আল ইয়াসিন ১০৫ মর্টার শেলের পেছনের গল্প

আল ইয়াসিন ১০৫ – দখলদার জায়োনিস্ট এবং ফিলিস্তিনি মুজাহিদ ও প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মধ্যকার সংঘাতের সময় ইহুদিরা এবং তাদের সমর্থকরা বিশ্বে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের বুলি ছড়ানোর জন্য অনেক পরিশ্রম করে।

জায়নবাদী ইহুদি ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মধ্যে পার্থক্য হলো, জায়োনিস্টরা সামরিক শক্তিতে অত্যন্ত শক্তিশালী।

তাদের নিকট আছে উন্নত অস্ত্র, আর্থিক সহায়তা এবং মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর প্রতক্ষ সমর্থন।

ফিলিস্তিনিদের যদিও এতটা শক্তি ও মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন ছিল না, কিন্তু সততা, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ় সংকল্প বিদ্যমান ছিল।

তাই ফিলিস্তিনিরা যুগের পর যুগ লড়াই চালিয়ে গিয়েছে। ময়দানে তারা পিছপা হয় নি।

ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা যুদ্ধে জায়োনিস্টদের সমস্ত ফ্রন্টে এবং শত্রুদের অত্যাধুনিক যানবাহনের মুখোমুখি হয়েছে।

কিন্তু শত্রুরা ফিলিস্তিনিদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারে নি। উল্টো ফিলিস্তিনি মুসলমানদের আক্রমণে শত্রুরা হয়েছে দিশেহারা ও পর্যদুস্ত।

২০০০ খিস্টাব্দে যখন দ্বিতীয় ইন্তিফাদার ডাক দেওয়া হয় তখন ইহুদিবাদীদের ট্যাঙ্ক এবং সাঁজোয়া যানবাহনগুলো ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজ্জা উপত্যকার দিকে দলে দলে অগ্রসর হয়।

সেই সময় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের নিকট হালকা কিছু রাইফেল ছিল। যা দ্বারা এত বড় ট্যাঙ্কের মোকাবেলা করা সম্ভব ছিল না।

তারপরও ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা হাল ছাড়েন নি। তারা ভিন্নভাবে এই দানব ট্যাঙ্কগুলোর মোকাবেলার জন্য তৈরি হয়।

চেষ্টা ছিল বড় বিস্ফোরক যন্ত্রের মাধ্যমে শত্রুদের গাড়িতে আক্রমণ করা। এই প্রচেষ্টাটি সফল হয়েছিল প্রায়।

কিন্তু এই বিস্ফোরক ডিভাইসগুলোর আকার-আকৃতি, ওজন বেশি থাকায় এবং পর্যাপ্ত উপকরণ না থাকায় অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।

এছাড়াও এই বিস্ফোরক ডিভাইসগুলো মাটিতে চাপা দিয়ে রাখতে হতো।

যাতে সেটার উপর দিয়ে ট্যাঙ্ক বা সাঁজোয়া যানবাহন গেলে তা বিস্ফোরিত হয়।

কিন্তু এটি তেমন একটা সম্ভব হতো না। কারণ শত্রুদের শ্যান ‍দৃষ্টির কারণে অনেক সময় আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতো না।

প্রথম প্রচেষ্টা

২০০২ সালে “অ্যান্টি আর্মার শেল” তৈরির চেষ্টা করা হয়। যেটির নাম ছিল “আল বান্না আল বাত্তার”। এর পাশাপাশি অনেক বোমা তৈরি করা হয়।

অ্যান্টি আর্মার শেল

কিন্তু শত্রুদের উন্নত প্রযুক্তি ও ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা বাহনে তা স্থাপন করা ও নিক্ষেপ করা ছিল কষ্টকর।

তারপরও আল কাসসাম ব্রিগেড তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। অবশেষে ২০০৪ খৃস্টাব্দে ফিলিস্তিনি প্রকৌশলীরা একটি সফলতার মুখ দেখতে পান।

তারা “আল-ইয়াসিন মিসাইল” এবং লঞ্চার P2 তৈরি করে। যা ছিল রাশিয়ান তৈরি লঞ্চার P2-RPG এর অনুলিপি।

P2-RPG

এর মাধ্যমে মুজাহিদ ও প্রতিরোধ যোদ্ধারা অনেকটা সফলতার সাথে অভিযান পরিচালনা শুরু করে।

কিন্তু এতে তেমন কোনো সমাধান আসে নি। শত্রুরা পঙ্গপালের মতো ফিলিস্তিনের ভূমিতে প্রবেশ করতে থাকে। অবশেষে একই বছর গাজ্জায় খুবই সীমিত কিছু অস্ত্র প্রবেশ করে।

