শিয়া মতবাদ ও আকীদাগত বিচ্যুতি – শিয়া মতবাদ নিয়ে কলম ধরলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যাবে। বলা যাবে অনেক কিছু। দিন শেষে তাদেরকে আপনি মুসলিম বলবেন নাকি অমুসলিম বলবেন, তা একান্তই আপনার বিষয়।
তবে একটা মূলনীতি হলো, কেউ যদি আল্লাহকে এক বলে স্বীকার না করে এবং নবীজিকে সর্বশেষ বলে স্বীকার না করে তাহলে তাকে কাফের বলা যাবে।
এখন যদি এমন কাউকে দেখেন, যে কিনা রাসূলের উপরেও আরো অনেক ব্যক্তিকে স্থান দেয় তাহলে তাকে আপনি কি বলবেন? ফাসিক নাকি কাফির?
আচ্ছা আমরা যেহেতু শিয়া সম্প্রদায়কে নিয়ে কথা বলছি, তাই তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি।
শিয়া কারা
শিয়া সম্প্রদায় বলতে আসলে কাদের বুঝানো হয়, এ নিয়ে রয়েছে অনেক বিরোধ অনেক মতানৈক্য। তবে আমরা সহজভাবে বলার জন্য জনশ্রুত প্রসিদ্ধ মতটি নিচ্ছি।
মূলত শিয়া বলা হয় তাদেরকে যারা আলী রা. ও মুয়াবিয়া রা. এর দ্বন্দ্বের সময় হযরত আলী রা. এর পক্ষ নিয়েছিল।
এটা কিন্তু শিয়া মতবাদ নয়।
এই সংজ্ঞা দ্বারা এটা বুঝা যায় যে, আলী রা. এর অনুসারীরা হলো, শিয়া ও মুয়াবিয়া রা. এর অনুসারীরা হলো, নন শিয়া বা আহলুস সুন্নাহ।১
(এখানে সুন্নি শব্দটি ব্যবহার না করার কারণ হলো, বর্তমানে সুন্নি শব্দটি অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়।)
কিন্তু এই বক্তব্যটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক নয়। কারণ, এমন বক্তব্য কোনো বই বা উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যক্তিও বলে নি।
কারণ, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত বিশ্বাস করে, সাহাবাদের ইজতিহাদি দ্বন্দ্বে আলী রা. ছিলেন সঠিক।
আর মুয়াবিয়া রা. এর নিকট সঠিক সংবাদ সময়মতো না পৌছার কারণে তিনি ইজতিহাদ করে অগ্রসর হয়েছেন।
আর এই ইজতিহাদ সঠিক হয় নি।
আল্লামা আবুল হাসান আশআরী রহ. শিয়াদের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে,
শিয়া হলো তারা যারা আলী রা. কে সকল সাহাবার উর্ধ্বে মনে করে।২
কোনো কোনো ঐতিহাসিকদের মতে, শিয়াদের সূচনা আলী রা. এর সময় হয় নি।
মূলত তাদের সূচনা হয়েছে হুসাইন রা. এর শাহাদাতের সময়।৩ এই মতটি খুবই শক্তিশালী।
কেন শক্তিশালী বললাম, কারণ আছে। হুসাইন রা. মূলত বিদ্রোহ করেছিলেন ইয়াজিদের খেলাফতকালে।
ইরাকবাসীদের চিঠি হুসাইন রা. এর নিকট
হযরত হুসাইন রা. শুরুতে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কোনো রকম বিদ্রোহে জড়ানোর ইচ্ছা পোষণ করেন নি। তিনি তখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন। সাথে ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা.।
সে সময় ইরাকবাসীরা হুসাইন রা. এর নিকট চিঠি ও প্রতিনিধিদল পাঠাতে লাগলো যে,
আপনি এখানে চলে আসুন। আমরা আপনার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবো।
অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, ইরাকের গভর্নর ছিলেন তখন নুমান ইবনে বশির রা.। ইরাকবাসীরা তার পেছনে নামায আদায় করা ছেড়ে দিল।
