নারীবাদ বা ফেমিনিজম কি এটি নিয়ে আমাদের মুসলিম সমাজে অনেকটা সংশয় এবং খাপছাড়া মনোভাব আছে। কেউ মনে করেন, পশ্চিমা নারীবাদ বা ফেমিনিজম যদিও ইসলাম সমর্থন করে না, এরপরও এটাকে যদি ইসলামের ধারাতে কনভার্ট করা যায়, তাহলে আর মন্দ কি!

বর্তমান সমাজে এই নারীবাদ বা ফেমিনিজম এতটাই মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, অনেক দ্বীনদার তরুণী কিংবা প্রাকটিসিং মুসলিম নারীরাও এই ফিতনার সম্মুখীন হচ্ছেন।

আমরা এই ফেমিনিজম কি এবং এটা কোথা থেকে শুরু, কেন সূচনা হয়, এর উদ্দেশ্য কি, এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ।

নারীবাদ বা ফেমিনিজমের সূচনা

পৃথিবীতে ফেমিনিজমের সূচনা হয় ১৮৩৭ খৃস্টাব্দে। ফরাসি দার্শনিক চার্লস ফুরিয়ে প্রথম ‘নারীবাদ বা ফেমিনিজম’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন।

কিন্তু নারীবাদ বা ফেমিনিজম ও নারীবাদী বা ফেমিনিস্ট শব্দ দুটি আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডে প্রথম ছড়িয়ে পড়ে ১৮৭২ খৃস্টাব্দে।

পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য বা ইংল্যান্ডে ১৮৯০ সালে ও যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকায় ১৯১০ সালে এই ফেমিনিজম বা নারীবাদ ও ফেমিনিস্ট বা নারীবাদী শব্দদ্বয় ব্যবহা শুরু হয়।

আভিধানিকভাবে ফেমিনিস্ট বা ফেমিনিজম কি

কেমব্রিজ ডিকশনারীতে আছে, নারীবাদী বা ফেমিনিস্ট হলো এমন একটি দর্শন যা একজন নারী পুরুষের সাথে মানুষের অভিজ্ঞতার সম্পর্ককে প্রত্যাখ্যান করে।

আর এটি এমন একটি দর্শন, যা বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমস্ত নারীরা পুরুষের আধিপত্য থেকে মুক্তি পেতে চায়।

অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে আছে, নারীবাদী বা ফেমিনিস্ট শব্দের উৎপত্তিকাল হলো ১৮৭২ সাল। আর নারীবাদ বা ফেমিনিজম শব্দের উৎপত্তিকাল হলো ১৮৯৫ সাল।

প্রথম ধাপে ফেমিনিজম আন্দোলন

উনবিংশ শতাব্দীতে একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে ফেমিনিজম বা নারীবাদের সূচনা ঘটে। তখন এটির মূল লক্ষ্য ছিল, নারীদের ভোটাধিকার ও সম্পদের মালিকানাসহ বিভিন্ন আইনি অধিকার আদায়।

যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে তারা এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু তখন থেকেই তারা ধর্মকে অগ্রাহ্য করা শুরু করে।

কারণ, নারীবাদীরা মনে করতো ধর্ম তাদেরকে নৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।

তৎকালীন সময়ে পৃথিবীতে খৃস্টান ধর্ম, ইহুদি ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, নাস্তিকতা এটাই শিক্ষা দিত যে, নারীর সমাজে কোনো অধিকার নেই। নারীরা অচ্ছুত, পাপিষ্ঠ, শয়তানের লাকড়ি ইত্যাদি।

নারীবাদ বা ফেমিনিজম আন্দোলনের সূচনাকালে নারীবাদীরা মনে করতো, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল নারী অধিকার খর্ব করার পেছনেই ভূমিকা রাখে এমনটা নয়। বরং ধর্মই হলো মানুষকে নারী বিদ্বেষী করার উৎস।

কারণ, গির্জাগুলো নারীদেরকে কুমারী বানানোর নাম দিয়ে পাদ্রীদের ধর্ষণের শিকার হতো।

মন্দিরে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল এবং অচ্ছুত বলে তাড়িয়ে দেওয়া হতো।

এজন্যই নারীবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেত্রীদের অন্যতম সুসান বি অ্যানথনি বলেছিল, “নারীর নিকৃষ্টতম শত্রু হলো গির্জার বেদি।”

উনবিংশ শতাব্দীর আরেক উল্লেখযোগ্য নারীবাদী বা ফেমিনিস্ট হলেন এইচ গার্ডনার।

নারীদের বিরুদ্ধে খৃস্টধর্মের পাদ্রীদের বিভিন্ন অপরাধ ও নিপীড়ন নিয়ে সে লেখালেখি করেছিল।

সে তার এক বইতে বলে, ধর্ম আর বাইবেল নারীদেরকে কিছুই দেয় না। অথচ তারা নারীর সবকিছু চায়। নারীর ভালোবাসা চায় কিন্তু বিনিময়ে নারীকে অত্যাচার করে, অবজ্ঞা করে।