এর মধ্যে রাশিয়ান P7-RPG লঞ্চারটি অনেক চড়া দামে আসে।

P7-RPG

প্রতিটা লঞ্চারের জন্য তখন $30,000 ডলার খরচ হয়। (২০০৪ সালের বাংলাদেশী টাকায় ১৭,৪০,০০০৳ প্রায়)

এছাড়াও এটি সরবরাহ করা ছিল অনেক কঠিন। অনেক বাধা অতিক্রম করে এটিকে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে হয়েছিল।

আল কাসসাম ব্রিগেড সামরিক অস্ত্রের উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করছিল।

২০০৫ সালে জায়োনিস্ট দখলদাররা গাজ্জা উপত্যকা দখল করে নিলে অস্ত্র সরবরাহ করা সহজ হয়েছিল।

এটি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের দক্ষতা বিকাশে এক অনন্য ভূমিকা রেখেছিল। সাধারণত আল কাসসাম ব্রিগেড সর্বদা তাদের সামরিক শক্তিতে উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করে।

২০০৭ সালে গাজ্জায় প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র প্রবেশ করে। যার মধ্যে অনেক P7-RPG ছিল।

এর ফলে শুরুর দিকে আল কাসসামের তৈরি “আল-ইয়াসিন মিসাইল”টি ব্যবহার করা আপাতত বন্ধ রাখা হয়।

এই বছর দুরপাল্লার অ্যান্টি-আর্মার অস্ত্রও গাজ্জায় এসেছিল। তার মধ্যে ছিল ফআগোট, কর্নেট, কনকোর্স এবং আরো অনেকগুলো।

এই সময় আল কাসসাম ব্রিগেড বাহির থেকে আসা এই অস্ত্রগুলোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিল অনেক মুজাহিদদের।

এইভাবে অস্ত্রের পাশাপাশি মুজাহিদদের দক্ষতা ও সরঞ্জামও বৃদ্ধি পেল।

প্রতিরোধ সংস্করণ ও আল ইয়াসিন ১০৫ শেল

২০১৪ সালে “মা’অরাকাতিল আসফ” বা ঝড়ের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর শত্রুরা তাদের যানবাহনগুলোকে রক্ষার জন্য নতুনভাবে বেশ কিছু সংস্করণ করে।

যেমন, মেরকাভা ৪, টাইগার ট্যাঙ্কার, ডি-৯ ফোর্টিফাইড বুলডোজার ইত্যাদি।

মেরকাভা
ইসরাইলের অহংকার মেরকাভা ট্যাঙ্ক
ডি-৯ ফোর্টিফাইড বুলডোজার
ডি-৯ ফোর্টিফাইড বুলডোজার

তাই নতুন এই যানবাহনগুলোতে ধ্বংস করতে আল কাসসাম ব্রিগেডের ইঞ্জিনিয়াররা দিন-রাত এক করে গবেষণা করে।

এছাড়াও যত ধরণের তথ্যের প্রয়োজন তা সংগ্রহ করে। আর তথ্য যেন নির্ভুল হয় সেদিকে নজর রাখা হয়।

অবশেষে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রচেষ্টার পরে “আল-ইয়াসিন ১০৫” অ্যান্টি আর্মার আবিষ্কৃত হয়।

আল ইয়াসিন ১০৫

এই কাজের জন্য ২০১৬-২০১৭ সালে এটি নিয়ে ইঞ্জিনিয়াররা কাজ করে। আর ২০১৮ সালে এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রথম উৎপাদন করা শুরু হয়।

এর পাশাপাশি “আল-ইয়াসিন অ্যান্টি ফোর্টিফিকেশন এবং অ্যান্টি পার্সোনাল মিসাইন, কমান্ডো ওয়ার্ক বোমা ও তৈরি করা হয়।

আল ইয়াসিন ১০৫

এটির সম্পূর্ণ উদ্ভাবনের কৃতিত্ব আল কাসসাম ব্রিগেডের ইঞ্জিনিয়াররা পাওয়ার যোগ্য। তারাই একদম শরু থেকে এবং শেষ পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে।

এছাড়াও বারবার পরীক্ষা করে নিত্য নতুন জিনিষ সংযুক্ত করা এবং এটিকে স্বয়ং সম্পূন্ন একটি ইসরাইলি জাহান্নাম তৈরি করার পেছনে এই ইঞ্জিনিয়ারদের অবদান অনেক।

এই অস্ত্র পরিচালনার জন্য মুজাহিদদের বিভিন্নভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয়।

