মুঈয বিন বাদিশ সনহাজি
(৪০৬-৪৪৯ হিজরী)
আমির মুঈয বিন বাদিশ ছিলেন আফ্রিকায় নিযুক্ত ফাতেমী সাম্রাজ্যের আমির। তিনি তার পিতার মৃত্যুর পর ৪০৬ হিজরীর জিলহজ্জ মাসে শাসক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
তিনি ছিলেন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অনুসারী। তিনি শিয়া মতবাদকে দুচোখে দেখতে পারতেন না।
এর পেছনে অবদান রেখেছিলেন তার সম্মানিত শিক্ষক শায়েখ আবুল হাসান।
শায়েখ আবুল হাসান ছিলেন মালেকি মাজহাবের বিখ্যাত ফকীহ। তিনি মুঈযের ছোটবেলার শিক্ষক ছিলেন।
শৈশবে তিনি মুঈযকে দ্বীনের সঠিক বিষয়গুলো শিক্ষা দিয়েছেন।
তাই মুঈয বিন বাদিশ ছিলেন দীন-ধর্ম সম্পর্কে বিশুদ্ধ চিন্তার ধারক-বাহক।
তিনি শিয়া মতবাদকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। তিনি সে সময় তার অধিনস্ত এলাকার লোকজনকে সংশোধনের জন্য তাবলীগ ও দাওয়তি কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
এমনকি মুইয সে সময় জুম্মার খুতবায় আব্বাসী খেলাফতের সম্মানিত খলিফা আল কায়িম বি আমরিল্লাহর নামে খুতবা চালু করেন।
ফাতেমীদের সাথে বিরোধ
ফাতেমীরা যখন জানতে পারলো মু্ঈয তাদের বিরোধী হয়ে গেছে তখনই তারা তৎকালীন বিখ্যাত সেনাপ্রধান মুস্তানসিরকে প্রেরণ করে।
আমীর মুইয বিন বাদিশ কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন।
মুস্তানসির তখন মুইযকে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি আমাদের আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করলে না কেন,
যেমন তোমার বাপ-দাদারা আমাদের বশ্যতা স্বীকার করতো?
মুইয বিন বাদিশ তখন জবাব দিলেন, তোমাদের পূর্বসূরীরা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে আমার পূর্বপুরুষরা আফ্রিকা শাসন করেছেন। তাই তোমাদের রাজত্ব কায়েমে আমাদের অনেক অবদান রয়েছে।
যদি আমরা শুরুতেই তোমাদের টুটি চেপে ধরতাম তাহলে আজ তোমরা এ পর্যন্ত আসতে পারতে না। আর আমার সামনে দাঁড়ানোর সাহস করতে না।
প্রকাশ্য বিরোধ
মুঈয বিন বাদিশ প্রকাশ্যে ফাতেমী শিয়াদের বিরোধিতা শুরু করেন ৪৩৫ হিজরীতে।
তারপর থেকে তিনি তার বাহিনী, সাম্রাজ্যব্যস্থা ইসলামের সঠিক মতাদর্শে পরিচালনা শুরু করেন।
সে সময় মানুষ নবীজির সাহাবাদের গালি দিতেও দ্বিধাবোধ করতো না।
তারা সাধারণ মানুষদের সম্পদকে হালাল মনে করতো।
মুইয ক্ষমতায় আসার পর সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন, যারাই সাহাবাদের গালি-গালাজ করবে তাদেরকেই হত্যা করা হবে।
এরপর থেকে উত্তর আফ্রিকায় উবায়দিয়া ফাতেমীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কমে যেতে থাকে।
আলেমগণ বিভন্ন গ্রন্থে মুইযের প্রশংসা করেছেন। কবিরা তাদের কবিতায় কাব্য লিখেছে।
জনৈক কবির কাব্য
জনৈক কবি আনন্দে উল্লাসিত হয়ে বলেছেন,
“হে দ্বীনের সম্মান বৃদ্ধিকারী আমীর মুঈয! আপনি আনন্দচিত্তে, তৃপ্তি সহকারে ও প্রশান্ত মনে বসবাস করুন।
আপনি প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সা. কে সন্তুষ্ট করেছেন।
আপনি পিছিয়ে পড়া জাতিকে উদ্ধার করেছেন। আপনি সকল দেশে জিহাদকে তাদের প্রিয় বানিয়েছেন।”
অবশেষে মুইয আস্তে আস্তে তার অঞ্চলকে আহলুস সুন্নাহ মতাদর্শ অনুযায়ী পরিচালিত করতে থাকেন।
