মুসায়লামাতুল কাজ্জাব এর ফেতনা – নবীজির জীবদ্দশাতেই নবুয়তের দাবীদাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফেতনাবাজ ছিল মুসায়লামা। সে ছিল বনু হানিফা গোত্রের সদস্য।

তার পূর্ণ নাম, মুসায়লামা ইবনে সুমামা ইবনে কাবির ইবনে হাবিব হানাফি। তার ডাকনাম আবু শামাহ। মুসায়লামা জন্মগ্রহণ করে ইয়ামামায়। সেখানেই সে বেড়ে উঠে।

ইয়ামামার অবস্থান আধুনিক সৌদি আরবের দক্ষিণ-পূর্ব নজদের একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল, বা কখনও কখনও আরও নির্দিষ্টভাবে বলা যায় যে,

আল- খার্জের নিকটে জাউ আল-ইয়ামামাহের অধুনা-বিলুপ্ত প্রাচীন একটি গ্রাম। যা পরবর্তীতে আশেপাশের অঞ্চলও এই নামে প্রসিদ্ধলাভ করে।

মুসায়লামার ভ্রমণ ও জ্ঞানলাভ

মুসায়লামা আরব-অনারবসহ প্রায় অনেক অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিল। সে মানুষকে আকর্ষণ করার বিদ্যা ভালোভাবেই রপ্ত করে।

তার শিক্ষক ছিল তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত পুজারী, পুরোহিত, জ্যোতিষী, গণক, জাদুকররা। সে এমন কিছু অদ্ভুত জ্ঞান জানতো, যার দ্বারা মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতে সক্ষম।

সে পাখির কাটা পাখা তার ডানায় জুড়ে দিতে পারতো। ডিমকে বোতলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারতো। মুসায়লামা রাসূলের জীবদ্দশাতেই নবুয়তের দাবী করে বসে।

সে মক্কায় কুরআন শেখার জন্য লোক পাঠাতো। যাতে সে তাদের থেকে শুনে সে রকম অন্য আয়াত বানিয়ে নিজের বলে চালিয়ে দিতে পারে।

মুসালামাতুল কাজ্জাবের কিছু মনগড়া আয়াত

“শপথ বকরি এবং তার রংয়ের। তার মধ্যে কালো বকরি এবং তার সাদা দুধ সবচেয়ে আশ্চর্যজনক। বকরি কালো কিন্তু তার দুধ সাদা।

এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের কথা। দুধের সাথে পানি মেশানো হারাম করা হয়েছে। তোমাদের কি হলো যে, তোমরা দুধের সাথে খেজুর খাও না?”

আরেকটি আয়াত হলো,

“হে ব্যাঙ, ব্যাঙের বাচ্চা, তুমি যাকে পরিষ্কার রাখ তা পরিষ্কার থাকে। তোমার মাথা পানির উপরে আর নিতম্ব কাদা মাটিতে।

তুমি পানকারীকে বাধা দিও না। আর পানিও বিনষ্ট করো না।”

এমন আরো বেশ কিছু আয়াত সে বানিয়েছিল। যা বাহ্যিকভাবে মানুষকে সম্মোহিত করলেও তা থেকে কোনোরুপ শিক্ষা হাসিল করা যেত না।

রাসূলের নিকট মুসায়লামার দূত

দশম হিজরীতে রাসূল সা. যখন অসুস্থ পড়ে পড়লেন তখন মুসায়লামা নবীজির নিকট দূত প্রেরণ করে।

সে এই পত্রটি উবাদা ইবনে হারিস হানিফীর মাধ্যমে পাঠায়।

পত্রটিকে বলা হয়েছিল, মুহাম্মাদুর রাসূলের নিকট আল্লাহর রাসূল মুসায়লামার পক্ষ থেকে।

অর্ধেক ভূ-খণ্ড আমাদের। অর্ধেক ভূ-খণ্ড কুরাইশদের। কিন্তু কুরাইশরা আমাদের সঙ্গে ইনসাফ করছে না।

নবীজি তখন প্রত্রের জবাব দেন এভাবে, আল্লাহর নবী মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে মুসায়লামা কাজ্জাবের নিকট,  জমিন আল্লাহর। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী বানিয়ে থাকেন।

নবীজি তখন দূতকে জিজ্ঞাসা করলো, তোমরা কি বলো?

দূত জবাব দেয়, মুসায়লামা যা বলে আমরাও তাই বলি।

নবীজি তখন বললেন, যদি আমি দূত হত্যা করা সঠিক মনে করতাম তাহলে তোমার ঘাড় মটকে দিতাম।

মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের নিকট রাসূলের দূত

রাসূল সা. মুসায়লামার নিকট হযরত হাবিব ইবনে জায়েদ রা. কে প্রেরণ করেন। মুসায়লামাতুল কাজ্জাব তখন তাকে জিজ্ঞাসা করে, তুমি কি বিশ্বাস করো মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল?

