অ্যাপল যেভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করছে

অ্যাপল যেভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করছে – গেজেটের দুনিয়ায় অ্যাপল একটি টেক জায়ান্ট কোম্পানী। ব্রান্ড ভ্যালু থাকার কারণে অ্যাপলের পণ্য অধিকাংশ মানুষের নিকট খুবই পছন্দনীয়।

অ্যাপলের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক কি, তা জানতে হলে আমাদেরকে খানিকটা ইতিহাসের পাতায় প্রথমে চোখ বুলাতে হবে।

ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও আরবরা

আমরা একটু পেছন থেকে শুরু করি। বিশ্বে জায়োনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগেই প্যোলান্ড থেকে দলে দলে ইহুদিরা এসে ফিলিস্তিন ভূমিতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করে।

গুপ্তচরবৃত্তি, গুপ্তহত্যা, মানুষকে ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদসহ নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত একটি ইহুদি গ্রুপ। নাম হাগানাহ। এছাড়াও আরো কিছু গ্রুপ ছিল। যেমন, ইরগুন, লেহি ইত্যাদি।

এই সকল গ্রুপগুলো স্বাধীন ফিলিস্তিনে বিভিন্ন রকম সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জাড়িত ছিল।

যেমন, ১৯৪৬ সালে ইরগুন একটি ফিলিস্তিনি গ্রামে আক্রমণ করে ১০০ এর অধিক মানুষকে হত্যা করে।

১৯৪৮ সালে ইসরাইল ফিলিস্তিনের বড় একটি অংশ দখল করে নেয়। এদিকে জাতিসংঘ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়।

ফলস্বরুপ বহু ফিলিস্তিনি নিজেদের বাড়ি-ঘর থেকে অজানা উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়। এর নাম নাকাবাহ।

জায়োনিস্টদের সন্ত্রাসী সংগঠন হাগানাহ, ইরগুন, লেহি মিলে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর নাম পাল্টে হয়ে গেল IDF বা ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্স।

জায়োনিস্ট ইসরাইল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র দখল করার পরেই  শুরু হয় প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। ১৯৪৮ সালের এই যুদ্ধে তেমন একটা আগ্রহ ছিল না আরব দেশগুলোর।

মূল যুদ্ধ করছিল ফিলিস্তিনিরাই। আর আরব দেশগুলো (মিশর, জর্ডান, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, সৌদি, ইয়ামেন) শুধুমাত্র নামকাওয়াস্তে যুদ্ধে ছিল।

যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ইসরাইল বেশ কিছু আরব এলাকা দখল করে নেয়। ১৯৪৯ এর পরে জায়োনিস্টরা ফিলিস্তিন এবং ফিলিস্তিনের বাহিরে বিভিন্ন ভূখন্ড কব্জা করতে থাকে।

তারা একটা সময় মিসরের সিনাই উপত্যকা দখল করে নেয়। ইসরাইলের এমন আক্রমণের ফলে চরম ঝুঁকিতে পড়ে যায় লেবানন, সিরিয়া ও মিসর।

অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতার বংশের গোঁড়া

ঠিক এই সময়টাতেই একটি টার্নিং পয়েন্ট আসে। আমরা প্রথমদিকের আলোচনায় ফিরে যাচ্ছি।

মধ্যপ্রাচ্যের এমন দুরবস্থার সময়ে সিরিয়ান এক আরব জমিদারের ছেলে লেবাননের বৈরুতের আমরিকান ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যায়।

এই সময়টাতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরব জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। উক্ত জমিদারের ছেলেও এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে।

ফলস্বরুপ সে জেল খাটে। একটা সময় তাকে বৈরুত ছাড়তে হয়। তার জমিদার পিতা সিরিয়াতে সন্তানের কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না।

কারণ, রাজনৈতিকভাবে অবস্থা এমন হয়ে গিয়েছিল, ইসরাইলের সিরিয়ার ভূখন্ড দখল করা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।

তাই জমিদার পিতা তার সন্তানকে পাঠিয়ে দেয় আমরিকার নিউ ইয়র্কে। ছেলেটির নাম আব্দুল ফাত্তাহ আল-জান্দালি।

এই আব্দুল ফাত্তাহ আল-জান্দালির ছেলেই হলো অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস।

