ইয়াকুব ইবনু লাইস আস সাফার – তৃতীয় হিজরী শতাব্দীতে দক্ষিণ-আফগানিস্তানে সালিহ ইবনু নাসর কিনানি নামের একজন মুজাহিদের নেতৃত্বে দরবেশ জামাআতের সদস্যরা একত্রিত হয়েছিল।

তখন এ অঞ্চলে খারিজিরা ইরাক থেকে এসে জড়ো হয়ে সামরিকভাবে শক্তিশালী হতে থাকে। একপর্যায়ে তারা রাজনৈতিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে।

তারা জনগণের উপর অত্যাচার করে তাদের সম্পদ আত্মসাৎ করতো। এদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে দরবেশ জামাআতের সদস্যরা আমিরের আদেশে এই খারিজিদের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করে।

সে সময়ে নিমরোজ প্রদেশের জারানজ শহরে ইয়াকুব ইবনু লাইস সাফফারি নামে একজন অসহায় ও অপরিচিত যুবক বাস করতো।

সেখানে সে শ্রমিকের কাজ করে প্রতিদিন আধা দিরহাম উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করত। চলমান এই যুদ্ধের কথা হঠাৎ একদিন সে জানতে পারে।

দ্বীনের পক্ষে যুদ্ধ করার অদম্য ইচ্ছা তাকে রোজগারের পথ থেকে সরিয়ে সরাসরি ইসলামের মুজাহিদ বানিয়ে দেয়।

এরপর সে দরবেশদের নেতা সালিহের কাছে উপস্থিত হয়। দরবেশেদের নেতা তাকে সুযোগ দেন সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার।

যুদ্ধে ইয়াকুব অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করে। তার যোগ্যতা ও বীরত্ব দেখে সালিহ ইবন নাসর প্রথমে তাকে একটি ছোট্ট অঞ্চলের প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং পরে নিজের নিকটতম উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত করেন।

সালিহের মৃত্যুর পর ইয়াকুব এ দলের নেতৃত্বে আসেন। এটি ২৫৩ হিজরি মোতাবেক ৮৬৭ খৃস্টাব্দের ঘটনা। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ সমাজে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইয়াকুব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

জামাআতের কার্যক্রমকে তিনি আরও ঢেলে সাজান এবং একটি সুসংগঠিত আন্দোলনের সূচনা করেন। পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলন বিখ্যাত ‘সাফারি আন্দোলন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

দূরদর্শী নেতৃত্ব ও ইসলামি চরিত্র

ইয়াকুব ইবনু লাইস ইতিহাসের সে-সকল ব্যতিক্রমধর্মী নেতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যারা বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শনের পাশাপাশি ক্ষমতার মোহ থেকে দূরে থেকেছেন।

সঙ্গীদের প্রতি সহমর্মিতা এবং তাদের যেকোনো প্রয়োজনে ইয়াকুব নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দুরদর্শী ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তি।

প্রতিটি ক্ষেত্রে বেছে বেছে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণে তিনি ছিলেন অনন্য। কঠিন পরিস্থিতিতেও অটলভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেন।

তিনি বলতেন, ‘কেউ যদি আমার কাছে ৪০ দিন অবস্থানের পরেও আমি তার নাড়ি-নক্ষত্র বুঝতে না পারি, তাহলে ৪০ বছর কোথাও অবস্থান করলেও কেউ তাকে চিনতে পারবে না। ‘

তিনি একজন সাহসী যোদ্ধা, সেনাপতি ও প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ ছিলেন। দূরদর্শিতা ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজের উপমা ছিলেন তিনি নিজেই।

কাবুল বিজয়ের অসাধারণ পরিকল্পনা

ইয়াকুব ইবনু লাইস তাঁর কর্মীদের সুসংগঠিত করার পর প্রথমে স্থানীয়ভাবে শরিয়ত প্রতিষ্ঠা করেন। দক্ষিণ-আফগানিস্তানে খারিজি ও ডাকাতদের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষের পর তাদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেন।

তাদের নেতা আম্মারকে হত্যা করে নিমরোজের প্রধান ফটকে ঝুলিয়ে রাখেন। এটি ছিল সাফফারি আন্দোলনের প্রথম বড় কোনো অর্জন।

