ইসলামের নামে গণতান্ত্রিক সিস্টেম – উসমানীয় খেলাফতের শেষ অবস্থাকে বলা হয় খেলাফতের পতনের যুগ।
এই সময়টাতে মুসলিমবিশ্ব হঠকারিতার কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়ে এবং ইউরোপ অগ্রসর হয়।1
ইউরোপীয়ানদের এই অগ্রসর হওয়ার পেছনে রয়েছে এক গোপন রহস্য। আর তা হলো, ভারত উপমহাদেশ। 2
এই উপমহাদেশে কোম্পানীর শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই এখানে সকল সম্পদ ইংল্যান্ডে স্থানান্তরিত করা হয়।
এককালের বিশ্বের সমৃদ্ধ শহর বাংলা পরিণত হয় দুর্ভিক্ষ ও মৃতপ্রায় নগরে। ইউরোপ ইন্ডিয়ানদের রক্তচুষে নিজেরা হয়ে উঠে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধশীল।
বিপরীতে মুসলিম বিশ্ব এই ভূমি উদ্ধার না করে নিজেদের দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে। শাসকেরা মদ-নারী নিয়ে পড়ে থাকে।
মুসলিম সেনাবাহিনী ক্যাম্পে অবস্থান করছিল এবং নিজেদের দাবী পুরণের চেষ্টায় লিপ্ত ছিল।3
একটা সময় ইউরোপে লিবারেল ডেমোক্রেসি সিস্টেম চালু হলে উন্নয়নের চোখ ধাধানো উৎকর্ষ দেখে তারাও বিদ্রোহ করে বসলো খলিফার বিরুদ্ধে। খেলাফতের বিরুদ্ধে।
প্রথমে চাইলো সাধারণ সংসদ এবং খলিফার ক্ষমতা সীমিতকরণ। পরক্ষণে চাইলো খলিফার অপসারণ।4 শেষ পর্যন্ত কুখ্যাত কামালের মাধ্যমে খেলাফতে উসমানীয়ার পতন হলো।
মুসলিমবিশ্বে ইহুদি-খৃষ্টানদের ছকে শাসনব্যবস্থা জুড়ে বসলো। এরপর এটি এমনভাবে ইনপুট হয়ে গেল যে, কেউ এটি বের করতে চিন্তাও করতে পারে না এখন।
তবে এসব কিন্তু একদিনে হয় নি। ক্রমে ক্রমে হয়েছে। ইহুদি-খৃষ্টানদের উপনিবেশ থাকাবস্থায় ও স্বাধীন পার্লামেন্ট ব্যবস্থা কায়েমের পরও অধিকাংশ মুসলিমের চাওয়া ছিল সেই শরীয়াহ শাসন। যা বিগত ১৩০০ বছর মুসলিমবিশ্বে ছিল।
বালাকোটের প্রান্তর থেকে ওমর মুখতার, সবখানেই এই আন্দোলন চলমান ছিল। কিন্তু পরে আস্তে আস্তে শিথীলতা আসতে শুরু করে।
মুসলিম নেতারা কাফেরদের সাথে ও মুনাফিকদের সাথে লড়াইয়ের জন্য ব্যালটকে ভরসা করা শুরু করে। তারা গণতান্ত্রিক ভোটে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। জোট গঠন করে।
তারা এই সিস্টেমে প্রবেশ করেছিল সিস্টেমকে চেঞ্জ করার জন্য, কিন্তু একটা সময় দেখা যায় সিস্টেম সিস্টেমের জায়গাতেই আছে কিন্তু এই লোকগুলো চেঞ্জ হয়ে গেছে।
তাই দেখবেন, বর্তমানে ইসলামী গণতান্ত্রিক দলগুলো বহু অপব্যাখ্যা হাজির করে এই ইসলামের।
এমনকি তারা তাওহীদবাদীদেরকে তাদের কার্যক্রমের শত্রু হিসেবেও বিবেচনা করে।
পশ্চিমাদের নিকট এই সকল মুসলিমরা ভালো। কারণ, তারা ফান্ডামেন্টালিস্ট নয় ।
ব্যর্থতা
গণতান্ত্রিক এই সিস্টেমে আজ পর্যন্ত কোনো ইসলামিক দল ইসলাম কায়েম করতে পারে নি।
তা হোক বাংলাদেশে কিংবা পাকিস্তানে অথবা তিউনিশিয়ায় কিংবা মিশরে।
সবখানেই একটা কমন প্যাটার্ন দেখা যায়, প্রথম প্রথম পুরোপুরি ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা দলটা একটা সময় স্রেফ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নীতির পরিবর্তন ঘটায়।
কিন্ত এত কিছু করার পরও তারা কি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ? কখনো কি তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে? কখনো ক্ষমতায় গেলে কি টিকে থাকতে পারবে? একত্রে উত্তর, না।
প্রথম উদাহরণ। খেয়াল করে দেখবেন, যেই দেশগুলোতে ইসলামিক দল রয়েছে, তারা কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়।
তারা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জোট গঠন করে ক্ষমতায় যায়। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
