মহাবিশ্ব এবং আমাদের পৃথিবী

অতীতকালের মহাবিশ্ব এবং আমাদের পৃথিবী – বিজ্ঞানের চর্চার শুরু আজ থেকে নয়। বহু প্রাচীনকাল থেকেই এর চর্চা শুরু। শুরুতে কিন্তু সব তথ্য সঠিক ছিল, এমনও নয়।

কখনো দেখা গেছে, একটি মস্তবড় ভুলের উপর মানুষ বিশ্বাস করে গেছে প্রায় হাজার বছর। বিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল ছিলেন খৃষ্টপূর্ব সময়ের একজন গণ্যমাণ্য ব্যক্তি।

জ্ঞান-বিজ্ঞানে তৎকালীন সময়ে তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন উচ্চতায়। সে সময় মানুষ এতটা শিক্ষিত ছিল না। গবেষণা তো বহুত দূরের কথা! তখন তিনি গবেষণা করতেন। আবিষ্কার করতেন নতুন নতুন জিনিষ।

দেশের রাজাও জানতো এই খবর। তাই কখনো কখনো রাজদরবারেও ডাক পড়তো তার।

সে সময়কালে মানুষ বিশ্বাস করতো যে, পৃথিবী হলো চ্যাপ্টা থালার মতো।

মহাবিশ্ব আমাদের পৃথিবী

অ্যারিষ্টটলের আবিষ্কার

বিজ্ঞানী অ্যারিষ্টটল সর্বপ্রথম এই ভুল ভাঙ্গলেন। তিনি বললেন ভিন্ন কথা। পৃথিবী গোলাকার। চ্যাপ্টা নয়।

মানুষ জানতে চাইলো কিভাবে? প্রমাণসহ তিনি দেখালেন। প্রমাণ কি? তা হলো, চন্দ্রগ্রহণ। কিভাবে?

অ্যারিস্টটল বললেন, যখন সূর্য এবং চাঁদের মাঝে পৃথিবী এসে পড়ে, তখনই চন্দ্রগ্রহণ হয়।

চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর যে ছাঁয়া চাঁদের উপর পড়ে, সেই ছায়াকে তো গোলাকার দেখা যায়। কখনো লম্বাটে হয় না আবার উপবৃত্তকারও হয় না।

যদি পৃথিবী চ্যাপ্টা হতো তাহলে এই ছাঁয়া উপবৃত্তকার হতো, গোলাকার নয়। এটা হলো অ্যারিস্টটলের প্রথম যুক্তি। আরেকটা চমৎকার যুক্তিও দেখিয়েছিলেন তিনি।

সেটা হলো ধ্রুবতারা। ধ্রুবতারা সবসময় আকাশের একই জায়গায় থাকে। ধ্রুবতারা থাকে উত্তর মেরুবিন্দুর ঠিক উপরে।

তাই উত্তর মেরু থেকে কোনো পর্যবেক্ষক যদি দেখেন, তিনি সবসময় মাথার উপরেই দেখবেন ধ্রুবতারাকে।

কিন্তু বিষুবরেখা থেকে দেখার চেষ্টা করেন, তিনি দেখবেন ধ্রুবতারা ঠিক দিগন্তরেখায় অবস্থান করছে।

সেকালে এক দেশে থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করতেন বণিক এবং ব্যবসায়ীরা। তারা দিক ঠিক করতেন ধ্রুবতারা দেখে।

তাদের কাছ থেকেই জানা যেত কোন দেশে ধ্রুবতারার অবস্থান কোথায়। গ্রীকরা জানতো, উত্তরদিকের দেশগুলো থেকে দেখলে এই তারাকে আকাশের অনেক উপরে দেখা যায়।

কিন্তু দক্ষিণদিক থেকে দেখলে একে নিচের  আকাশে দেখা যায়। ধ্রুবতারার অবস্থানের এই তারতম্য থেকেও পৃথিবীর গোলাকৃতির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়।

এই যুক্তি দ্বারা মানুষ মানতে বাধ্য হলো, পৃথিবী চ্যাপ্টা নয়। বরং গোলাকার।

অ্যারিষ্টটলের ভ্রান্ত বিশ্বাস

অতীতকালের মহাবিশ্ব এবং আমাদের পৃথিবী – কিন্তু সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গায়। অ্যারিস্টটল এই বড় একটা জিনিষ আবিষ্কার করেও কিছু বিষয় তিনি ভিন্ন মতামত দিলেন।

