খলিফা ওমর রাঃ এর খেলাফতের সুচনালগ্নেই সবচেয়ে বড় যুদ্ধক্ষেত্রের নাম ছিল ইয়ারমুকের যুদ্ধ । এই যুদ্ধের মাধ্যমে রোমানদের মধ্যে ফাঁটল সৃষ্টি হয়ে যায়।

তাদের রাজধানী হিমস পর্যন্ত এলাকা ‍মুসলমানদের কবজায় চলে আসে। হযরত আবু বকর রাঃ এর মৃত্যুর ছয়দিন পর ইয়ারমুকের যুদ্ধ শুরু হয়।

তখন পর্যন্ত ইয়ারমুকে অবস্থানরত মুসলমানরা আবু বকর রাঃ এর মৃত্যুর সংবাদ জানতেন না। আবু বকর রাঃ এই যুদ্ধকে সামনে রেখে বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন।

আবু বকর রাঃ এর পরিকল্পনা

রোমানরা যেহেতু অনেক বড় বাহিনী ছিল তাই তাদেরকে পরাজিত করতে হলে মুসলমানদেরকেও বড় সংখ্যক সৈন্যবাহিনী দরকার।

তাই আবু বকর রাঃ শামের আশেপাশে অবস্থানরত বিভিন্ন মুজাহিদ ইউনিটগুলোকে একত্রিত হতে বললেন। তাদের সকলকে এই আদেশ দিলেন যে, তারা যেন ইয়ারমুকে চলে আসে।

বড় বড় মুসলিম সেনাপ্রধানদের তত্ত্বাবধানে ৬ বা ৭ হাজার করে সৈন্য সংখ্যা ছিল। তাদের মধ্যে আমর ইবনে আস রাঃ, ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান রাঃ শুরাহবিল বিন হাসানা রাঃ সকলের অধীনে ছিল প্রায় ৭ হাজার করে সৈন্য।

হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ তখন ইরাকে অবস্থান করছিলেন। তার সাথে ছিল ৯ হাজার মুজাহিদ। আবু বকর রাঃ তাকে তার বাহিনীসহ ইয়ারমুকে গমন করতে বললেন।

সব মিলিয়ে প্রায় ৩৬ হাজার মুসলমান মুজাহিদ ইয়ারমুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এই যুদ্ধে রোমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লক্ষ ৪০ হাজার।

ইয়ারমুকে আসার পর সকলেই নিজের বাহিনী নিয়ে নিজের মতো অবস্থান করছিলেন। কারণ, কেন্দ্রীয় খেলাফত থেকে কোনো নতুন আদেশ আসে নি।

সকলেই ভেবেছিলেন এভাবে হয়তো আলাদা আলাদাভাবে যুদ্ধ সংগঠিত হবে। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ বুঝতে পারলেন, এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক।

খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ এর সিদ্ধান্ত

আল্লাহর তরবারি হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ সকল অভিজ্ঞ সাহাবীদেরকে একত্রিত করে বললেন,

আবু বকর রাঃ তো আমাদেরকে পৃথক পৃথকভাবে লড়াইয়ের জন্য এখানে আনেন নি।

আমরা যেন একত্রে শত্রুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারি, সে জন্যই তিনি আমাদেরকে এখানে এনেছেন। আমরা যদি বিভক্ত থাকি তাহলে শত্রুরা খুব সহজেই আমাদেরকে পরাস্ত করতে পারবে।

তাই আমাদের সকলকে একত্রে একজনের নেতৃত্বে লড়াই করা উচিৎ। অন্যথায় আমরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের কারণ হবো।

অন্যান্য অভিজ্ঞ সাহাবারা তখন বললেন, আচ্ছা তাহলে আপনিই বলুন যে, কে আমাদের আমির নির্ধারিত হবেন? খালিদ রাঃ তখন বললেন,

আমাদের সকলকে একসাথে এক আমিরের নেতৃত্বে যুদ্ধ করতে হবে। আর প্রত্যেক সিপাহসালারকে একদিন করে নেতৃত্বের সুযোগ দেয়া হবে।

আর আপনারা যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে প্রথমদিন আমাকে আমির হিসেবে নিযুক্ত করুন।

