ঘুম নিয়ে অবহেলা কেন?

এককালে মানুষ রাত ৮টা বা ৯টার মধ্যে ঘুমিয়ে যেত। কিন্তু এখন স্মার্টফোন আর আধুনিকতার ছড়াছড়িতে আমাদের ঘুমাতে ঘুমাতে প্রায় ১২টা বা ১টা বেজে যায়। বর্তমানে আমাদের ঘুম নিয়ে এমন অবহেলা কেন? প্রশ্নের উত্তরটা খুব সহজ। এককথায় স্ক্রীনটাইম হলো মূল সমস্যা।

আগে যখন স্মার্টফোনের এত ছড়াছড়ি ছিল না, ইন্টারনেটের অবাধ সুবিধা ছিল না, তখন মানুষ সর্বোচ্চ ১০টা বা ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে যেত।

যুগ বদলেছে। মানুষের অভ্যাসও বদলেছে। কেউ কেউ আবার এককাঠি সরেষ! তারা ঘুমায় রাত ৩টা, ৪টা কিংবা ফজরের আযান হলে।

আমরা যদিও এটাতে তেমন গুরুত্ব দেই না। কিন্তু এর দ্বারা আমরা আস্তে আস্তে নিজেদের বিপদ ডেকে আনছি। যা বুঝতেও পারছি না।

মানুষের প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট পরিমান ঘুমের দরকার হয়।

যদি কেউ সেই নির্দিষ্ট পরিমান না ঘুমায়, তাহলে তার মাঝে অস্থিরতা, উদ্বিগ্নতা, অবসাদ ফুটে উঠে।

এছাড়াও তার চিন্তা-ভাবনা এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হতে পারে। আত্মহত্যার মতো জঘন্য চিন্তাও মাথায় আসে।

আমরা দেখতে পাই, একটি শিশু জন্মের পরের সময়টাতে দৈনিক ১৮-২২ ঘন্টা ঘুমিয়েই কাঁটায়।

তার ঘুম ভেঙ্গে গেলে কেঁদে ঘর-বাড়ি অস্থির করে তুলে। [1]

ঘুমের ধাপগুলো কি কি? – ঘুম নিয়ে অবহেলা কেন?

গবেষণায় ঘুমের পর্যায়গুলো দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এটি সাধারণত ৯০-১১০ মিনিটের চক্র হয়ে থাকে।

নন-রেম ঘুম হলো প্রতিটি সাইকেলে বা চক্রে ৭৫-৮০% সময় নিয়ে থাকে।

নন-রেম ঘুমের তিনটি ধাপ হলো,

১. ঘুমের একেবারে প্রাথমিক স্থর। এটির স্থায়িত্ব ১-৫ মিনিট। এই ধাপে আমরা আধো ঘুম আধো জাগরণে থাকি। সহজেই আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে।

২. এটির স্থর ১০-৬০ মিনিট। এই ধাপে শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রকৃতি এবং হৃৎপিণ্ডের গতি স্থিমিত হয়ে আসে।

৩. এই ধাপে মস্তিষ্ক থেকে ডেল্টা তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃৎপিণ্ডের গতি একেবারে নিচে নেমে আসে। এ পর্যায়ে আমরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকি। এটির স্থায়িত্বকাল ২০-৪০ মিনিট।

এরপর ঘুমের আরেকটি ভাগকে বলা হয় রেম ঘুম। [2] অর্থাৎ এতে চোখ নড়াচড়া করে।

ঘুমিয়ে পড়ার ৭০-৯০ মিনিট পর রেম ঘুমের প্রথম পর্যায়টি শুরু হয়। এর স্থায়িত্বকাল ১০-৬০ মিনিট।

এ সময়ে আমরা সচেতন না থাকলেও মস্তিষ্ক ঠিকই সচেতন থাকে। [3]

এই রেম ঘুমের সময়টাতেই আমরা স্বপ্ন দেখি। তখন আমাদের চোখ নড়াচড়া করে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস ও রক্তচাপ বেড়ে যায়।

স্লিপ সাইকেল – ঘুম নিয়ে অবহেলা কেন?

উপরের ধাপগুলোকে স্লিপ সাইকেল বা ঘুমের পরিক্রমাও বলতে পারি আমরা।

আপনি যদি ঘুমের পরিক্রমার মাঝে জেগে উঠেন, তাহলে শরীরে আরো বেশি ক্লান্তি ধরবে।

একটা বিরক্তিকর ভাব চোখে মুখে ফুঁটে উঠবে। এখন কথা হতে পারে, স্লিপ সাইকেলের হিসাব কিভাবে করবো?

