চীনের জিনজিয়াংয়ের কাজাখ পরিবারগুলোর দুঃখ

চীনের জিনজিয়াংয়ের কাজাখ পরিবারগুলোর দুঃখ কবে শেষ হবে? পূর্ব তুর্কিস্তান। বর্তমান নাম জিনজিয়াং। এক উন্মুক্ত কারাগার। এক রক্তক্ষয়ী বর্তমান। স্বাধীন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ভূমি হলো চীনের জিনজিয়াং অঞ্চল।

২০২১ সালের শুরুর দিকে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুর মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী কার্যক্রমের নতুন প্রমাণ তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনগুলোতে ২০১৭ সাল থেকে চীনের বন্দী শিবিরের ছদ্মবেশে প্রতিষ্ঠিত রি-এডুকেশন সেন্টারের চিত্র তুলে ধরা হয়।

চীন জাতিগত উইঘুর, কাজাখ, হুই, কিরগিজ, উজবেক এবং তাজিকদের পুরো নজরদারির আওতায় এনে তাদেরকে সন্দেহের বশে ধরে নিয়ে যাচ্ছে যখন ইচ্ছা তখন।

চীনে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত মাধ্যমগুলো নিষিদ্ধ থাকায় সেখানের কোনো খবর বাহিরের পৃথিবী প্রায় জানেই না বললেই চলে।

যদি কেউ হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, ফেসবুক কিংবা অন্য কোনো অ্যাপ ধারা চীনের বাহিরে যোগাযোগ করে তৎক্ষণাৎ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়।

সার্বক্ষণিক নজরদারির আওতায় রাখতে চীন সরকার প্রত্যেক উইঘুর নাগরিকের মোবাইলে বাধ্যতামূলক নজরদারি অ্যাপ ইন্সটল করিয়ে রেখেছে।

আজকের গল্পের সবগুলোই কাজাখ জাতির সাথে সম্পৃক্ত।

কাজাখস্তান ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর বিদেশে বসবাসকারী কাজাখদের দেশে ফিরে আসতে উৎসাহিত করে।

পূর্বে অনেক কাজাখ চীনে চলে আসায় তাদের পরবর্তী উত্তরসূরী কাজাখস্তানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সকলের ভাগ্যে এটি নসীব হয় নি।

কাউকে চীন সরকার অনুমতি দেয় নি। কারো বা পাসপোর্ট কেড়ে নিয়েছে। কেউ দেশত্যাগের ইচ্ছা করার কারণে তাকে বন্দী করে নিয়ে গেছে।

এদিকে কাজাখস্তানের সরকার চীনের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখার জন্য জিনজিয়াং এ থাকা কাজাখদের ব্যাপারে কোনো টুঁ শব্দ করে না।

এমনকি যেই সকল কাজাখরা চীন থেকে পালিয়ে আসে, তাদেরকে পুরোপুরি শরণার্থীর মর্যাদাও দেওয়া হয় না।

অনেক তথ্যমতে, তাদেরকে পুনরায় চীনের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

উদাহরণস্বরুপ, সাইরাগুল একজন জাতিঘত কাজাখ হয়েও চীনের বন্দীশিবিরের ভয়াবহতা প্রকাশ করে দেওয়ায় তাকে কাজাখস্তানে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে।

পরবর্তীতে তিনি সুইডেনে যেতে বাধ্য হন। এই অনুসন্ধানী রিপোর্টে আমরা এই কাজাখ পরিবারগুলোর গল্প আনছি। যাদের কেউ চীন সরকারের নিকট বন্দী অবস্থায় আছে।

মায়ের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন গুলপিয়া কাজিবেকের

গুলপিয়া কাজিবেকের জন্ম ও বেড়ে উঠা চীনেই। ২০১৯ সালে তিনি ও তার স্বামী-সন্তানরা মিলে চীন ছেড়ে কাজাখস্তানে চলে যান।

কাজাখস্তানের যাওয়ার পেছনে ছিল এক বীভৎস কাহিনী। হান চাইনিজ সৈন্যরা একদিন বন্দী করে নিয়ে যায় গুলপিয়া কাজিবেকের মাকে।