হুসাইন রা. ইরাকের অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি ইরাক যাওয়ার মনস্থ করলেন।৪
এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, হুসাইন রা. ইরাকে যেতে চেয়েছেন এই জন্য যাতে ইরাকবাসীরা খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে।
এখানে পরবর্তী ঘটনা আর বিস্তারিত বললাম না। এরপর হুসাইন রা. কারবালায় অবস্থানকালে যুদ্ধ শুরু হয়।
এই যুদ্ধে হুসাইন রা. শহীদ হয়ে গেলেন।৫ সে সময় ইরাকের গভর্নর ছিল উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ।
হুসাইন রা. এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সেনাপতি ছিল উমর ইবনে সা’দ। হুসাইন রা. এর মাথা আলাদা করেছিল খাওলা বিন ইয়াজিদ।৬
এই ঘটনার পর ইরাকবাসীর বোধ উদয় হলো। তারা তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য উমাইয়া শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ইচ্ছা পোষণ করলো।
একটা পর্যায়ে তারা বিদ্রোহ করে এবং বিদ্রোহে অনেক ব্যক্তি নিহত হয়। পরবর্তী সময় তারা শিয়া নামে পরিচিতি লাভ করে।৭ এটাকেও শিয়া মতবাদ বলা যায় না।
শিয়াদের উত্থান তাহলে কখন হলো?
আমরা উপরে দুইটা ব্যাখ্যা পেলাম। একটা মত অনুযায়ী, আলী রা. এর যামানায় শিয়াদের উত্থান ঘটে। অন্য মত অনুযায়ী, হুসাইন রা. এর শাহাদাতের ঘটনার পর বিদ্রোহের মাধ্যমে তাদের উত্থান ঘটে।
আচ্ছা আমরা এটা অন্যভাবে পর্যালোচনা করি। শিয়ারা কি আলী রা. মৃত্যুর স্বরণে কোনো তাজিয়া মিছিল বের করে বা শোক সমাবেশ করে? উত্তর হলো, না।
তাহলে শিয়ারা কি হুসাইন রা. মৃত্যুর স্বরণে তাজিয়া মিছিল বা শোক সমাবেশ করে? উত্তর হলো, হ্যাঁ।
তাহলে আমরা এটাকে হুসাইন রা. মৃত্যুর পরে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিসেবে ধরতে পারি। কারণ, তারা উমাইয়া খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।
এমনকি সে সময়ের শিয়াদের আকীদাগত কোনো বিচ্যুতি ছিল না। তারা অন্যন্য সাধারণ মুসলমানদের ন্যায় আকীদা পোষণ করতো।
তারা আলী রা. কে প্রথম তিন খলিফার উর্ধ্বে মনে করতো না। আবার তারা আলী রা. কে ইমাম ও মনে করতো না।৮
হুসাইন রা. এর হত্যার পর
হুসাইন রা. এর শাহাদাতের দিন তার সকল সন্তানই শহীদ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শুধুমাত্র আলী বিন হুসাইন জীবিত ছিলেন। আলী বিন হুসাইন মূলত যাইনুল আবেদীন বিন হুসাইন নামেও প্রসিদ্ধ ছিলেন।
কারবালার দিন তিনি অসুস্থতার কারণে তাবু থেকে বের হন নি। তাই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণে বেঁচে যান।৯
যাইনুল আবেদীন ছিলেন দুনিয়ার মোহত্যাগী একজন আলেম। তিনি সাহাবাদের আকীদার বিপরীত কোনো কাজ করেন নি।
যাইনুল আবেদীনের সন্তান ছিল দুইজন। একজন ছিল মুহাম্মাদ বাকের রহ. আর অন্যজন ছিল যায়েদ রহ.। তারা উভয়েও সাহাবাদের ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করতেন।
যায়েদ বিন আলী বিন হুসাইন বিন আলী রা.