এছাড়াও সে আরো বলে, খৃস্টধর্মীয় দেশগুলো নারীদের বিরুদ্ধে যত অত্যাচার করছে, এগুলোর বৈধতা দেয় বাইবেল ও গির্জার বেদি।

উপরে আমরা নারীবাদ বা ফেমিনিজম কি এবং এর সূচনা কিভাবে হয়, সেটা নিয়ে আলোকপাত করলাম।

নারীবাদের তিনটি পর্যায় আছে। আমরা প্রথম পর্যায় বর্ণনা করলাম। এখন আমরা দেখবো নারীবাদের দ্বিতীয় পর্যায় সম্পর্কে আলোকপাত।

নারীবাদের সূচনাতেই আমরা দেখতে পাই, তারা ছিল ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী।

এখন তাদের এই ধর্মবিদ্বেষ যদিও খৃস্টধর্মের সাথে সম্পৃক্ত ছিল, কিন্তু তারপরও আজকে সাধারণ কোনো মুসলমান এটি দেখে ভাববে, ইসলামও হয়তো এমন।

অথচ ইসলাম নিয়ে তার ধারণার স্বল্পতার কথা, সে জানেই নি। নারীবাদের তৃতীয় পর্যায় তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। তাই বিস্তারিত আলোকপাত করলাম না।

নারীবাদের দ্বিতীয় পর্যায়

ফেমিনিজম বা নারীবাদের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ফরাসি দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়ার মাধ্যমে। সে ছিল একজন ধর্মবিদ্বেষী।

সে বলতো, পুরুষের লেখা নিয়মগুলোকেই ঈশ্বর বৈধতা দিয়েছে। আর পুরুষ যেহেতু নারীর উপর কর্তৃত্ব করে, তাই সার্বভৌম সত্তাও সেই ধর্মমতে পুরুষকেই বুঝিয়েছে।

এই সেকেন্ড ওয়েভের আরেক বিখ্যাত নারীবাদী গ্লোরিয়া স্টাইন্যাম ধর্মের ব্যাপারে বলেছে, ধর্ম হলো একটি ধোঁকা।

মৃত্যুর পরে অজানা পুরষ্কারের আশায় একটি বিশ্বাসকে তারা আঁকড়ে ধরে রাখে।

নারীবাদের দ্বিতীয় পর্যায়ে নারীবাদীদের মধ্যে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয় যে, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অসমতা পরষ্পর জড়িত।

তাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী চলতে হবে।

এছাড়াও নারীবাদ সম্পর্কে ইউরোপীয়, আমেরিকান ও এশিয়ান নারীবাদীদের বক্তব্য দেখলে বুঝা যায়, তারা গোঁড়া থেকেই ধর্মবিদ্বেষী।

বাংলাদেশে নারীবাদের উত্থান ও অবস্থান

দক্ষিণ এশিয়ার এই বাংলাদেশে নারীবাদের উত্থান ঘটে বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই। ১৯২৪ সালে বেগম রোকেয়া প্রথম মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে।

যদিও শিক্ষা নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলাটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু আস্তে আস্তে এই কার্যক্রম নারীবাদ বা ফেমিনিজম কার্যক্রমে রূপ নেয়।

ইউরোপীয় নারীবাদীরা যদিও ইসলাম নিয়ে তেমন কোনো কথা বলার প্রয়াস চালায় নি।

কিন্তু বঙ্গদেশের এই নারীবাদী ইসলামের বিভিন্ন বিধান নিয়ে কটাক্ষ করে এবং কাল্পলিক নির্যাতনের ইতিহাস লিখে।

বেগম রোকেয়া সেসময়ে নারীদের বাল্যবিবাহ, পুরুষের বহুবিবাহ প্রথার বিরোধিতা করেছেন। এছাড়াও আরো বিভিন্ন বিষ মুসলিম সমাজে প্রবেশ করানোর চেষ্টা করেছেন।

পরবর্তীতে ১৯৭০ এর পর বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন করা হলে এখানে মহিলারা রাজনীতি, বিভিন্ন ফোরাম, দল বানিয়ে এই নারী জাগরণকে আরো বড় করে।

বাংলাদেশের ফেমিনিজম এভাবেই আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে বাংলাদেশে এই ফেমিনিজমের ধারা শুরু সাধারণ নারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, অনেকে এটাকে ইসলামের আতশ কাঁচে ফেলে পরিমার্জিত করতে চান।

কেউ বা মুসলিম ফেমিনিস্ট নাম দিয়ে বলার চেষ্টা করেন, পশ্চিমা নারীবাদ আমরা মানি না। তবে ইসলামী নারীবাদ আমরা মানি।

এটার উদাহরণ দিতে গিয়ে তারা খাদিজা রা. সহ নবীজির জীবনের অন্যান্য উদাহরণকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেন।

ফেমিনিজম কি ইসলাম সমর্থিত

আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন পবিত্র কুরআনে এবং নবীজি সা. হাদীসের মাধ্যমে মুসলিম নর-নারীর জন্য কর্তব্য ও দিক-নির্দেশনা বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন।