উপস্থিত সাহাবারা খালিদ রাঃ এর সমরনীতি ও অভিজ্ঞতার কথা জানতেন।

তাই সকলেই আনন্দচিত্তে তাকে নেতৃত্বের অনুমতি প্রদান করেন। হযরত খালিদ রাঃ পূর্বেই রোমানদের পরিকল্পনা ধরতে পেরেছিলেন।

তাই তার জন্য যুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ ছিল।

যুদ্ধের ময়দানে দুই বাহিনী

পরদিন উভয় বাহিনী ময়দানে মুখোমুখি হয়। রোমানরা তাদের সৈন্যদের এমনভাবে বিন্যাস করে, যা আগে কখনো কেউ দেখে নি।

কিন্তু অপরদিকে মুসলমানদেরকে খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ এমনভাবে বিন্যাস করেন যে, তাদেরকে দেখে বুঝার উপায় ছিল না, এরা আরবের সৈন্যদল।

হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ মুসলিম বাহিনীকে ৩৬ টি ইউনিটে ভাগ করেন। প্রতিটি ইউনিটে ভিন্ন ভিন্ন কাতার তৈরি করেন।

ইতিপূর্বে কখনো কোনো বাহিনী এতগুলো বিন্যাসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি।

মুসলিম বাহিনীর মাঝের ১৬ টি ইউনিটের দায়িত্ব ছিল আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ রাঃ এর হাতে।

ডান দিক থেকে ১০ টি কাতার ছিল আমর ইবনে আস রাঃ ও শুরাহবিল বিন হাসানা রাঃ এর হাতে।

বাম দিক থেকে ১০ টি বাহিনী ছিল ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ান রাঃ এর হাতে।

এরপর খালিদ রাঃ প্রত্যেক ইউনিটে একজন করে দক্ষ ও অভিজ্ঞ অফিসার নিযুক্ত করেন।

হযরত ‍মিকদাদ বিন আসওয়াদ রাঃ কে দায়িত্ব দেয়া হয়, মুসলমানদের আবেগ উদ্দীপনা জাগ্রত করতে।

জনৈক সৈন্যের উক্তি – ইয়ারমুকের যুদ্ধ

যুদ্ধের পূর্বে একজন মুসলিম সৈন্য বলে উঠে, রোমানরা কত বেশি। আমরা কত সামান্য! তখন খালিদ রাঃ এটা শুনে বললেন,

কখনো নয়। মুসলমানরাই হলো সবচেয়ে বেশি। আর মুসলমানদের তুলনায় রোমানরা কত সামান্য!

জনৈক রোমান অফিসারের ইসলাম গ্রহণ

যুদ্ধের প্রারম্ভেই একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে যায়। রোমানদের সিপাহসালার জারিজ ঘোড়া ছুটিয়ে মুসলমানদের নিকট এসে খালিদ রাঃ এর সাথে কথা বলতে চাইলেন।

খালিদ রাঃ অগ্রসর হলে জারিজ বললেন, খালিদ তুমি সত্য সত্য বলবে। আল্লাহ কি তোমাদের নবীর উপর আসমান থেকে কোনো তরবারি দিয়েছেন, যা দিয়ে তোমরা যুদ্ধ করে থাক।

তখন খালিদ রাঃ বললেন, না। তিনি আমাদেরকে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে ছড়িয়ে যেতে বলেছেন।

তখন জারিজ বললো, তাহলে তোমাকে কেন সকলে আল্লাহর তরবারি বলে ডাকে?

খালিদ রাঃ তখন দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, আমিও এক সময় নবীর বিরোধিতা করতাম। নবীকে আমরা মিথ্যা প্রতিপন্নও করতাম।

তারপর তিনি আমাদেরকে হেদায়েত দিয়েছেন। আমি তার আনুগত্য করেছি। তখন নবীজি আমাদের বললেন, তুমি হলে আল্লাহর তরবারি।

যা আল্লাহর কাফেরদের বিরুদ্ধে কোষমুক্ত করেছেন। রাসূলের দোয়াতেই আল্লাহ আমাকে যুদ্ধের ময়দানে সাহায্য করেছেন।

জারিজ তখন ইসলাম সম্পর্কে আরো জানতে চাইলো। খালিদ রাঃ পূর্ণাঙ্গরুপে বলার চেষ্টা করলেন।

এরপর জারিজ ইসলাম গ্রহণ করে তার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তরবারি নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

