আমি মৃত্যু দেখেছি – মৃত্যু! হিমশীতল একটি শব্দ। কখনো কখনো ভয়ে কুকড়ে উঠি। বিমর্ষিত হয়ে উঠি। আতঙ্কে চুপসে যাই। অতীত ভেবে আশাহত হই।
এমন কোনো ব্যক্তি আছে কি, যার মৃত্যু হবে না? যার মৃত্যু নেই? যে চিরঞ্জীব? যে মৃত্যুঞ্জয়ী? উত্তর আসবে, নেই। এমন কেউ নেই।
ইতিহাসগ্রন্থে রয়েছে, পূর্বেরকার যামানায় অনেক ব্যক্তি ছিল। যারা নিজেকে বড় মনে করতো। নিজেকে খোদা-ভগবান মনে করতো।
নিজের পূজা-অর্চনা করতে মানুষকে বাধ্য করতো। তারাও কিন্তু একটা সময় কালের গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছে।
গ্রীষ্মকালের এই মুহুর্তে হঠাৎ ভ্যাপসা গরম আবার হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকায় আবার রৌদ্র উঠে চারিদিক আলোকিত করে দেয়।
এমন একটা দিনেই ঢাকার ব্যস্ততম একটি এলাকা দিয়ে হাঁটছিলাম। প্রথম প্রথম রৌদ্রের তাপে বুকের ছাতি ফেঁটে যাবার যোগাড়।
কিন্তু পরক্ষণেই হঠাৎ এক ঝাপটা বাতাস এসে অন্তরসহ গোটা দেহ-মনকে ঠান্ডা করে দিল। অধিক স্বস্তির জন্য একটি খালি স্থানে দাঁড়ালাম।
মেঘলা আকাশ, দক্ষিণা বাতাস, গোধূলির ধূসর এলাকা দেখে খুবই ভালো লাগছিল। স্থানটি খালি হওয়ায় একটা আতঙ্কও ছিল।
যদি বজ্রপাত হয়! তারপরও আল্লাহর উপর হাওয়ালা করে উক্ত স্থানে পরিচিত এক ভাইয়ের সাথে দাঁড়িয়েছিলাম। আমরা পরষ্পর বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করছি।
কখনো এক আলোচনা থেকে প্রসঙ্গ পরিবর্তন হয়ে অন্য আলোচনায় রূপ নেয়। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালো। এরপর বজ্রপাতের আওয়াজ। অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে ছুটাছুটি করছিল।
২
তখনই মনে হলো, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষের কি আপ্রাণ চেষ্টা! নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সে পালাতে চায়।
নিজের শেষ চেষ্টা পর্যন্ত সে ছুটতে চায়। যদি আরো কিছুক্ষণ বেঁচে থাকতে পারি। যদি আরো এক মিনিটের নিঃশ্বাস নিতে পারি।
একটি অতৃপ্তি ও চাপা আর্তনাদ আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। তারপরও এর শেষ রক্ষা হয়তো হয় না। কপালে মৃত্যু লেখা থাকলে মূহুর্তের মধ্যে শেষ।
আর কখনোই সেই গভীর ঘুম থেকে কেউ জাগ্রত হবে না। কখনোই না। দুনিয়া উলট-পালট হলেও না। এই ঘুম মানে শেষ ঘুম। এই ঘুম মানে আজীবন বিশ্রাম। এই ঘুম হলো মরণঘাতি, আত্মঘাতি।
اِنَّ الۡمَوۡتَ الَّذِیۡ تَفِرُّوۡنَ مِنۡہُ فَاِنَّہٗ مُلٰقِیۡکُمۡ
তোমরা যে মৃত্যু হতে পলায়ন কর সেই মৃত্যু তোমাদের সঙ্গে অবশ্যই সাক্ষাৎ করবে। (সূরা জুমআ, আয়াত ৮)
কিভাবে আমরা মৃত্যু থেকে পালাবো? আমরা কিভাবে মৃত্যু থেকে দূরে থাকবো? কিভাবে আমরা মৃত্যুর সাথে সাক্ষাৎ থেকে বিরত থাকবো?
