বিয়ন্ড ডেমোক্রেসি বইটার ব্যাপারে কাভারে লেখা আছে, ২০ টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং কোনো সময়ের বেস্ট সেলার বইও ছিল এটি।

বইটাতে আলাদা কি আছে, তা জানতাম না পড়ার আগে। ওয়াফিলাইফে কোনো একদিন এমনিতেই ক্রল করার সময় বইটা সামনে আসে।

নামটা দেখেই কেমন যেন অদ্ভূত লাগলো। ডেমোক্রেসি নিয়ে কথা বলবে! গণতন্ত্র নিয়ে! গণতন্ত্রকে তো হারাম জানি সেই ছোটবেলা থেকেই।

কেন হারাম, কার জন্য হারাম, কিভাবেই বা হারাম হবে, এসব নিয়ে ভাবি নি কখনো। সমীকরণ মিলাতেও যাই নি কখনো।

ওয়াফিলাইফের পিডিএফে ক্লিক করে সূচিপত্রে চোখ পড়তেই দেখলাম, গণতন্ত্র নিয়ে ১৩ টা মিথ দেয়া রয়েছে। বড়ই অদ্ভূত তো!

যেই গণতন্ত্রের জন্য আমাদের দেশের বড় বড় রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ডক্টর, সাংবাদিকরা মায়াকান্না করে, সেই গণতন্ত্র কিনা মিথে বা মিথ্যায় ভরা? কেমন যেন অবিশ্বাস্য!

তখনো বইটা যেহেতু পড়ি নি, তাই বই সম্পর্কে তেমন কিছু আর জানলাম না। অর্ডার করে নিয়ে আসলাম এটি। এরপর পড়বো পড়বো করে রেখে দিয়েছি সেলফের এক কোণায়।

আমাদের এক ক্লাসমেট মাহমুদের বাসায় অর্থাৎ যাত্রাবাড়িতে গিয়েছিলাম একদিন। মালিবাগ থেকে যাত্রাবাড়ি অনেকটা দূর!

এত লম্বা সময় বাসে বসে থেকে কি করবো। তাই ব্যাগে করে বিয়ন্ড ডেমোক্রেসি বইটা নিলাম। দেখি, যদি পড়তে পারি কয়েক পাতা!

প্রথমেই প্রকাশকের কথা, অনুবাদকের কথা, ভূমিকা পড়তে পড়তে আগ্রহ-অনাগ্রহ দুটোই ভেতরে কাজ করতে লাগলো।

একপর শুরু হলো ভেতরের কাহিনী। যদিও এই বইটা পুরোটা বাসে বসে পড়ি নি। বা যাত্রাবাড়িতেই পড়ি নি। পরে বাসায় এসে পুরোটা পড়েছি।

গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থায় আমরা সবচেয়ে উপভোগ করি, নির্বাচন। নির্বাচন আসলেই এলাকায় পোস্টারে ভরে যায়। মিছিল-মিটিং, ক্ষেত্রবিশেষে সংঘাতও হয়।

তার মানে কি যত ভোট দেয়া হচ্ছে, সবই কি গণনা করা হয়? এমন প্রশ্ন শৈশব থেকেই অন্তরে ছিল। লেখক সেই কথাটি এনে ব্যাখ্যা করেছেন।

আরে কিসের গণনা! আমি যে ভোট দিলাম, সেটার ভিত্তিতে দল জেতা বা হারার সম্ভাবনা মাত্র ০.০০০০০০০১%! এটাকে তো পুরোপুরি শূন্যই ধরা হয়। দশমিকের পরের সংখ্যা কবে আবার দামী হলো?

আবার রাজনীতিবিদরা একটা কথা হামেশাই বলে থাকে, গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন। গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণই হয় শাসনের হকদার।

কথাটা শুনতে খুব ভালো লাগলেও এটি যে, এটি মিথ্যা প্রতারণা, একটি নাটক, একটি ফাঁদ সেটা লেখক সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ চায়, সংবিধানে আল্লাহর নাম থাকুক, জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন ব্যক্তিদের চেহারার ফটো ঝুলানো না থাকুক।

কিন্তু এটা কি মানা হয়? যেই দল ক্ষমতায় আসে, সেই দলের পারে না যে, সবার ফটো অফিসে ঝুলিয়ে রাখতে। শেষে দু-একজনের ছবি ঝুলাতেই হয়।

অথচ নবীজি সা. স্পষ্ট হাদীসে বলেছেন, যেই ঘরে কোনো ছবি ঝুলানো থাকে, হোক তা মানুষ কিংবা কুকুর কিংবা অন্য পশু সেই ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না।

