হস্তমৈথুন একটি মারাত্মক গুনাহ – চারিদিকে শুনশান নিরবতা। গভীর নিস্তব্ধ রাত। পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। রাতে ঘুম আসছে না। মোবাইল বা কম্পিউটারে রয়েছে হাইস্প্রিড ইন্টারনেট।
রাতেরবেলায় নেটের স্প্রিড বেড়ে তিনগুণ হয়ে যায়। ইন্টারনেটের বিশাল জগতে নিজেকে যেন খুবই ক্ষুদ্র মনে হয়।
একটি সার্চের মাধ্যমে কত কত তথ্য সামনে চলে আসে। আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে আমার জানার পরিধিও বাড়তে থাকে।
পাড়ার বখাটে ছেলেটা বা ক্লাসের দুষ্ট ছেলেটার পাল্লায় পড়ে একটা সময় পরিচিত হয় ব্লু ফিল্মের সাথে।
নীলছবি প্রথম প্রথম দেখার পর যে কেউ ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়।
কিন্তু প্রবল আকর্ষণ ও জৈবিক চাহিদার বশবর্তী হয়ে একটা সময় নিজের নিকট আত্মসমর্পন করে যাত্রা শুরু হয় একাকিত্বের প্রেতাত্মার সাথে।
ভিডিও দেখার পাশাপাশি চলে শারিরীক পরিবর্তন। পবিত্র মন ও দেহ কখন যে অপবিত্র হয়ে উঠে, টেরও পাওয়া যায় না।
সময় যাওয়ার পর শুরু হয় হতাশা। আহ্ কি করলাম! কেন করলাম! আক্ষেপ শুরু হয়। আসুন, হস্তমৈথুন একটি মারাত্মক গুনাহ তা সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহ থেকে একটু জানি।
২.
হযরত উমর রা. থেকে বর্ণিত, সূরা মুমিনুনের প্রথম ১০ আয়াত যখন আল্লাহ নবীজি সা. এর নিকট নাজিল হয়, তখন তিনি কেবলামুখী হয়ে দোয়া করেন,
হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে অধিক দান করুন, আমাদের প্রতিদান হ্রাস করবেন না। আপনি আমাদের সম্মানিত করুন, লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আমাদেরকে প্রাধান্য দান করুন, অপরকে প্রাধান্য দান করবেন না। আমাদের প্রতি আপনি সন্তুষ্ট হোন এবং আমাদেরকে সন্তুষ্ট রাখুন।
এই দোয়া শেষ হওয়ার পর রাসূল সা. বললেন, আমার প্রতি ১০টি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে।
যেই ব্যক্তি তদানুযায়ী আমল করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
অতঃপর নবীজি প্রথম দশ আয়াত পাঠ করলেন।
قَدۡ اَفۡلَحَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ۙ﴿۱﴾ الَّذِیۡنَ هُمۡ فِیۡ صَلَاتِهِمۡ خٰشِعُوۡنَ ۙ﴿۲﴾ وَ الَّذِیۡنَ هُمۡ عَنِ اللَّغۡوِ مُعۡرِضُوۡنَ ﴿ۙ۳﴾ وَ الَّذِیۡنَ هُمۡ لِلزَّکٰوۃِ فٰعِلُوۡنَ ۙ﴿۴﴾ وَ الَّذِیۡنَ هُمۡ لِفُرُوۡجِهِمۡ حٰفِظُوۡنَ ۙ﴿۵﴾ اِلَّا عَلٰۤی اَزۡوَاجِهِمۡ اَوۡ مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُهُمۡ فَاِنَّهُمۡ غَیۡرُ مَلُوۡمِیۡنَ ۚ﴿۶﴾ فَمَنِ ابۡتَغٰی وَرَآءَ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الۡعٰدُوۡنَ ۚ﴿۷﴾ وَ الَّذِیۡنَ هُمۡ لِاَمٰنٰتِهِمۡ وَ عَهۡدِهِمۡ رٰعُوۡنَ ۙ﴿۸﴾ وَ الَّذِیۡنَ هُمۡ عَلٰی صَلَوٰتِهِمۡ یُحَافِظُوۡنَ ۘ﴿۹﴾ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡوٰرِثُوۡنَ ﴿ۙ۱۰﴾ الَّذِیۡنَ یَرِثُوۡنَ الۡفِرۡدَوۡسَ ؕ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ
অর্থ; অবশ্যই মুমিনগণ সফল হয়েছে। যারা নিজেদের নামাযে বিনয় নম্রতা অবলম্বন করে। যারা অসার কথাবার্তা এড়িয়ে চলে। আর যারা যাকাতের ক্ষেত্রে সক্রিয়। যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। তবে নিজেদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসী ব্যতীত, কারণ এ ক্ষেত্রে তারা নিন্দা থেকে মুক্ত। অতঃপর যারা এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করে তারাই সীমালঙ্ঘনকারী। আর যারা নিজেদের আমানাত ও ওয়াদা পূর্ণ করে। আর যারা নিজেদের নামাযের ব্যাপারে যত্নবান। তারাই হল উত্তরাধিকারী। তারা ফিরদাউসের উত্তরাধিকার লাভ করবে, যাতে তারা চিরকাল থাকবে।
সূরা মুমিনুন, আয়াত ১-১১
আয়াতের শুরুতেই আল্লাহ বলছেন, মুমিনরা নিশ্চয় সফল হয়েছে। তবে সেই সকল ব্যক্তিরাই, যারা…….। এরপর আল্লাহ তাদের ৬টা গুণ উল্লেখ করেছেন।
৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, যারা নিজের যৌন অঙ্গকে হেফাজত করে, (তারা সফল)। তবে নিজের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীগণ ব্যতিত, এ ক্ষেত্রে তারা নিন্দিত হবে না। তবে কেউ যদি এই হালাল পন্থা ব্যতিত অন্যকে কামনা করে তাহলে সে হবে সীমালঙ্ঘনকারী।
ইমাম শাফেয়ী রহ. এই আয়াতের মাধ্যমে হস্তমৈথুনকে হারাম বলেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ বলেছেন যারা স্ত্রী ও মালাকানাধীন দাসী ব্যতিত অন্য কোনোভাবে যৌনক্রিয়া সম্পন্ন করবে, সে হবে সীমালঙ্ঘনকারী। হস্তমৈথুন একটি মারাত্মক গুনাহ ।
এই বিষয়ে একটি হাদীস বর্ণিত রয়েছে, হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. হতে বর্ণিত, নবীজি সা. ইরশাদ করেন, সাত শ্রেণীর ব্যক্তির প্রতি কেয়ামতের দিন আল্লাহ দৃষ্টিপাত করবেন না।
আর তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং জগতবাসীর সাথে তাদেরকে একত্রিত করবেন না। আর প্রথমবারই তাদেরকে দোযখে দাখিল করবেন। তবে যারা তাওবা করবে এবং ফিরে আসবে তারা ভিন্ন।
১. যে ব্যক্তি হস্তমৈথুন করে। ২. যে ব্যক্তি পুংমৈথুন করে। ৩. যে ব্যক্তির সাথে পুংমৈথুন করা হয়। ৪. মদপানকারী। ৫. পিতা-মাতাকে প্রহারকারী। ৬. প্রতিবেশীকে কষ্টদানকারী। ৭. যে ব্যক্তি প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যবিচার করে।
৩.
