ফিঙ্গারপ্রিন্ট আবিষ্কার

ফিঙ্গারপ্রিন্ট আবিষ্কার – ১৮৯২ সালে বেঙ্গল পুলিশের মহাপরিদর্শক এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি একটি চিঠি পাঠালেন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপালের নিকট।

সেখানে তিনি বললেন, পরিসংখ্যানে খুব ভালো এমন ছাত্র যেন তার নিকট পাঠানো হয়। তার অধীনে তাদেরকে পুলিশ বাহিনীতে চাকরি দেয়া হবে।

চিঠি পেয়েই প্রিন্সিপাল ঝটপট আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বসু নামে দুজন শিক্ষার্থীর ব্যাপারে সুপারিশ করলেন। ফলে স্যার হেনরির মাধ্যমে পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর হিসেবে চাকরি পেয়ে গেলেন আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র।

অপরাধী শনাক্ত করতে গবেষণা

হাতের রেখা ও আঙুলের ছাপ নিয়ে আলোচনা-গবেষণা ইত্যাদি শুরু হয় ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে। কিন্তু এর মাধ্যমে কাউকে শনাক্ত করা যেতে পারে, এমন ধারণা কিন্তু মাত্র দেড় শ বছর আগে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

অবিভক্ত বাংলায় তখন অপরাধী শনাক্ত করার হতো অ্যানথ্রোপমেট্রি (মানবদেহের আকৃতি) পদ্ধতিতে। হেনরি এই পদ্ধতিতে বেশ কিছু ত্রুটি দেখতে পান।

তিনি লক্ষ্য করেন, একজন লোকের দেহের মাপ বিভিন্ন হাতে এক ধরনের থাকে না। তাই তিনি ১৮৯৩ সালে অপরাধের সঙ্গে জড়িত লোকেদের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের ছাপ নেওয়ার নির্দেশ দেন।

এর বছর তিনেক পর তিনি ধরা পড়া প্রত্যেক অপরাধীর দুই হাতের ১০ আঙুলের ছাপ নেওয়া বাধ্যতামূলক করেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় আঙুলের ছাপ নেওয়া এসব কাগজপত্র ফাইলভুক্ত করা নিয়ে। এ কাজের জন্যই লোক দরকার হয় তার।

ফিঙ্গারপ্রিন্ট আবিষ্কার

ডাটা বিশ্লেষণ

স্যার হেনরি আজিজুল হক ও হেমচন্দ্রকে নিয়োগ দিয়েছিলেন মূলত এ কাজ করার জন্যই।

ফিঙ্গারপ্রিন্টের ‘হেনরি ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম’ তৈরি করার ভার দিলেন তিনি দুজনের ওপর।

আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র যখন কাজ শুরু করেন, তত দিনে সেখানে প্রায় সাত হাজার অপরাধীর আঙুলের ছাপ ও হাতের ছাপ সংরক্ষিত ছিল।

সেই ডেটাগুলো বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি তাঁরা দুজন স্যার হেনরির সঙ্গে একমত হন,

এটি সহজভাবে ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই একটি গাণিতিক সূত্র বের করতে হবে।

আঙুলের ছাপের শ্রেণীবিভাগ

তবে গাণিতিক পদ্ধতিতে যাওয়ার আগে তাঁরা এই সাত হাজার আঙুলের ছাপকে খিলান, বৃত্ত ও ঘূর্ণিতে ভাগ করেন।

আঙুলের ছাপের রকম

দেখতে পান, এগুলোর মধ্যে মাত্র ৫% খিলান, ৬০% চক্র ও ৩৫% ঘূর্ণি।

যেহেতু খিলানের সংখ্যা পরিসাংখ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, কাজেই তাঁরা সেটিকে ঘূর্ণির সঙ্গে একীভূত করে ফেললেন।

ফলে হাতের আঙুলের ছাপ হয়ে গেল দুই রকমের—চক্র ও ঘূর্ণি।

তারপর তাঁরা এদের চিহ্নিত করলেন যথাক্রমে L ও W হিসেবে। এরপর দুই হাতের ১০ আঙুলকে পাঁচটি জোড়ায় ভাগ করা হলো।

এ জন্য ছবিতে দেখানো পদ্ধতিতে তালু নিচে রেখে ডান হাতকে বাঁ দিকে ও তালু ওপরে রেখে বাঁ হাতকে ডানে বসানো হলো।

ছবিতে দেখানো পদ্ধতি জোড়া তৈরি করা হলো। জোড়া তৈরিকে এভাবে লেখা যায়।

এখন প্রথম জোড়া ডান তর্জনী ও ডান বৃদ্ধাঙ্গুলির যেকোনোটি চক্র (L) বা ঘূর্ণি (W) হতে পারে।

কাজেই মোট চার রকমের বিন্যাস আমরা দেখতে পাব।

১. ডান তর্জনী চক্র (L), ডান বৃদ্ধাঙ্গুলি ঘূর্ণি (W)

২. ডান তর্জনী ঘূর্ণি (W), ডান বৃদ্ধাঙ্গুলি চক্র (L)