একজন মুসলিম পরিবারে এমন সন্তানের জন্ম কিভাবে হলো, সেটাও এক ইন্টারেস্টিং বিষয়।

আব্দুল ফাত্তাহ আমেরিকাতে থাকাবস্থায় জোয়ান ক্যারোল নামক এক খৃস্টান নারীর সাথে সম্পর্ক হয়। পরবর্তীতে তারা বিয়ে করে। এই দম্পতির মধ্যেই জন্ম নেয় একটি শিশু।

কিন্তু এই বিয়ে মেনে নিতে পারে নি মেয়েটির পরিবার। তাই একটা সময়ে এই পরিবারে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।

পরবর্তীতে এই শিশুকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করে পল জবস ও ক্লারা জবস। তারা এই শিশুটির নামকরণ করে স্টিভ পল জবস

স্টিভ জবসের পিতা ছিলেন সিরিয়ান মুসলিম। মা ছিলেন জার্মান বংশদ্ভুত আমরিকান খৃষ্টান।

কিন্তু ছেলে স্টিভ জবস ১৯৭৪ সালের দিকে ভারতে ভ্রমণ করে। এই সময়ে সে বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হয়।

স্টিভ জবসের অ্যাপলের সাথে জায়োনিস্টদের সম্পর্ক

অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস সর্বপ্রথম পার্সোনাল কম্পিউটার তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এছাড়াও প্রযুক্তি দুনিয়াতে অ্যাপল অনেক প্রোডাক্ট বাজারজাত করে।

রাতারাতি সম্পদ বাড়তে থাকে স্টিভ জবসের। এই স্টিভ জবস তার সম্পদের বড় একটি অংশ দান করে দেয় এনজিওতে।

সামনের কথাগুলো বুঝার সুবিধার্থে আমরা এখানে ভিন্ন কিছু এনজিও সংস্থার নাম উপস্থাপন করছি।

Friends of the Israel Defense Forces (FIDF) হলো, ১৯৮১ সালে আমেরিকাতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া জায়োনিস্টজমকে সরাসরি সাপোর্ট করা এনজিও প্রতিষ্ঠান।

HAYOVEL হলো, টমি ওয়ালার নামক এক খৃস্টান জায়োনিস্ট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি এনজিও। এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হলো, ইসরাইলে জায়োনিস্ট খৃস্টান কর্মীদের এনে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্য কাজ করানো। চাষাবাদ করা। ঘর-বাড়ি তৈরি করা, গাছ লাগানো ইত্যাদি। এছাড়াও এই সংস্থা সরাসরি ইসরাইলে জায়োনিস্ট বসতি স্থাপনকারীদের সহায়তা করে।

Jewish National Fund হলো, জায়োনিস্টদের সাপোর্ট করা আরো একটি এনজিও সংস্থা। এরা নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে বৃক্ষ রোপণ (প্রায় ২৫ কোটি। এর ফলে ফিলিস্তিনিদের বাড়ি-ঘরের চিহ্ন পর্যন্ত নেই), পার্ক নির্মাণ করে। এছাড়া এরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকদের ইসরাইলে নিয়ে আসে।

One Israel Fund হলো, আমেরিকায় পরিচালিত জায়োনিস্টদের আরো একটি সংস্থা। তারা জুডিয়া এবং সামারিয়াকে সমর্থন করার জন্য বছরে ২০০টির ও বেশি প্রজেক্ট পরিচালনা করে।

এই জুডিয়া ও সামারিয়া এলাকা হল একটি প্রশাসনিক বিভাগ যা ইসরায়েল রাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিত হয়।

এটি সমগ্র পশ্চিম তীরকে বেষ্টন করে, যা ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েল দখল করে আছে। শুধুমাত্র পূর্ব জেরুজালেম ব্যাতিত।

এখন আবার পূর্বের অ্যাপলের কাছে ফিরে আসি। অ্যাপল উপরোক্ত সংস্থাগুলোর মাধ্যমে জায়োনিস্ট ইসরাইলকে সরাসরি ডোনেশন দেয়।

এমনকি অ্যাপলের ম্যাচিং ফান্ড নামে একটি সিস্টেম আছে।

এটি হলো, কেউ যদি ১০৳ দান করে তাহলে অ্যাপল এটার সাথে আরো ১০৳ যুক্ত করে ২০৳ বানিয়ে ইসরাইলকে দেয়।