আছে কি কোনো পথ? নেই। এমন পথ নেই। এমন পথ থাকার কথাও নয়। তাহলে উপায়? এই মৃত্যু কি আমাদের জন্য ভয়াবহ হবে?
মৃত্যু কি আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে? সেটা কি আমাদের জন্য আতঙ্কের কারণ হবে? আমাদের জন্য দুঃস্বপ্নের কারণ হবে?
کُلُّ نَفۡسٍ ذَآئِقَۃُ الۡمَوۡتِ ؕ وَاِنَّمَا تُوَفَّوۡنَ اُجُوۡرَکُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ فَمَنۡ زُحۡزِحَ عَنِ النَّارِ وَاُدۡخِلَ الۡجَنَّۃَ فَقَدۡ فَازَ ؕ وَمَا الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَاۤ اِلَّا مَتَاعُ الۡغُرُوۡرِ
প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে তোমাদের কর্মফল পূর্ণ মাত্রায় দেওয়া হবে। আর যাকে জাহান্নাম হতে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে দাখিল করা হবে সে-ই হবে সফলকাম আর পার্থিব জীবন তো ছলনাময় ভোগ ব্যতীত আর কিছুই নয়। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৮৫)
আমরা কি জান্নাতে যাওয়ার মতো আমল করি? প্রতিদিন ঠিকভাবে সালাত তথা নামাজ আদায় করি? আমি কি প্রতিদিন ভালোকাজগুলো করি?
প্রতিদিন কি অন্যের সাথে খারাপ ব্যবহার থেকে বিরত থাকি? প্রতিদিন কি গালি দেয়া থেকে, রাগ করা থেকে বিরত থাকি? আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে উত্তর দেই।
আমরা একটু ভাবি, যদি আজ আমার মৃত্যু হয়, আর গতকাল কারো সাথে আমার ঝগড়া হয়, আমার নামাজ কাযা হয় তাহলে আমি আল্লাহর নিকট কি জবাব দিব?
আমি কিভাবে আল্লাহর নিকট মুখ দেখাবো? মৃত্যু খুবই ভয়ঙ্কর জিনিষ হলেও ঈমানদারদের জন্য এটি সৌভাগ্যের বিষয়।
৩
হযরত বেলাল রা. যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত তখন তার স্ত্রী আফসোস করছিলেন। তখন তিনি বললেন, তোমার তো খুশী হওয়া উচিৎ, কারণ আমি একটু পর মিলিত হবো আমার নবী মুহাম্মাদ সা. এর সাথে। আমি মিলিত হবো আল্লাহর সাথে।
আল্লাহর দিদার লাভে আমি ধন্য হবো। তারা কতটা ত্যাগ করেছিলেন ইসলামের জন্য। আমরা কি তার আধা ইঞ্চিও করেছি? এখানে আমি মৃত্যু দেখেছি । যেখানে মৃত্যু এসেছে ত্যাগের প্রতিদান হিসেবে।
মৃত্যু আমাদেরও হবে, বিগত লোকদেরও হয়েছে। বিধর্মীদেরও হবে। তাহলে তাদের মধ্যে আমাদের অবস্থান কি হবে?