৩. উভয়টি চক্র (L) এবং

৪ উভয়টি ঘূর্ণি (W)

একইভাবে বাকি চারটি জোড়াতেও এ রকম চারটি করে বিন্যাস হতে পারে। তার মানে, মোট পাঁচ জোড়াতে বিন্যাস হবে = 4×4×4×4×4=1024

1024 কে লেখা যায় 32×32 হিসাবে।

তার অর্থ হলো, আমরা যদি 32টি ক্যাবিনেটের প্রতিটিতে 32টি করে ফাইল রাখি,

তাহলে আমরা 1024 জন অপরাধীর তথ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারব।

এখন প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম জোড়াতে যদি কোনো ঘূর্ণি থাকে, তাহলে সেটির গাণিতিক মান হবে যথাক্রমে 16, 8, 4, 2 ও 1।

আর চক্রের বেলায় যা–ই থাকুক না কেন, সেটির গাণিতিক মান হবে 0।

আঙুলের ছাপ

উদাহরণস্বরুপ,

ধরা যাক, কোনো অপরাধীর ডান বৃদ্ধাঙ্গুলি, ডান অনামিকা, বাম মধ্যমা, বাম তর্জনী এবং বাম অনামিকাতে ঘূর্ণি আর অন্যগুলো চক্র।

এখন হরে ও লবে 1 যোগ করে আমরা চূড়ান্ত ফলাফল পেলাম, অর্থাৎ এই লোকের তথ্য পাওয়া যাবে ২০ নম্বর ক্যাবিনেটের ১১ নম্বর ফাইলে।

যদি সব আঙুলের ছাপই চক্র হয়, তাহলে এটির মান হবে 0/0।

যেহেতু শূন্য ক্যাবিনেট বা শূন্য ফাইল বলে কিছু নেই, তাই 1/1 যোগ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এ জন্য যে ব্যক্তির সব আঙুলেই চক্র, তার ছাপ থাকবে প্রথম ক্যাবিনেটের প্রথম ফাইলে।

আঙুলের ছাপের শ্রেণীকরণের এই প্রাথমিক পদ্ধতিকে ইচ্ছেমতো সেকেন্ডারি বা টারশিয়ারি শ্রেণীকরণের মাধ্যমে লাখ লাখ ডেটা সংরক্ষণ করা সম্ভব।

সহজভাবে বললে নিজের তৈরি বিশেষ এক গাণিতিক ফর্মুলার ওপর ভিত্তি করে আজিজুল হক ৩২টি সারি বানান।

তারপর ওই ৩২ সারিতে বানান ১ হাজার ২৪টি খোপ।

এসব খোপে তিনি গড়ে তুললেন ৭ হাজার আঙুলের ছাপের বিশাল সংগ্রহ।

এতে অনেকটাই সহজ হয়ে যায় লাখ লাখ আঙুলের ছাপের শ্রেণিবিন্যাস করার কাজ।

আজিজুল-হেমচন্দ্র-হেনরির গবেষণা অপরাধবিজ্ঞানে বিপ্লব আনে। বর্তমান বায়োমেট্রিক সিস্টেম তৈরিতেও বড় ভূমিকা রেখেছে ‘হেনরি ক্লাসিফিকেশন’।

হেনরি ক্লাসিফিকেশন বা হেনরি সিস্টেম

কিছুদিন কাজ করে আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বসু আঙুলের ছাপের শ্রেণীকরণের কাজটা করে ফেলেন।

এর মধ্যে গাণিতিক পদ্ধতিটির মূল কৃতিত্ব আজিজুল হকের। নিয়মিত তাঁদের অগ্রগতি স্যার হেনরিকে অবহিত করতেন।

হেনরি সিস্টেম

যখন বোঝা গেল সিস্টেমটি ভালো, তখন স্যার হেনরি আনুষ্ঠানিকভাবে গভর্নর জেনারেলের দপ্তরকে জানান।

একটি কমিশন পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে পদ্ধতিটিকে অর্থোপোমেট্রিক পদ্ধতির চেয়ে উন্নত বলে রায় দেয়।

কাজেই পুলিশ এটি গ্রহণ করে ১৮৯৭ সালে এবং ওই বছরই কলকাতায় বিশ্বের প্রথম ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো স্থাপিত হয়।

এই পদ্ধতির নাম দেওয়া হয় তারই নামে—’হেনরি সিস্টেম’। অবশ্য ইংরেজদের কেনা লেখক ও বিদ্বানরা বলেন যে,

এই পদ্ধতির মূল ধারণা যেহেতু হেনরির মাথা থেকে এসেছে, তাই সিংহভাগ কৃতিত্বের দাবিদারও তিনিই।

কিন্তু এ কাজের উদ্ভাবনী চিন্তার পরিচয় দিয়ে মূল পরিশ্রম যে আজিজুল হকই করেছেন, এ কথাও তো সত্য।

অথচ স্যার হেনরি তার ‘ক্লাসিফিকেশন অ্যান্ড ইউজেস অভ ফিঙ্গারপ্রিন্টস’ বইয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট আবিষ্কার করা নিয়ে মুসলিম এই বিজ্ঞানী আজিজুল হকের নাম পর্যন্ত নেন নি।

