আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা  – মুসলিম উম্মাহর মাঝে সর্বপ্রথম ভুল আকিদা ও বিতর্কিত মতাদর্শের বীজ রোপণ করে একজন ইহুদী। যাকে ইতিহাসের পাতায় আব্দুল্লাহ ইবনে সা’বা নামে উল্লেখ করা হয়েছে।

আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা ছিল ইহুদী বংশের একজন ব্যক্তি। নিজের সুবিধার জন্য সে মুসলিম বলে পরিচয় দিত জনগণের সামনে।

তার উঠাবসা ছিল সে সময়ের পাপিষ্ঠ ও মুনাফিক ব্যক্তিদের সাথে।

আব্দুল্লাহ ইবনে সা’বা সর্বদা ইসলাম ও মুসলামাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করায় লিপ্ত থাকতো।

সময়টি ছিল ইসলামী ইতিহাসের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান রা. এর সময়কার।

স্বার্থের পেছনে…

আব্দুল্লাহ ইবনে সা’বা নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মদীনা, বসরা, কূফা, মিসর ও সিরিয়ায় ছুটে বেড়াতো।

যেখানেই সে গিয়েছে সেখানেই ভেতরে ভেতরে লোকদের উস্কে দিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও বিদ্রোহ লাগিয়ে দিয়েছৈ। সর্বদা সে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতো।

আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা

এই আব্দুল্লাহ ইবনে সা’বা “ইবনে সাওদা” নামেও প্রসিদ্ধ ছিল।

বিশ্বব্যাপি সে ইহুদীবাদ ও ইহুদী বিশ্বাসের বীজ ছড়িয়ে দেয়ার মিশনে নেমেছিল।

আব্দুল্লাহ ইবনে সাবার দাবী

আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা নিজের স্বার্থের জন্য কিছু দাবী সমাজে উত্থাপন করেছিল।

১. তার দাবী ছিল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুবরণ করেন নি। তিনি আবার জীবিত হবেন। সে বলতো,

ওই ব্যক্তির ব্যাপারটি আশ্চর্যজনক যে দাবী করে হযরত ইসা আ. পুনরায় আগমন করবেন। অথচ আগমন করবেন হলো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

কারণ আল্লাহ তো কুরআনে বলেছেন,

“যিনি আপনার প্রতি কুরআনের বিধান পাঠিয়েছেন, তিনি অবশ্যই আপনাকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনবেন। (সূরা কাসাস, আয়াত ৮৫)

২. সে দাবী করতো, প্রত্যেক নবীর একজন করে অসী থাকে। আর আলী রা. হলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসী।

আর মুহাম্মাদ হলেন শেষ নবী আর আলী হলেন শেষ অসী। আর যে ব্যক্তি এই কথার বিরুদ্ধে কাজ করে তার থেকে বড় জালেম আর কে আছে?

ইবনে সাবার কূট-কৌশল

মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে সা’বা তার অনুগত শিষ্য ও অনুচরদেরকে বিভিন্ন ইসলামী রাষ্ট্রে প্রেরণ করতে থাকে।

যাতে তারা মুসলিম গভর্নরদের দোষ-ত্রুটি ও তাদের ব্যাপারে মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ-আপত্তির কথা লিপিবদ্ধ করে খলিফার কাছে প্রেরণ করে।

সে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ করতে উদ্ধুদ্ধ করে। যাতে সাধারণ জনগণ তাদের মূল উদ্দেশ্য বুঝতে না পারে আর তাদের সাথে একাত্বতা পোষণ করে।

আব্দুল্লাহ ইবনে সা’বার উদ্দেশ্য ছিল, যদি খলিফার কাছে এমন সংবাদ পৌছে তাহলে খলিফা গভর্নদের তলব করে এর কারণ জানতে চাইবেন।

আর গভর্নররা যেহেতু এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত নয় তাই তারা বিষয়টিকে অশ্বীকার করবে। এর ফলে খলিফা এবং গভর্নরদের মাঝে মনোদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে এবং বিরোধ সৃষ্টি হবে।

এভাবেই সে বিভিন্ন ইসলামী শহরগুলোতে জগসাধারণকে ক্ষেপিয়ে তোলে। বসরা, কূফা ও মিশরবাসী খুব দ্রুতই এই ফাঁদে পা দিয়ে বসে।

এই ঘটনার সবচেয়ে নির্মম হৃদয়বিদারক ঘটনা হলো, হযরত ওসমান রা. কে নির্মমভাবে হত্যা করা।

ইতিহাসের গ্রন্থগুলো পর্যালোচনা করতে পাওয়া যায়, ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম খলিফা বিদ্রোহ এবং খলিফাকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটায় এই আব্দুল্লাহ ইবনে সা’বা।

প্রোপাগান্ডা

আব্দুল্লাহ ইবনে সা’বা জীবনভর কূটনামি, ষড়যন্ত্র, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার গৃহীত প্রোপাগাণ্ডার কারণে কোনো ঈমানদার এবং ভালো মুসলিম তার ব্যাপারে ভালো মন্তব্য করে নি।

এই ব্যক্তিই সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর রা., হযরত ওমর রা. এর ব্যাপারে বিদ্ধেষ ও বিষেদগার ছড়িয়েছে। কোনো কোনো ব্যক্তি তার ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন,

সে ছিল পাপাচারী, মিথ্যুক, কপটচারী, নাস্তিক, নিজে পথভ্রষ্ট এবং অন্যকে পথভ্রষ্টকারী।