ফলে সেই সঠিক মতামতটি প্রতিষ্ঠা করতে উদীয়মান কয়েকজন বিজ্ঞানীর জীবন দিতে হলো। তাদের মধ্যে জিওর্দানো ব্রুনো এবং গ্যালিলিও অন্যতম।

অ্যারিস্টটল বললেন, পৃথিবী হলো মহাবিশ্বের কেন্দ্র। সূর্যসহ অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্র-উপগ্রহ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সেকালে তার কথাকে প্রতিবাদ করার মতো লোক ছিল না।

কারণ তিনি এত বড় একজন গণ্যমাণ্য ব্যক্তি। তার কথা কি ফেলে দেয়া যায়? কিন্তু তারপরও তো কিছু ব্যক্তি থাকে।

যারা কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে পারে না। তেমনই একজন ব্যক্তি ছিলেন অ্যারিস্টার্কাস। তিনি বলেছিলেন সম্পূর্ণ উল্টো কথা। বললেন, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়।

টলেমির উত্থান 

প্রথম শতকের খিষ্টাব্দে আরেকজন ব্যাক্তির আবির্ভাব হলো। নাম টলেমি। সে এসে আরো জোরেশোরে প্রচার করতে লাগলো অ্যারিস্টলের তথ্য।

তিনি মহাবিশ্বের ছোটোখাটো একটি মডেল তৈরী করলেন। সেই মডেলে দেখানো হলো পৃথিবী কিভাবে মহাবিশ্বের কেন্দ্র হলো।

আর অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্র এবং উপগ্রহগুলো কিভাবে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। সে সময়ের মানুষ এই মতকে গ্রহণ করলো। বাড়তে লাগলো অ্যারিস্টটল এবং টলেমির জনপ্রিয়তা।

টলেমির বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ

ষোড়শ শতাব্দীতেই সর্বপ্রথম এই মতবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেন একজন পোলিশ ব্যক্তি। নাম কোপার্নিকাস। তিনি পৃথিবীকেন্দ্রিক মডেলের বিরুদ্ধে মত দিলেন।

বললেন, পৃথিবীর চারপাশে গ্রহ-নক্ষত্র ঘুরছে না। বরং পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘুরছে।

তিনি তখন লিখে ফেললেন একটি বই। নাম, ডি রেভল্যুশনিবাস অরবিয়াম কলেস্তাম। সেখানে তিনি ব্যাখ্যা করলেন, কেন অ্যারিস্টটল এবং টলেমির তথ্য ভুল।

কিন্তু বইটি তিনি তখন প্রকাশ করলেন না। জানেন যে, এর জন্য তিনি খৃষ্টান পাদ্রীদের তোপের মুখে পড়বেন। কিন্তু দীর্ঘ ১৩ বছর পর প্রকাশ করা হলো সেই গ্রন্থটি।

তখন চলছিল ১৫৪৩ সাল। কোপার্নিকাস যখন প্রকাশকের হাতে বইটি দিলেন তখন প্রকাশক তাকে না জানিয়েই বইয়ে একটা বাক্য বৃদ্ধি করে দিলেন।

সেখানে লেখা ছিল, গ্রহ নক্ষত্রের চলাচল ব্যাখ্যা করতে গেলে এই সূত্র কাজে লাগে। বাস্তবে এই তথ্যগুলো ভুল।

এই ঘটনার এক বছরের মধ্যেই কোপার্নিকাস মারা যান। কিন্তু তার বইটি রেহাই পায় নি। সেটাকে নিষিদ্ধ করা হয় তখন।

এভাবেই সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। হয়তো সেই সূর্যকেন্দ্রিক মহাবৈশ্বিক মডেলটি হারিয়েই যেতো। কিন্তু সেটাকে আবার বাচিঁয়ে তুললেন জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহান কেপলার।

সে সময় প্রাদ্রীরা তার পিছনেও লাগলো। কিন্তু প্রাগের সম্রাট রোদলফ কেপলারকে স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি দিলেন। কিন্তু বিপদে পড়লেন গ্যালিলিও।