তার নিকট আলেম-উলামারা আসতে থাকে। তিনি মিসর ভূখনণ্ড থেকে উবায়দিয়াদের আস্তানা বিচূর্ণ করে অগ্রসর হতে থাকেন। নিজ অঞ্চলে তিনি আহলুস সুন্নাহকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
কার্যক্রম
পরিশেষে তিনি নিজের অঞ্চলকে আব্বাসীদের শাসনাধীন করে ঘোষণা দেন এবং ফাতেমীদের মুদ্রা ও পতাকা অচল বলে ঘোষণা করেন।
তিনি নতুন মুদ্রার প্রচলন শুরু করেন। যার মধ্যে লেখা ছিল, সূরা আলে ইমরানের ৮৫ নং আয়াত।
৪৪৩ হিজরীতে বারাকা অঞ্চলের আমীরও মুইযের সাথে যোগ দেয়। এতে তার দল আরো বড় হয়।
ফাতেমীরা তখন মুইযকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে যানাতা সম্প্রাদায়কে মুইযের পেছনে লাগিয়ে দিল।
এর ফলে মুইযের সাথে এক রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা হয়।
উত্তর আফ্রিকায় বিভিন্ন গোত্রের অভিযান
বনী হিলাল ও বনী সুলাইম গোত্র বসবাস করতো আরবে।
তাদের ফসলী জমি মক্কা, মদীনা, তায়েফ, ও নজদ পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল। কারামেতা সম্প্রদায় তাদেরকে আব্বাসী খেলাফত ও ফাতেমী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্ররোচিত করে।
কারামেতাদের চিন্তাধারা ও মতাদর্শে এই গোত্র সমূহের কতিপয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি প্রভাবিত হয়ে যায়।
কারণ, এই গোত্রগুলো চাইতো এসব সাম্রাজ্য থেকে বের হয়ে নিজেরা স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন করতে। যখন ফাতেমীরা এই বিষয়ে জানতে পারলো তখন তারা তাদেরকে অর্থ সম্পদের লোভ দেখিয়ে নিজেদের দলে ভেড়াতে সক্ষম হলো।
ফাতেমীরা তাদেরকে নীলনদের নিকটস্থ উর্বর জমিগুলো তাদেরকে দিয়ে দিল।
এর ফলে উক্ত গোত্রগুলো তাদের নেতৃত্বের ভার ফাতেমীদের হাতে অর্পন করে।
এভাবেই ফাতেমীদের নিকট মুসলমানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান মক্কা-মদীনা দখলে চলে আসে।
ফাতেমীরা মূলত এই গোত্রগুলোকে নিজেদের কাছে টেনে নিয়েছিল অন্য একটি কারণে।
যাতে তারা মুঈয বিন বাদিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কারণ, ফাতেমীদের সেনারা তখন সিরিয়া ও প্রাচ্যে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।
এদিকে আফ্রিকায় মুঈয বিন বাদিশের সনহাজি সাম্রাজ্যের প্রতাব ক্রমে ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল।
তাই ফাতেমীরা বনু হিলাল ও বনু সুলাইমকে কাছে টেনে নেয়।
এই গোত্রগুলো পারষ্পরিকভাবে দ্বন্দ্ব বিবাদ, অনাচার ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে পারদর্শী ছিল।
আমীর মুস্তানসির আরব গোত্রগুলোকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,
আমি তোমাদের নিকট মুঈযের ভূমির মালিকানা প্রদান করলাম। তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তা দখল করে নাও।
৪৪২ হিজরীতে আবর গোত্রীয় সম্মলিত যোদ্ধারা যাত্রা শুরু করে। ফাতেমীরা তখন মুঈযের নিকট চিঠি পাঠিয়ে লিখে, আমরা তোমার নিকট এমন বাহিনী পাঠাচ্ছি, যারা রণ-কৌশলে পারদর্শী। এটা আল্লাহর ফায়সালা ছিল।
আরবীয় বাহিনীর দখলদারিত্ব
আরবের বাহিনী প্রথমে এসে উত্তর আফ্রিকার সাধারণ মানুষের সাথে মেশা শুরু করে।
এরপর তারা মুঈয বিন বাদিশের সাথে দেখা করার জন্য জিরি সাম্রাজ্যের রাজধানীতে আগমন করে।
সেখানে মুঈয তাদের উত্তম মেহমানদারী করে।
