ইয়ারমুকের দ্বিতীয় যুদ্ধ – ফিহিল ও দামেষ্কের যুদ্ধের পর রোমানরা যেখানে পারে সেখানেই পলায়ন করতে থাকে। এ সকল পলায়নকারী সৈন্যরা হিরাক্লিয়াসের নিকট একত্রিত হয়েছিল।

হিরাক্লিয়াস কয়েক বছর পূর্বেই নবীজির চিঠি পাঠ করেছিলেন। তাই তিনি তার রাজ্য ধ্বংস হওয়ার বিষয়ে পূর্ণ অবগত ছিলেন।

আরো পড়ুন: ইয়ারমুকের প্রথম যুদ্ধ

এ জন্য সে তার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গদের এ কথা বুঝানোর জন্য চেষ্টা করতে থাকে। হিরাক্লিয়াস তাদেরকে বলে, মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করাটা অর্থহীন। তাদের সাথে সন্ধি করে নাও।

এর দ্বারা কমপক্ষে এশিয়া মাইনর আমার হাতে থাকবে। কিন্তু যদি তোমরা লড়াই অব্যাহত রাখ তাহলে মনে রেখো, শামের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আরবরা এশিয়া মাইনর থেকে কোহেস্তান পর্যন্ত আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে।

রোমান সেনাপতিদের সন্ধি প্রত্যাখ্যান

রোমান সেনাপতিরা হিরাক্লিয়াসের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তারা সর্বাবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য কঠোরতা প্রদর্শন করতে থাকে।

স্বজাতির পক্ষপাতিত্বের কারণে হিরাক্লিয়াস তখন কনস্টান্টিপোপল, এশিয়া মাইনর, আল জাজিরা, আর্মেনিয়াসহ সমস্ত এলাকার প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে সামরিক বাহিনীতে ভর্তি করে একটি নতুন বাহিনী তৈরি করে।

এরপর রোমান সেনারা ঢলের ন্যায় এন্তাকিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। রোমানদের আগ্রহ উদ্দীপনা এত বেশি ছিল যে,সন্যাসী ও উদ্ভ্রান্ত ব্যক্তিরাও যুদ্ধে শরীক হয়।

তারা যুদ্ধের যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করে দক্ষিণদিকে মার্চ করা শুরু করে। মুসলমানরা সেখানে নিজেদের পতাকা গেড়ে অবস্থান করছিলেন।

রোমানদের সৈন্যসংখ্যা – ইয়ারমুকের দ্বিতীয় যুদ্ধ

ইয়ারমুকের দ্বিতীয় যুদ্ধে রোমানদের সৈন্যসংখ্যা ছিল ৪ লক্ষ। অন্যান্য ঐতিহাসিকদের মতে, তার সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় দুই লাখ।

তবে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইসমাইল রেহান বলেন, পেশাদার রোমান সৈন্যসংখ্যা ছিল ২ লাখ। আর বাকীরা ছিল আরব খৃষ্টান, স্বেচ্ছাসেবক এবং নতুন ভর্তি হওয়া সাধারণ জনগণ।

মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া – ইয়ারমুকের দ্বিতীয় যুদ্ধ

মুসলিম সিপাহসালার হযরত আবু উবাইদা রাঃ সেনাবাহিনীর একটি অংশের সাথে হিমস শহরে অবস্থান করছিলেন। বহু মুজাহিদ ও পরিবার সেখানে অবস্থান করছিলেন।

ততদিনে মুসলমানরা উক্ত এলাকাকে নিজেদের মতো সাজিয়ে নিয়েছিলেন। রোমানদের এত বড় প্রস্তুতির কথা শুনে আবু উবায়দা রাঃ জরুরি পরামর্শে বসেন।

প্রধন সেনাপতি আবু উবাইদা রাঃ বললেন, এত অধিক রোমান সৈন্য আসছে, মনে হচ্ছে যেন পৃথিবী কেঁপে উঠছে। বলো, এখন আমাদের কি করণীয়?

ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ান রাঃ নারী ও শিশুদের শহরে রেখে সৈন্যদের ময়দানে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু হযরত শুরাহবিল বিন হাসানা রাঃ বললেন,

শহরবাসী সকলেই খৃষ্টান। আমাদের অনুপস্থিতিতে তারা আমাদের পরিবারদের উপর আক্রমণ করতে পারে।

হযরত আবু উবাইদা রাঃ বললেন, শহরবাসীকে তাহলে আমরা বের করে দেই। এতেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

শুরাহবিল বিন হাসানা রাঃ বললেন, এটা কিভাবে হতে পারে? আমরা তো তাদেরকে জিজিয়া করের মাধ্যমে নিরাপত্তা দিয়েছি।

এখন আমরা যদি তাদের সাথে ওয়াদা রক্ষা না করি, তাহলে তো আমাদের ব্যর্থতা। হযরত আবু উবাইদা রাঃ  তার মত থেকে ফিরে আসেন।

এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, হিমস এলাকা ছেড়ে মুসলমানরা চলে যাবে। ফায়সালা হওয়ার পর সরকারি কোষাগারের দায়িত্বশীল মাসলামা রাঃ কে আসতে বললেন।

খৃষ্টানদের থেকে গৃহিত প্রতিটি দিরহাম তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন তিনি। আবু উবাইদা রাঃ বলেন, তাদেরকে নিরাপত্তার বিনিময়ে অর্থ নিয়েছি আমরা।

যেহেতু এখন নিরাপত্তা দিতে পারছি না। তাই আমরা তাদেরকে অর্থ ফেরৎ দিচ্ছি। শহরবাসীরা অবাক হয়ে যায় মুসলমানদের এই আচরণে।

পড়ুন: দামেষ্ক বিজয়

তারা অশ্রুসজল চোখে মুসলমানদের বিদায় জানায়। খ্রিষ্টানরা দোয়া করছিল, আল্লাহ যেন তোমাদের পূনরায় এই শহরে ফিরিয়ে আনেন।

মুসলমানদের ফিরে চলা – ইয়ারমুকের দ্বিতীয় যুদ্ধ

হযরত আবু উবাইদা রাঃ মুসলমানদেরকে নিয়ে দামেশক পৌঁছেন। সকল সেনাপতিকে নিয়ে যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করেন তিনি।

হযরত আমর ইবনুল আস রাঃ পূর্ব থেকেই এখানে নিজের সৈন্যদের নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। পুরোটাই ছিল খালি ময়দান।

এটা ছিল আরবের সীমান্তবর্তী এলাকা। পরাজিত হলে মুসলমানদের জন্য পেছনে গিয়ে নিরাপদ স্থানে অবস্থান গ্রহনের সুযোগ ছিল।

হযরত আবু উবাইদা রাঃ হিমস থেকে রওয়ানা দেওয়ার সময় ওমর রাঃ কে রোমানদের সৈন্যসংখ্যা ও আধিক্য সম্পর্কে অবগত করেছিলেন।

কারণ তখন মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ হাজার। ওমর রাঃ এর নিকট এই সংবাদ পৌঁছানোর পর তিনি তৎক্ষণাৎ সৈন্য সংগ্রহের চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাতে এত বেশি সময় ছিল না।

তাই ওমর রাঃ আবু উবাইদা রাঃ কে নসিহতমূলক কিছু কথা বলে আগ্রহ উদ্দীপনা দিলেন।

মুসলমানদের সৈন্যবিন্যাস

যুদ্ধের ময়দানে মুসলমানদের মধ্যে ১ হাজার সাহাবী ছিরেন। তাদের মধ্যে ১০০ বদরী সাহাবী ছিলেন।

ইয়ামেনি গোত্র আজদের ১০ হাজারের বেশি মুহাজিদ ছিল।

মুসলিম বাহিনীর ডান বাহুর আমির ছিলেন হযরত মুয়াজ রাঃ ও বাম বাহুর আমির ছিলেন কাবাস বিন আশইয়াম রাঃ।

পড়ুন: ফিহিলের যুদ্ধ

পদাতিক বাহিনীর আমির ছিলেন উতবা রাঃ ও অশ্বারোহী বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ।

প্রধান সেনাপতি ছিলেন আবু উবাইদা রাঃ। তবে তিনি খালিদ রাঃ এর পরামর্শ গ্রহণ করতেন।

তার পরামর্শেই সৈন্যবাহিনীকে কয়েকভাগে ভাগ করা হয়। আর প্রত্যেক ভাগে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হয়।

যুদ্ধের ময়দানে

এরপর শুরু হয় প্রচন্ড যুদ্ধ। উভয়পক্ষই পরষ্পরকে নিঃশেষ করে দিতে অগ্রসর হচ্ছে। যুদ্ধের ময়দানে রোমানরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যায়।

তারা যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করতে থাকে। মুসলমানদের নিকট তারা দূত প্রেরণ করে। দূত বলে,

আমাদের নিকট একজন নির্ভরযোগ্য দূত প্রেরণ করুন।

আবু উবাইদা রাঃ খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ কে দূত হিসেবে প্রেরণ করেন। খালিদকে দেখে রোমান সেনাপতি বাহান বললো,

হে আরবেরা! আমরা তোমার উত্তম প্রতিবেশি। তোমাদের যে গোত্রই আমাদের ভূমিতে এসেছে, আমরা তাদের সাথে সবসময় ভালো আচরণ করেছি।

আমাদের আশা ছিল, তোমরা কৃতজ্ঞ হবে। কিন্তু তোমরা তো আমাদের রাজ্য ধ্বংসের মিশনে নেমেছ। তোমাদের এত দুঃসাহস কিভাবে হয়?