যায়েদ রহ. একটা বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করতেন। তিনি মনে করতেন, খেলাফতপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে আলী রা. আবু বকর রা. ও ওমর রা. থেকেও অধিক হক্বদার ছিলেন।
আর এটা তিনি উম্মাহর ইজমা ও অনেক হাদীসের বিপরীতে ভিন্নমত পোষণ করতেন।
এখন কথা হলো, যায়েদ বিন আলী কি প্রথম তিন খলিফাকে পছন্দ করতেন না?
উত্তর হলো: অবশ্যই করতেন। তিনি কখনো প্রথম তিন খলিফার মর্যাদা অশ্বীকার করেন নি এবং তাদের শানে বেয়াদবীমূলক কোনো শব্দও ব্যবহার করেন নি।
তারপরও তিনি ভাবতেন, তার দাদা (আলী রা.) খেলাফতের অধিক উপযুক্ত ছিলেন। এ ক্ষেত্রে তার আকীদাগত বা চিন্তাগত কোনো বিরোধ অন্যান্যদের সাথে ছিল না। এটাকে ভুল করে আপনি শিয়া মতবাদ হিসেবে ভেবে বসবেন না।
যায়েদ ইবনে আলী রহ. এর বিদ্রোহ ও হত্যা
যায়েদ রহ. দশম উমাইয়া খলিফা হিশাম ইবনে আব্দুল মালিকের শাসনামলে কুফার কয়েকজন আমিরের কথায় ১২২ হিজরীতে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। আর এই বিদ্রোহে লোকবল তেমন ছিল না। ফলে খলিফা হিশাম ইবনে আব্দুল মালিক তাকে হত্যা করে।
যায়েদ ইবনে আলী রা. ছিলেন তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে বিজ্ঞ আলেম। যদিও তিনি আলী রা. কে অন্যান্য খলিফাদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। কিন্তু তিনি কখনো এটা মনে করতেন না যে, আবু বকর ও ওমর এবং উসমান অন্যায়কারী ছিল।১০
তিনি প্রত্যেক সাহাবার ব্যাপারে সু-ধারণা রাখতেন। তিনি প্রত্যেক সাহাবারা মর্যাদার দিকে খেয়াল রাখতেন।
যায়েদিয়্যাহ মতবাদের উত্থান
যায়েদ রহ. এর মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা নতুন এক মতবাদের উদ্ভব ঘটায়। তবে এই মতবাদে কোনো রকম উল্টাপাল্টা আকীদা ছিল না। তারা শুধুমাত্র যায়েদ রহ. এর মতো আলী রা. কে অন্যন্য খলিফাদের থেকে অধিক যোগ্য মনে করতো।
কিন্তু তারা অন্য খলিফাদেরকে ও মানতো এবং তাদের সম্মান করতো। ইতিহাসে এই দলটিকে “যায়েদিয়্যাহ” নামে অবহিত করা হয়। দলটি মূলত শিয়াদের অন্তর্ভুক্ত একটি দল।
কিন্তু তাদের সাথে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের সাথে মিল থাকার কারণে তাদেরকে শিয়া হিসেবে আলাদাভাবে চেনা খুবই মুশকিল।
তাই তারা শিয়াদের সাথে সম্পৃক্ত হলেও তারা বর্তমান শিয়া মতবাদ এ বিশ্বাসী নয়।
বর্তমানে তারা ইয়ামেন ও আশেপাশের অঞ্চলে বসবাস করে থাকে।১১
রাফেযীদের উত্থান
রাফেযীদের ঘটনা যায়েদ রহ. এর সাথে সম্পৃক্ত। একবার যায়েদ রহ. কে তার অনুসারীদের একটি দল দুই শায়েখ অর্থাৎ আবু বকর রা. ও ওমর রা. সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, তখন তিনি এই দুজনের জন্য রহমতের দোয়া করেন। তখন তারা যায়েদ রহ. কে পরিত্যাগ করে।১২