এক পারিবারিক উৎসবের দিন মাকে বন্দী করা হয় বলে জানান তিনি। প্রথমে চাইনিজ সৈন্যরা এসে বলে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে দরকার।

এরপর তাকে থানায় নেওয়া হয়। সাথে গুলপিয়ার ছোটভাই ছিল মায়ের সাথে।

থানায় ৭ ঘন্টা অপেক্ষা করার পর গুলপিয়ার ভাইকে বলা হয়, তার মা বাড়ি যেতে পারবেন না।

এরপর কেঁটে যায় কয়েক মাস। এর মধ্যে তাদের মা পুরোপুরি নিঁখোজ ছিলেন। গুলপিয়া বলেন, আমরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেছিলাম।

বন্ধু-বান্ধব এবং সহকর্মীদের মাধ্যমে প্রতিনিয়্যত অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে থাকি। অবশেষে আমরা জানতে পারি, মা রি-এডুকেশন (চীনের কারাগার) ক্যাম্পে আছেন।

তারপর একদিন একটি ফোনকল এলো। বলা হলো, “তোমার মা হাসপাতালে আছে। তার চিকিৎসা দরকার। এর জন্য তোমাকে টাকা দিতে হবে।”

গুলপিয়া কাজিবেক বলেন, যখন আমি হাসপাতালে পৌঁছলাম তখন দেখি আমার মা ক্ষতবিক্ষত। তার হাত-পাঁয়ে শেকল দিয়ে বাঁধা এবং চোখ বাঁধা। আমি মায়ের সাথে দেখা করার সময়ে সাথে নজরদারির জন্য ক্যামেরা চালু করে রাখা হয়েছিল। মা আমাকে বললেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার বুকে লাথি মারা হয়। তারপর তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এরপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এরপর মা আমার কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমাকে এখন থেকে নিয়ে যাও, আমাকে বাঁচাও।’ পরে আরো দুইবার মায়ের সাথে দেখা করতে পেরেছিলাম। কিন্তু তখন আমার সাথে দুইজন গার্ড ছিল। তারা আমাকে মায়ের নিকটে যেতে দেয় নি। তারপর আমার মা আবার ‍নিখোঁজ হয়ে যায়। ৮ মাস পর আমার ভাই মাকে আদালতে দেখতে পেল। আদালত তাকে ১২ বছরের সাজা দিয়েছে। এর মধ্য হতে ৭ বছর সে রি-এডুকেশন ক্যাম্পে কাঁটাবে। আমাকে ভিডিও কলের মাধ্যমে মাকে দেখতে দেওয়া হয়েছিল। তারা আমার মায়ের লম্বা চুল কেটে ফেলে। তার বাহু ও পায়ে শেকল ছিল। পেছনে দুইজন মহিলাকে মেশিনগান ধরে থাকতে দেখেছি। তারা আমার মায়ের কাধে আঘাত করে এবং একটি চেয়ারে বসিয়ে দেয়। আমি তার সাথে কথা বলার জন্য মাত্র ৫ মিনিট সময় পেয়েছি। আমি কাঁদছিলাম এই দৃশ্য দেখে। এটি ছিল ২০১৭ সালের ঘটনা।

আমার মাকে দোষী সাব্যস্ত করার কারণে আমার ভাইবোনদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দেওয়া হয় না।

ভালো চাকুরি পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। তাছাড়া আমি খুব ভয় পাচ্ছি, হয়তো চীন সরকার আমার ভাই-বোনকেও ক্যাম্পে নিয়ে যাবে।

তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। হান চাইনিজ সৈন্যরা ঘরে কুরআন শরীফ রাখার মতো সামান্য অজুহাতেও লোকেদেরকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়।

যখন আমি বিয়ে করছিলাম তখন আমার মা তার রুমাল দিয়ে বলেছিলেন,

‘যখন তুমি এই রুমালটি হাতে নিবে তখন ভাববে, আমি তোমার সাথেই আছি।’ এটিই এখন আমার নিকট থাকা মায়ের শেষ স্মৃতি।

