ওহুদ যুদ্ধ ও আবু বকর – বদরের যুদ্ধের পর ওহুদ যুদ্ধ ছিল মুসলমান এবং মুশরিকদের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। বদর যুদ্ধে কাফেররা শোচনীয় পরাজয় বরণ করার পরে যখন তারা প্রতিশোধের স্পৃহায় আবার একত্রিত হলো, তখনই সংগঠিত হলো ওহুদ যুদ্ধ। একবারে শুরু থেকেই বর্ণনা করি।

প্রতিশোধ ও ক্রোধ

বদর যুদ্ধে পরাজয় বরণ করার পর মক্কার কাফেররা ক্রোধে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারা শপথ করলো, মুসলমানদের এক এক করে হত্যা করবে।

বদর যুদ্ধে কাফেরদের সৈন্য সংখ্যা ছিল এক হাজার আর মুসলমানদের মাত্র তিনশত তেরো জন। এই যুদ্ধে আবু জাহল, উতবা, শায়বার মতো কট্টরপন্থি কাফেরদের সলীল সমাধি ঘটলো।

ওহুদের যুদ্ধের জন্য তার পূর্বের থেকেও বড় প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। এই যুদ্ধে তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল তিন হাজার। অর্থাৎ পূর্বের থেকেও আরো তিনগুণ।

কাফেরদের যুদ্ধের প্রস্তুতি

কাফেররা বদর যুদ্ধে পরাজয় বরণ করার পর মক্কায় গিয়েই শুরু করলো যুদ্ধের প্রস্তুতি। প্রায় পূর্ণ এক বছর তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করলো।

এই সময়ে তারা প্রয়োজনীয় অস্ত্র, সৈন্য, খাদ্য ও নানাপ্রকার রণসামগ্রী সংগ্রহ করে তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে মদীনায় আক্রমণের জন্য যাত্রা শুরু করলো।

এই যুদ্ধে ৩০০০ হাজার সৈন্যের পাশাপাশি অংশগ্রহণ করলো বহু কবি-সাহিত্যিক ও নারীরা। তাদের কাছ ছিল নিস্তেজ হয়ে পড়া সৈন্যদের মনোবল জাগ্রত করা।

মুশরিকদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির অংশগ্রহণ

মুশরিকদের সেনাপ্রধান ছিল আবু সুফিয়ান। তার সাথে ছিল তার স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবা ইবনে রবিআ।

বদর যুদ্ধে নিহত আবু জাহলের পুত্র ইকরিমা বিন আবু জাহলও অংশগ্রহণ করলো ওহুদ যুদ্ধে। সাথে ছিল তার স্ত্রী ও চাচাতো বোন উম্মু হাকীম বিনতে হারিস।

আবু জাহলের ভাই হারিস বিন হিশাম ও ছিল এই ওহুদ যুদ্ধে। সাথে ছিল তার স্ত্রী ফাতেমা বিনতে ওলাীদ বিন মুগিরা।

মুসলমানদের প্রস্তুতি

রাসূল সা. যখন জানতে পারলেন মক্কায় তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন তিনিও মুসলমানদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন।

রাসূল সা. একটি পরামর্শসভা ডাকলেন। সেখানে তিনি বললেন, যুদ্ধ কোথায় অবস্থান করে করলে ভালো হবে? তখন নবী সা. মতামত দিলেন যে, আমার মতে মদীনায় থেকেই আমরা যুদ্ধ করি।

এতে আমরা মদীনায় সকলে মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবো। আমরা তাদের উপর পাথর নিক্ষেপ করে হলেও মোকাবেলা করতে পারবো।

কিন্তু তখন এমন অনেক মুসলমান ছিল, যারা বদর যদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। তাই তারা পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা মদীনা থেকে বের হয়েই যুদ্ধ করি।

রাসূল সা. শেষ পর্যন্ত সাহাবাদের কথায় মদীনার বাহিরে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু তিনি এতে সন্তুষ্টি ছিলেন না।

দিনটি ছিল শুক্রবার। নবীজি জুমআর নামাজ পড়ে যুদ্ধের পোশাক পরিধান করলেন। তারপর সকলকে যুদ্ধের জন্য বের হতে নির্দেশ দিলেন।

বিজ্ঞ সাহাবারা পরষ্পর বলাবলি করতে লাগলো, রাসূল তো মদীনায় থেকেই যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু আমরা বাধা সৃষ্টি করলাম। এখন কোন বিপদ হয়, আল্লাহই ভালো জানেন।

শেষে সাহাবারা বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি মদীনাতেই থাকুন। আমরা মদীনাতেই আপনার পাশে থেকে যুদ্ধ করবো।

রাসূল সা. বললেন, কোনো নবী যখন যুদ্ধের পোশাক পরিধান করে ফেলে তখন সেখান থেকে ফিরে আসা শোভনীয় নয়।

