তুলায়হা আসাদি এর ফেতনার অবসান – রাসূল সা. এর ইন্তিকালের পর বনু আসাদ গোত্রের সরদার তুলাইহা আসাদি নবুয়তের মিথ্যা দাবী করে।

সে তার গোত্র এবং আশেপাশের গোত্র মিলিয়ে অনেক অনুসারী জমা করে ফেলেছিল। সে দাবী করতো, জিবরাইল আ. তার নিকট ওহী নিয়ে আসেন।

রাসূলের জীবনের শেষ সময় তুলায়হা

নবী কারীম সা. এর ইন্তিকালের পূর্বে সে একদল প্রতিনিধিসহ রাসূলের নিকট আসে। মদীনায় পৌছে সে রাসূল সা. কে সালাম দেয়।

এরপর সে অনুগ্রহ প্রকাশ করতে গিয়ে বলে, আমরা নিজে থেকে আপনার খেদমতে এসেছি।  আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ব্যতিত কোনো মাবুদ নেই এবং আপনি তার বান্দা ও রাসূল।

কিন্তু আল্লাহ আমাদের কাছে কাউকে পাঠান নি। আমরা আমাদের পেছনে থাকা লোকদের জন্য যথেষ্ঠ।

এরপরেই আল্লাহ তা’আলা সূরা হুজরাতের ১৭ নং আয়াত অবতীর্ণ করেন,

یَمُنُّوۡنَ عَلَیۡکَ اَنۡ اَسۡلَمُوۡا ؕ قُلۡ لَّا تَمُنُّوۡا عَلَیَّ اِسۡلَامَکُمۡ ۚ بَلِ اللّٰهُ یَمُنُّ عَلَیۡکُمۡ اَنۡ هَدٰىکُمۡ لِلۡاِیۡمَانِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ

“তারা ইসলাম গ্ৰহণ করে আপনাকে ধন্য করেছে মনে করে। বলুন, তোমরা ইসলাম গ্ৰহণ করে আমাকে ধন্য করেছ মনে করো না। বরং আল্লাহই ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন। যদি তোমরা সত্যবাদী হও।”

এরপর তুলায়হা প্রতিনিধিদল নিয়ে নিজ এলাকায় ফিরে আসে এবং একটা সময় সে নবুয়তের দাবী করে বসে। কিন্তু এবার সে ফাঁদে পড়ে যায়।

তুলায়হা বুঝতে পারে, মুসলমানদের সঙ্গে তার সংঘাত অনিবার্য। সে তখন সামিরা অঞ্চলকে নিজের ঘাঁটি বানিয়ে নেয়।

সাধারণ মানুষের নিকট সে তার নবুয়তের দাবী ছড়াতে থাকে। অনেকেই তার ফাঁদে পা দিযে বসে।

মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য সে ভেলকিবাজি প্রদর্শন করতো।

তুলায়হার ভেলকিবাজি

একবার কিছু লোক তার সঙ্গে সফরে ছিল। পথিমধ্যে তাদের সাথে থাকা পানি শেষ হয়ে যায়। মরুভূমিতে প্রচন্ড পিপাসায় তারা কাতরাতে থাকে।

তখন সে তার অনুসারীদের বলে, তোমরা ঘোড়ায় চড়ে কয়েক মাইল সামনে অগ্রসর হও। সেখানে পানির মটকা দেখতে পাবে।

লোকেরা সেখানে গিয়ে দেখে, সত্যি পানির মটকা রয়েছে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষ এটাকে তুলায়হার ‍মোজেজা ভেবে বসে।

তুলায়হা বিভিন্নরকম ভেলকিবাজির মাধ্যমে বনু আসাদ, বনু গাতফান, বনু তায়ীর লোকদের বিভ্রান্ত করে ফেলে।

এর ফলে এই গোত্রের লোকেরা মদীনার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

তুলায়হার ওহী

তুলায়হা দাবী করতো, তার নিকট জিবরাইল আ. আসে। সে কিছু মনগড়া আয়াত মানুষের নিকট বলে বেড়াতো। যেমন,

والحمام واليمام والصرد الصوام قد صمن قلبكم بأعوام ليبلغن ملكنا بالشام

অর্থ: শপথ শহুরে এবং জংলি কবুতর এবং রোজাদার শিকারী পাখির। তারা তোমাদের কযেক বছর পূর্বেই রোজা রেখেছে। আমার রাজত্ব শাম পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।

তুলায়হার বিরুদ্ধে আবু বকর রা. এর অভিযান

হযরত আবু বকর রা. তুলায়হার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য সেনাপ্রধান হিসেবে খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. কে নির্বাচন করেন।

তুলায়হা তখন তার বাহিনীর সাথে বুযাখ নামক স্থানে অবস্থান করছিল। হযরত আবু বকর রা. খালিদকে পাঠানোর সময় এই নির্দেশ দেন যে,

“তুমি প্রথমে তায়ী গোত্রের নিকট যাবে। এরপর বুযাখের দিকে যাত্রা করবে। এই দায়িত্ব শেষ করার পর বিতাহে বনু তামিমের মালেক বিন নুয়াইরার খরব নিবে।

এরপর আমার নির্দেশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।”

