সুরা নিসার আলোকে এতিমের অধিকার

এতিমের অধিকার – হঠাৎ করেই টেবিলের উপরে থাকা মোবাইলটি বেজে উঠলো। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখলাম,

আবিরের ফোন নম্বর এটি। রিসিপ করতেই ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে উঠলো।

“ভাইজান, আমার এহন কি হইবো? আমার পিচ্চি পোলাডার কি হইবো” বলে আবিরের স্ত্রী কাঁদতে লাগলো। আমি খানিকটা সান্তনা দিয়ে বললাম,

কি হয়েছে? আবিরের কি শরীর খারাপ?

আবিরের স্ত্রী আয়েশা বললো, না ভাইজান। আবির আজকে সকালে মারা গেছে।

বলেই তিনি ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলেন। খানিকটা শক খেলাম আমি। কি তাড়াতাড়িই না মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

এই তো কয়েকদিন আগেও তার সাথে বসে লেকে আড্ডা দিয়েছি।

দুইদিন আগে বাইক এক্সিডেন্ট হয়ে হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল। ডাক্তার বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিল তাকে দেখেই। তারপরও লাইফ সাপোর্টে রাখা হলো তাকে।

আজ সে সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছে। আমি তড়িগড়ি করে বারডেমে হাজির হলাম।

২২৫ নং রুমের সামনে দাঁড়াতেই কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো।

কিছুক্ষণ পর একটা বক্স এনে সামনে রাখলো কর্তব্যরত ব্যক্তিরা। আবির তাতে শুয়ে আছে।

এক মহাশান্তির ঘুম। দুনিয়ার কোনো পরাশক্তি তার ঘুম ভাঙ্গতে পারবে না।

আবিরের সন্তান সিয়ামের দিকে তাকিয়ে মায়া লাগলো। ফুটফুটে সন্তানটি গত মাসে পৃথিবীর আলো দেখেছে।

কথা বলা শেখার আগেই বাবা পৃথিবী ত্যাগ করলো।

জানাযা – এতিমের অধিকার

সবই তো আল্লাহর ফায়সালা। আমরা শুধু তার আনুগত্য স্থাপন করি। লাশ দাফন করে বিলের ধারে বসে আছি।

আবিরের গ্রামের বাড়ি বি বাড়িয়ায়।

ঢাকা থেকে এখানে লাশ নিয়ে আসলাম। এলাকার মুরুব্বি ও আবিরের বাবার অনুরোধে আমি জানাজা পড়ালাম। আবিরের বাবা আমাকে বললেন,

আবিরের বন্ধুদের মধ্যে তুমি আলেম মানুষ। আমরা তো আর তাকে এতটা ভালোভাবে জানি না। যতটা না তুমি জান।

কারণ, শৈশব থেকে তোমরা একসাথে বেড়ে উঠেছ। একই মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছ।

২ মাস পর আমি বসে আছি ঘরের বারান্দায়। আবিরের এতিম সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্ব আমিই নিয়েছি।

আয়েশা ও তার ছেলে সিয়াম আমাদের বাসার পাশের ফ্লাটে থাকে।

আমাকে একসাথে দুই পরিবার সামলাতে হয়। যদিও আয়েশা নিকটস্থ কেউ নয়, তারপরও চাই নি, তাকে দূরে ঠেলে দিতে।

স্বামী মারা যাওয়া একটা মেয়ে সমাজে কতটা হেনস্তার শিকার হয়, তা আমার জানা আছে।

আয়েশাকে সমাজের ধারে ধারে ঘুরতে দেই নি।

তা ছাড়া আয়েশার মা বাবা নেই। মামা থাকে সুদূর নীলফামারীতে। এত দূরে সে সন্তানকে নিয়ে গেলে আরো বিপদে পড়তে পারে।

আবিরের সহায়-সম্পত্তি আছে ৪ লাখ টাকা সমপরিমাণ স্বর্ণ। যা গচ্ছিত আছে আয়েশার নিকট। আয়েশা সেগুলো বিশ্বাস করে আমাকে আমানতস্বরুপ দিয়েছে।

প্রতিবেশী ও এতিমের হক্ব সম্পর্কে আমাদের শিক্ষকরা আলোচনা করেছিলেন বহুআগে। কুরআন শরীফ খুলে আরেকবার পড়লাম সেগুলো।

সূরা নিসার ২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,

وَ اٰتُوا الۡیَتٰمٰۤی اَمۡوَالَهُمۡ وَ لَا تَتَبَدَّلُوا الۡخَبِیۡثَ بِالطَّیِّبِ ۪ وَ لَا تَاۡکُلُوۡۤا اَمۡوَالَهُمۡ اِلٰۤی اَمۡوَالِکُمۡ ؕ اِنَّهٗ کَانَ حُوۡبًا کَبِیۡرًا

“তোমরা ইয়াতীমদেরকে তাদের ধন-সম্পদ দিয়ে দাও এবং তোমরা অপবিত্র বস্ত্তকে পবিত্র বস্ত্ত দ্বারা পরিবর্তন করো না এবং তাদের ধন-সম্পদকে তোমাদের ধন-সম্পদের সাথে খেয়ো না। নিশ্চয় তা বড় পাপ।”

সূরা নিসার ১০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,

اِنَّ الَّذِیۡنَ یَاۡکُلُوۡنَ اَمۡوَالَ الۡیَتٰمٰی ظُلۡمًا اِنَّمَا یَاۡکُلُوۡنَ فِیۡ بُطُوۡنِهِمۡ نَارًا ؕ وَ سَیَصۡلَوۡنَ سَعِیۡرًا

