ইসলামী গণতন্ত্রের স্বরূপ সন্ধানে

ইসলামী গণতন্ত্রের স্বরূপ সন্ধানে – উপনিবেশ শাসনামলের পরবর্তী সময়ে যখন দখলদাররা মুসলিম ভূমি থেকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করল তখন একটি সমস্যা প্রকট আকারে দেখা দিলো।

ইউরোপিয়ানরা চাচ্ছিল, তাদেরই অনুগত ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতা বুঝিয়ে দিতে দেশত্যাগ করতে। তারা সর্বদাই কিছু ব্যক্তিদের স্কলারশিপ দিয়ে ইউরোপ থেকে লেখাপড়া করিয়েছিল।

এই ‘জাতে দেশি, চিন্তায় বিদেশি’ ব্যক্তিদের হাত ধরেই মুসলিমবিশ্বে সেক্যুলারিজমের উত্থান ছড়িয়ে পড়ে।

পশ্চিমারা তখন ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টের আদলে নির্বাচন করার প্রস্তাব দিল। যারা জয়ী হবে, তাদের হাতে ক্ষমতা বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

মুসলিমবিশ্বের উলামায়ে কেরামগণ বহু আগেই পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার কুফলসমূহ ধরতে পেরেছিলেন। তাই উলামায়ে কেরামগণ কোনোমতেই গণতান্ত্রিক পন্থায় আগ্রহী হলেন না।

তারা এর শক্ত বিরোধিতা করলেন। কিন্তু একটা সময় দেখা গেল, কোনো কোনো আলিম সরকারে যাওয়ার অন্য কোনো প্রক্রিয়া সিস্টেমের মধ্যে না পেয়ে এই গণতন্ত্রকে বিভিন্ন কঠিন শর্তের ভিত্তিতে গ্রহণ করলেন।

তাদের নিকট গণতন্ত্র মূল উদ্দেশ্য ছিল না, বরং তারা গণতন্ত্রকে গ্রহণ করলেন পার্লামেন্টে যাওয়ার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যাতে পার্লামেন্টে গিয়ে ইসলাম কায়েম করতে পারেন।

আস্তে আস্তে এই চিন্তা গ্রহণ করে নিল মুসলিমবিশ্বের বিভিন্ন ইসলামী দলসমূহ

যেমন মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিন, জর্ডানের ইসলামিক অ্যাকশন ফ্রন্ট, ইয়েমেনের আল-ইসলাহ পার্টি, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, তিউনিশিয়ার আন-নাহদা ইসলামিক পার্টি, আলজেরিয়ার ইসলামিক স্যালভেশন পার্টি, তুরস্কের সাদাত পার্টি, মালয়েশিয়ার পার্টি ইসলাম-ই-মালোয়শিয়া ইত্যাদি।

দেখা গেল, প্রথম প্রজন্ম এই গণতান্ত্রিক পন্থাকে গ্রহণ করেছিলেন প্রক্রিয়া হিসেবে, পরবর্তী প্রজন্ম গণতন্ত্রকেই মূল বানিয়ে নিল।

প্রথম প্রজন্মের যুক্তি ছিল, পার্লামেন্টের নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটা সময় তাদের আসনের মধ্যেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসবে।

পরবর্তী সময়ে তারা সর্বোচ্চ আসন পেয়ে সরকার গঠন করবে। এর মাধ্যমেই ইসলামী শাসন কায়েম হবে। যুক্তির আঙ্গিক থেকে এটি সুন্দরই বটে।

প্রক্রিয়া

কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় অন্য জায়গায়। ইসলামী শাসনব্যবস্থা তৈরির এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে সরকার গঠন করা হয়েছিল।

কিন্তু কোনো সরকারই টিকে থাকতে পারেনি। কাউকে অপসারণ করা হয়েছে, কেউ কেউ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে, কারও ক্ষেত্রে সামরিক ক্যু করা হয়েছে।

মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিন, আলজেরিয়ার ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট, তুরস্কের রেফাহ পার্টি এর জ্বলন্ত উদাহরণ।

এটি কেন হয়? কারণ, আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলো কখনোই  চাইবে না দেশে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম হোক।

তাই কোথাও চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে, কোথাও অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে এই কাজটি করা  হয়। আরেকটি প্রক্রিয়া হলো দেশের সামরিক বাহিনী কর্তৃক।