ইমাম আসমায়ী রহ বলেছেন, রাফেযীদের এই নামে নামকরণের কারণ হলো, তারা যায়েদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আলী রা. কে পরিত্যাগ করেছে।১৩
রাফেযীরা মূলত একদিক থেকে আবু বকর ও ওমর রা. কে বর্জন করেছে। আবার অন্যদিক থেকে তারা যায়েদ রহ. এর চিন্তাধারাকেও বর্জন করেছে। তাই তাদের নাম রাফেযী হিসেবে নামকরণ করা হয়।
পরবর্তীতে তাদের মধ্য থেকে একজন ব্যক্তি ইসনা আশারিয়া তথা বারো ইমামের ধারা গোড়াপত্তন করে।১৪ এটা শিয়া মতবাদ এর সাথে উৎপ্রতভাবে জড়িত।
তালিবিয়্যিনের উত্থান
যায়েদ রহ. রা ছিলেন মুলত দুই ভাই। পূর্বেও এ বিষয়ে বলা হয়েছে। তার আরেক ভাইয়ের নাম ছিল বাকের রহ.। তিনি যায়েদ রহ. এর আট বছর পূর্বেই ইন্তিকাল করেন।
সে সময় তিনি একজন বিদগ্ধ সন্তান রেখে যান। যার নাম জাফর সাদেক রহ.।
জাফর সাদেক রহ. আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের ধারক-বাহক ছিলেন।
উমাইয়া খেলাফতের পতনের পর আব্বাসী খেলাফতের উত্থান ঘটে ১৩২ হিজরীতে। তখন খেলাফতের মসনদে আরোহণ করে আবু আব্বাস ফাফফাহ। তারপর মসনদে আসে আবু জাফর মনসুর।
তখন জাফর সাদেক রহ. এর সমর্থকরা বুঝতে পারে, আলী রা. এর পরিবার খেলাফতের দায়িত্বে আসবে না। তখন তারা এটা নিয়ে হাঙ্গামা সৃষ্টি করে।
পরবর্তীতে তারা এই বিষয় নিয়ে বিদ্রোহ করে। ইতিহাসে এই ব্যক্তিরা তালিবিয়্যিন নামে পরিচিত।১৫
১৪৮ হিজরীতে জাফর সাদেক মৃত্যুবরণ করে। তখন তিনি মুসা কাযেম নামে একজন সন্তানকে রেখে যান।
তিনিও বড় আলেম ছিলেন। ১৮৩ হিজরীতে মুসা কাজেম ও ইন্তিকাল করেন।
তার কয়েকজন সন্তানকে তখন রেখে যান তিনি। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন আলী রেজা।
বিখ্যাত সপ্তম আব্বাসী খলিফা আল মামুন তালেবিয়্যিন ফেতনার ইতি ঘটাতে চাইলেন।
তাই তিনি তার পরবর্তীতে ওলিয়্যুল আহাদ বা ভবিষ্যত খলিফা হিসেবে আলী রেজাকে নির্বাচন করেন।
কিন্তু ২০৩ হিজরীতে আলী রেজা ইন্তিকাল করেন। ফলে তালিবিয়্যিনরা খলিফা মামুনের বিরুদ্ধে তার হত্যার অভিযোগ তোলে।
হুসাইন রা. এর সময় থেকে এই পর্যন্ত শিয়াদের আকীদা
ইতিহাসের গ্রন্থগুলোর মাধ্যমে জানা যায়, এ পর্যন্ত অর্থাৎ তালিবিয়্যিনদের বিদ্রোহ পর্যন্ত শিয়ারা কোনো রকম ভুল আকীদা পোষণ করতো না।
শুধুমাত্র রাফেযীরা ব্যতিত। রাফেযীদের মতবাদ ছিল ভিন্ন। যায়েদিয়্যিনদের দেখেছি আমরা।
তাদের আকীদা আহলে সুন্নাহর মতোই। তালিবিয়্যিনদের আকীদাও আহলে সুন্নতের মতোই। তারা প্রত্যেক সাহাবাকে সম্মান করতো। তারা কাউকে গালি দিত না।
আবু বকর ও ওমর রা. এর খেলাফত মেনে নিত এবং তাদের সম্মান করতো।
শুধুমাত্র এটা মনে করতে যে, আলী রা. উপযুক্ত ছিলেন খেলাফতের। এটাকে আমরা মহব্বতের বহির্প্রকাশ হিসেবে ধরে নিতে পারি।
শিয়াদের আলাদা ধর্মীয় মতবাদের প্রতিষ্ঠা