১৮৯৯ সালে স্যার হেনরি বিলেতের ডোভারে গিয়ে এই পদ্ধতি সম্পর্কে একটি পেপার উপস্থাপন করেন।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, হেনরি শুরু থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট আবিষ্কার নিয়ে আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বসুর অবদান সম্পর্কে কোথাও কোনো স্বীকৃতি দেননি।

১৮৯৯ সালে দখলদার ব্রিটিশ সরকার হেনরির পেপারটি মুদ্রণ করে প্রকাশ করে।

ফলে এটি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০০ সালে দখলদার ব্রিটিশ সরকার একই পদ্ধতি চালু করার জন্য হেনরিকে দক্ষিণ আফ্রিকাতে পাঠায় এবং তিনি সেখানেও সাফল্যের সঙ্গে এটি চালু করেন।

তারপর থেকে বিশ্বব্যাপী এই পদ্ধতি ‘হেনরির সিস্টেম’ নামে চালু হয়ে যায়।

ইংরেজদের উপেক্ষা

নানা যাচাই-বাছাইয়ের পর আনুষ্ঠানিকভাবে আঙুলের ছাপের সাহায্য অপরাধী শনাক্ত করার প্রচলন শুরু হয়।

১৯০০ সালের মধ্যে অ্যানথ্রোপমেট্রিকের জায়গা নিয়ে নেয় এই পদ্ধতি।

আঙুলের ছাপের সাহায্যে অপরাধী শনাক্তকরণের পদ্ধতি আবিষ্কারের মূল কাজটি করেছেন আজিজুল হক।

কিন্তু কাজের পুরো কৃতিত্ব নিজের পকেটে পুরে নিলেন অহংকারী ইংরেজ হেনরি।

হেনরি অহংকারবশত ফিঙ্গারপ্রিন্ট আবিষ্কার এর পুরো কৃতিত্ব নিজের পকেটে পুরলেও,

ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে অনুসন্ধিৎসু গবেষকরা ঠিকই বের করে এনেছেন আঙুলের ছাপের সাহায্যে পরিচয় শনাক্তকরণ পদ্ধতির মূল আবিষ্কারককে।

‘কারেন্ট সায়েন্স’ সাময়িকীর ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি সংখ্যায় জিএস সোধী ও যশজিৎ কউর ‘দ্য ফরগটেন ইন্ডিয়ান পাইওনিয়ারস অভ ফিঙ্গারপ্রিন্ট সায়েন্স’ নামে এক নিবন্ধ লেখেন।

ওই নিবন্ধে তারা হাতের ছাপ শ্রেণীবিন্যাসকরণে আজিজুল হকের অবদানের কথা অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করেছেন।

ওই নিবন্ধ থেকে এ-ও জানা যায় যে, মুসলিম বিজ্ঞানী আজিজুল হক তার কাজের স্বীকৃতি চেয়ে আবেদনও করেছিলেন।

কিন্তু ইংরেজরা তার আবেদন গ্রাহ্য করে নি। হেনরি যতদিন ভারতে ছিলেন, ততদিন এ ব্যাপারে কথা বলার সুযোগ তাকে দেওয়া হয়নি। উল্টো হুমকি দেয়া হয়েছে।

তবে স্যার হেনরি বোধহয় পরে চাপে পড়ে ১৯২৬ সালের ইন্ডিয়া অফিসের তখনকার সেক্রেটারি জেনারেলকে লেখা এক চিঠিতে জানান,

‘আমি স্পষ্ট করতে চাই যে আমার মতে, শ্রেণীবিন্যাসকরণ (ফিঙ্গারপ্রিন্ট) পদ্ধতিকে নিখুঁত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন আমার কর্মচারীদের মধ্যে তিনি (আজিজুল হক)।’

আনুষ্ঠানিকভাবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট আবিষ্কার এর স্বীকৃতি না দিলেও অসামান্য কাজের খানিকটা পুরস্কার আজিজুল হক পেয়েছিলেন।

দখলদার ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে তাকে খান বাহাদুর উপাধি দেওয়া হয়।

সেইসঙ্গে দেওয়া হয় পাঁচ হাজার টাকা ও ছোটখাটো একটা জায়গির।

আর চাকরিতে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন পুলিশের এসপি। পাশাপাশি হেমচন্দ্রও পান রায় বাহাদুর উপাধি ও পাঁচ হাজার টাকা অর্থপুরস্কার।

আজিজুল হক
মুসলিম বিজ্ঞানী আজিজুল হক খান
এডওয়ার্ড হেনরি
এডওয়ার্ড হেনরি

তথ্যসুত্র

বিজ্ঞানচিন্তা, ফেব্রুয়ারী ২০২৩

টিবিএস নিউজ ডট নেট, ডিসেম্বর ২০২১

ফিঙ্গারপ্রিন্টের আবিষ্কারক কে

মুসলিম বিজ্ঞানী আজিজুল হক ও সহকারী হেমচন্দ্র রায়

ফিঙ্গারপ্রিন্ট গবেষণার উদ্যোগ নেন কে

এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি

Scroll to Top