“নিশ্চয় যারা ইয়াতীমদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে তারা তো তাদের পেটে আগুন খাচ্ছে; আর অচিরেই তারা প্রজ্জ্বলিত আগুনে প্রবেশ করবে ”

সূরা বনী ইসরাইলের ৩৪  নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,

وَ لَا تَقۡرَبُوۡا مَالَ الۡیَتِیۡمِ اِلَّا بِالَّتِیۡ هِیَ اَحۡسَنُ حَتّٰی یَبۡلُغَ اَشُدَّهٗ ۪ وَ اَوۡفُوۡا بِالۡعَهۡدِ ۚ اِنَّ الۡعَهۡدَ کَانَ مَسۡـُٔوۡلًا

“আর ইয়াতীম বয়োপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সদুপায়ে ছাড়া তার সম্পত্তির ধারে-কাছেও যেও না এবং প্রতিশ্রুতি পালন করো; নিশ্চয় প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।”

কুরআনের আয়াতগুলো পড়ে বারবার কেঁপে উঠেছি। না জানি, আমার আবার কোন ভুল হয়ে যায়।

কিছুদিন পর আমি একটা ব্যবসা শুরু করলাম।

আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই চলতে লাগলো। আয়েশার অনুমতি নিয়ে ১ লাখ টাকা উক্ত ব্যবসায় ইনভেস্ট করলাম।

চারদিনের মাথায় মূলধনসহ ৬০ হাজার টাকা লাভ আসলো।

এমন অকল্পনীয় লাভে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আরেকবার ব্যবসায় লাগালাম সম্পদ। এরইমাঝে একদিন আমার স্ত্রী বললো,

আয়েশাকে দেখে তেমন একটা সুস্থ মনে হচ্ছে না। স্বামী ছাড়া একা একা থাকে।

তার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। আমিও ভাবলাম বিষয়টা।

অসুস্থতা – এতিমের অধিকার

কাজী সাহেবের নিকট বায়োডাটা পাঠিয়ে কোনো ফল পাই নি। সপ্তাহখানেক পর আয়েশা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলো।

অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে হসপিটালে ভর্তি করলাম। আয়েশা আমার স্ত্রীর হাত ধরে বললো,

যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তাহলে আমার সন্তানের দিকে খেয়াল রেখ।

আমার স্ত্রী তাকে সান্তনা দিয়ে বললো, কোনো ভয় নেই। তুই সুস্থ হয়ে যাবি।

আল্লাহর ইচ্ছা বোধ হয় ভিন্ন ছিল। দুইদিন পর আয়েশা মৃত্যুবরণ করলো। রেখে গেল একটা ফুটফুটে ৫ মাসের সন্তান।

আমার স্ত্রী তার ছোট বোনের মৃত্যুতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল। এদিকে আমার দুই বছরের সন্তান,

অন্যদিকে আমার ৫ মাসের শালীর সন্তানদের দেখে রাখতে হিশশিম খেতে হচ্ছিল।

পরদিন আমার স্ত্রীর অনুরোধে আমাদের বাসার পাশের কবরস্থানেই তাকে দাফন করি। আমাদের ঘরে দুই সন্তান আসলো।

যেহেতু সিয়াম আমার স্ত্রীর বোনের ছেলে, তাই মায়ের স্নেহ সে পরিপূর্ণরূপেই পেয়েছে।

২৬ বছর পর – এতিমের অধিকার

আমি আমার রুমে বসে আছি। আমার দুই ছেলে আব্দুল্লাহ ও সিয়াম পাশে বসা। তারা দুইজন একটা ব্যবসা শুরু করতে চাচ্ছে।

মালিবাগে আমার একটা শপ ছিল। মোটামুটি বড় সাইজের। দুজনেই আলেম হওয়ার পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে।

আমি তখন আলমারি থেকে দুইটা প্যাকেট বের করলাম। একটা প্যাকেট দিলাম আব্দুল্লাহর হাতে। আরেকটা প্যাকেট দিলাম সিয়ামের হাতে।

আব্দুল্লাহর প্যাকেটে ছিল সাড়ে ৫ লাখ টাকা। সিয়ামের প্যাকেটে ছিল ২৮ লাখ টাকা। এত বড় পার্থক্য দেখে দুজনেই খানিকটা অবাক হলো।

তখন আমি আমার স্ত্রীর দিকে তাকালাম। সে বললো, সিয়াম যতুটুকু প্রাপ্য ততুটুকুই পেয়েছে। আর আব্দুল্লাহকে তার বাবা যতুটুকু দেয়ার ইচ্ছা ততুটুকুই দিয়েছে।

সিয়াম তখন বললো, কিভাবে আমি এত টাকার প্রাপ্য হলাম? তখন আমার স্ত্রী বললো,

তোমার বাবা-মা যতুটুকু সম্পদ তোমার জন্য রেখে গিয়েছিলেন, তা আমানত হিসেবে আমরা রেখেছিলাম। আজ সেই টাকা তোমার নিকট আমরা ফিরিয়ে দিচ্ছি।

সিয়াম তো অবাক হয়ে গেল। মা এসব কি বলছে! সে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল, আরেকবার আমার স্ত্রীর দিকে।

শেষে বললো, কখনো তো শুনি নি, কারো দুইজন মা-বাবা থাকে। তোমরা যদি আমার মা-বাবা না হও, তাহলে আমার আসল মা-বাবা কে?

আরো পড়ুন

জীবন বীমা কাকে বলে?

হযরত আবু জর গিফারী রা. কিভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন

প্রাথমিক যুগে কিভাবে দাওয়াত দেয়া হতো

লেখাটি অন্যের নিকট শেয়ার করে তাকেও জানার সুযোগ করে দিন....

About The Author

Scroll to Top