গান গাওয়ার অপরাধে বন্দী কুমিসখানের ভাই

কুমিসখান বাবান চীনে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৮ সালে তার স্বামী-শাশুড়ি এবং দুই সন্তান কাজাখস্তানে চলে আসেন।

নিজের ভাষায় তিনি তার দুঃখের ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে আমি জানতে পারলাম,

আমার দুরবর্তী এক আত্মীয়কে আটক করা হয়েছে এবং তাকে ক্যাম্পে ৮ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে।

তারপর আমি খবর পাই, আমার ছোট ভাই এবং তার স্ত্রীকে আটক করা হয়। অভিযোগ হিসেবে বলা হয়, তারা মুসলিম ধর্মচর্চা করেছে। আমার ভাই ২ মাস পর ও আমার শ্যালিকা ১ বছর পর মুক্তি পায়।

ভাই ভালো গাইতে পারতেন। মার্চ ২০১৯ এ তাকে আবার আটক করা হয়। কারণ, এই সময়ে তিনি ‘কাজাখদের দুঃখ’ নামে একটি গান গেয়েছিলেন।

পূর্বেও তিনি ৬০ এর অধিক গান প্রকাশ করেছিলেন এবং অনেক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। তার এই জনপ্রিয়তা ছিল তার গ্রেপ্তারের কারণ।

ছোট একটা ছেলে আছে আমার ভাইয়ের। এ বছর (২০২১) তার বয়স হবে ৫ বছর। বাবা-মায়ের যত্ন ছাড়াই সে বড় হচ্ছে।

চীনে আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করা অসম্ভব। সকলেই আতঙ্কে থাকে। কিন্তু আমরা তো অলসভাবে বসে থাকতে পারি না।

প্রতিদিন আমি চাইনিজ কনস্যুলেটে যাই। প্রতিবাদ করার জন্য আমাকে কয়েকবার আটক এবং জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু বের হয়ে আবার প্রতিবাদ করেছি।

আমার স্বজনদের মুক্তি না দিলে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমরা এই আন্দোলন চালিয়ে যাব। যত বড় বাধা আসুক, আমরা পিছপা হবো না।

ইমাম হওয়া ছিল আলমাখানের ভাইয়ের অপরাধ

আলমাখান মিরজান চীনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০০৩ সালে কাজাখস্তানে চলে যান এবং পরে নাগরিকত্ব পান। তিনি চীনে থাকা তার বড় ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ হারিয়েছেন।

নিজমুখে তিনি বর্ণনা করেন, আমার বাবা-মা মারা গেলে আমার ভাই আমাকে কাজাখস্তানে যেতে উৎসাহিত করেন।

এর পরই পুলিশ এসে আমার ভাইকে আটক করে। যদিও তিনি ছিলেন নির্দোষ। তাকে ৯ মাস একটি শিবিরে বন্দী করে রাখা হয়। তারপর তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওযা হয়। তার অপরাধ কি? তিনি শুধুমাত্র এলাকার স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম ছিলেন। ৪ বছর ধরে আমি আমার ভাইকে খুঁজছি। কিন্তু কোনো সাহায্য পাই নি।

আলমাটি (কাজাখস্তানের রাজধানী) র কর্তৃপক্ষ আমাকে অননুমোদিত প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার কারণে জরিমানা করেছে। কিন্তু আমরা তো শুধুমাত্র আমাদের প্রিয়জনদের বাঁচাতে চাই।

একবার খবর এসেছিল, তার স্বাস্থ্য খুবই খারাপ। উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি এবং হার্টের সমস্যায় ভুগছে আমার ভাই।

চীনা কর্তৃপক্ষ বলছে, তার ক্যান্সার হয়েছে। এর উপর তিনি প্রতিবন্ধী। তার একটি হাত নেই।

আমার ভাইয়ের বয়স ইতিমধ্যেই ৬০ বছর। জেল থেকে মুক্তি পেলে তার বয়স হয়তো হবে ৭০ এর বেশি।

আমি ভয় পাচ্ছি, হয়তো সেখানে সে বাঁচবে না। আমরা তাকে দেখতে পাব না। যদি আমরা তাকে না খুঁজি তাহলে তাকে কে খুঁজে বের করবে?