ইয়াকুব ইবনে লাইস ভালো করেই জানতেন, যতক্ষণ পামিরের সুউচ্চ ভূমি থেকে হেলমান্দের মরুভূমি পর্যন্ত সমগ্র এলাকা বিজয় করে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা না যাবে, ততক্ষণ এসব অঞ্চলে শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

আর এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে প্রথমে কাবুলের মূর্তিপূজারি বৌদ্ধ রাজাকে পরাজিত করতে হবে। কেননা, তারা সবসময় উত্তর ও পূর্বে বসবাসকারী গোত্রগুলোকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে অযথা রক্তপাত ঘটিয়ে থাকে।

কাবুলের বাদশাহদের বংশকে ‘কাবুলশাহি’ বলা হতো এবং প্রধান রাজা “রুতিবিলা” উপাধিতে প্রসিদ্ধ ছিল।

সাহাবিগণ আফগানিস্তানে যখন প্রথম অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, তখন সাময়িকভাবে পরাজিত হলেও হিজরি তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত এই বংশ তাদের শাসন ধরে রাখতে সক্ষম হয়।

যদিও আফগান বিজেতা আবদুর রাহমান ইবনু সামুরা রা. প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে কাবুল বিজয় করেছিলেন।

কিন্তু পাহাড়ঘেরা প্রাকৃতিক প্রতিরোধ-ক্ষমতাসম্পন্ন এই শহর তার অধিবাসীদের যুদ্ধবাজ ও স্বাধীনচেতা হিসেবে তৈরি করেছিল।

এ জন্য সাহাবিগণ এই বংশকে ক্ষমতায় রেখে পূর্ণ আনুগত্যের শর্তে তাদের ছেড়ে দিতে একমত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় হিজরি শতাব্দী পর্যন্ত পরিস্থিতি মোটামুটি এমনই ছিল।

ইয়াকুব ইবনু লাইস কাবুল বিজয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা হাতে নেন। যেহেতু তিনি নিজেই একজন আফগান ছিলেন, তাই আফগানদের মানসিকতা সম্পর্কে তাঁর ভালো জানাশোনা ছিল।

তিনি জানতেন, কাবুলের ওপর চূড়ান্ত হামলা করতে হলে প্রথমে দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল বিজয় করতে হবে। তবে উত্তরাঞ্চল বিজয় করতে হলে কাবুল বিজয়ের কোনো বিকল্প নেই।

হেরাত ও ইরান বিজয়

ইয়াকুব ইবনু লাইস দক্ষিণ-আফগানিস্তানে শাসনপ্রতিষ্ঠার পর পশ্চিমাঞ্চলের দিকে দৃষ্টি দেন। ছোট ছোট শহর বিজয় করে এগিয়ে যেতে থাকেন হেরাতের দিকে।

সেখানে তখন শাসন করছিল তাহিরিয়া সালতানাতের প্রশাসক মুহাম্মাদ ইবনু ইদরিস। ইয়াকুবের সঙ্গে প্রচণ্ড এক লড়াইয়ের পর তাহিরিয়া বাহিনী পরাজিত হয়।

এরপর সমগ্র হেরাত অন্যলে ইসলামি বিধান প্রতিষ্ঠা করেন ইয়াকুব। এটি ২৫৪ হিজরির ঘটনা।

পরবর্তী বছর অর্থাৎ, ২৫৫ হিজরিতে ইয়াকুব সাফফারি পশ্চিমের দিকে আরও এগিয়ে যান।

এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল, কাবুল অভিযানের সময় পারস্যের দিক থেকে যেন কেউ তাঁকে পেছন থেকে হামলা করতে না পারে।

এ লক্ষ্যে এবার কিরমানে অভিযান পরিচালনা করেন। এই শহর বিজয় করতে বড় চ্যালেঞ্জও ছিল। কারণ, এটি ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যবর্তী এলাকার একটি প্রধান শহর ছিল।

কাগজে-কলমে এই শহর তখন তাহিরিয়া সালতানাতের অধীনে থাকলেও এখানে শক্তিমান কোনো প্রশাসক ছিল না।

এ ছাড়া পারসিকদের হাত থেকে বাঁচতে এই শহর বিজয় করা বেশ জরুরি ছিল।

পারস্যের শাসকও অত্যন্ত গভীরভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল।

কিরমানের দিকে ইয়াকুবের এগিয়ে আসার সংবাদ পেয়ে পারস্যের শাসকও একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে কিরমানের দিকে এগিয়ে যায়।