ঘুম বিষয়ক গবেষকদের অনুমান অনুযায়ী, বেশিরভাগ মানুষের স্লিপ সাইকেল বা ঘুমের পরিক্রমা গড়ে ৯০ মিনিট হবে।

এই বিষয়টা উদাহরণসহ আরো ভালোভাবে বুঝা যাবে।

কোনো ব্যক্তি যদি রাত ১০টায় ঘুমায় এবং ভোর ৫টায় জাগতে চায়, তাহলে তার ঘুমের সাইকেলটা আমরা নির্ণয় করতে পারি।

রাত ১০টা থেকে ১১:৩০ = ১ম স্লিপ সাইকেল
১১:৩০ থেকে রাত ০১:০০ = ২য় স্লিপ সাইকেল
রাত ০১:০০টা থেকে ০২:৩০ = ৩য় স্লিপ সাইকেল
০২:৩০ থেকে রাত ০৪টা পর্যন্ত = ৪র্থ স্লিপ সাইকেল

এখানে রাত ৫টা পর্যন্ত স্লিপ সাইকেল আসছে না। এর জন্য ৫:৩০ এ উঠতে হবে।

এতে ফজরের নামাজ কাযা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। [4]

এখন বাড়তি এই আধ ঘন্টা বা ১ ঘন্টা আপনি নামাজ, তসবিহ, কুরআন তেলওয়াত কিংবা বই পড়ে কাঁটাতে পারেন।

ঘুমের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য

আপনি যদি সঠিক স্লিপ সাইকেল বা ঘুমের পরিক্রমা অনুযায়ী ভোরে ঘুম থেকে উঠেন, তাহলে হাতে কিছু বাড়তি সময় পাওয়া যাবে।

উক্ত সময়টাতে তাহাজ্জুত নামাজ, তসবিহ, কুরআন তেলওয়াতআল্লাহর নিকট দোয়া করতে পারেন। শেষ রাতের এই সময়টা আল্লাহর নিকট অনেক দামী।

ঘুমের ব্যাপারে ইসলাম কি বলে বা এতে ধর্মীয়ভাবে কোনো তাৎপর্য বলা হয়েছে কিনা, তা আমাদের জানা উচিৎ।

কুরআনে (نوم) বা ঘুম শব্দটি ৩বার উল্লেখ আছে।

আয়াতুল কুরসীতে (সূরা বাকারা, আয়াত ২৫৫) আল্লাহ বলেন,

اَللّٰهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَۚ اَلۡحَیُّ الۡقَیُّوۡمُ ۬ۚ لَا تَاۡخُذُهٗ سِنَۃٌ وَّ لَا نَوۡمٌ ؕ لَهٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ مَنۡ ذَا الَّذِیۡ یَشۡفَعُ عِنۡدَهٗۤ اِلَّا بِاِذۡنِهٖ ؕ یَعۡلَمُ مَا بَیۡنَ اَیۡدِیۡهِمۡ وَ مَا خَلۡفَهُمۡ ۚ وَ لَا یُحِیۡطُوۡنَ بِشَیۡءٍ مِّنۡ عِلۡمِهٖۤ اِلَّا بِمَا شَآءَ ۚ وَسِعَ کُرۡسِیُّهُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ ۚ وَ لَا یَـُٔوۡدُهٗ حِفۡظُهُمَا ۚ وَ هُوَ الۡعَلِیُّ الۡعَظِیۡمُ

আল্লাহ হলেন তিনি, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি চিরঞ্জীব ও সর্বদা রক্ষণাবেক্ষণকারী। তন্দ্রা ও ঘুম তাঁকে স্পর্শ করে না। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু রয়েছে সবকিছুই তাঁর। কে আছে এমন, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে? সামনের অথবা পেছনের সবকিছু সম্পর্কেই তিনি পূর্ণ অবগত আছেন। একমাত্র তিনি যতটুকু ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত কেউই তাঁর জ্ঞানের কিছুই নিজের আয়ত্ত করতে পারে না। তাঁর কুরসী আকাশ ও যমীন পরিবেষ্টন করে আছে এবং এগুলোর সংরক্ষণ করা তাঁকে ক্লান্ত করে না। তিনিই সর্বোচ্চ এবং মহীয়ান।

আল্লাহ এই আয়াতে নিজের যেসব গুণের কথা বর্ণনা করেছেন, তার মধ্যে একটি হলো – তন্দ্রা বা ঘুম তাকে স্পর্শ করতে পারে না।

কুরআনের সূরা নাবা এর ৯ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ঘুমকে উল্লেখ করেছেন আমাদের জন্য নেয়ামত হিসেবে। তিনি বলেন,