যদি আমি নেক-আমল করে ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করি, তাহলে আমার জন্য রয়েছে জান্নাত। আমার হাশর হবে নেককার মুসলমানদের সাথে।
আর যদি আমি আজীবন গুনাহ করে বদলোকদের মতো মৃত্যুবরণ করি, তাহলে আমার হাশর হবে কাফের-মুশরিক, মুনাফিক ও ফাসিকদের সাথে।
৪
শায়েখ আব্দুর রহমান বিন আরিফী হাফিঃ একটি লেকচারে বলেন, একবার এক পরিচিত ডাক্তার আমাকে বললো, আমেরিকায় থাকাবস্থায় একটা ঘটনা আমার জীবনে আচঁড় কেটেছিল।
প্রতিদিনকার মতো আমি হাসপাতালে রোগীদের বেড নিরীক্ষা করছিলাম। হঠাৎ এক যুবককে দেখে আমার চোখ আঁটকে যায়। তার বয়স হবে আনুমানিক ২১-২২ বছর। সে রোগে কাৎরাচ্ছিল।
আমি তার বেডের পাশে ঝুলিয়ে রাখা প্রেসক্রিপশন ফাইলটি নিয়ে দেখলাম, তার নাম মুহাম্মাদ। আমি বুঝতে পারলাম, সে মুসলমান। আরো জানতে পারলাম, সে এইডস রোগে আক্রান্ত।
হঠাৎ রোগীর অবস্থা আস্তে আস্তে অবনত হচ্ছিল। আমি তখন কর্তব্যরত ব্যক্তিদের থেকে রোগীর মায়ের নম্বর সংগ্রহ করে ফোন দিয়ে বললাম,
আপনার ছেলের অবস্থা খুবই খারাপ। জলদি হাসপাতাল আসুন। উক্ত মহিলা বললেন, আমি একটু ব্যস্ত আছি। পরে আসবো।
আমি তখন জোর দিয়ে বললাম, যদি ছেলেকে শেষবারের মতো দেখতে চান, তাহলে এখুনি আসুন।
কিছুক্ষণ পর মহিলাটি আসলো। ছেলেটি তখন মৃত্যুশয্যায় ছিল। আমি তখন তাকে বলছিলাম, অ্যাই মুহাম্মাদ! বলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
ছেলেটি বলতে পারছিল না। আমি আবার বললাম, অ্যাই মুহাম্মাদ! বলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এরপরও ছেলেটি বলতে পারছিল না।
সে কাৎরাচ্ছিল। আর উহ্ আহ্ শব্দ করছিল। হঠাৎ ছেলেটি আমার দিকে তাকালো। ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হলো, সে কিছু বলতে চায়।
তখন আমি খুশী হয়ে বললাম, হে মুহাম্মাদ! বলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। কিন্তু ছেলেটি এটি না বলে বলো, আমার প্রেমিকা কোথায়? তাকে দেখতে চাই। আমার প্রেমিকা কোথায়? তাকে দেখতে চাই। এটা বলতে বলতে ছেলেটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো।
আমাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখলাম, ছেলেটির মা-ও কাঁদছিলেন।
এরপর উক্ত ছেলেটির মা বললেন, আমার ছেলে বলতো যে, আমি বৃদ্ধ হয়ে মক্কা গিয়ে হজ্জ্ব করে ভালো মানুষ হয়ে যাব। তখন তওবা করে নিব। সংশোধিত হয়ে যাব।
৫
আহ্! ছেলেটির উক্ত ইচ্ছা কোনো কাজে আসলো না। মৃত্যু তাকে তওবা করার সুযোগ দেয় নি। তাকে কালিমা পড়ার সুযোগ দেয় নি। এখানে আমি মৃত্যু দেখেছি । যা এসেছে বিভীষিকাময় হয়ে।
আমরা কি এমন বিভীষিকাময় মৃত্যু কামনা করি? নাকি শান্তিময় ঈমানের সাথে মৃত্যু কামনা করি? তাহলে আমাদের কি করতে হবে?
উপরোক্ত লেখাটি জুন ২০২৩ এ প্রকাশিত মাসিক নবীন দীপ্ত ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে
আরো পড়ুন
গাজ্জার জন্য অনুদান
৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে তুফানুল আকসা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ফিলিস্তিনের গাজ্জায় অসংখ্য মানুষ আহত ও শহীদ হয়েছে। বহু মানুষ নিজেদের ঘর-বাড়ী হারিয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে গাজ্জার ৯৮% মানুষ অনাহারে জীবন-যাপন করছে। গাজ্জার মানুষের এই দুঃসময়ে আমরা যদি তাদের পাশে না দাঁড়াই তাহলে কে দাঁড়াবে?
আর-রিহলাহ ফাউন্ডেশন তুফানুল আকসা যুদ্ধের শুরু থেকেই ফিলিস্তিনের গাজ্জার জন্য ডোনেশন সংগ্রহ করে আসছে। এই মহান কাজে আপনিও আমাদের সাথে যুক্ত হতে পারেন।