আমি তো তোমাদেরকে আগেই বলেছিলাম, তোমরা রাজী হলে না। এখন তোমরা ধৈর্যধারণ করো এবং তাওবা করো।

ওহুদ যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যসংখ্যা

বদর যুদ্ধে মুসলমানরা ছিল মাত্র ৩১৩ জন। ওহুদ যুদ্ধে প্রথমে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ১০০০ জন। এই যুদ্ধে মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও ছিল।

কিছুদূর গিয়ে সে তার ৩০০ অনুসারীকে নিয়ে পিছুটান নেয়। তারা দলত্যাগ করে চলে যায়।

শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা ছিল মাত্র ৭০০ জন।

তাদেরকে নিয়েই রাসূল সা. ওহুদের ময়দানে পৌছেন।

যুদ্ধ

ওহুদ যুদ্ধ ও আবু বকর – যুদ্ধের শুরুতেই আবু বকর রা. রাসূলের দেহরক্ষী হিসেবে নিজেকে নিযুক্ত করেন।

এই যুদ্ধে রাসূল সা. এর নির্দেশ অমান্য করার কারণে বড় একটা বিপর্যয় সৃষ্টি হয়।

তখন চারিদিকে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, মুহাম্মাদ সা. নিহত হয়েছেন।

সাহাবারা এটা শুনে সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হয়ে যায়। তারা যেন চোখে শর্ষেফুল দেখতে থাকে।

তখন আবু বকর রা. কাফেরদের বেষ্টনি অতিক্রম করে রাসূলের নিকট পৌছে যান।

এরপর আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ রা., আলী রা., যুবায়ের রা., তালহা রা., উমর রা., হারিসা ইবনে সাম্মাহ রা., প্রমুখ সাহাবারা রাসূলের নিকট এসে রাসূলকে কাফেরদের থেকে নিকট থেকে সরিয়ে ফেলেন।

এই সাহাবারা রাসূলের চারিপাশে বেষ্টনির ন্যায় অবস্থান করছিল। রাসূলের নিরাপত্তায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন তালহা রা.।

তিনি মুশরিকদের চারপাশ থেকে আক্রমণ করছেন। কখনো ডাকদিক থেকে বা কখনো বামদিক থেকে। আবু বকর রা. বলেন, আমি এই সুযোগটা সম্পূর্ণ হারিয়েছি। যদি তালহার জায়গায় আমি হতাম!

এরইমধ্যে জনৈক কাফেরের আঘাতে রাসূলের দাঁত ভেঙ্গে গেল। তার চেহারায় রক্ত লাল হয়ে গেছে।

মাথায় পরিধান করা শিরস্ত্রাণ ভেঙ্গে গালের ভেতর ঢুকে পড়েছিল।

রাসূল এই কঠিন পরিস্থিতিতেও বলছিলেন, তালহার কি খবর, তার খবর নাও।

আবু বকর রা. বলেন, তখন আমরা রাসূলের চেহারা ঢুকে যাওয়া লোহার টুকরো বের করতে উদ্যত হলাম।

তখন আবু উবায়দা রা. বললেন, আল্লাহর দোহাই, এই কাজটি আমাকে করতে দিন।

আবু উবায়দা রা. দাঁত দিয়ে কামড়ে লোহার একটা টুকরো বের করলেন। লোহাকে দাঁত নিয়ে বের করার কারণে তার একটি দাঁত ভেঙ্গে গেল।

দ্বিতীয় লোহাটি আমি বের করতে চাইলে এবারও আবু উবায়দা রা. আমাকে বাধা দিয়ে তিনি কাজটি করতে চাইলেন। ফলে আবু উবায়দা রা. এর দুইটি দাঁত ভেঙ্গে গেল।

আবু সুফিয়ানের হুঙ্কার

যদ্ধের কঠিন সময়ে আবু সুফিয়ান চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো, মুহাম্মাদ কি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে?

নবীজি তখন সাহাবাদেরকে উত্তর দিতে নিষেধ করলে। দ্বিতীয়বার আবু সুফিয়ান বললো, আবু বকর কি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে?

তৃতীয়বার আবু সুফিয়ান বললো, উমর কি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে?

এরপর আবু সুফিয়ান বলতে লাগলো, মনে হয় তারা মারা গেছে।

তখন উমর রা. বললেন, হে আল্লাহর দুশমন! এরা সবাই এখনো জীবিত আছে।

তথ্যসুত্র

১. আবু বকর সিদ্দিক রা.। ড. আলী মুহাম্মাদ আস সাল্লাবী। পৃষ্ঠা ১০৭-১০৯

২. আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া। ইসলামিক ফাউন্ডেশন। খণ্ড ৪। পৃষ্ঠা ২৭-১২২

৩. হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. জীবনী। সোলায়মানিয়া বুক হাউজ। পৃষ্ঠা ৭৫-৭৮

Abdur Rahman Al Hasan
Scroll to Top