হাবিব রা. বললেন, হ্যাঁ। আমি বিশ্বাস করি।

এরপর মুসায়লামা বললো, তুমি কি এটা বিশ্বাস করো যে, আমি আল্লাহর রাসূল?

তখন হাবিব রা. না বুঝার ভান করে বললেন, আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না।

মুসায়লামাতুল কাজ্জাব তখন হাবিব রা. এক একটি অঙ্গ কেঁটে তাকে হত্যা করে।

মুসায়লামার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী গঠন

হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. খেলাফতের মসনদে আরোহনের পর মুসায়লামাকে দমন করার জন্য প্রথম ইকরিমা বিন আবু জাহেল রা. এর নেতৃত্বে পাঠান।

কিছুদিন পর দ্বিতীয়তে হযরত শুরাহবিল বিন হাসানা রা. এর নেতৃত্বে আরো একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। হযরত আবু বকর রা. ইকরিমা রা. কে নির্দেশ দেন যে,

যতক্ষণ না শুরাহবিল তোমার নিকট না পৌছবে ততক্ষণ তুমি যুদ্ধ শুরু করবে না। কিন্তু ইকরিমা রা. এই নির্দেশনার উপর কাজ না করে নজদে পৌছেই আক্রমণ করে বসেন।

মুসায়লামাতুল কাজ্জাব এর বাহিনী ছিল যুদ্ধবাজ বাহিনী। তারা হযরত ইকরিমা রা. এর বাহিনীকে পরাজিত করে পিছু হটতে বাধ্য করে।

আবু বকর রা. এর নিকট ইকরিমা রা. এই সংবাদ পাঠান। তখন আবু বকর রা. শুরাহবিল বিন হাসানা রা. কে থামিয়ে দেন।

তাদেরকে বললেন, তোমরা খালিদ বিন ওয়ালিদের বাহিনী আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো।

আবু বকর রা. মুসায়লামার সামরিক শক্তি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। এদিকে খালিদ রা. তুলাইহা ফেতনা দমন করে মদীনায় আসেন।

হযরত আবু বকর রা. তৎক্ষণাৎ তাকে মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের বিরুদ্ধে সেনাপ্রধান করে পাঠান।

ইয়ামামার যুদ্ধ

তখন এই তিন বাহিনী একত্রিত হয়ে মুসাইলামা বিন কাজ্জাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে।

এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর আগমণের সংবাদে মুসাইলামা বনু হানিফা থেকে ৪০ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা নিয়ে ময়দানে অপেক্ষা করতে থাকে।

মুসলমানরা পৌছামাত্র তাদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

এই যুদ্ধে হযরত আব্দুল্লাহ বিন হাফস রা. সহ আরো অনেক সাহাবী শহীদ হয়ে যান।

শেষের দিকে মুসাইলামার বাহিনীল পরাজয় ঘটতে থাকে। তাই মুসাইলামা তার দলবল নিয়ে পলায়ন করতে থাকে।

এই সুযোগে হযরত ওয়াহশি রা. বর্শা হাতে নিয়ে তার দিকে এমনভাবে ছুঁড়ে মারেন যে, সাথে সাথে সে সেখানেই লুটিয়ে পড়ে।

এ সময় আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ রা. তরবারির মাধ্যমে শরীর থেকে তার মাথা আলাদা করে ফেলেন।

এই প্রলয়ঙ্কারী যুদ্ধে প্রায় ৩৬০ জন সাহাবী শাহাদাত বরণ করে। যাদের মধ্যে ৩৫ জন হাফেজ ছিলেন।

আরো পড়ুন

ইয়ামামার যুদ্ধ

ফ্রি ফায়ার গেম খেলতে না দেয়ায় আত্মহত্যা

তথ্যসুত্র

১. মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খন্ড ৩। পৃষ্ঠা ৫৮-৬৩

২. আবু বকর সিদ্দিক । কালান্তর প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ৩৭৩-৩৮০

মুসায়লামা কে ছিলেন?

মুসায়লামা ছিল একজন মিথ্যা নবুয়তের দাবীদার। তাই তাকে কাজ্জাব বা মিথ্যাবাদী বলা হয়।

ইয়ামামার যুদ্ধে সেনাপতি কে ছিলেন?

হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.

ইয়ামামার যুদ্ধে কতজন হাফিজ শহীদ হন?

প্রায় ৭০ জন

Abdur Rahman Al Hasan
Scroll to Top