উসমান রা. এর খুতবা – খলিফা হওয়ার পর হজরত উসমান রা. মুসলমানদের সম্মুখে সর্বপ্রথম প্রদত্ত খুতবায় বলেন, ‘লোকসকল, তোমরা একটি অস্থায়ী ঘরে আছো।
জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো তোমরা পূরণ করছো। মৃত্যুর পূর্বেই নেক কাজ করে নাও। সকাল-সন্ধ্যা যেকোনো সময় মৃত্যু চলে আসতে পারে।
সাবধান! দুনিয়ার জীবন পুরোটাই ধোঁকা। লক্ষ রেখ, যেন তোমরা কোথাও ধোঁকা না খাও। শয়তান যেন আল্লাহর ব্যাপারে তোমাদের ধোঁকায় ফেলে না দেয়।
বিগত লোকদের মাধ্যমে শিক্ষা অর্জন করো। দুনিয়াদাররা কোথায় গেল? যারা একসময় দুনিয়ার পাগল ছিল, যারা দুনিয়া আবাদ করেছে, তাতে উন্নতি অগ্রগতি সাধন করেছে, তারা কিছুকাল মাত্র ভোগ করেছে।
তারা কি দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়নি? আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াকে দ্বিতীয় পর্যায়ে রেখেছেন, তেমনই তোমরাও দুনিয়াকে দ্বিতীয় পর্যায়ে রাখো। পরকালের প্রত্যাশী হও।
যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে উসমান রা.
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় হজরত উসমান মক্কি- জীবনের প্রাণসংহারক বহু কষ্ট-মুসিবত সহ্য করেছেন।
একসময় তিনি হিজরত করে মদিনায় আসেন। ইসলাম নামক বৃক্ষের প্রবৃদ্ধির বহু স্তর স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। একজন অহি-লেখক এবং হাফেজে কুরআন হওয়ার সুবাদে কালামুল্লাহর প্রতিটি শব্দের ব্যাপারে তিনি সম্যক অবগত ছিলেন।
দিবারাত্রি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গভীর সাহচর্যলাভের ফলে তিনি শরিয়তের মেজাজ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করতে পেরেছিলেন।
তিনি আবু বকর সিদ্দিক রা. এর জমানায় উদ্ভূত বড় বড় ফেতনা এবং তার দমন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। হজরত উমর ফারুক রা. এর বিজয়কাল সম্পর্কে তিনি ভালোভাবেই অবগত ছিলেন।
মুসলমানদের প্রতিটি বিজয়াভিযানে খেলাফতের পক্ষ থেকে পরামর্শের মধ্যে তিনিও অংশীদার ছিলেন। এজন্য খেলাফতের লাগাম হাতে নেওয়ার পর একজন খলিফা হিসেবে তার করণীয় সম্পর্কে তিনি ভালোভাবেই সচেতন ছিলেন।
সাধারণ দৃষ্টিতে তাকালে তার জন্য খেলাফতের জিম্মাদারি পালন করাটা সামান্যও কষ্টসাধ্য ছিল না। কেননা সেটা ইসলামের বিজয়কাল ছিল।
পূর্ব থেকে পশ্চিম কোথাও ইসলামের বিরুদ্ধে মাথা ওঠানোর মতো কোনো শক্তি ছিল না। হজরত উমর ফারুক রা. নিজের অসাধারণ পরিচালনাগত যোগ্যতার মাধ্যমে উম্মতকে একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থা উপহার দিয়েছিলেন।
এই উত্তম ব্যবস্থায় কোনো ধরনের ফাটল সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ না দেওয়াই তখন হজরত উসমান রা. এর দায়িত্ব ছিল।
কিন্তু সাড়ে বাইশ লক্ষ বর্গমাইল (৩৬ লক্ষ ২১ হাজার বর্গকিলোমিটারের) এই বিশাল সাম্রাজ্যের সকল বিষয় দেখাশোনা করা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন জিম্মাদারি ছিল।
পরীক্ষাগার – উসমান রা. এর খুতবা
মুসলমানদের আমিরকে আল্লাহর সামনে যেমন জবাবদিহি করতে হয় তেমনিভাবে সাধারণ জনগণের সামনেও তার জবাবদিহিতার একটি বিষয় থাকে।
এটা অনেক বড় পরীক্ষা ছিল। হজরত উমর রা. তার শাসনকালের শেষবছর (যখন তার বয়স ষাটও হয়নি) দোয়া করছিলেন,
হে আল্লাহ, আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমার শক্তি কমে গেছে। আমার জনগণ বহু দূরদূরান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে।
কারো অধিকারে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি কিংবা ত্রুটি আমার দ্বারা সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই আমাকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নিন।