সূরা কাহাফের ১১০ নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন,
فَمَنۡ کَانَ یَرۡجُوۡا لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلۡیَعۡمَلۡ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا یُشۡرِکۡ بِعِبَادَۃِ رَبِّهٖۤ اَحَدًا
যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাতের আশা করে, সে যেন সৎ আমল করে আর তার প্রতিপালকের সাথে ইবাদাতে কাউকে শরীক না করে।
উক্ত আয়াতে ইবাদাতের ক্ষেত্রে শরীক দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে, এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. লিখেন, যদি কেউ লোক দেখানোর জন্য কোনো ইবাদত করে তাহলে তার সেই আমল বরবাদ হয়ে যাবে।
লোক দেখানো ইবাদাতকে শিরকে খফী অর্থাৎ গোপন শিরক বলা হয়। এ সম্পর্কে একটি হাদীস রয়েছে। যা হযরত আহমাদ রহ. বর্ণনা করেছেন,
আমরা পর্যায়েক্রমে রাসূল সা. এর নিকট আসতাম এবং রাত্রিযাপন করতাম। নবীজির কোনো কাজের প্রয়োজন হলে আমাদের তাতে প্রেরণ করতেন।
একবার আমরা রাতে পরস্পর কথা বলছিলাম। তখন তিনি বললেন, তোমরা কি কথা বলছো? আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আল্লাহর নিকট তওবা করছি, আমরা দাজ্জালের আলোচনা করছিলাম।
তখন নবীজি বললেন, সেটা থেকেও কি অধিক বিভীষিকাপূর্ণ বিষয়ের কথা তোমাদেরকে বলবো না? আমরা বললাম, অবশ্যই ইয়া রাসূলাল্লাহ! বলুন।
তখন নবীজি বললেন, তা হলো শিরকে খফী অর্থাৎ গোপন শিরক। অর্থাৎ লোককে দেখানোর জন্য যদি সালাত পড়ো।
ইবনে গারাম রহ. বলেন, একবার সাদ্দাদ ইবনে আওস রহ. বললেন, হে লোকসকল! যে বিষয়টি আমি তোমাদের পক্ষে সর্বপেক্ষা ভয়াবহ মনে করি যা আমি রাসূল সা. কে বলতে শুনেছি।
তিনি ইরশাদ করেছেন, من الشهوة الخفية الشرك অর্থাৎ গোপন কু-কামনা করাও শিরক।
ইমাম আহমাদ রহ. বলেন, যায়েদ ইবনে হুবাব রহ. ধারাবাহিকভাবে শাদ্দাদ ইবনে আওস রা. হতে বর্ণনা করেন যে,
একদিন তিনি ক্রন্দন করছিলেন। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, কেন আপনি ক্রন্দন করছেন? তখন তিনি বললেন, আমি রাসূল সা. কে একটা কথা বলতে শুনেছি। সেটাই আমাকে কাঁদাচ্ছে।
রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, আমার উম্মতের উপর শিরক ও গোপন কু-কামনার ভয় করি। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার পরে কি আপনার উম্মত শিরক করবে?
তিনি বললেন, হ্যাঁ করবে। তবে তারা সূর্য চন্দ্র প্রস্তর মূর্তি পূজা করবে না। বরং তারা অন্য লোককে দেখানোর জন্য আমল করবে।
আর গোপন কু-কামনা হইলো, কেউ রোজা রাখলো কিন্তু হঠাৎ কোনো কু-কামনায় উত্তেজিত হয়ে রোজা ভঙ্গ করলো।
৪.