একটা সময় খুব প্রতাপের সাথে শাসন করা ইরান জয় করেছিলেন সাহাবারা ও তাবেয়ীরা। তারা ইরানে ইসলাম প্রচার করেছেন। মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ ও করেছে। কিন্তু তারা তাদের পূর্ব ঐতিহ্য ভুলতে পারে নি।
তাই তারা পারস্য সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আক্ষেপ করতো। তারা মনে করতো,
মুসলিম আবরবা হলো খুবই নিম্ন জাতি। আর পারসিকরা হলো, উচুঁ জাতি। পারসিক বলা হয়, ইরানের মানুষদের।
এর ফলেই জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান ঘটে। মানুষ তখন নিজেকে মুসলিম পরিচয় না দিয়ে বলতে শুরু করে, আমি অমুক জাতিগোষ্ঠীর লোক।
পারসিকরা নিজেদেরকে পারস্যের অধিবাসী বলে পরিচয় প্রকাশ করতে থাকে।
কিন্তু তখনো তাদের এতটা ক্ষমতা ছিল না যে, তারা মুসলিম খেলাফত তথা আব্বাসীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। কারণ, একদিক থেকে তারা সমাজে মুসলিম হিসেবে পরিচিত।
এখন তো জাতিগত সত্তার কারণে এভাবে বিদ্রোহ করা যায় না। সে সময় তারা এটার সুন্দর সমাধান পায়।
তালিবিয়্যিনরাই হলো এই সমস্যার সমাধান। দলে দলে পারসিকরা তালিবিয়্যিনদের নিকট ভিড়তে থাকে।
একটি সতন্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করে।
পারসিকরা তালিবিয়্যিনদের সাথে যোগ দেয়ার পর শুরু হয় ধর্মের বিধানগুলোতে হস্তক্ষেপ করা। ফলে পারসিকরা ইসলামকে বিকৃত করে ফেলে।
তারা নিজেদের মতো ইসলামের বিধান বানাতে থাকে। ফলে খুব সহজেই সমাজে অশান্তি ও অরাজগতা ছড়িয়ে পড়ে।
তালিবিয়্যিনদের ইমামগণের মৃত্যু ও দ্বন্দ্ব
একটু পেছনে ফিরে যাই। খলিফা মামুন কর্তৃক ভবিষ্যত খলিফা আলী রেজার মৃত্যুর পর তার ছেলে মুহাম্মাদ জাওয়াদ দৃশ্যপটে আসেন। তিনি ২২০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
তখন তার ছেলে আলি হাদী সামনে আসেন। তিনি ২৫৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
এরপর সর্বশেষ তার ছেলে হাসান আসকারি নেতৃত্বে আসেন। কিন্তু তিনিও ২৬০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। আর তিনি উত্তরাধিকারী হিসেবে একজন শিশুপুত্র রেখে যায়।
সর্বশেষে এই শিশুটিও একটা সময় মৃত্যুবরণ করে। শুরু হয় শিয়াদের মাঝে বিভক্ত হওয়া। তারা আদর্শগত ও আকিদাগত বিষয়ে অনেক বিবাধে জড়িয়ে পড়ে।
ইসনা আশারিয়াদের উত্থান
ইসনা আশারিয়া হলো, যারা বারো ইমামের মতবাদ চালু করেছে। শিয়া মতবাদ এর সূচনা হয় এখান থেকেই। তারা বিশ্বাস করে, এই বারো ইমামরা নবী রাসূলের উর্ধ্বে। তারা নিষ্পাপ। তারা কোনো গুনাহ করতে পারে না। এই বারো ইমামদ্বয়েরা হলো,
১. আলী রা.
২. হাসান রা.
৩. হুসাইন রা.
৪. যাইনুল আবেদীন রহ.
৫. মুহাম্মাদ বাকের রহ.
৬. জাফর সাদেক রহ.
৭. মুসা কাযেম রহ.
