সভ্যতার দ্বন্দ্ব

সভ্যতার দ্বন্দ্ব – এনলাইটেনমেন্টের পর বিশ্ব প্রতিনিয়্যত বদলেছে। ধর্মীয় কাঠামোকে পরিবর্তন করে নতুন রূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বদলেছে পরিভাষার মারপ্যাচ, উপসংহারের চিরায়ত তত্ত্ব।

তাওহীদ বনাম শিরক, ঈমান বনাম কুফর, ইসলাম বনাম জাহিলিয়্যাত – এগুলোই হলো মানব ইতিহাসের প্রধানতম দ্বন্দ্ব।

প্রত্যেক নবী এই দ্বন্দ্বকে সামনে রেখেই দাওয়াহ পেশ করেছেন, কর্মপদ্ধতি সাজিয়েছেন।

আল্লাহ তা’আলা মানুষের জন্য যেই নীতি ঠিক করে দিয়েছেন, ভালো-খারাপের মানদণ্ড ঠিক করে দিয়েছেন, সেটিকে যখনই কেউ চ্যালেঞ্জ করেছে তখনই ঈমান বনাম কুফর, ইসলাম বনাম জাহিলিয়্যাতের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে হাজির হয়েছে।

আল্লাহর আইন কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। তা ১৪০০ বছর আগের হোক কিংবা ১৪ হাজার বছর আগের হোক।

আল্লাহর আইন চিরকালের জন্য দ্রুব সত্য। আমাদের কোনো ইচ্ছাধিকার নেই তাতে পরিবর্তন করার, পরিমার্জন করার।

সেই আলোকে  বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় প্রধান দ্বন্দ্ব হলো ইসলাম বনাম আধুনিকতার দ্বন্দ্ব। আধুনিকতা নতুন নতুন বেশ কিছু চিন্তাধারা হাজির করেছে। যেমন, হিউম্যানিজম, লিবারেলিজম, সেক্যুলারিজম, জাতীয়তাবাদ

এই চিন্তাধারার আলোকে আরো বিভিন্ন আনুষাঙ্গিক চিন্তাধারাও হাজির হয়েছে। যেমন, গণতন্ত্র, নারীবাদ, বিজ্ঞানবাদ, প্রাচ্যবাদ ইত্যাদি।

ইসলাম বনাম আধুনিকতার দ্বন্দ্ব হলো আল্লাহর আইন বনাম গাইরুল্লাহর আইনের দ্বন্দ্ব। আল্লাহ একটি মানদন্ড নির্ধারণ করে দিয়েছেন, আধুনিকতা আরেকটি মানদন্ড নির্ধারণ করে।

আল্লাহর আইনকে চ্যালেঞ্জ করে টিকে আছে এই আধুনিকতার সকল চিন্তাধারা।

এগুলো তুরুপের তাসের মতো। ফুঁ দিলে উড়ে যাবে। কিন্তু ফুঁ দেওয়াটা ফুঁ দেওয়ার মতো দিতে হবে।

তাই সমাজে আমাদের প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে আমাদের প্রধান সংকটগুলো। সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক অবক্ষয়, পারিবারিক অবক্ষয় হলো মূল সমস্যাগুলোরই উপসর্গ।

তাই মূল সমস্যাগুলো নিয়ে কথা না বলে যতই আমরা উপসর্গ নিয়ে কথা বলি, রোগ থেকে কখনোই চিরতরে মুক্তি পাওয়া যাবে না।

এটা নিছক কোনো মতাদর্শিক বিরোধ নয়। রাজনৈতিক বিতর্ক নয়।

এটি বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব, দ্বীনের দ্বন্দ্ব। এখান থেকেই প্রশ্ন আসে মানব অস্তিত্বের মৌলিক বিষয়ে।

আমি কে?

আমি কেন পৃথিবীতে এসেছি?

আমাকে কোথায় যেতে হবে?

মানবজীবনের উদ্দেশ্য কী?

ভালো কী?

মন্দ কী?

ভালো-মন্দের মাপকাঠি কোথা থেকে আসে?

বিধান কে দেবে?

আইনের ভিত্তি কী হবে?

সমাজের রীতিনীতি আর শাসনব্যবস্থার উৎস কী হবে?

সার্বভৌমত্ব কার? কর্তৃত্ব কার?

প্রত্যেক সমাজ ও সভ্যতাকে এই প্রশ্নগুলোর মীমাংসা খুঁজে বের করতে হয়। নির্ধারণ করতে হয় মাপকাঠিসমূহ। এখানেই ইসলামের সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব স্পষ্ট।

আধুনিকতা, পশ্চিমা সভ্যতা হলো মানবকেন্দ্রিক। মানুষের বিবেককে এখানে মাপকাঠি হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। মানুষের আইনকে এখানে শাসনব্যবস্থার উৎস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।

বিপরীতে ইসলাম বলে, সকল কিছুর মূল হলেন মহান আল্লাহ তা’আলা।

তিনিই নির্ধারণ করে দেন বৈধ-অবৈধ, নীতি-নৈতিকতার চূড়ান্ত সীমা।

তার আইনই সর্বোচ্চ, তিনিই সার্বভৌমত্বের অধিকারী, কর্তৃত্বের অধিকারী।

তাই আধুনিকতা ও ইসলামের মধ্যে সংঘাত চিরদিনের জন্য। এখানে কোনো কম্প্রোমাইস চলে না।

এই দুটো কখনো এক হয় না। যেমন, আগুন আর পানি কখনো এক হয় না।

ইসলামের আকিদাহ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, রূহানিয়াত এর মতো বিষয়গুলোর সামগ্রিক প্রকাশ ঘটে ঘটে ইসলামী শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে। পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে ইসলামের বাস্তবায়নের মাধ্যমে।

আর আধুনিকতার মৌলিক বিশ্বাস, মতাদর্শ, জীবনব্যবস্থার পুরোপুরি প্রকাশ ঘটে সেক্যুলার শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে।

তাই আধুনিকতার এসব আলাপগুলো দৈনন্দিন আমাদের জীবনে শুধুমাত্র একাডেমিক আলাপ, দার্শনিক চিন্তাধারা হিসেবে হাজির হয় না।

বরং তা সমাজে কার্যকররূপে আমাদের জীবনে হাজির হয়। তাই এসব আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে খুবই গভীরভাবে। আর সামাজিক কাঠামোর বৃহৎ অংশই নিয়ন্ত্রণ করে সেক্যুলার রাষ্ট্র।

তাই সেক্যুলার শাসনব্যবস্থাই আমাদের মধ্যে আধুনিক জাহিলিয়্যাত হিসেবে আমাদের জীবনে কার্যকর হয়।

অতএব এটি কেবল কিছু রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং ইসলাম বনাম আধুনিকতার দ্বন্দ্ব হলো প্রধান সভ্যতার দ্বন্দ্ব, ওয়ার্ল্ডভিউ এর দ্বন্দ্ব, আকিদার দ্বন্দ্ব, সভ্যতার দ্বন্দ্ব।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top