ইয়াকুব তাঁর বাহিনী নিয়ে কিরমান থেকে দুদিন দূরত্বে অবস্থান করছিলেন। এ সময় তাঁর কাছে সংবাদ আসে, পারসিকরা কিরমান দখল করে নিয়েছে।

ইয়াকুব তাঁর বাহিনীকে সেখানেই শিবির স্থাপন করতে আদেশ দেন।

এতে বাহিনীর সদস্যরা বেশ অবাক হলেও আমিরের বিরোধিতা না করে হুকুম পালন করতে থাকে।

এদিকে কিরমানে খবর পৌঁছে যায়, ইয়াকুবের বাহিনী দুদিন দূরত্বে স্থির হয়ে বসে আছে। পারস্যের শাসক তাওক ইবনু মুসলিম তখন ধারণা করে, ইয়াকুব সম্ভবত ভয় পেয়ে থেমে গেছেন।

এদিকে ইয়াকুব টানা দুই মাস একই জায়গায় শিবির স্থাপন করে অবস্থান করতে থাকেন।

বিজয়

বার বার কিরমানের গোয়েন্দারা এই একই সংবাদ পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিরক্ত হয়ে পড়ে।

একসময় কিরমান-বিজেতা তাওক ইবনু মুসলিম ভেবে বসে, ইয়াকুব সম্ভবত সাহস হারিয়ে ফেলেছেন।

ফলে তাওক নিরাপত্তা শিথিলের আদেশ দেয়। ইতিমধ্যে সংবাদ আসে, ইয়াকুব ফিরতি পথের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

দুদিন পর জানা যায়, ইয়াকুব হেলমান্দের দিকে দুই মনজিল এগিয়ে গেছেন।

এরপর আর তাদের থামার কে! পুরো বাহিনীকে অস্ত্র ছেড়ে মদের গ্লাস আর গোশত নিয়ে মেতে ওঠার নির্দেশ দেয় তাওর ইবনু মুসলিম। কিরমান নগরীতে শুরু হয় বিজয়োৎসব।

কিন্তু কে জানত, দুই মনজিল ফিরে যাওয়া দরবেশ আবারও কিরমানের পথ ধরতে পারেন! হ্যাঁ সত্যি, ইয়াকুব ইবনু লাইস ঝড়ের বেগে দুদিনের পথ মাত্র এক দিনে অতিক্রম করেন।

রাত পেরিয়ে সকাল হলে কিরমানের সেনারা হতবাক হয়ে যায়। পুরো শহর তখন ইয়াকুববাহিনীর অবরোধের কবলে।

প্রধান ফটকের খানিক দূরে শিবির স্থাপন করেছেন ইয়াকুব সাফফারি। কিরমানি বাহিনীকে কোনো সুযোগ না দিয়ে এক ঝটকায় দুর্গ জয় করে নেয় সাফফারি সেনারা।

কিরমানের বাহিনী তখন চাইলেও কোনো প্রতিরোধ করতে পারত না। কেননা, রাতভর নেশায় মত্ত ছিল তারা।

এরপর তাওক ইবনু মুসলিমকে বন্দি করে ইয়াকুবের সামনে আনা হয়।

তিনি তাওককে মদপানের জন্য তিরস্কার করেন। ঘাড়ে ঝোলানো থলি থেকে শুকনো রুটি বের করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন,

‘আমি দুই মাস ধরে কাঁধে এই থলি ঝুলিয়ে রেখেছি। যখনই ক্ষুধা পেত, এখান থেকে শুকনো রুটির টুকরো চিবিয়ে নিতাম।

আর এখানে তুমি মদের আসর জমিয়ে বিজয়োৎসবে মেতে উঠেছ!’

কাবুলে মূর্তিপূজারি বৌদ্ধ শাসনের অবসান

এদিকে কাবুলের বাদশাহ বুতবিলও ইয়াকুব ইবনু লাইসের গতিবিধি সম্পর্কে বেখবর ছিল না। সে প্রতিরক্ষার জন্য বিশাল একটি বাহিনী প্রস্তুত করে।

কাবুলে বসে না থেকে দক্ষিণ-আফগানিস্তানের দিকে রওনা হয়। পথে তাকে কেউ বাধা না দেওয়ায় সরাসরি কান্দাহারে উপস্থিত হয় কাবুলি বাহিনী।

ইয়াকুবের সামরিক শক্তি কাবুলশাহির সামরিক শক্তির তুলনায় কম ছিল;