এই সকল ডোনেশন আইডিএফ, অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের জন্য পাঠায় অ্যাপল।

আর ডোনেশনগুলো ব্যবহার করা হয় ফিলিস্তিনিদের হত্যা, উচ্ছেদ এবং নির্যাতনের জন্য।

অ্যাপল কোম্পানীর বিরুদ্ধে কর্মী এবং শেয়ারহোল্ডারদের অভিযোগ

একচেটিয়াভাবে ফিলিস্তিনিদের নির্যাতনের জন্য ফান্ড দেওয়ায় প্রতিবাদ করে অ্যাপলের অনেক কর্মী ও শেয়ারহোল্ডার।

ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে কুফিয়া, ব্রাসলেট ও ফিলিস্তিনি পতাকা ব্যবহার করার কারণে বেশ কিছু কর্মীকে সতর্ক করেছে অ্যাপল।

এমনকি অনেককে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করেছে। এই কার্যক্রমকে অ্যাপল সন্ত্রাসী কার্যক্রম বলে উল্লেখ করেছে।

অ্যাপলের কর্মীরা অ্যাপলের নিকট এপ্রিল ২০২৪ এ খোলা চিঠি লিখে। যেখানে ৩০০ জন কর্মীসহ অনেক শেয়ারহোল্ডারদের সাক্ষর ছিল।

তারা অ্যাপলের নিকট ইসরাইলের জন্য ফান্ড দেওয়া বন্ধ করতে দাবী জানায়। কিন্তু অ্যাপল এতে কোনোরূপ কর্ণপাত করে নি।

গাজ্জায় চলমান ইসরাইলি আগ্রাসনের কারণে ৩৫ হাজারের অধিক মানুষ শহীদ হওয়ার পর মে ২০২৪ এ অ্যাপলের নিকট পূনরায় ১৩৩ জন বর্তমান ও সাবেক কর্মী এবং শেয়ারহোল্ডাররা মিলে অ্যাপলের নিকট চিঠি লিখে।

পূর্বেরকার মতো অ্যাপল এবারও কর্ণপাত করে নি। টেক জায়ান্টে অ্যাপলের বড় আধিপত্য থাকার কারণে এবং আমেরিকার সরকার প্রধানদের ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে অ্যাপল কখনো ইসরাইলকে এই সাহায্য দেওয়া বন্ধ করবে না বলে আমার বিশ্বাস।

২০২৩ সালের অক্টোবরে তুফানুল আকসা যুদ্ধ শুরু হওয়ার ২ সপ্তাহ পরেই অ্যাপল IDF কে ৩৪.৫ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পাঠায়। যা বাংলাদেশী টাকায় ৪০০ কোটি টাকার বেশি।

ইসরাইলিদের নৃশংস হামলার কারণে খোদ আমেরিকাতেই যখন ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে মানুষ আন্দোলন করছে, পণ্য বয়কট করা হচ্ছে, সেখানে একেবারে প্রকাশ্যেই অ্যাপল ইসরাইলকে সহায়তা করছে।

আমাদের টাকায় ক্রয় করা অ্যাপলের পণ্য আইফোন, আইপ্যাড, ম্যাকবুক সহ সকল লভ্যাংশের অর্থ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যখন ইসরাইলের কাছে যাচ্ছে আর সেই টাকায় কেনা অস্ত্র দিয়ে আমাদের ভাই-বোন, শিশু-বৃদ্ধদেরকে হত্যা করা হচ্ছে, এর দায় কি আমরা কখনো এড়িয়ে যেতে পারবো?

তথ্যসুত্র

অ্যাপল যেভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করছে শিরোনামের লেখাটির মূলভাব নেওয়া হয়েছে তাহমিদ ভাইয়ের একটি ইউটিউব থেকে

অ্যাপল যেভাবে যুদ্ধাপরাধে জড়িয়ে পড়েছে | Apple War Crime | iTahmid

APPLE MATCHES WORKER DONATIONS TO IDF AND ILLEGAL SETTLEMENTS, EMPLOYEES ALLEGE

133 Apple employees demand company to stop funding Israeli Occupation

Apple accused of sending employee donations to Israeli army, illegal settlers: Report

Employees accuse Apple of donating to groups funding West Bank settlements

লেখাটি শেয়ার করতে সর্ট লিংক কপি করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top