আবিসিনিয়ায় হিজরত- মক্কায় মুসলমানরা কাফেরদের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য বাদশাহ নাজ্জাশীর দেশে তথা হাবশায় হিজরত করে।

প্রায় ৮০ এর অধিক সাহাবী তখন হাবশায় হিজরত করেছিলেন। মক্কার কাফেররা যখন দেখতে পেল, মুসলমানরা তো তাদের নাগালের বাহিরে চলে যাচ্ছে তখন তারা নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করলো।

মুসলমানরা আবিসিনিয়ায় হিজরত করার পর কাফেররা কুরাইশদের মধ্য হতে বাগ্মী ও বাকপটু ব্যক্তিদের নাজ্জাশির নিকট পাঠানোর চিন্তা করলো।

বহু আলোচনার পর তারা আমর ইবনে আস এবং আব্দুল্লাহ ইবনে রাবিয়াকে তারা হাবশার বাদশাহর নিকট পাঠানোর মনস্থ করলো।

এ দুজন তখনো মুসলমান হন নি। তারা উভয়ে ছিলেন যথেষ্ঠ বুদ্ধিমান ও বাকপটু ব্যক্তি।

মক্কার কাফেররা হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশির নিকট বহু উপহার প্রেরণ করলো। উক্ত দুইজন বাদশাহর সাথে দেখা করে বললো,

হে বাদশাহ! আপনার দেশে আমার দেশ হতে কিছু ধর্মত্যাগী নির্বোধ ব্যক্তিরা পালিয়ে এসেছে। তারা স্বজাতির ধর্ম পরিত্যাগ করেছে।

তারা আপনাদের খৃস্টান ধর্মও গ্রহণ করে নি। বরং নতুন এক অদ্ভুত ধর্ম গ্রহণ করেছে। যে ধর্ম সম্পর্কে আপনি অবগত নন, আমরাও অবগত নই।

তাই তাদের পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন তাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদেরকে প্রেরণ করেছেন। তারা চান, আপনি তাদেরকে আমাদের নিকট ফিরিয়ে দিবেন।

বাদশাহ নাজ্জাশি একপক্ষের কথা শোনে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন মনে করেন নি। তিনি উক্ত মুসলমানদেরকে রাজ-দরবারে ডেকে আনলেন।

বাদশাহ নাজ্জাশির দরবারে মুসলমানরা

মুসলমানরা বাদশাহর দরবারে আসার পর বাদশাহ তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা যেই ধর্ম-বিশ্বাসের কারণে স্ব-জাতির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছ, সেটি কি?

মুসলমানদের মধ্য হতে হযরত জাফর বিন আবু তালিব রা. বললেন, হে বাদশাহ! আমরা ছিলাম মূর্তিপূজায় লিপ্ত একটি জাতি। আমরা মৃত পশুর গোশত ভক্ষণ করতাম, প্রতিবেশীদের সাথে রুক্ষ আচরণ করতাম, আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম। আমাদের মধ্যে সবলরা দুর্বলদের উপর অত্যাচার করতো। আমাদের এমন অবস্থার মাঝে আল্লাহ আমাদের নিকট একজন রাসূল প্রেরণ করলেন। তার উচ্চ বংশমর্যাদা, সচ্চরিত্রতা, আমানতদারি ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে আমরা পূর্ব থেকেই অবগত। তিনি আমাদেরকে এক আল্লাহর পথে আহবান করেন। তিনি আমাদেরকে এক আল্লাহর আনুগত্য করতে বললেন, মূর্তিপূজা ত্যাগ করতে বললেন। আমাদেরকে সত্য বলতে আদেশ করলেন। আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে ও প্রতিবেশির সাথে রুক্ষ আচরণ করতে নিষেধ করলেন। তিনি আমাদেরকে পাপ কাজ হতে ও রক্তপাত হতে বিরত থাকতে বললেন। ……………..