 কিন্তু মুত্তাকি দরবেশের সামান্য এই শক্তি অসাধারণ ভূমিকা প্রদর্শন করে। প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর কাবুলি বাহিনী পরাজিত হয়।

যুদ্ধে কাবুলের বাদশাহ রুতবিল মারা যায়।

এরপর কাবুলে পরবর্তী রুতবিল নির্বাচিত করা হয় একজন নতুন রাজাকে। কিছুদিন পর সে তার জেনারেলকে বাহিনীসহ পুনরায় দক্ষিণ-আফগানিস্তানের পাঠায়;

কিন্তু ইয়াকুবের খোদাভীরু বাহিনীর কাছে এই বাহিনীও পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। এই পরাজয় কাবুলশাহিকে অত্যন্ত শঙ্কিত করে তোলে।

ইয়াকুবের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে না গিয়ে এবার সে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়।

শিরাজ অভিযান

এ সময় নিজেদের বিজিত অঞ্চলে শক্তি অর্জন করে শক্তিশালী শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ হয় ইয়াকুব ইবনু লাইসের।

কাবুলের ওপর অভিযান চালাতে হলে এই সংগঠিত শহির অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।

এরপর তিনি শিরাজ শহর অভিমানের পরিকল্পনা করেন। তখন সমকালীন ইরানের কেন্দ্রীয় একটি শহর ছিল শিরাজ।

এর প্রশাসক আলি ইবন হুসাইন আগে থেকেই ইয়াকুবের ব্যাপারে ভীতসন্ত্রস্ত ছিল।

সে ইয়াকুবের অভিযানের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বাহিনী নিয়ে যুদ্ধের জন্য দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসে।

এমন একটি অবস্থান সে গ্রহণ করে, যেটি ছিল প্রতিরক্ষার দিক থেকে অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

সে তার বাহিনীকে একটি প্রশস্ত উপত্যকায় এনে শিবির স্থাপন করে।

এই উপত্যকার তিন দিকে ছিল সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি। পেছনে পালানোর পথ তারা আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিল। মূলত তাদের পেছনে ছিল একটি সংকীর্ণ গিরিপথ।

এই গিরিপথ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একটিমাত্র পথ ছিল, যেটি একসঙ্গে মাত্র একজন মানুষকেই বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিত।

সামনে ছিল একটি স্রোতস্বিনী নদী। ইয়াকুবের বাহিনীকে যদি এগিয়ে আসতে হয়, তাহলে নদী পেরিয়ে তবেই হামলা করতে হবে।

শিরাজের রাজা তার সেনাদের বলেছিল, ‘ইয়াকুব কোনোভাবেই এই নদী পেরিয়ে আমাদের ওপর হামলা করতে পারবে না।

একসময় তাকে হতাশ হয়েই ফিরে যেতে হবে।’

ইবনু লাইস নদীর এক মাইল দূরে শিবির স্থাপন করেন। এরপর একজন ব্যক্তিগত দেহরক্ষীকে সঙ্গে নিয়ে সংকীর্ণ সেই পথ দেখতে বের হন।

চতুর্দিক ভালোভাবে দেখার পর তিনি নদীর তীরে এসে পৌঁছান। আলি ইবনু হুসাইন তার কিছু সঙ্গীসাথি নিয়ে তখন নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে ছিল।

তারা ইয়াকুবকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে গালিগালাজ ও বিশ্রী ভাষায় ডাকতে থাকে।

তিনি কোনো জবাব না দিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে ফিরে আসেন।

পরদিন দুপুরে তিনি সেনাদের সব জিনিসপত্র তাঁবুতে রেখে নগ্ন ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসতে আদেশ দেন।

ঘোড়ার সঙ্গে শুধু তরবারি ও বর্গা নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

বিজয়

এরপর তিনি একটি কুকুর সঙ্গে নিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে যান। এবার কুকুরটি তিনি নদীতে ছেড়ে দেন। কুকুর সাঁতরে অপর তীরে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে থাকে।

অপর তীরে বিপক্ষের সেনারাও অপেক্ষা করছিল। এই দৃশ্য দেখে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে তারা।

এদিকে কুকুরের সাঁতরে যাওয়া পথটি ইয়াকুব ভালোভাবে পরণ করেন।

কেননা, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, প্রাকৃতিকভাবে কুকুর যে পথে নদী পেরিয়ে যায়, এই পথেই স্রোতের বেগ থাকে সবচেয়ে কম।