কাছাকাছি এবং দূরবর্তী স্থানে লক্ষ্য করে আঘাত হানার প্রশিক্ষণ ও দেওয়া হয়।

এটি হলো আল কাসসাম ব্রিগেডের সরঞ্জাম এবং গুরুত্বপূর্ণ এবং পর্যায়,

যা শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আল কাসসাম বিগ্রেডের প্রস্তুতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ বর্ণনা করে।

আল ইয়াসিন ১০৫

আল ইয়াসিন ১০৫ এবং তুফানুল আকসা যুদ্ধ

৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে তুফানুল আকসা বা আল আকসা বন্যা যুদ্ধ শুরু হয়।

এই সময় আল কাসসাম ব্রিগেড আল ইয়াসিন ১০৫ অ্যান্টি আর্মার মিসাইল এবং আল ইয়াসিন ১০৫ (টিবিজি) অ্যান্টি ফোর্টিফিকেশন এবং অ্যান্টি পারসনাল মিসাইল ব্যবহার করা শুরু করে।

আল ইয়াসিন ১০৫

এটি শত্রুদের শক্তিতে খর্ব করে দিচ্ছিল। তাদের দম্ভ মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিল।

আল কাসসাম ব্রিগেডের মুজাহিদরা গ্রেট ক্রসিং অপারেশনের সময় এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ব্যবহার শুরু করে।

জায়োনিস্টদের যানবাহন ও ট্যাঙ্ক, বিশেষ করে মেরকাভা ৪ বাজ ট্যাঙ্ক –

যেটি নিয়ে ইহুদিরা গর্ব করতো এবং এটি ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র এবং গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধক।

এই ট্যাঙ্কটি উৎপাদন করতে প্রায় ৬ মিলিয়ন ডলার খরচ হতো।

মেরকাভা

যার মধ্যে ট্যাঙ্কের বডি এবং আর্মারের জন্য ৩ মিলিয়ন, কামান সিস্টেমের জন্য ১ মিলিয়ন এবং ট্যাঙ্কে দেওয়া বাকী ডিভাইস ও সিস্টেমর জন্য ২ মিলিয়ন খরচ হতো।

কিন্তু বিপরীতে “আল ইয়াসিন ১০৫” শেল তৈরি করতে খরচ হতো মাত্র ৫০০ ডলারের কম।

মুজাহিদদের দৃঢ়তা এবং শহীদ হওয়ার অভিপ্রায় তাদেরকে শত্রুদের উপর আক্রমণ করতে উদ্বুদ্ধ করতো।

মুজাহিদরা বোমারু বিমান, ড্রোন এবং আর্টিলারি বোমাবর্ষণ হওয়া সত্ত্বেও জায়োনিস্টদের ট্যাঙ্ক ধ্বংস করতে সদা তৎপর থাকে।

এছাড়াও আল কাসসাম ব্রিগেডের টেলিগ্রাম চ্যানেলে ও হামাসের অফিসিয়াল চ্যানেলে প্রকাশিত ভিডিওগুলোতে মুজাহিদদের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের দৃশ্য দেখানো হয়।

মুজাহিদদের এমন আক্রমণে জায়োনিস্ট ভাড়াটে সৈন্যরা নিহত ও আহত হয়ে ময়দান থেকে পলায়ন করতে বাধ্য হয়।

শেষবারের মতো প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী,

আল কাসসাম ব্রিগেড ৯৬২টি ট্যাঙ্ক, ৫৫টি সৈন্যবাহী গাড়ি, ৭৪টি বুলডোজার, ৩টি এক্সকাভেটর এবং ১৪টি সামরিক জিপ সহ ১,১০৮টির বেশি যানবাহনকে ক্ষতিগ্রস্থ ও ধ্বংস করতে সক্ষম হয়।

এছাড়াও উক্ত ট্যাঙ্ক, জিপ ও হামলার আশেপাশে থাকা অনেক জায়োনিস্ট সৈন্য, অফিসার ও ভাড়াটে সৈন্য নিহত ও আহত হয়।

আল কাসসাম ব্রিগেডের মুজাহিদদের বীরত্বপূর্ণ এই যুদ্ধের জন্য তৈরি অস্ত্র ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে গাজ্জায় অবরুদ্ধ ও অবহেলিত অবস্থায় থেকে তৈরি করা হয়।

একমাত্র আল্লাহর সাহায্য এবং দয়ার মাধ্যমেই এই বারাকাহপূর্ণ অর্জন জিহাদ ও প্রতিরোধের ইতিহাসে নতুন কয়েকটি পৃষ্ঠা লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম হবে ইনশাআল্লাহ।

তথ্যসুত্র

আল কাসসাম ব্রিগেডের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত الياسين 105 قصة تحدٍ وإنجاز في ظل الحصار শিরোনামের লেখাটির বাংলা অনুবাদ করা হলো।

Scroll to Top