চীনে ব্যবসার জন্য যাওয়া ছিল জামিলার স্বামীর জন্য অপরাধ

জামিলা মাকেনের জন্ম পূর্ব তুর্কিস্তান বা জিনজিয়াং এর রাজধানী উরুমচিতে। ২০০৬ সালে তিনি কাজাখস্তানে চলে যান এবং ২০১৩ সালে কাজাখস্তানের নাগরিকত্ব পান।

তিনি চীনে থাকা তার স্বামী এবং ভাইকে খুঁজে চলছেন। এই বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১৭ সালে আমার স্বামী ব্যবসার জন্য চীনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে গেলে চীন সরকার তার সমস্ত কাগজপত্র কেড়ে নেয়। এবং কারাগারে আটক করে।

তারপর তারা তাকে রি-এডুকেশন নামক জেলখানায় স্থানান্তরিত করে। তারপর থেকে আমাদের আর কোনো যোগাযোগ নেই।

আমাদের ছোট্ট ‍দুইটা ছেলে আছে। যখন তাদের বাবা কারারুদ্ধ হয় তখন ছোট ছেলের বয়স ছিল ১ বছর।

তারা সর্বদা জিজ্ঞাসা করে, তাদের বাবা কোথায়? কবে আসবে?

বাচ্চারা বাবার আদর পেতে চায়। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, জানতে চায়। তারা তাদের বাবার সাথে দেখা করার স্বপ্ন দেখে।

আমি বাচ্চাদের নিকট হতে আমার অনুভূতি লুকিয়ে রাখি।

আমি তাদেরকে এই বলে বুঝ দেই যে, তোমাদের বাবা ব্যবসার কাজে গিয়েছেন এবং শীঘ্রই ফিরে আসবেন।

আমার ছোট ভাইও নিঁখোজ হয়েছে। সে চীনে গিয়েছিল এক কাজে। এরপর তার কাগজপত্র জব্দ করে এবং তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। পরে আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। আমি কেবল শুনেছি, তাকে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে, এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে পাঠানো হচ্ছে।

আমার স্বামীর একটিমাত্র স্মৃতি আমার নিকট অবশিষ্ট আছে। তা হলো একটি টুপি। আমি সর্বদা এটি আমার সাথে রাখি।

স্বপ্ন দেখি, একদিন আমার প্রিয় স্বামী ফিরে আসবে এবং আবার এই টুপিটি পরিধান করবে।

মসজিদে যাওয়ার কারণে গ্রেপ্তার হলো গুলবারানের ভাগ্নে

গুলবারান ওমিরালি চীনে জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৯ সালে তিনি কাজাখস্তান চলে আসেন এবং ২০১১ সালে তিনি সেখানের নাগরিকত্ব পান। তিনি তার ভাগিনার খোঁজ করছেন সর্বত্র।

এই বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১৫ সালে জিনজিয়াংয়ের অনেক কাজাখ এবং উইঘুরদের নিকট হতে চীন সরকার পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া শুরু করে। আমার আত্মীয়দের সাথেও এটি ঘটেছে।

এরপর ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে যখন আমার ভাগ্নে আমার সাথে দেখা করতে কাজাখস্তানে আসে তখন আমি তাকে কাজাখস্তানে থেকে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম।

পূর্বেই আমি চীনের নিপীড়নের কথা জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার ভাগ্নে তখন আমাকে বলে, আমি চীনে থাকা অন্য আত্মীয়দের সাথে নিয়ে খুব শীঘ্রই কাজাখস্তানে ফিরবো।

এরপর যখন সে চীনে ফিরে যায়, এরপর থেকে তার সাথে আর যোগাযোগ করতে পারি নি আমি।

অনেকদিন পর আমি জানতে পারি, আমার ভাগ্নেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পরে আমি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার নিকট চিঠি লিখেছি এবং রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদনও করেছি।