এমনকি যেই দেশগুলোকে সংসদীয়ভাবে ইসলামী দেশ বলা হয় যেমন, পাকিস্তান, ইরান। সেখানেও ইসলামী দল সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়।
কারণ, গণতান্ত্রিক সিস্টেমটাই এমন যে, মূল প্রভূ পশ্চিমাদের ছকের বাহিরে এখানে কিছুই ঘটে না।
দ্বিতীয় উদাহরণ। তিউনিশিয়ায় বিপ্লবের পর সেখানের ইসলামিক দল নাহদা ২০১১ সালে আরব বসন্তের পর ক্ষমতায় আসে। কিন্তু বছরখানেকও টিকে নি।5
পশ্চিমা প্রভুরা সন্তুষ্ট হয় নি এজন্য যে, কোনো ইসলামী দল ক্ষমতায় গিয়েছে।
অবশেষে বিরোধীদের প্রবল আন্দোলনের মুখে নাহদা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, ২০১৭ এর দিকে এই ইসলামী দল আন নাহদা নিজেদের থেকে ইসলামিক লেবেল খুলে ফেলে অন্য দশটা গণতান্ত্রিক দলের ন্যায় নিজেদেরকে ঘোষণা দেয়।
তৃতীয় উদাহরণ। মিশরে দীর্ঘদিন জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে অবশেষে ইখওয়ানুল মুসলিমীন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় আসে ২০১২ সালে।
মুরসী সরকার সরকার গঠন করে। কিন্তু ১ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারে নি।
সেনাপ্রধান মিলিটারি ক্যু করে মুরসীকে বন্দী করে এবং মুরসী বন্দী অবস্থাতেই ২০১৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।6
আমাদের দেশে ইসলামী দলগুলো সেই পুরোনো হোলেই ঘুরপাক খায়।
সংসদীয় পন্থায় তারা ক্ষমতায় যাবে এবং ইসলাম কায়েম করবে। অথচ তারা শিক্ষা নিতে চায় না পূর্বের ইতিহাস থেকে।
উত্তরণ কোন পথে
একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের চাওয়া হলো, ইসলামী ইমারাহ ও খেলাফাহ। এটাই গত ১৩শত বছর ছিল। খলিফার অধীনে মুসলমানরা থাকবে। এমনটাই বিধান। এমনটাই নিয়ম।
এই ইমরাহ এবং খেলাফাহ কোনো বাটন নয় যে, ক্লিক করলেই তা অটোমেটিক চালু হবে। বরং এটা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
রক্তপিচ্ছিল পথ পাড়ি দিতে হবে এর জন্য। পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব কিংবা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই এটি অর্জিত হবে। যেমনটা হয়েছে আফগানিস্তানে।7
কোনো নির্যাতিত মুসলিম দেশ যদি কাফেরদের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য পশ্চিমাদের ছকে যেতে কাজ করতে চায় তাহলে এটি হবে পুরোপুরি ব্যর্থতা।8
বর্তমান ফিলিস্তিন সংকট কখনোই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমাধান হবে না। এই প্রক্রিয়ায় থাকলে কখনোই বিপ্লবী দলকে পশ্চিমারা সমর্থন করবে না।
ফিলিস্তিন সংকট সমাধান হবে একমাত্র ইমরাহ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আজ হোক কাল হোক, এই প্রক্রিয়ায় আসতে হবে।
অন্যথায় আরো শত শত তুফানুল আকসা যুদ্ধ করলে কেবল দাবী আদায়ের মাধ্যমেই ইসরাইলকে অস্বীকার করা হবে। তাদের প্রভু আমেরিকা ও ইউরোপ কখনোই এটা মেনে নিবে না।
সহায়ক
- অবাধ্যতার ইতিহাস এবং ইতিহাসের আয়নায় বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা পড়ুন ↩︎
- রেশমি রুমাল আন্দোলন পড়ুন ↩︎
- উসমানীয় খেলাফতের পতনকাল সম্পর্কে পড়ুন ↩︎
- সুলতান আব্দুল হামিদ আস সানী রহ. এর জীবনী পড়ুন ↩︎
- শ্বেত সন্ত্রাসের এই সময় পড়ুন ↩︎
- ইখওয়ানুল মুসলিমীনের ইতিহাস পড়ুন ↩︎
- আফগানিস্তানের ইতিহাস, আফগানিস্তানে আমার দেখা আল্লাহর নিদর্শন, সিসঢালা প্রাচীর পড়ুন ↩︎
- মুসলিমবিশ্বের ঘটনার পাশাপাশি পড়ুন বসনিয়া যুদ্ধের ইতিহাস ↩︎
লেখাটি শেয়ার করতে সর্ট লিংক কপি করুন