ওইদিকে খেলাফতের শুরুতেই হজরত উসমান রা. এর বয়স ছিল সত্তর বছর। সুস্থতা এবং শারীরিক শক্তির দিক থেকে তিনি হজরত উমর রা. এর সমতুল্য ছিলেন না।
তা সত্ত্বেও তিনি মুসলমানদের দেখাশোনা, তাদের অধিকার সংরক্ষণ এবং খেলাফতের কেন্দ্র মজবুত করার জন্য নিজেকে ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন।
নিঃসন্দেহে এর পেছনে অসাধারণ ঈমানি শক্তি, আত্মোৎসর্গের স্পৃহা, কোরবানি ও বিপদ সহ্য করার যোগ্যতা এবং আধ্যাত্মিক শক্তি সক্রিয় ছিল।
ফেতনার গন্ধ – উসমান রা. এর খুতবা
উসমান রা. গভীর দৃষ্টিতে মুসলিম উম্মাহর সকল বিষয় লক্ষ করছিলেন। ফলে বিশেষ দুটি বিষয় তার দৃষ্টিগোচর হয়, যে-জন্য তার প্রস্তুতি গ্রহণ করাটা জরুরি ছিল।
একটি বিষয় হলো, হজরত উমর ফারুক রা. এর শাহাদাত একটি বড় ফেতনার সংকেত দিচ্ছিল।
হজরত হুযাইফা রা. থেকে বর্ণিত হাদিস সম্পর্কে হজরত উসমান রা. অবগত ছিলেন।
হজরত উমর রা. হজরত হুজাইফা রা. কে বলেছিলেন, আমাকে সেই ফেতনার ব্যাপারে সংবাদ দাও,
যা উম্মাহকে ঢেউয়ের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
হজরত হুযাইফা রা. উত্তর দেন, আমিরুল মুমিনিন, আপনার এবং সেই ফেতনার মাঝে একটি মজবুত দরজা প্রতিবন্ধক হিসেবে রয়েছে, আপনার জীবদ্দশা পর্যন্ত যা বন্ধ থাকবে।
পরবর্তীতে হজরত হুজাইফা রা. নিজেই বলেছিলেন, হজরত উমর রা. নিজেই সেই দরজা ছিলেন।
তার মৃত্যুর পর ফেতনাগুলো প্রকাশ পেতে থাকবে ।
রাসূলের ভবিষ্যদ্বানী
হজরত উসমান রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনার ব্যাপারে খুব ভালোভাবে অবগত ছিলেন।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, তাকে পরীক্ষাসহ সুসংবাদ দাও, তাকে যার মোকাবেলা করতে হবে।
মৃত্যুর পূর্বে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার উসমান রা. কে একা ডেকে নিয়ে তাকে কিছু রহস্যের কথা বলেছিলেন, যা শুনে তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বলেছিলেন, অচিরে আল্লাহ তোমাকে একটি পোশাক (খেলাফতের দায়িত্ব) পরিধান করাবেন।

মুনাফিকরা যদি তোমার থেকে সেটা ছিনিয়ে নিতে চায় তা হলে তুমি একদম খুলবে না।
অবশেষে তুমি আমার সাথে মিলিত হবে ।
হজরত উসমান রা. এবং তার পরামর্শক সাহাবিগণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসকে চাক্ষুষ বিষয়ের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন।
উমর ফারুক রা. এর পর বিভিন্ন ফেতনার প্রকাশ ঘটার ব্যাপারে তাদের কোনো সন্দেহ ছিল না।
এইসকল হাদিস ছাড়াও স্বয়ং খলিফার মসজিদের মেহরাবে শহিদ হওয়া, হত্যাকারী সম্পর্কে জানার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রভৃতি বিষয় বলে দিচ্ছিল যে, শত্রুরা এখন সম্মুখযুদ্ধের পরিবর্তে গোপন লড়াই শুরু করেছে।
এখন বিভিন্ন ফেতনা- ফাসাদ তৈরি করা এবং তা উসকে দেওয়ার পথ অবলম্বন করাকেই তারা নিজেদের কর্মপন্থা স্থির করে নিয়েছে।
এটা নিশ্চিত যে, এসব ফেতনার রাস্তা আর বন্ধ করা যাবে না। হ্যাঁ, অবশ্যই তাদের সঙ্গে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে।
যথাসম্ভব ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। এতে অবশ্যই সফলতার আশা ছিল। আর সাহাবিগণ চেষ্টাপ্রচেষ্টার জন্য নির্দেশিতও ছিলেন।
হজরত উসমান বিন আফফান রা. এর সামনে এটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
আর নিঃসন্দেহে খেলাফতের জিম্মাদারি গ্রহণ করার সাথে সাথেই তিনি এ সকল ফেতনা মোকাবেলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন।
এজন্য তিনি আপন প্রতিরক্ষামূলক পলিসিতে সবসময় এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখতেন।
তথ্যসুত্র
মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৬৬-২৬৯ (বুঝার সুবিধার্থে হুবহু প্রতিলিপি)