوَلِيدِ بْنِ عُبَادَةَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، قَالَ بَايَعْنَا رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِي الْعُسْرِ وَالْيُسْرِ وَالْمَنْشَطِ وَالْمَكْرَهِ وَعَلَى أَثَرَةٍ عَلَيْنَا وَعَلَى أَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ وَعَلَى أَنْ نَقُولَ بِالْحَقِّ أَيْنَمَا كُنَّا لاَ نَخَافُ فِي اللَّهِ لَوْمَةَ لاَئِمٍ

উবাদাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাতে বাই’আত হলাম এ মর্মে যে,

আমরা তার কথা শুনবো ও মানবো, সংকটের সময় ও স্বাচ্ছন্দ্যের সময়, খুশীর অবস্থায় ও অপছন্দের অবস্থায় এবং আমাদের উপর অন্যদেরকে প্রাধান্য দিলেও।

 এবং আরে এ মর্মে বাইয়াত করেছি যে, আমরা যোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্ব বরণ করে নিতে কোনরূপ কোন্দল করবো না।

আর এ মর্মে যে, আমরা যেখানেই থাকবো হক কথা বলব। আল্লাহর ব্যাপারে কোন ভৎসনাকারীর ভৎসনাকে ভয় করবো না।

অন্যান্য বাইয়াত

বাইয়াত কত প্রকার এই প্রশ্নে উপরোক্ত বাইয়াতগুলো ছাড়াও আরো বেশ কিছু বাইয়াত হতে পারে।

যথা: অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার উপর বাইয়াত। এ সমর্কে মুসলিমের ১৭০৯ নং হাদীসে বলা হয়েছে।

হক কথা বলার উপর বাইয়াত হতে পারে। এমনটাও মুসলিম শরীফের ১৭০৯ নং হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

প্রত্যেক মুসলমানের কল্যান কামনা করার বাইয়াত। এটা বুখারীর ২১৫৭ নং হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

মুসলিম খলিফা নির্ধারণের পদ্ধতি

মুসলিম খলিফা নির্ধারণ করার পর তার নিকট যেই বাইয়াতটি করা হয়, সেটি হলো আনুগত্যের উপর বাইয়াত করা।

তবে এখানে মুসলিম খলিফা কিভাবে নির্বাচন হবে, এটা নিয়েও আলাপ আছে। প্রখ্যাত ইমাম মুহাম্মাদ বিন হাবিব আল মাওয়ারদি রহ. (৯৭২-১০৫৮ খ্রি.) বলেন,

যখন গণ্যমান্য ব্যক্তিরা একত্র হবেন তখন তারা নিজেদের মধ্য থেকে নেতৃত্বের উপযোগী ব্যক্তিদের মাঝে নেতৃত্বের শর্ত ও গুণাবলি যাছাই করবেন।

তারপর তাদের মধ্য হতে গুণাবলীর দিক হতে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে পেশ করবেন। লোকজন তার আনুগত্য গ্রহণ করবে।

এভাবেই বাইয়াতের মাধ্যমে তিনি খলিফা হবেন। যদি তিনি খলিফা হতে অস্বীকৃতি জানান তাহলে উনার পরে যিনি সবচেয়ে উত্তম তার হাতে বাইয়াত হবে।

গণ্যমান্য, জ্ঞানী, অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আলোচনা করে যাকে খলিফা হিসেবে নির্ধারণ করবেন, সাধারণ মানুষের জন্য তখন উক্ত ব্যক্তির উপর বাইয়াত করা অপরিহার্য।

খিলাফত ব্যবস্থা আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে এখানেই হলো মুল বিরোধ যে, গণতন্ত্রে চোর-বাটপার, শিক্ষিত, অভিজ্ঞ, লম্পট, নারীলোভী, মদখোর, ঘুষখোর, ধর্ষক, নির্যাতনকারীর মূল্যায়ন (ভোট) সমান।

কিন্তু খেলাফত ব্যবস্থায় শিক্ষিত, অভিজ্ঞ, গণ্যমান্য ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো মতামত গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো কাফের তো দূরের কথা, কোনো ফাসেকের মতামতও গ্রহণযোগ্য নয়।

তথ্যসুত্র

ইসলামি রাস্ট্রব্যবস্থা। বিচারপতি শাইখ আব্দুল হাকিম হককানি। দারুল ইলম। পৃষ্ঠা ৮৯-৯১

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া। ‍পৃষ্ঠা ১৫২

Scroll to Top