তোমরা এখান থেকে চলে যাও। আমরা তোমাদের প্রত্যেককে একশত দিনার করে দিব ও প্রধান সেনাপতিকে দশ হাজার দিনার দিব।

খালিদ রাঃ তাকে বললেন, তোমাদের শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে আমরা পূর্ণ অবগত আছি। আর আমরা যদি সম্পদ বাড়ানোর জন্য যুদ্ধ করতাম তাহলে তোমাদের প্রস্তাব গ্রহণে আমাদের কোনো সমস্যা ছিল না।

কিন্তু আমরা যুদ্ধ করছি দ্বীন ইসলামের জন্য। আমাদের রাসূল আমাদেরকে কুফরী করতে নিষেধ করেছেন। আমাদেরকে সৎপথে চলতে বলেছেন।

আর যেই ব্যক্তি আমাদের মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে তার সাথে আমাদের যুদ্ধের ময়দানে ফয়সালা হবে।

সেনাপতি বাহান এ কথা শুনে বুঝতে পারে যে, লড়াই ব্যতিত আর কোনো পথ নেই। এরপর পূনরায় যুদ্ধ শুরু হয়।

আবারো যুদ্ধ

যুদ্ধের কিছুক্ষণ পূর্বে এক যুবক আবু উবাইদা রাঃ এর নিকট এসে বললো, আমি আমার প্রাণ উৎসর্গের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

আপনি যদি রাসূলকে কোনো সংবাদ দিতে চান তাহলে বলতে পারেন। আবু উবাইদা রাঃ আশান্বিত হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন,

রাসূলকে আমাদের সালাম পেশ করবে আর বলবে, আল্লাহ আপনার মাধ্যমে যেই ওয়াদা করেছেন, তা পূর্ণ হয়েছে।

অবশেষে রোমানরা যুদ্ধ শুরু করে। তারা তাদের পায়ে শেকল বেধে রেখেছিল, যাতে পলায়ন না করতে পারে।

তাদের তীরন্দাজরা ক্রমাগত তীর নিক্ষেপ করছিল।

মুসলমানদের ডান বাহু অত্যন্ত সাহসীকতার সাথে লড়াই করছিল। খ্রিষ্টানরা সর্বাত্মক শক্তি ব্যবহার করেও তাদেরকে পিছপা করতে পারছিল না।

তাদের পা উপড়ে গেল। একটা সময় রোমানরা আক্রমণ করতে করতে তাবুর নিকটে চলে আসে।

এখানে মুসলিম নারীরা বলতে থাকে, তোমরা যদি পিছু হটো তাহলে তোমাদের মাথা আমরা ফাঁটিয়ে দিব।

মুসলমানদের আত্মসম্মান জাগ্রত হয়। তারা রোমানদের উপর প্রবলবেগে আক্রমণ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত রোমানরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

শেষ পর্যন্ত রোমানদের অবস্থান দুর্বল হয়ে যায়। তারা স্থির থাকতে পারছিল না। সন্ধার মধ্যেই ইয়ারমুকের ময়দানে ১ লক্ষ সৈন্য নিহত হয়।

আর মুসলমানদের মধ্যে ৩ হাজার মুজাহিদ শাহাদাতলাভ করেন।

সম্রাট হিরাক্লিয়াস পরাজয়ের সংবাদ পাওয়ার পর এশিয়া মাইনরকে চিরতরে বিদায় জানিয়ে কনস্টান্টিনোপলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।

সে তখন বলে উঠে, হে শাম! তোমাকে অন্তিম সালাম!

তথ্যসুত্র

মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খন্ড ৩

মুসলমানরা কেন আবিসিনিয়ায় হিজরত করলো?

হিজাব কি নারীর নিরাপত্তা দেয়? পড়ুন

নবীজি কি মন্দভাষী ছিলেন? পড়ুন

ইসলাম কি ছোঁয়াচে রোগ অস্বীকার করে? পড়ুন

Scroll to Top