বর্তমান বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর সামরিক বাহিনী জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেয়। এর পর তারা জাতিসংঘের হয়েও কাজ করে।

সেনাবাহিনীর চিন্তাচেতনা হলো সেক্যুলার কেন্দ্রিক। তাই তারা কখনোই ইসলামী শাসনব্যবস্থাকে সহ্য করবে না। তারা ক্যু করবে। হয় নিজেরা করবে অথবা বহির্বিশ্বের প্ররোচনায় হলেও করবে।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে গিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া, এরপর ইসলাম কায়েম করা, এটি নববী পন্থা নয়। নবীজি ﷺ, সাহাবায়ে কেরাম, খাইরুল কুরুন (ইসলামী স্বর্ণযুগ), এমনকি ﷺ ১৯২৪ সালে খিলাফত ধ্বংসের আগ পর্যন্ত এই গণতান্ত্রিক পন্থা মুসলিমরা কখনো দেখেনি।

উসমানীয় খিলাফতের শেষের দিকে ইউরোপ থেকে পড়াশোনা করে আসা ছাত্ররা ইউরোপীয় চাকচিক্যে মুগ্ধ হয়ে তারাও এনলাইটেনমেন্টের মতো ধর্মকে ছুড়ে ফেলতে চাচ্ছিল।

এই লক্ষ্যে তারা আন্দোলন করে। সুলতান আব্দুল হামিদ পার্লামেন্ট গঠনের অনুমতি দিয়েছিলেন সাময়িকভাবে পরিস্থিতি দমানোর জন্য। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনিই এই পার্লামেন্টকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।

পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ক্ষমতায় গিয়ে এরপর ইসলাম কায়েম করার প্রক্রিয়াটিই ভুল। একে তো এতে ইসলামের অবমাননা করা হয়।

দ্বিতীয়ত এখানে ইসলামের স্বকীয়তা ক্ষুণ্ণ হয়। সংক্ষেপে পার্লামেন্ট প্রক্রিয়াটি এখানে উল্লেখ করি। সাধারণত গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্রধানত দুই রকমভাবে সরকার গঠিত হয়।

এক, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। দুই, পার্লামেন্ট নির্বাচন। যদিও কিছু কিছু দেশে উভয়টাকে মিশ্রিত করেও সরকার গঠিত হয়। আমরা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে পার্লামেন্ট নির্বাচন দিয়ে উদাহরণ দিই।

আমাদের দেশের উদাহরণ

দেশে ৩০০ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যে-ই দল ১৫১টি আসনে জয়লাভ করে, তারাই ক্ষমতায় যাবে।

ধরা যাক, কোনো একটি ইসলামী দল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ক্ষমতায় গিয়ে সরকার গঠন করল।

এরপর কি তারা সংবিধান থেকে ইসলামবিরোধী আইনগুলো বাতিল করতে পারবে?

সংসদে বিল উপস্থাপনের মাধ্যমে কোনো আইন যুক্ত বা বাতিল হতে পারে।

যেহেতু ১৫১টি আসন উক্ত ইসলামী দলের দখলে, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন সম্ভব। তাই না? না।

বিষয়টা এত সহজ নয়। যেমন মদের আইন বাতিল, চুরি-ব্যভিচারীর শাস্তি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে? প্রথমে পার্লামেন্টে এটি উপস্থাপন করা হবে।

এরপর হ্যাঁ-না ভোট হবে। হয় হ্যাঁ ভোট জিতে মদের আইনকে বাতিল করবে, চুরি-ব্যভিচারীর কুরআনী শাস্তি বাস্তবায়ন করবে।

অথবা না ভোটের মাধ্যমে মদের আইন বহাল রাখবে, চুরি-ব্যভিচারীর কুরআন শাস্তিকে রহিত করা হবে।

ধরা যাক, তারা হ্যাঁ ভোটের ভিত্তিতে এটিকে বাতিল করল। মদকে হারাম ঘোষণা দিল, চুরি-ব্যভিচারীর কুরআনী শাস্তি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিল।

এতেই কি ইসলাম কায়েম হয়ে গেল? মদ হারাম হওয়ার আদেশ কার? আল্লাহর। চুরি-ব্যভিচারের কুরআনী শাস্তির আদেশ কার? আল্লাহর।

আল্লাহর দেওয়া আদেশ-নিষেধকে কি মানুষ আবার ভোটাভুটির মাধ্যমে যাচাই করতে পারে? সংসদের চিত্রটা তো সেদিন এমন হবে, হয় আজ আল্লাহ জিতবে অথবা আজ গণতন্ত্র জিতবে। নাউজুবিল্লাহ!