জনগণ যা চায়, তা কি হয়? হয় না। গণতন্ত্র হলো, বিভিন্ন ইন্টারেস্ট গ্রুপ এবং এক্টিভিস্টদের দ্বারা তাড়িত রাজনীতিবিদদের ইচ্ছাকে শাসন করে।

দেশে আরেকটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, গণতন্ত্রের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ বা অধিকাংশ জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া হয়।

কথাটা কি বাস্তবসম্মত? আগামীকাল যদি দেশের অধিকাংশ জনগণ শাপলা চত্বরে সমাবেত হয়ে আন্দোলন করে, তাদেরকে কি মেনে নেয়া হবে? ২০১৩ সালে কি মেনে নেয়া হয়েছিল?

দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চায়, দ্রব্যমূল্য কমুক। সিন্ডিকেট বন্ধ হোক। চোরাচালান বন্ধ হোক। কালোবাজারি বন্ধ হোক। টাকাপাচার বন্ধ হোক।

এর কোনোটি কি হয়? এত পরিমাণ টাকা পাচার হয়, পত্রিকায় তা পড়লে মাথা শুধু ভোঁ ভোঁ করে ঘুরে। এত এত চোরাচালান হচ্ছে, তার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।

দ্রব্যমূল্য নিয়ে তো কিছু বলা বারণ। আমরা বেগুনির বদলে কাঠাল খাবো, পেয়াজের বদলে আলু খাবো, ভাতের বদলে কি খাবো, এসব নিয়েও আজকাল সংসদে কথা হয়।

অনেকে আবার ভাবেন, গণতন্ত্রের রাজনীতিবিদরা হয়তো নিরপেক্ষ। এটাও নিশ্চয় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বুঝিয়ে বলা লাগবে না।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে, সংসদে বসে, সাংবাদিক সম্মেলনে কি পরিমাণ ধোঁকাবাজি ও মিথ্যা কথা রাজনীতিবিদরা বলেন, তা তো হামেশায় দেখতে দেখতে এখন শয়ে গেছে।

কেউ কেউ তো গণতন্ত্রকে বানিয়ে ফেলে উন্নয়নের মহাসড়ক। অথচ যেই গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষকে পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেতে উৎসাহিত করা হয়-নিজের বোঝা অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে।

বাংলাদেশে কি পরিমাণ মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে, তা তো আমরা সর্বদাই দেখতে পাচ্ছি। এটা তো এখন আর ইস্যুও হয় না।

সর্বশেষ থমাস জেফারসন এর কথাটা দিয়ে শেষ করি। তিনি বলেছিলেন,

গণতন্ত্র হলো গণশাসন। যেখানে ৫১% মানুষ মিলে বাকী ৪৯% মানুষ এর অধিকার কেড়ে নিতে পারে।

আবার উয়িম কান তো বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের ইচ্ছা। তাই প্রতিদিন সকালে পত্রিকা পাঠের মাধ্যমে নিজের ইচ্ছা জেনে শিহরিত হই।

বিয়ন্ড ডেমোক্রেসি বইটা প্রতিটা বাংলাভাষী পাঠকের পড়া উচিৎ। কারণ, আমরা যেই শাসনব্যবস্থায় আছি, সেই শাসনব্যবস্থা কতুটুকু বৈধ ও এবং কতুটুকু অবৈধ তা সম্পর্কে হয়তো কিছুটা ধারণা লাভ করতে পারবো।

একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের নীতি-আদর্শ ও শাসনব্যবস্থা হওয়া উচিৎ খেলাফত। খেলাফতের কথা বললেই মানুষ মনে করে, শুধু যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি ইত্যাদি।

অথচ তাদের মুসলমানদের সমৃদ্ধি চোখে পড়ে না। তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি চোখে পড়ে না। তাদের চারিত্রিক মূল্যবোধ চোখে পড়ে না।

যুদ্ধ-বিগ্রহ তো এখনো হচ্ছে। কোথাও হয়তো সৈন্য দিয়ে। কোথাও ডলার দিয়ে। কোথাও কম্পিউটার দিয়ে। কোথাও আবার তথ্য দিয়ে।

পৃথিবীতে যুদ্ধ কখনোই বন্ধ হবে না। হবার কথাও নয়। একটা কথা আল্লাহ ষ্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ইহুদী-খৃষ্টানরা তোমাদের ততক্ষণ পর্যন্ত বন্ধ হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের অনুসরণ করো।

Abdur Rahman Al Hasan
Scroll to Top