وَّ جَعَلۡنَا نَوۡمَکُمۡ سُبَاتًا

আমি তোমাদের (জন্য) নিদ্রাকে করে দিয়েছি বিশ্রাম স্বরূপ।

এর দ্বারা আমরা বুঝতে পারি, ঘুম আমাদের জন্য কোনো বিরক্তিকর কাজ নয়।

কিংবা কোনো দুর্বলতা নয়। বরং এটি স্রষ্টার পক্ষ হতে দেওয়া বিশ্রাম।

এছাড়াও ঘুম হলো মুসলমানদের জন্য একটি মৃত্যুর সতর্কবার্তা। কুরআনের সূরা যুমার এর ৪২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,

اَللّٰهُ یَتَوَفَّی الۡاَنۡفُسَ حِیۡنَ مَوۡتِهَا وَ الَّتِیۡ لَمۡ تَمُتۡ فِیۡ مَنَامِهَا ۚ فَیُمۡسِکُ الَّتِیۡ قَضٰی عَلَیۡهَا الۡمَوۡتَ وَ یُرۡسِلُ الۡاُخۡرٰۤی اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ

আল্লাহ জীবসমূহের প্রাণ হরণ করেন তাদের মৃত্যুর সময় এবং যারা মরে নি তাদের নিদ্রার সময়। তারপর যার জন্য তিনি মৃত্যুর ফয়সালা করেন তার প্রাণ তিনি রেখে দেন এবং অন্যগুলো ফিরিয়ে দেন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল জাতির জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে!

সুতরাং প্রতিটা ঘুম থেকে জেগে উঠা মানে আমাদের প্রাণকে আল্লাহ ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমাদেরকে আরো কিছু সুযোগ তিনি দিয়েছেন।

পাওয়ার ন্যাপের শক্তি

ন্যাপ বলা হয় হালকা তন্দ্রাকে। বাংলাদেশে দুপুরবেলা আমরা যেই ঘুমটা দেই, সেটা ধরা যায়। এটি ভাতঘুম নামেও পরিচিত।

বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, যদি কেউ ন্যাপিং তথা ভাতঘুম দিতে চায় তাহলে দুপুর খাবার খেয়ে ৩টার আগে ঘুমানো উচিৎ।

আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, ভাতঘুমের ফলে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চনমনে থাকে।

একটি গবেষণায় এসেছে, ৩০ মিনিটের ন্যাপেং ৩৪% কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ১০০% সজীবতা আনে।

আরো একটি পর্যবেক্ষণ সমীক্ষায় দেখা গেছে, সপ্তাহে এক বা দুইবার ভাতঘুম দিলে কার্ডিওভাসকুলার [5] সমস্যার ঝুঁকি কমে। যেমন হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা হৃদরোগ।

ভাতঘুম বা ন্যাপিং ২০ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট হতে পারে। এর বেশি হলে অবশ্যই ৯০ মিনিটের কাছাকাছি যেতে হবে। যাতে এক সাইকেল পূর্ণ হয়।

অন্যথায় মাথা ব্যাথা, মাথা ধরা, ঝিমুনি, বিরক্তিভাব সহ নানান উপসর্গ দেখা দিতে পারে। [6]

চীনে একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ৯০ মিনিটের বেশি ভাতঘুম দিলে উচ্চ রক্তচাপের সাথে জড়িত সমস্যা হয় মধ্যবয়সী এবং বয়স্ক মহিলাদের মধ্যে।

একাধিক গবেষণার বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, দিনে ৬০ মিনিটের বেশি ঘুমালে Type 2 ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

তথ্যসুত্র

[1] সন্তান প্রতিপালনে এ যুগের চ্যালেঞ্জ, পৃষ্ঠা ৮০

[2] এ বিষয়ে বিস্তারিত দেখুন sleepfoundation.org ওয়েবসাইটের REM Sleep Revealed: Enhance Your Sleep Quality আর্টিকেলটি। এছাড়াও দেখুন en.wikipedia.org এর Rapid eye movement sleep আর্টিকেলটি।

[3] সন্তান প্রতিপালনে এ যুগের চ্যালেঞ্জ। পৃষ্ঠা ৮৩, প্রোডাক্টিভ মুসলিম। পৃষ্ঠা ১১৮

[4] প্রোডাক্টিভ মুসলিম। পৃষ্ঠা ১১৯

[5] কার্ডিওভাসকুলার মানে হলো, সংবহন তন্ত্র। এটি হৃৎপিণ্ড এবং রক্তনালী নিয়ে গঠিত। এর দুটি বিভাগ রয়েছে, এক, সিস্টেমিক সংবহন ও দুই, ফুসফুসীয় সংবহন। বিস্তারিত পড়ুন, সংবহন তন্ত্র উইকিপিডিয়া ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের রোগ।

[6] প্রোডাক্টিভ মুসলিম, পৃষ্ঠা ১২২-১২৪ । এছাড়াও বিস্তারিত ন্যাপিং সম্পর্কে দেখুন Napping: Benefits and Tips শিরোনামের sleepfoundation.org ওয়েবসাইটের আর্টিকেলটি।

Scroll to Top