সৃষ্টির শুরু থেকেই আল্লাহ তা’আলা নারীদেরকে বানিয়েছেন কোমলভাবে আর পুরুষদের বানিয়েছেন শারিরিকভাবে সবল করে।

একজন পুরুষ যতটা পরিশ্রম করার সামর্থ্য রাখে মাসের প্রতিটা দিন, একজন নারী তা কখনোই পারে না। এছাড়াও নারীদের প্রাকৃতিক অসুস্থতার কারণেও তারা কর্মবিরতি নিতে বাধ্য হয়।

ইসলাম নারীদেরকে পর্দা করার বিধান এজন্য দিয়েছে, যাতে সে নিজেও নিরাপদ থাকে এবং অপরকেও নিরাপদ রাখে।

কেউ কেউ এখানে পোশাকের স্বাধীনতার নাম দিয়ে যুক্তি দেখান। বাস্তবে এ যুক্তিটা একেবারেই অর্থহীন। যেমন বলা যায়,

স্বর্ণের দোকানদার যদি দোকানে কোনোরূপ নিরাপত্তা না দিয়েই দোকান খুলেন এবং তিনি যদি বলেন, স্বর্ণ হলো সৌন্দর্য। আমি সেই সৌন্দর্য প্রকাশ করলে অন্যের ক্ষতি কি? তাহলে তার দোকান কি ডাকাত, চোরদের হাত থেকে নিরাপদ থাকবে?

বর্তমান নারীবাদীরা বলে, ইসলাম তো নারীদেরকে ঘরবন্দী করে রেখেছে। তারা কেন চাকুরি করবে না? উপার্জন করতে পারবে না?

এখানেও নারীবাদীদের বুঝার ভুল হয়। ইসলাম নারীদেরকে ঘরবন্দী করে নি। বরং নারীদের সুরক্ষা বাড়িয়েছে কেবল।

একজন নারীর সম্মান একজন পুরুষের সম্মানের থেকেও অনেক অনেক বেশি। একজন নারীর সম্মান রক্ষার্থে অনেক খলিফারা যুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন।

নারী ঘরে থাকলে নিরাপদে থাকে। নিজের সন্তানদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে পারে।

একজন সন্তান কেমন হবে, তা অনেকটাই নির্ভর করে মায়ের উপর। মা যেমন হয়, সন্তানও তেমনই হয়।

সুতরাং পশ্চিমাবিশ্ব থেকে আমদানি করা এই ফেমিনিজম বা নারীবাদ ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না। কারণ, এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বিরোধী এবং ধর্মবিরোধী সিদ্ধান্ত।

নারীদের ভোগের বস্তু বানায় কারা ও ফেমিনিজম কি ভালো

অনেকে বহুবিবাহ বা বাল্যবিবাহ দেখতে পারে না। এসব দেখলে তাদের চুলকানি উঠে। খিঁচুনি উঠে।

ফেমিনিজম কি সেটা তো আমরা জেনেছি। বর্তমানে এই ফেমিজিমের প্রভাব কেমন, সেটা কি আমরা ভেবে দেখেছি?

বর্তমান সময়ে নারীদেরকে ভোগের বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করে মিডিয়া, নিউজ পেপার এবং কর্পোরেট হাউজগুলো।

তারা নারীদের ছবি দিয়ে পত্রিকার পাতা সাজায়। বিলবোর্ড সাজায়। বিজ্ঞাপনের প্রচারণা চালায়।

পুরুষদের বিভিন্ন পোশাকেও নারীদের ছবি ব্যবহার করতে দেখা যায়। বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য কিংবা ম্যাগাজিন, সব বিজ্ঞাপনেই নারী থাকবেই।

আজ পর্যন্ত বড় বড় কর্পোরেট হাউজগুলো কোনো পুরুষকে অন্তর্বাস পরিধান করিয়ে কোনো বিজ্ঞাপন করে নি। কারণ, তারা জানে এতে কোনো লাভ নেই। কোনো ফান্ড তারা পাবে না।

তাই তারা নারীদের অর্ধ উলঙ্গ পোশাক পরিধান করিয়ে এবং ছোট ছোট টাইট জামা পরিধান করিয়ে বিজ্ঞাপন করে।

এই সকল কিছুর পেছনে আসে যৌন কামনা, বাসনা, চেতনা ইত্যাদি। নারীবাদীরা বোরকা পরিধান করলে রেগে যায় অথচ শরীর অনাবৃত করে চললে তাকে বাহবা দেয়।

আসলে এসকল কিছুর পেছনে কলকাঠি নাড়ে কিছু অভিজাত লোকেরা।

তারা তাদের মুনাফার লোভে যে কোনো কাজ করতে রাজী। নারীদেরকে এভাবেই বোকা বানিয়ে তারা ব্যবহার করছে।

সহায়ক গ্রন্থ

বিহাইন্ড ফেমিনিজম। মারইয়াম তানহা। সংগ্রহ করুন রকমারি অথবা ওয়াফিলাইফ থেকে।

ফিতনাতুন নিসা। সালেহ আল মুনাজ্জিদ হাফিঃ। সংগ্রহ করুন রকমারি অথবা ওয়াফিলাইফ থেকে।

Scroll to Top