গুনাহ করতে করতে ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে পড়া ব্যক্তির কখনোই উচিৎ নয় যে, সে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হবে। আল্লাহ তার রহমত থেকে নিরাশ হতে নিষেধ করেছেন।
সূরা যুমার, আয়াত ৫৩ তে আল্লাহ বলেন,
قُلۡ یٰعِبَادِیَ الَّذِیۡنَ اَسۡرَفُوۡا عَلٰۤی اَنۡفُسِہِمۡ لَا تَقۡنَطُوۡا مِنۡ رَّحۡمَۃِ اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ یَغۡفِرُ الذُّنُوۡبَ جَمِیۡعًا ؕ اِنَّہٗ ہُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ
বলে দাও, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজের উপর সীমালংঘন করেছ, তারা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত পাপ ক্ষমা করেন। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
নিসা, আয়াত ১১০ তে আল্লাহ বলেন,
وَمَنۡ یَّعۡمَلۡ سُوۡٓءًا اَوۡ یَظۡلِمۡ نَفۡسَہٗ ثُمَّ یَسۡتَغۡفِرِ اللّٰہَ یَجِدِ اللّٰہَ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا
যে ব্যক্তি কোনও মন্দ কাজ করে ফেলে বা নিজের প্রতি জুলুম করে বসে, তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, সে অবশ্যই আল্লাহকে অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালুই পাবে।
সূরা মায়েদা, আয়াত ৭৪ তে আল্লাহ বলেন,
اَفَلَا یَتُوۡبُوۡنَ اِلَی اللّٰهِ وَ یَسۡتَغۡفِرُوۡنَهٗ ؕ وَ اللّٰهُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
তারা কি আল্লাহর নিকট তাওবা করবে না, তাঁর কাছে ক্ষমা চাইবে না, আল্লাহ তো হলেন বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
এখন কেউ যদি মনে করে, প্রতিবার তওবা করবো আর প্রতিবার গুনাহ করবো, তাহলে তার ব্যাপারে বলা হবে, সে জেনে বুঝে আল্লাহর বিধানকে অমান্য ও অস্বীকার করছে।
তাকে বলা হবে মুনাফিক। সূরা মুনাফিকুনের ২-৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
اِتَّخَذُوۡۤا اَیۡمَانَهُمۡ جُنَّۃً فَصَدُّوۡا عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ اِنَّهُمۡ سَآءَ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ . ذٰلِکَ بِاَنَّهُمۡ اٰمَنُوۡا ثُمَّ کَفَرُوۡا فَطُبِعَ عَلٰی قُلُوۡبِهِمۡ فَهُمۡ لَا یَفۡقَهُوۡنَ
তারা নিজদের শপথকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। অতঃপর তারা আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে। তারা যা করছে, নিশ্চয় তা কতইনা মন্দ! তা এ জন্য যে, তারা ঈমান এনেছিল তারপর কুফরী করেছিল। ফলে তাদের অন্তরসমূহে মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই তারা বুঝতে পারছে না।
আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাকে পরীক্ষা করবেন। এমনকি স্বয়ং আল্লাহ এটা ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, সূরা আনকাবুতের ১-৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
الٓـمّٓ ۚ﴿۱﴾ اَحَسِبَ النَّاسُ اَنۡ یُّتۡرَکُوۡۤا اَنۡ یَّقُوۡلُوۡۤا اٰمَنَّا وَ هُمۡ لَا یُفۡتَنُوۡنَ ﴿۲﴾ وَ لَقَدۡ فَتَنَّا الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِهِمۡ فَلَیَعۡلَمَنَّ اللّٰهُ الَّذِیۡنَ صَدَقُوۡا وَ لَیَعۡلَمَنَّ الۡکٰذِبِیۡنَ ﴿۳﴾ اَمۡ حَسِبَ الَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ السَّیِّاٰتِ اَنۡ یَّسۡبِقُوۡنَا ؕ سَآءَ مَا یَحۡکُمُوۡنَ
আলিফ-লাম-মীম। মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম, আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দিবেন কারা সত্যবাদী ও কারা মিথ্যাবাদী। যারা মন্দ কাজ করে তারা কি মনে করে যে, তারা আমার আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে? তাদের সিদ্ধান্ত কত মন্দ!
এরপরও কেউ যদি ধারণা করে, সে আল্লাহর রাজত্বের বাহিরে চলে যাবে। গুনাহ তার নিকর শোভনীয় মনে হয়, তাহলে তার চিন্তা অতি জঘন্য।
অতএব ফিরে আসুন রবের নিকট। রব আপনার জন্য রেখেছেন অতি মর্যাদাবান জান্নাত। আপনি কি সেই জান্নাতে প্রবেশের জন্য তৈরি?
সহায়ক গ্রন্থ
তাফসীরে ইবনে কাসীর ৭,৮,৯ খন্ড। ই.ফা. প্রকাশিত