মুঈয তখনও জানতো না, তাদেরকে ফাতেমী শিয়ারা পাঠিয়েছে। আবরবা কিছুদিন পর দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে থাকে। চুরি, ডাকাতি, হত্যা ও আরো জঘন্য কাজ করায় মুঈয তাদেরকে প্রতিহত করতে যায়।
কিন্তু আবরবা অনেক বড় দলের থাকায় তারা যুদ্ধের আহবান জানায়। পরিশেষে মুঈয তার সেনা ও দাসদের নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হন।
আবরদের এই বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা ছিল ৩ হাজার।
আরববা এত বড় বাহিনী দেখে ভয় পেয়ে গেল। তারা বুঝতে পারছিল না, কি করবে।
তখন তারা বলাবলি করতে লাগলো, আজ তো পলায়নের দিন।
সে সময় তাদের নেতা মুনিস বিন ইয়াহইয়া বললো, না আজ পলায়নের দিন নয়।
লোকেরা তাকে বললো, আমরা কিভাবে যুদ্ধ করবো? তারা তো বর্ম ও অস্ত্রসজ্জিত হয়ে আছে।
তখন তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা তাদের চোখের মধ্যখানে আঘাত করবে।
এ জন্য এই যুদ্ধের নামকরণ করা হয় ইয়াওমুল আইন নামে।
ইয়াওমুল আইনের দিন
উভয় দলের মধ্যে মারাত্বক যুদ্ধ হতে লাগলো। ক্রমে ক্রমেই লড়াই ভয়াভহ আকার ধারণ করতে থাকে।
সনহাজিরা বুঝতে পারে, এখানে জয়ী হওয়া অনেকটা কঠিন হবে। তাই তারা মুঈযকে তার দাসদের সঙ্গে রেখে সৈন্যরা পলায়ন করে। যাতে তারা আরবদের দ্বারা নিহত না হয়।
শেষ পর্যন্ত মুঈয যুদ্ধে হেরে যায়। সে পরাজিত সৈন্যের ন্যায় কারওয়ানে প্রবেশ করে।
মুঈয এসেই আবার যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহন করে। ৪৪২ হিজরীর ঈদুল আযহার দিনে মুঈয সাতাশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে আরবদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।
আরবরা প্রথমে গণহারে নিহত হয়। পরবর্তীতে তারাও যুদ্ধসাজে ঘুরে দাঁড়ায়।
আরবদের আক্রমণের ফলে অনেক সৈন্য মারা যেতে থাকে।
ফলে যুদ্ধ শেষে দেখা যায়, মুঈযের বাহিনীর ৩৩০০ সৈনিক নিহত হয়।
আরবরা ক্ষেপে গিয়ে পূর্ণশক্তিতে আক্রমন করে মুঈয বিন বাদিশকে রাজধানী থেকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।
মুঈয তখন মাহদিয়া গিয়ে নতুন রাজধানী স্থাপন করে। মাহদিয়া হলো বর্তমান আলজেরিয়ার একটা জেলা।
এ সময় আরবরা কায়রাওয়ান সম্পূর্ণরূপে দখল করে নেয়। মুঈয সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়।
কেন মুঈয পরাজিত হলো?
আবররা পূর্ব থেকেই যুদ্ধে জড়িত ছিল। কারণ, তাদের দখলে তখন মক্কা মদীনা, তায়েফ, নজদসহ আরো বহু অঞ্চল ছিল।
তাই এত বড় অঞ্চল নিজেদের করায়াত্বে রাখতে নিশ্চয় অনেক সমর কৌশল জানা দরকার। তেমনটাই ছিল আরবরা।
কিন্তু মুঈযের সৈন্যরা এবং বার্বারিয়ানরা বড় কোনো যুদ্ধ না করায় তারা যুদ্ধে পলায়ন করতে লাগলো্ তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে মুঈযকে যুদ্ধের ময়দানে রেখে চলে গিয়েছিল।
মুঈযের ইস্তফা দান
মাহদিয়ায় রাজধানী স্থাপনের পর জিরি সাম্রাজ্যের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে মুইযের বিরোধ সৃষ্টি হয়।
কারণ, পূর্বের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তার পাশে সৈন্যরা নেই। তাই তিনি তার পুত্র তামীমের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
মুইযের ইন্তিকাল
মুঈয বিন বাদিশ ৪৫৪ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন।
যার ফলে তার পাকস্থলি দুর্বল হয়ে পড়ে। মুইয বিন বাদিশ প্রায় ১১ বছর ক্ষমতায় ছিলেন।