একবার আবু ইসহাক ফারাযী রহ. এর সুত্রে বর্ণনা করেছেন, একবার সুওয়াইদ ইবনে গাফালা নামক এক ব্যক্তি হযরত আলী রা. কে বললেন,

আমি একদল লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় শুনেছি।

তারা আবু বকর রা. ও ওমর রা. এর সমালোচনা করছিল। তারা মনে করে, আপনিও এই ধারণা পোষণ করে থাকেন।

তখন আলী রা. বললেন, আমার ও এই খবীসদের মাঝে কিসের তুলনা? এরপর বললেন, তাদের ব্যাপারে সুন্দর মনোভাব পোষণ না করলে আমি আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।

তিনি তখন আবদুল্লাহ ইবনে সা’বাকে মাদায়েনে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, সে যেন আর কখনো খেলাফতের শহরে না আসে।

এরপর আলী রা. মিম্বারে দাঁড়ালেন। লোকেরা তার কাছে সমাবেত হলো। তিনি দীর্ঘসময় পর্যন্ত হযরত আবু বকর রা. ও হযরত ওমর রা. এর নামে গুণকীর্তন করলেন।

সবচেয়ে তিনি বললেন, আমার কাছে কারো ব্যাপারে যেন এই অভিযোগ না আসে যে, সে হযরত আবু বকর ও ওমর রা. এর নামে অশ্লীল কথা বলেছে।

এমনটা শুনলে আমি তাকে স্মরণকালের শেষ্ঠ শাস্তি দিব।

শেষ পরিণতি

কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, আলী রা. আব্দুল্লাহ ইবনে সা’বাকে হত্যা করার জন্য তরবারী পর্যন্ত বের করেছিলেন। সে সময় কে যেন তার পক্ষে সুপারিশ করে।

এরপর আলী রা. তাকে মাদায়েনে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।

ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস বইয়ে ড. আলী সাল্লাবী হাফিঃ উল্লেখ করেছেন, হযরত আলী রা. আব্দুল্লাহ ইবনে সা’বাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,

তুমি ধ্বংস হও। আল্লাহর কসম! আমাকে এমন কোনো রহস্যময় জ্ঞান দান করা হয় নি, যা তুমি মানুষের কাছে বলে বেড়াচ্ছ।

বর্ণনাকারী আরো বলেন, আলী রা. আব্দুল্লাহ ইবনে সা’বাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

নিশ্চয় কেয়ামতের আগে ত্রিশজন মিথ্যা নবীর দাবীদার আত্মপ্রকাশ করবে। আর তুমি তাদের একজন।

এই কুলাঙ্গার আব্দুল্লাহ ইবনে সা’বার শেষ পরিণতিটা আমার ভালোভাবে জানা নেই।

তবে ড. আলী সাল্লাবী লিখেছেন, ইমাম যাহাবী রহ. বর্ণনা করেছেন, আলী রা. আব্দুল্লাহ ইবনে সা’বাকে পুঁড়িয়ে মেরেছেন।

হাফেজ ইবনে হাজার রহ. লিখেছেন, সাবায়ীরা বা শিয়ারা আলী রা. কে খোদার সমতুল্য মনে করতো।

ইবনে হাজার রহ. ও লিখেছেন, আব্দুল্লাহ ইবনে সা’বাকে আলী রা. পুঁড়িয়ে হত্যা করেছেন।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আপনারা নিশ্চয় বুঝেছেন, মুসলিম বিশ্বে ইহুদীদের ষড়যন্ত্র কতটা গভীরভাবে ধারণ করেছিল। সাধারণ মুসলমানরা এই ফেৎনার কারণে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল।

তারা কোনদিকে যাবে, কাদেরকে অনুসরণ করবে, সেটা নিয়ে পুরো বিভ্রান্ত ছিল।

আল্লাহ আমাদের সকলকে ফেতনা থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

তথ্যসুত্র

১. ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাসড. আলী মুহাম্মাদ আস সাল্লাবী। মাকতাবাতুন নূর। পৃষ্ঠা ২৭

২. ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস। পৃষ্ঠা ২৭

৩. ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস। পৃষ্ঠা ২৭

৪. ফাতমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস। পৃষ্ঠা ২৮

৫. ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস। পৃষ্ঠা ২৮

৬. ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস। পৃষ্ঠা ২৯

৭. ফাতেমী সাম্রাজ্যের ইতিহাস। পৃষ্ঠা ৩০

আরো পড়ুন

হালিমার বাড়িতে নবীজির শৈশব

শিয়া মতবাদ ও আকীদাগত বিচ্যুতি

উবায়দুল্লাহ মাহদী কিভাবে শিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলো?

FAQ

আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা কে ছিল?

আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা ছিল জন্মগতভাবে ইহুদী। পরবর্তীতে মুসলমান হয়। কিন্তু সে মুনাফিক হিসেবে জীবন পার করে।

আব্দুল্লাহ ইবনে সা’বা নবীজির ব্যাপারে কি বলতো?

ইবনে সাবা বলতো, ঈসা আ. যদি পূনরায় পৃথিবীতে আসতে পারেন তাহলে নবীজি সা. ও আবার পৃথিবীতে আসবেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা আলী রা. এর ব্যাপারে কি বলতো?

সে বলতো, তিনি হলেন নবীজির পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত। সুতরাং আবু বকর, ওমর, উসমান রা. অবৈধভাবে খেলাফতে ছিলেন।

Abdur Rahman Al Hasan
Scroll to Top