আল্লাহর বাতলে দেওয়া হারাম কাজকে কোনো সংসদের অধিকার নেই হালাল বানানোর কিংবা হারাম বানানোর।

কেননা তা আগে থেকেই হালাল অথবা হারাম। এরপরও আমরা যদি ধরে নেই, তারা মদের আইন বাতিল করতে সক্ষম হলো, চুরি-ব্যভিচারের কুরআনী আইন বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হলো।

এরপর কি হবে? ৫ বছর পর আবার নতুন দল আসবে সংসদে। তখন তারা আবার মদকে হালাল হিসেবে ঘোষণা দেবে, চুরি-ব্যভিচারের কুরআনী আইনকে হারাম হিসেবে ঘোষণা দেবে।

এতে তো আল্লাহর আইন নিয়ে ফুটবল খেলা হলো। একবার একদল এই গোলপোস্টে কিক করছে, আবার অন্য দল অন্য গোলপোস্টে কিক করছে। যার যেভাবে ইচ্ছা লাথি দিচ্ছে, আঘাত হানছে।

উপায়

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যে-ই দল ক্ষমতায় যায় তাদেরকে সংসদে শপথ পড়ে এরপর দায়িত্ব নিতে হয়।

আর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার শপথের মধ্যে অন্যতম মূলনীতিই থাকে গণতন্ত্রকে রক্ষা করা।

অথচ ইসলাম কোনো হারাম প্রক্রিয়াকে রক্ষা করার জন্য শপথ করাকে সমর্থন করে না।

দেশের প্রেসিডেন্ট, আদালতসহ অন্যান্য স্বাধীন সত্তাগুলো তো আছেই। তারা যে-ই কোনো মুহূর্তে ইসলামী দলকে উৎখাত করতে পারে।

সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করে বলবে, তোমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করতে পারছ না। যেমনটা অন্যান্য দেশে ঘটেছে।

তাই প্রচলিত গণতান্ত্রিক সিস্টেমে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কখনোই ইসলাম বাস্তবায়িত হতে পারে না। ইসলামী হুকুমত কায়েম হবে না।

গত ১০০ বছরে গণতন্ত্রের মাধ্যমে বিশ্বের ১ ইঞ্চি জায়গাতেও ইসলামী শরীয়াহ প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে সেই পদ্ধতিতে, যে-ই পদ্ধতিতে নবীজি ﷺ ও সাহাবায়ে কেরামরা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তা হলো ইদাদ এবং জিহাদ।

জিহাদ ছাড়া উম্মাহ কখনোই ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাস্তবায়িত করতে পারবে না।

যতই সংসদীয় পন্থা থাকুক না কেন, যতই ইসলামের নামে দেশ প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন।

সেক্যুলার সিস্টেমে ইসলাম কখনো বাস্তবায়ন হবে না। ইসলাম এবং সেক্যুলারিজম কখনো এক হতে পারে না।

সেক্যুলারদের একটি পতাকা আছে। ইসলামের একটি পতাকা আছে। সেক্যুলার সিস্টেম বিশ্বকে এক দৃষ্টিতে দেখে। ইসলাম বিশ্বকে অন্য দৃষ্টিতে দেখে।

সেক্যুলারদের নিকট ইসলামের মাপকাঠি হলো তাদের বাতলে দেওয়া কার্যক্রমের মধ্যে। আপনি ‘অনুমোদিত ইসলাম’ এর বাহিরে যেতে পারবেন না।

গেলে আপনি আর সেক্যুলারদের পক্ষের নন। হয়ে যাবেন জাতের শত্রু।

যতদিন সেক্যুলারদের পতাকাতলে গিয়ে ইসলামকে বিজয়ী করার স্বপ্ন দেখা হবে ততদিন সেটা হবে দিবাস্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, অলীক কল্পনা, ভ্রান্তি বিলাস।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top