এতে তেমন কোনো লাভ হয় নি। কেউই কর্ণপাত করে নি।

২০১৮ সালের ডিসেম্বেরে আমি জানতে পারি, আমার ভাগ্নেকে ১৫ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। তার অপরাধ ছিল, সে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েছে।

চীন কর্তৃপক্ষ এই তথ্য জানতে পারে একজন আলেমকে গ্রেপ্তারের পর। তিনি নির্যাতনের কারণে মুসুল্লিদের ব্যাপারে সরকারকে বলতে বাধ্য হন।

কাজাখস্তান থেকে চীনে যাওয়াটা ছিল তুরসিঙ্গুর স্বামীর অপরাধ

তুরসিঙ্গু নুরাকায়ের জন্ম এবং বেড়ে উঠা চীনে। তিনি ২০১৭ সালে তার স্বামীর সাথে কাজাখস্তান চলে আসেন। সেই সময়ে তার স্বামীকে চীন সরকার আটক করে।

এই বিষয়ে তিনি বলেন, চীনে ভাষা শিক্ষক হিসেবে ৩৪ বছর চাকুরি করে আমি ২০১৫ সালে অবসর নেই।

৩ বছর পর আমি এবং আমার স্বামী কাজাখস্তানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেখানে আমাদের সন্তানরা থাকতো।

২০১৭ সালের মে মাসে, আমার স্বামীর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তিনি এটি রিনিউ করার জন্য চীনে যান। ১ মাস পর আমি তার সাথে যোগাযোগ হারাই।

আমি চীনে যেতে পারি নি, কারণ ওরালম্যান স্ট্যাটাসের আবেদনের জন্য আমাকে কাজাখ সরকারের নিকট পাসপোর্ট দিতে হয়েছিল।

(এটি কাজাখ সরকার প্রবাসী সদস্যদেরকে কাজাখস্তানে পুনর্বাসনের অনুমতি দেয়)।

কিন্তু আমার সন্তানরা ধারণা করছে, হয়তো তাদের বাবাকে ‘রাজনৈতিক শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য রি-এডুকেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে।

প্রথম প্রথম আমরা এটিকে একটি সাধারণ শিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে ভেবেছিলাম।

যেমনটা চীন সরকার প্রচার করতো। কিন্তু পরে তার সাথে আমরা আর যোগাযোগ করতে পারি নি।

২ মাস পরে আমরা জানতে পারি, তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

৩৬ বছর যাবৎ তিনি চীন সরকারের হয়ে কাজ করেছেন। কখনো তিনি আইন ভঙ্গ করেন নি।

আমরা শুনেছি, তারা কাজাখস্তান থেকে যাওয়া প্রত্যেকের উপর নজরদারি করছে এবং আটককৃত উপর পাষবিক নির্যাতন করা হচ্ছে।

এছাড়াও শুনতে পেয়েছি, চীন সরকার মসজিদে গেলে বা কাউকে নামাজ পড়তে দেখলে গ্রেপ্তার করছে।

আমি কয়েকবার চাইনিজ কনস্যুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে সাহায্য চাই। কিন্তু কোনো প্রত্যুত্তর পাই নি।

চীনে ফিরে যাওয়ার কারণে বাইবোলাতের ভাই গ্রেপ্তার হয়

বাইবোলাত কুনবোলাত চীনে বেড়ে উঠেন। তিনি ২০০৫ সালে তার বাবা-মায়ের সাথে কাজাখস্তানে চলে আসেন। তিনি তার ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ হারিয়েছেন।