ইয়াকুব আল্লাহর নাম নিয়ে ঘোড়াকে নদীতে নামিয়ে দেন। সেনাদেরও তাঁকে অনুসরণের নির্দেশ দেন। পাহাড়ি খরস্রোতা নদী তেমন গভীর ছিল না।

ফলে তাঁরা সহজেই এগিয়ে যেতে পারছিলেন। শিরাজের সেনারা এমন পরিস্থিতির কথা কল্পনাও করেনি। ইয়াকুবকে নদী পার হতে দেখে তাদের কলিজার পানি শুকিয়ে যায়।

যুদ্ধ করবে কী; বরং তারা পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। দেখতে দেখতে ইয়াকুব ও তাঁর বাহিনী নদীর ওপাড়ে পৌঁছে যায়।

শুধু হয় তুমুল যুদ্ধ। শিরাজের বাহিনী যে পথ ধরে এগিয়ে এসেছিল, সেটি এতটাই সংকীর্ণ ছিল যে, একসঙ্গে মাত্র একজনই এই পথ দিয়ে আসা-যাওয়া করতে পারত।

ফলে চাইলেও সেনারা পালানোর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। এই সুযোগে সাফফারি সেনারা শিরাজি বাহিনীকে কচুকাটা করতে থাকে।

তাদের নেতা আলি ইবনু হুসাইন পালানোর চেষ্টা করলে ঘোড়া থেকে পড়ে মুসলিমবাহিনীর হাতে বন্দি হয়। এভাবে ইয়াকুবের হাতে বিজিত হয় বিখ্যাত শিরাজ শহর।

এ সময় আব্বাসি খিলাফতের তরফ থেকে সমগ্র ইরান। শাসনের অনুমতিপত্র ও প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

শিরাজ শহরের ওপর তাঁর প্রশাসনিক কর্তৃত্বের বিবরণ ইবনুল আসির রাহ. বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন।

কাবুলের ঐতিহাসিক বিজয়

২৫৭ হিজরি মোতাবেক ৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে ইয়াকুব কাবুল অভিমুখে রওনা হন। কাবুলশাহ তার পুত্রকে একটি বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দেয়।

জাবুল শহরে উভয় বাহিনীর মোকাবিলা হয়। এই যুদ্ধে কাবুলবাহিনী পরাজিত হলে বন্দি করা হয় শাহজাদাকে।

এবার সাফারি মুসলিমবাহিনী সরাসরি কাবুল অভিমুখে এগিয়ে যেতে থাকে।

কাবুলশাহ শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে নিজেই যুদ্ধে নামে, কিন্তু কাবুলের বিজয় ইয়াকুব ইবনু লাইসের কপালে লিখিত ছিল।

সুদীর্ঘকালের বৌদ্ধ শাসন দ্বারা পরিচালিত কাবুলশাহি বংশ অবশেষে ইয়াকুবের হাতে চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করে। বাদশাহ পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়।

গারদেজ শহরে কিছুদিন থাকার পর নিরাপত্তা না পেয়ে সিন্ধু নদের কিনারে অবস্থিত ‘আটক’ শহরে চলে যায়।

এখানে কিছুদিন সে অপরিচিত পথিক বেশে বসবাস করতে থাকে।

অবশেষে এখানেই তার জীবনাবসান ঘটে। দীর্ঘকাল রাজত্ব করা বৌদ্ধধর্মীয় শাহি বংশ এভাবে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায়।

ইসলামি বিজেতাদের বার বার আনুগত্য স্বীকার করেও বিদ্রোহ সৃষ্টিকারী এই বংশ অবশেষে আফগানিস্তানের মাটি থেকে চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়।

ইসলামি বাহিনী কাবুলে প্রবেশ করে বৌদ্ধধর্মের মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলে। গনিমত হিসেবে অর্জিত হয় অসংখ্য মূল্যবান ধাতু ও ধাতব মুদ্রা।

আব্বাসি খিলাফতের দরবারে এই গনিমতের অধিকাংশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এবার আব্বাসি খলিফা ইয়াকুবকে ইরানের পাশাপাশি আফগানিস্তানেরও প্রশাসক হিসেবে মনোনীত করেন।

তথ্যসুত্র

আফগানিস্তানের ইতিহাস, খন্ড ১, লেখক ইসমাইল রেহান, পৃষ্ঠা ৬৫-৭৪

Scroll to Top