তখন বাদশাহ নাজ্জাশি জাফর রা. কে বললেন, তোমাদের রাসূল যেই গ্রন্থ এনেছে, তা থেকে আমাকে একটু পড়ে শোনাও তো দেখি।

হযরত জাফর বিন আবু তালেব রা. তখন সূরা মারয়াম থেকে কয়েক আয়াত তেলওয়াত করলেন। কুরআন তেলওয়াত শুনে বাদশাহর মন পরিবর্তন হয়ে গেল।

তিনি অঝোরে ক্রন্দন করতে লাগলেন। বাদশাহর দরবারে থাকা ধর্ম পোপরাও ক্রন্দন করতে লাগলো। বাদশাহ নাজ্জাশি তখন বললেন,

এই বাণী এবং মুসা আ. এর বাণী একই উৎস থেকে এসেছে। এরপর নাজ্জাশী আমর ইবনে আস ও আব্দুল্লাহ ইবনে রবিয়াকে বললেন,

তোমরা মক্কায় ফিরে যাও। আমি এই ব্যক্তিদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দেব না।

এছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের কোনো ষড়যন্ত্রও সহ্য করবো না।

কুরাইশদের নতুন ষড়যন্ত্র

বাদশাহর নির্দেশের পর কুরাইশরা দরবার থেকে বের হয়ে এলো। আমর ইবনে আস তখন বললেন,

আমি আগামীকাল তাদের বিরুদ্ধে এমন কথা বলবো, যাতে বাদশাহ তাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে রাবিয়া তখন বললেন, থাকুক না এসব কাজ। যদিও তারা আমাদের বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করেছে, কিন্তু এরপরও তারা তো আমাদের গোত্রেরই লোক।

কিন্তু আমর ইবনে আস তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। পরেরদিন আমর ইবনে আস আবার বাদশাহ নাজ্জাশীর দরবারে হাজির হলেন।

বাদশাহ তাকে দেখে বললেন, কি ব্যাপার আবার এসেছ কেন?

আমর ইবনে আস বললেন, মহামান্য বাদশাহ! উক্ত মুসলমানরা আপনাদের নবী ঈসা আ. কে আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করে না। এছাড়াও তারা আপনাদের ধর্মবিশ্বাসকেও অসার ভাবে।

বাদশাহ নাজ্জাশি তখন পূনরায় মুসলমানদেরকে রাজ-দরবারে তলব করলেন। মুসলমানরা আসার পর বাদশাহ নাজ্জাশি তাদেরকে ঈসা আ. সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন।

মুসলমানরা তখন খানিকটা ভয় পেলেও নিজেদের গুছিয়ে নেন এবং আল্লাহর উপর ভরসা করেন। বাদশাহর প্রশ্নের জবাবে হযরত জাফর বিন আবি তালিব রা. বললেন,

হযরত ঈসা আ. সম্পর্কে আমরা সেই কথাই বলে থাকি, যা আমাদেরকে আমাদের নবী মুহাম্মাদ সা. শিক্ষা দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, হযরত ঈসা আ. হলেন আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল এবং তার রুহ ও তার কালিমা। তাকে আল্লাহ কুমারী হযরত মরিয়মের উপর ন্যস্ত করেছেন।

এ কথা শুনে বাদশাহ নাজ্জাশী বললেন, তোমরা যা বলেছ হযরত ঈসা আ. এর চেয়ে বেশি কিছু ছিলেন না। এ কথা শুনে উপস্থিত পোপরা বিরক্তির সাথে হুঁ হুঁ বলতে লাগলো।

বাদশাহ নাজ্জাশি তখন তাদেরকে বললেন, তোমরা হুঁ হুঁ বললেও আমি যা বলেছি, এটাই সত্য। এর বাহিরে তিনি কিছু ছিলেন না।

নাজ্জাশির নিকট মুসলমানদের সম্মানজনক অবস্থান

এরপর বাদশাহ নাজ্জাশি আবিসিনিয়ায় হিজরত করে আসা মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা আমাদের দেশে সম্পূর্ণ নিরাপদ। তোমাদেরকে যে গালি দিবে তাদেরকে জরিমানা করা হবে।

বাদশাহ নাজ্জাশী তখন তার ভৃত্যদেরকে বললেন, মক্কার কুরাইশরা যেই উপহার পাঠিয়েছে তা তাদেরকে ফিরিয়ে দাও। সেগুলো আমার দরকার নেই।

এর মাধ্যমে মক্কার কুরাইশদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলো। তারা দ্বীনকে নিভিয়ে দিতে চাইলেও আল্লাহ তা হতে দেন নি।

তথ্যসুত্র

আর রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ১০৩-১০৫

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৩৫-১৪৫

বিশ্বনবী, ১২৭-১৩০

Scroll to Top