এই বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১১ সালে আমার ভাই যখন সাংহাইয়ের হাই স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন তখন আমি তাকে কাজাখস্তানে পড়াশোনা করতে বলেছিলাম। এরপর সে কাজাখস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং প্রথম সেমিস্টারের পর শীতকালীন ছুটিতে সে তার পিতা-মাতার সাথে দেখা করতে চীনে ফিরে যান। পিতা-মাতা অসুস্থ থাকার কারণে সে চীনে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৭ সালে পুলিশ তাকে টার্গেট করে। এরপর আত্মীয়দের মাধ্যমে জানতে পারি, তাকে রি-এডুকেশন ক্যাম্পে নেওয়া হয়েছে। প্রথমে তারা বলেছিল, ১ মাসের জন্য। পরে বলা হয় ১ বছরের জন্য। সেই ১ বছর পার হওয়ার পরও আমার ভাইকে মুক্তি দেওয়া হয় নি।

আরো দেড় বছর পর আমি জানতে পারি, তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

আমার ভাইকে যখন প্রথম আটক করা হয় তখন আমি কিছুই করি নি।

আমি বিশ্বাস করতাম যে, সে মুক্তি পেয়ে যাবে যদি আমি কোনো ঝামেলা না করি। কিন্তু এই চীনাদের বিশ্বাস করাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।

তারপর থেকে আমি যা পেরেছি, তা করেছি। আমি কাজাখ রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লিখেছি।

প্রথমে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি নুরসুলতান নাজারবায়েভকে, তারপর বর্তমান রাষ্ট্রপতি কাসিম-জোমার্ট কেমেলেভিচ টোকায়েভকে।

আমি অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, কাজাখস্তানে চীনা দূতাবাস, জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করেছি।

কিন্তু কোনো জায়গা থেকে আমি কোনো উত্তর পাই নি। আমি চাইনিজ কনস্যুলেটে কনসালের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা আমাকে প্রবেশ করতে দেয় নি।

আমি প্রতিদিন আমার ভাইয়ের ছবি নিয়ে গণসমাবেশে অংশগ্রহণ করি।

২০২০ সালের মার্চ মাসে আমি নিজেকে কনস্যুলেটে রশি দিয়ে বেধে ফেলি। চেয়েছিলাম, যেন তারা আমাদের ক্ষতির তীব্রতা বুঝতে পারে।

বেশ কয়েকবার তারা আমাকে কনস্যুলেট ছেড়ে চলে যেতে বলে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারীতে আমাকে ৬ ঘন্টা আটক করে রাখে।

আমাকে আটক করার সময় ৩ জন মহিলা জিনজিয়াং এ তাদের আত্মীয়দের মুক্তির দাবীতে কনস্যুলেটে এসেছিলেন।

পরেরদিন ২০ জনের একটি দল আবার ভবনের বাহিরে জড়ো হয়। আমি আমার প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছি। রাস্তায় প্রতিবাদের পাশাপাশি আমি সোস্যাল মিডিয়াতেও এই বিষয়ে কাজ করছি।

২০২১ সালের জুলাই মাসে আমাকে বেসামরিক পোশাক পরা কিছু লোক গ্রেপ্তার করে। তারা আমার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয় এবং জোর করে গাড়িতে তুলে নেয়। তারা কোনো ওয়ারেন্টের কাগজপত্র দেখায় নি। আমার স্ত্রী এবং প্রতিবেশীরা দৌঁড়ে এসে আমাকে সাহায্য করে এবং সেখানকার ছবি তুলে রাখে। তারা রাত পর্যন্ত আমাকে এবং আমার আত্মীয়দের থানায় আটকে রাখে।

পরে জানতে পারি, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১০০ বছর বার্ষিকী উদযাপনের সময় যেন আমরা কনস্যুলেটে জড়ো না হতে পারি, তাই আমাকেসহ আরো অনেক প্রতিবাদকারীকে গ্রেপ্তার করেছিল তারা।

তথ্যসুত্র

উপরোক্ত আর্টিকেলটি অনুবাদ করা হয়েছে  ‘If I don’t look for him, who will?’ The Kazakh families searching for loved ones in Xinjiang’s detention camps শিরোনামে ৬ ডিসেম্বর ২০২১ সালে প্রকাশিত New East Digital Archive থেকে

চীনের ভয়াবহ নিপীড়নের ব্যাপারে জানতে পড়তে পারেন “কাশগড় কতো না অশ্রুজল” বইটি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top