কুরাইশ কাফেররা যখন দেখলো, কোনোভাবেই নবীজিকে থামানো যাচ্ছে না, তার ইসলাম প্রচারের কাজ দিন দিন বেড়ে চলছে, তখন তারা নবীজিকে বয়কট করতে চাইলো।

নবীজির চাচা আবু তালেব তার ভাতিজা মুহাম্মাদ সা. এর বিষয়ে শঙ্কিত ছিলেন। কারণ, কুরাইশরা তাকে হত্যা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

পূর্বে ওলীদের ছেলের বদলে নবীজিকে হত্যার প্রস্তাব, এর আগে আবু জাহলের নবীজির মাথায় পাথর নিক্ষেপ করে হত্যাচেষ্টাসহ আরো বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল।

এমন নাজুক পরিস্থিতিতে আবু তালেব দুইটি বিশেষ গোত্র বনু হাশেম ও বনু আব্দুল মুত্তালিবকে একস্থানে সমাবেত করলেন।

এরপর তিনি তাদেরকে আবেগজড়িত কণ্ঠে আহবান করলেন, এতদিন তো আমি একা মুহাম্মাদের দায়িত্ব পালন করেছি।

এখন এসো আমরা সকলে মিলে এই দায়িত্ব পালন করি। তার এই আহবানে সকলে সাড়া দিল। শুধুমাত্র আবু লাহাব ব্যতিত।

সে গিয়ে কাফেরদের সাথে মিলিত হলো।

ভয়ঙ্কর বয়কটের মুখে নবীজি

মক্কার কাফেররা রাসূল সা. কে হত্যা করতে অস্থির হয়ে পড়লো। এমন মুহুর্তে বনু হাশেম ও বনু আব্দুল মুত্তালিব তাকে রক্ষার জন্য একত্রিত হলেন।

যেহেতু মুহাম্মাদকে হত্যা করবে মক্কায় বড় একটি যুদ্ধ-বিগ্রহ শুরু হবে, তাই তারা ভেবে-চিন্তে নতুন এক ধরনের পথ বের করলো।

তারা রাসূল সা. কে হত্যার বদলে তাকে ও মুসলমানদের উপর যুলুম নির্যাতন করার পথ বেঁছে নিল। এরপর তারা নবীজিকে বয়কট করে একটি দলীল লিখলো।

এটি বোগাইজ ইবনে আমের ইবনে হাশেম লিখেছিল। রাসূল সা. মনোকষ্টে তার জন্য বদদোয়া করেন। এতে তার হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল।

এই দলীলটি এরপর কা’বাগৃহে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়।

তাতে আবু লাহাব ব্যতিত মুসলমানরা, বনু হাশেম ও বনু আব্দুল মুত্তালিবের নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, মুসলিম-অমুসলিম সবােই শিয়াবে আবু তালিব নামক স্থানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন।

শিয়াবে আবি তালিবে বন্দি

নবুয়তের সপ্তম বর্ষে এই ঘটনা ঘটে। কাফেরদের এই বয়কটে পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠলো। মক্কার কাফেররা শিয়াবে আবি তালিবে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিল।

মক্কায় বাহির থেকে যেসব খাদ্য-দ্রব্য আসতো সাথে সাথে মূর্তিপূজক কাফেররা তা কিনে নিত। ফলে অবরুদ্ধদের কাছে কোনো খাদ্য পৌঁছাতো না।

তারা অনাহারে বৃক্ষপত্র ও চামড়া খেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকতেন। ক্ষুধার যন্ত্রণা এতটাই মারাত্মক ছিল যে, শিয়াবে আবু তালিবের বাহির থেকে তাদের ক্রন্দন শোনা যেত।

বাহির থেকে সেখানে কেউ খাদ্য-দ্রব্য পৌঁছাতে পারতেন না। কেউ চেষ্টা করলে মক্কার কাফেররা তাকে বাধা প্রদান করতো।

নিষিদ্ধ চার মাস তথা জিলকদ, জিলহজ, মহরম, রজব মাসগুলোতে শুধু অবরোধ উঠানো হতো।

এসময়ে তারা যতুটুকু খাদ্য মজুদ করতে পারতেন তা দিয়েই সারা বছর চলতে হতো।

নবীজির অবরুদ্ধ দিনগুলো

নবীজিকে বয়কট করার সময়টাতে নবীজি সা. এর চাচা আবু তালিব সর্বদা রাসূল সা. কে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। রাতে তিনি সকলকে শুয়ে পড়ার পর নবীজিকে বলতেন, যাও শুয়ে পড়ো।

তিনি একথা এজন্য বলতেন, যদি কোনো আততায়ী এখানে থাকে, তাহলে যেন সে জানতে পারে, কোথায় নবীজি শুয়েছেন?

এরপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নবীজিকে উক্ত স্থান হতে উঠিয়ে সেখানে নিজের কোনো ছেলে বা ভাইকে শোয়াতেন। যাতে আক্রমণ হলে নবীজির উপর না হয়।

যেহেতু জিলহজ মাসে অবরোধ থাকতো না, তাই এ সময়টাতে নবীজি হজের উদ্দেশ্যে আসা লোকদেরকে ইসলামের বাণী শোনাতেন।

এভাবে তিন বছর অতিবাহিত হয়। নবুয়তের দশম বর্ষের মহরম মাসে অলৌকিকভাবে এই অবরোধ থেকে আল্লাহ মুক্তিদান করেন।

মক্কায় তখন কাফেরদের মধ্যেও কিছু ভালো লোক ছিল। যারা নবীজি সা. এর এই অবরোধ পছন্দ করতেন না।

তাদের মধ্যে একজন হলেন হিশাম ইবনে আমের।

হিশাম ইবনে আমের ছিলেন বনু আমের গোত্রের লোক। হিশাম রাতের বেলায় চুপিসারে শিয়াবে আবি তালিবে প্রেরণ করতেন।

হিশাম ইবনে আমের একদিন যুহাইর ইবনে আবু উমাইয়া মাখজুমির সাথে সাক্ষাৎ করেন। যুহাইরের মা আতেকা ছিলেন আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা।

তখন হিশাম তাকে বললেন, হে যুহাইর! তুমি কি চাও তোমরা মজা করে পানাহার করবা অথচ তোমার মামা ও অন্যরা ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে?

তারা কেমন অসহায় অবস্থায় আছে, সে বিষয়ে কি তুমি অবগত নও? যুহাইর তখন বললেন, আফসোস! কিন্তু আমি একা কি করতে পারি তাদের জন্য?

হিশাম তখন বললেন, চিন্তা করো না। আমিও তোমার সাথে আছি। যুহাইর তখন বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তবে তৃতীয় আরেকজনকে তালাশ করো।

একথা শোনার পর হিশাম ইবনে আমের মোতয়েম ইবনে আদীর নিকট গমন করে।

তার নিকট বনু হাশেম ও বনু আব্দুল মুত্তালিবের  ‍দুরবস্থার কথা তুলে ধরে সাহায্য চাইলেন।

মোতয়েম তখন বললো, আমি একা কিভাবে তাদের সাহায্য করতে পারি?

হিশাম বললো, চিন্তা করো না। আরো একজন আছেন।

মোতয়েম বললো, কে সে? হিশাম তখন তাকে যুহাইর ও নিজের কথা বললেন। মোতয়েম তখন বললো, আচ্ছা তবে চতুর্থ কাউকে তালাশ করো।

নবীজির বয়কট থেকে মুক্তিলাভ

এরপর হিশাম জাময়া ইবনে আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিবের নিকট সাহায্য চাইলেন। তার সাথেও অনুরূপ কথাবার্তা হলো।

উপরোক্ত এই চারজন (হিশাম, যুহাইর, মোতয়েম, জাময়া) শিয়াবে আবু তালিবের বিরুদ্ধে লেখা দলীল বিনষ্ট করার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন।

পরদিন সকলে যথারীতি কা’বার চত্বরে এসে আম মসলিসে বললো। যুহাইর দামী পোশাক পড়ে সেখানে হাজির হলো।

প্রথমে সে কা’বা সাতবার তাওয়াফ করে সকলকে সম্বোধন করে বললো, হে মক্কাবাসীরা শোনো! আমরা খাব, পান করবো, পোশাক পরবো আর বনু হাশেম ধ্বংস হয়ে যাবে।

তাদের নিকট কিছুই বিক্রি করা হচ্ছে না, তাদের থেকে কিছু খরিদও করা হচ্ছে না। আল্লাহর কসম! এই অমানবিক দলীলের ব্যাপারে আমি নীরব থাকতে পারি না।

আবু জাহল তখন বললো, তুমি ভুল বলছো। আল্লাহর কসম! এই দলীল ছিন্ন করা যাবে না।

জায়মা ইবনে আসওয়াদ তখন বললেন, এই আবু জাহল! তুমি ভুল বলছো। এই দলীল লেখার সময় আমরা সম্মত ছিলাম না।

এরপর মোতয়েম ইবনে আদী বললেন, তাদের কথা ঠিক আছে। এই দলীল থেকে আমরা আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। হিশাম ইবনে আমরও এমন কথা বললেন।

এ অবস্থা দেখে আবু জাহল বললো, আচ্ছা বুঝেছি। তোমরা আগেই পরামর্শ করে এসেছ।

সে সময় আবু তালিব অদূরে ছিলেন। নবীজি সা. তাকে জানিয়েছিলেন, আল্লাহ দলীল বিনষ্ট করতে একরকম পোকা পাঠিয়েছেন।

সেই পোকা বিসমিল্লাহ বাদে বাকী লেখা কেটে ফেলেছে। আবু তালিব তখন কুরাইশদেরকে বললেন, আমার ভাতিজা আমাকে বলেছে যে,

আল্লাহ তাকে জানিয়েছেন, এই দলীলকে পোকা কেটে ফেলেছে। শুধুমাত্র আল্লাহর নাম অবশিষ্ঠ আছে। এটা যদি মিথ্যা হয়, তাহলে আমি তার থেকে সরে যাব।

তখন মুতয়াম বিন আদি দলীল দেখতে গিয়ে দেখেন, দলীলটি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। শুধু আল্লাহর নাম বাকী আছে। এভাবেই নবীজিকে বয়কট করার অবসান হলো।

নবীজি সা. ও বনু হাশেম ও বনু আব্দুল মুত্তালিব শিয়াবে আবু তালিব থেকে বের হয়ে আসলেন। এত বড় মোজেজা দেখার পরও কাফেরদের অন্তরে কোনো পরিবর্তন আসলো না।

তথ্যসুত্র

আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ১১৭-১২০

Scroll to Top