৮. আলী রেজা
৯. মুহাম্মাদ জাওয়াদ
১০. আলি হাদি
১১. হাসান আসকারি
১২. মুহাম্মাদ আসকারি
তারা ভেবে থাকে বারোতম ইমাম মুহাম্মাদ আসকারি মারা যায় নি। তিনি আত্মগোপনে আছেন। তারা তাকে ঈমাম মাহদী নামেও অবহিত করে থাকে।
বর্তমানে ইরান, ইরাক, লেবাননে এই দলটি বিদ্যমান।
আর এই নিষ্পাপের ধারণা উদ্ভব হয়েছে, পূর্বে পারস্যের রাজবংশ থেকে।
লোকেরা তাদেরকে নিষ্পাপ মনে করতো। তাই তারা এই বারো ইমামকেও নিষ্পাপ মনে করে।১৬
ইসলাম কখনো এই মতবাদকে সমর্থন করে না। এমনকি কোনো মুসলিম রাজবংশগুলোও এমন আকীদা রাখতো না।
উমাইয়া, আব্বাসী, সেলজুকি, উসমানী, আইয়ুবী খেলাফতের কেউই এমন উদ্গট ধারণা পোষণ করে নি।
নাসিরিয়্যাহ সম্প্রদায়ের উত্থান
শিয়াদের মধ্যে আরেকটি দল হলো, নাসিরিয়্যাহ। এরা খুবই উগ্রপন্থী।
তারা নিজেদেরকে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে নাসীর আল মানীরীর সাথে সম্পৃক্ত করে।১৭
এরা মূলত ইসনা আশারিয়াদেরই অন্যতম একটি দল। তারা হযরত আলী রা. কে খোদা হিসেবে সাব্যস্ত করে থাকে। (নাউযুবিল্লাহ)
তারা সর্বদা মুসলমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু তারা খৃষ্টান এবং বর্বর তাতারীদের সাহায্য করেছে। ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে এ ব্যাপারে লেখা আছে।
এটা শিয়া মতবাদ এর পাশাপাশি এমন কিছু আকীদা পোষণ করে, যারা দরূণ তাদেরকে কাফের বলতে হয়।
নাসিরিয়্যাহ সম্প্রদায়ের আকীদা সমূহ:
১. তারা আলী রা. কে খোদা বা খোদার সমতুল্য মনে করে।
২. তারা পুনর্জম্ম বিশ্বাস করে। অর্থাৎ মৃত্যুর পর সে আবার জীবিত হয়। তারা ভেবে থাকে,
যারা আলী রা. এর ইবাদত করে না তারা গাধা ও খচ্চর হয়ে জন্মায়।
৩. তারা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা পালন করে না।
৪. তারা খৃষ্টানদের উৎসব তথা ঈদুল গুতাস ওয়াল বারাবারা পালন করে থাকে।
৫. ঈদুল নাইরোজ বা অগ্নিপূজকদের ঈদ পালন করে থাকে।১৮
নাসিরিয়্যাহদের নিয়ে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে পড়ুন ইবনে তাইমিয়া রহ. রচিত ফাতওয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া। খণ্ড ৩৫
এ পর্যন্তই থাকলো শিয়াদের আকীদাগত বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা। পরবর্তীতে আমরা তাদের রাজত্ব ও ক্ষমতা দখল নিয়ে আলোচনা করবো ইনশাল্লাহ।
তথ্যসুত্র
১. শিয়া, অজানা কিছু কথা। ড. রাগিব সারজানি। মাকতাবাতুল হাসান। পৃষ্ঠা ১৭
২. ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস। ড. আলী মুহাম্মাদ আস সাল্লাবী। মাকতাবাতুন নূর। পৃষ্ঠা ২৩
ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস বইয়ের রেফারেন্স অনুযায়ী, মাকালাতুল ইসলামিয়্যীন। খণ্ড ১। পৃষ্ঠা ৬৫
৩. শিয়া, অজানা কিছু কথা। পৃষ্ঠা ১৭
৪. মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। ইসমাইল রেহান। মাকতাবাতুল ইত্তিহাদ। খণ্ড ৬। পৃষ্ঠা ৪০
মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বইয়ের রেফারেন্স অনুযায়ী, তারিখুত তাবারী। খণ্ড ৫। পৃষ্ঠা ৩৯১। সনদ বিশুদ্ধ
তারিখুত তাবারী। খণ্ড ৫। পৃষ্ঠা ৩৪৭। সনদ বিশুদ্ধ
৫. মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খণ্ড ৬। পৃষ্ঠা ৬৬
৬. মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বইয়ের রেফারেন্স অনুযায়ী, তারিখুত তাবারী। খণ্ড ৫। পৃষ্ঠা ৩৯৭
মারিফাতুস সাহাবা। পৃষ্ঠা ১৭৭৮
৭. শিয়া, অজানা কিছু কথা। পৃষ্ঠা ১৮
৮. শিয়া, অজানা কিছু কথা। পৃষ্ঠা ১৮
৯. মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খণ্ড ৬। পৃষ্ঠা ৬৯
মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বইয়ের রেফারেন্স অনুযায়ী, তারিখুত তাবারী। খণ্ড ৫। পৃষ্ঠা ৩৯০
১০. মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খণ্ড ৮। পৃষ্ঠা ৩২১
মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বইয়ের রেফারেন্স অনুযায়ী, মাকালাতুল ইসলামী। আবুল হাসান আশআরী। খণ্ড ১। পৃষ্ঠা ৬৯
আল কামিল ফিত তারিখ। ১২২ হিজরী ঘটনা সংকলন অধ্যায়
১১. শিয়া, অজানা কিছু কথা। পৃষ্ঠা ১৯
১২. ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস। পৃষ্ঠা ২৪
ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস বইয়ের রেফারেন্স অনুযায়ী, লিসানুল আরব। খণ্ড ৭। পৃষ্ঠা ১৫৭
১৩. ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস। পৃষ্ঠা ২৪
ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস বইয়ের রেফারেন্স অনুযায়ী, আস সিহাহ, ঈমাম জাওহারী রহ.। খণ্ড ২। পৃষ্ঠা ১০৭৮
লিসানুল আরব। খণ্ড ৭। পৃষ্ঠা ১৫৭
১৪. শিয়া, অজানা কিছু কথা। পৃষ্ঠা ২০
১৫. শিয়া, অজানা কিছু কথা। পৃষ্ঠা ২০
১৬. শিয়া, অজানা কিছু কথা। পৃষ্ঠা ২৫
১৭. ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস। পৃষ্ঠা ৩২
১৮. ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস। পৃষ্ঠা ৩৬
ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস বইয়ের রেফারেন্স অনুযায়ী, আল মুজায ফিল আদইয়ান ওয়াল মাযাহিব, নাসিরুল উকল ওয়াল ফাকারি। পৃষ্ঠা ১৩৯
FAQ
শিয়া কারা?
যেসব ব্যক্তিরা আলী রা. কে প্রথম তিন খলিফার উর্ধ্বে মনে করে।
শিয়ারা কি কাফের?
যদি তারা আল্লাহকে এক ও রাসূলকে শেষ নবী বলে স্বীকার করে তাহলে তারা মুসলিম। যদি তারা তা না মেনে কাউকে রাসূলের উপরে মর্যাদা দেয় তাহলে তারা কাফের হতে পারে।
যায়েদিয়্যাহ কারা?
যায়েদিয়্যাহ হলো, যারা যায়েদ বিন আলী বিন হুসাইন বিন আলী রা. কে অনুসরণ করে।
রাফেযী কারা?
রাফেযী হলো, যারা যায়েদ বিন আলী রহ. কে পরিত্যাগ করেছে।
তালেবিয়্যিন কারা?
তালেবিয়্যিন হলো, যারা মনে করে, আলী রা. এর বংশধরের খেলাফত পাওয়া উচিৎ।
ইসনা আশারিয়া কারা?
শিয়াদের মধ্যে যারা বারো ঈমামে বিশ্বাসী।
নাসিরিয়্যাহ কারা?
যারা আলী রা. কে খোদার সমতুল্য মনে করে।