গ্যালিলিওর তথ্য এবং গ্যালিলিওর প্রতি নির্যাতন

গ্যালিলিও তখন ইতালির একজন সাধারণ নাগরিক। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি জানলেন অ্যারিস্টটল এবং টলেমির মতবাদের কথা।

সেই সাথে এটাও জানলেন, কোপার্নিকাস এবং কেপলারের তথ্যের কথা। তখন তিনি নিজেই এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করলেন। কিছুদিন পরে তিনি আবিষ্কার করেন, বৃহস্পতি গ্রহকে ঘিরে ঘুরছে কয়েকটি উপগ্রহ।

এই তথ্য ছিল অ্যারিস্টটল তথ্যের বিরোধী। কারণ অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, পৃথিবী ব্যতিত অন্য কোনো গ্রহের উপগ্রহ থাকতে পারে না।

ফলে তিনিও পাদ্রীদের চক্ষুশূলে পরিণত হলেন। তখনই ঘটলো আরেক ঘটনা। প্রাদ্রীদের মধ্যে তখন নতুন একজনের আবির্ভাব হলো।

বয়সে তরুণ। নাম জিওর্দানো ব্রুনো। তিনিও বললেন, সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে গ্রহ-উপগ্রহগুলো। প্রাদ্রীসমাজ তো এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।

আমাদের মধ্য থেকেই কিনা একজন অবাধ্য পাপিষ্ঠের জন্ম হলো? আর ঠিক থাকতে পারলেন না তারা।

ভ্যাটিক্যান থেকে স্বয়ং প্রধান পাদ্রী চলে এলেন এই নরাধমকে শাস্তি দিতে।

প্রথম নির্মম হত্যার শিকার

অতীতকালের মহাবিশ্ব এবং আমাদের পৃথিবী – ১৭ই ফেব্রুয়ারী ১৬০০।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি ঘোর কালো অধ্যায় হয়ে আছে। ইতালির রাজধানী রোমের ক্যাম্পে ডি ফিওরি স্কয়ার লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে।

সবাই দেখতে এসেছে । বড়ই নিষ্ঠুর তামাশা। একজন ধর্মাদ্রোহীকে আগুনে পুড়িঁয়ে মারা হবে।

আনা হলো সেই ব্যক্তিকে। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং জিওর্দানো ব্রুনো। তরুণ পাদ্রী।

ভ্যাটিকানের প্রধান পোপের নির্দেশে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় জিওর্দানো ব্রুনোর শরীরে। অল্প কিছুক্ষণ পরেই মারা যান তিনি।

এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো গোটা ইউরোপজুড়ে। জানতে পারলেন গ্যালিলিওও। বুঝলেন তার জন্য সামনে কঠিন দিন অপেক্ষা করছে।

সৈন্য পাঠিয়ে গ্যালিলিওকে গ্রেপ্তার করে আনা হলো। বিচার করা হলো তার। শাস্তি নির্ধারণ হলো দশ বছরের কারাদণ্ড।

অতঃপর কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেন এই বিজ্ঞানী।

আজ আমরা এই তথ্য সকলেই জানি, সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে আমাদের পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলো।

শুরুতে কিন্তু এই বিষয়টা এত সহজ ছিল না।

এই তথ্যের জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে জানা, না-জানা অনেককে।

এই কঠিন সত্যটি মানুষের থেকে আড়াল করা হয়েছে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে।

তাই সকল বিজ্ঞানীর প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।

তথ্যসুত্র

গুপ্ত মহাবিশ্বের খোঁজে। আবদুল গাফফার। প্রথমা প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ১৯-২৪

আরো পড়ুন

১. ডিস্যালাইনেশন কি?

২. লোহা কি এবং লোহার প্রকারসমূহ

জিওনার্দো ব্রুনোকে কবে হত্যা করা হয়?

১৭ ফেব্রুয়ারী ১৬০০ খৃষ্টাব্দে।

কোপার্নিকাসের লিখিত বইয়ের নাম

De revolutionibus orbium coelestium

Abdur Rahman Al Hasan
Scroll to Top