উভয় দলের মধ্যে লড়াই – ইয়ারমুকের যুদ্ধ

অবশেষে লড়াই শুরু হয়। একদল অপরদলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারাদিন তুমুল লড়াই চলে। এর মধ্যেই মদীনা থেকে দূত আসে।

সে তখন খালিদ রাঃ এর নিকট গিয়ে সংবাদ প্রদান করে যে, খলিফা আবু বকর রাঃ ইন্তিকাল করেছেন।

আর ওমর রাঃ খলিফা হয়েছেন। আর তিনি এই যুদ্ধে হযরত আবু ‍উবায়দা ইবনে জাররাহ রাঃ কে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেছেন।

খালিদ রাঃ এই সংবাদ শ্রবণ করে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত সংবাদটি গোপন রাখার চেষ্টা করেন।

কারণ, অন্যথায় খলিফার মৃত্যুতে মুসলমানরা শোকাহত হয়ে পড়তে পারে।

মুসলমানরা পূর্ণ উদ্যমে যুদ্ধ করতে থাকে। খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ এর নেতৃত্বে তারা শত্রুদের এক একটি প্রতিরক্ষা ভেদ করে ফেলতে সক্ষম হয়।

অবশেষে কাফেররা পলায়ন করতে থাকে। এ সময় হযরত ইররিমা বিন আবু জাহল রাঃ বলেন, আমি কয়েকবার রাসূলের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি।

ইসলাম গ্রহণের পর আজ আমার কোরবানি দেয়ার সময় এসেছে। আমি কি এখান থেকে পলায়ন  করবো? এরপর তিনি চিৎকার করে বলেন,

কে আছে আজ মৃত্যুর সাথে বাইয়াত গ্রহণ করবে? তখন তার চারপাশে ৪০০ মুজাহিদ চলে আসে। তিনি তখন তাদেরকে নিয়ে কাফেরদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।

এই যুদ্ধে ২০ হাজার রোমান সৈন্য নিহত হয়। মুসলমানদের মধ্যেও অনেক মুজাহিদ শহীদলাভ করেন। মুসলমানরা যুদ্ধে খুব সাহসিকতার সাথে লড়াই করছিল।

যুদ্ধে আবু সুফিয়ান রাঃ এর এক চোখে তীর লেগে তা নষ্ট হয়ে যায়।

আর নওমুসলিম জারিজ লড়াই করতে করতে শাহাদাতলাভ করেন।

ইকরিমা রাঃ ও তার ছেলে মারাত্মক আহত হয়ে যান। এরপর খলিদ রাঃ এর সামনেই পিতা ও পুত্র শাহাদাতের সুধা পান করেন।

বিজয়ের ধারপ্রান্তে নতুন সিপাহসালার

যুদ্ধশেষ হওয়ার পূর্বে যখন খালিদ রাঃ বুঝতে পারলেন, এখন মুসলমানরা খলিফার মৃত্যু সংবাদ জানলে কোনো অসুবিধা নেই। তখন তিনি সাহাবী ও মুজাহিদদের একত্রিত করে তা জানালেন।

পাশপাশি এই বিশাল মুসলিম মুজাহিদের প্রধান হিসেবে ওমর রাঃ এর নিয়োগের কথা বললেন।

যেহেতু খালিদ রাঃ সকলের ঐক্যমতে কিছুদিনের জন্য প্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন,

তাই আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ রাঃ এর সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগের পর খালিদ রাঃ তার অধীনে থেকেই যুদ্ধ করেছেন।

এভাবেই ইয়ারমুকের যুদ্ধ এ তিনি মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য বজায় রেখেছেন।

তথ্যসুত্র

মুসলিম ‍উম্মাহর ইতিহাস। খন্ড ৩। পৃষ্ঠা ১১০-১১৮

হযরত ইসমাইল আঃ কি কম মর্যাদাবান ছিলেন? পড়ুন

কুরআনের আয়াত সংখ্যার ভিন্নতা কি কুরআনের ত্রুটি? পড়ুন

জাহান্নামের উত্তাপের কারণে কি জ্বর হতে পারে? পড়ুন

ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলমানদের সেনাপতি কে ছিলেন

হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ

ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা কত ছিল

৩৬ হাজার মুসলমান ইয়ারমুকের যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। আর রোমানরা ছিল ২ লক্ষ ৪০ হাজার

Scroll to Top