আবু বকর রা. এই নির্দেশের ফলে খালিদ রা. প্রথমে তায়ী গোত্রের সাথে যোগাযোগ করেন।

তারা তখনো ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাদের কিছু লোক বিভ্রান্ত হয়ে তুলায়হার অনুসারী হয়েছিল।

বনু তায়ীর সরদার আদি বিন হাতেম খালিদ রা. এর নিকট তিনদিন সময় চান। এই সময়টায় আদি রা. তার গোত্রকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করেন।

শেষ পর্যন্ত আদি বিন হাতেম রা. এর প্রচেষ্টায় তার গোত্র তুলায়হার সঙ্গ ছেড়ে দিয়ে খালিদ রা. এর বাহিনীতে যোগদান করে।

হযরত আবু বকর রা. এর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করার সফলতা ছিল এটা। দেখা যায়, যুদ্ধ শুরু করার পূর্বে শত্রুসারিতে ভীতি ছড়িয়ে যায়।

তুলায়হার সাথে খালিদ রা. এর যুদ্ধ

বুযাখা নামক স্থানে উভয় বাহিনী মুখোমুখি হয়। জায়গাটি ছিল মদীনা থেকে ৪০০ কি.মি. দূরে।

তুলায়হা আসাদি তখন চাদর মুড়ি দিয়ে মুরাকাবার সূরতে এমনভাবে বসে, যেন মনে হচ্ছে তার উপর ওহী নাযিল হবে।

তার বাহিনীর সেনাপ্রধান ছিল উয়াইনা বিন হিসিন। তার অধীনে বনু ফাযারার ৭০০ যোদ্ধা ছিল। মুসলমানদের উপর তুলায়হার বাহিনী আক্রমণ করে বসে।

উয়াইনা মুসলমানদের আক্রমণ দেখে ভড়কে যায়। সে বুঝতে পারে, খালিদ রা. কে হারানো বেশ কঠিন।

সে তখন তুলাইহার নিকট এসে জিজ্ঞাসা করে,

জিবরাইল কি কোনো বার্তা নিয়ে এসেছে? তুলাইহা বললো, আসে নি। আস্তে আস্তে উয়াইনা পরাজয়ের রক্তিম আভা দেখতে থাকে।

তখন সে তুলায়হার নিকট এসে বলে, তোর বাপের মৃত্যু হোক। এতক্ষণ লাগে জিবরাইলের আসতে?

তুলাইহা বললো, জিবরাইল না এলে আমি কি করবো?

উয়াইনা তার বাহিনীকে যুদ্ধে ব্যস্ত রাখে। কিন্তু তারা ময়দানে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারছিল না। তারা দলে দলে মৃত্যুবরণ করছিল।

উয়াইনা এবার পাগলের মতো ছুটে এসে তুলায়হাকে ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, এবার কি আসছে?

তুলাইহা বললো, হ্যাঁ এসেছিল। উয়াইনা উচ্ছ্বাসিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কি বললো তিনি?

উয়াইনা তখন মনগড়া একটা আয়াত বলে, “তোমার ভাগ্যে তার মতো একটি চাক্কি নসিব হবে।

তোমার অবস্থা এমন হবে যে, ‍তুমি চিরকাল তা স্মরণ রাখবে।”

এমন উল্টাপাল্টা কথা শুনে উয়াইনা বুঝে যায়, সে মিথ্যা নবুয়তের দাবীদার। তখন সে বাহিনীর নিকট এসে ঘোষণা দিয়ে বললো,

লোকসকল, তোমরা পালিয়ে যাও। এই লোক একটা মিথ্যুক এবং ধোঁকাবাজ। সে মিথ্যা নবুয়তের দাবী করেছে।

তখন উয়াইনার লোকজন পলায়ন করতে থাকে। মুরতাদরা পরাজয়বরণ করে। হযরত খালিদ রা. উয়াইনাকে গ্রেপ্তার করেন।

মিথ্যা নবুয়তের দাবীদার উয়াইনা আগে থেকেই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য ঘোড়া তৈরি করে রেখেছিল।

সে তার স্ত্রীকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে পলায়ন করে শামে চলে যায়।

তুলাইহার তওবা

এরপর তুলায়হা আসাদি কিছুদিন এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করে অবশেষে সে হযরত আবু বকর রা. এর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে দ্বিতীয়বার ইসলাম গ্রহণ করে।

আবু বকর রা. তার তওবা করা দেখে সাদরে গ্রহণ করে নেন। এরপর তুলায়হা আসাদি ইরাকে একজন মুসলিম যোদ্ধা হিসেবে জীবন অতিবাহিত করে।

এদিকে তুলাইহার সেনাপতি উয়াইনাও তওবা করে ‍ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নেয়। তাকেও ক্ষমা করে দেয়া হয়।

তথ্যসুত্র

১. মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খণ্ড ৩। পৃষ্ঠা ৫০-৫৩

২. আবু বকর সিদ্দিক। পৃষ্ঠা ৩৩৭-৩৪৩

তুলায়হা আসাদী কে?

তুলায়হা আসাদি আরবের বনু আসাদ গোত্রের সরদার ছিলেন। তিনি নবীজির নিকট ইসলাম গ্রহণ করার পর মুরতাদ হয়ে নিজেকে নবী দাবী করেন।

তুলায়হা কি তওবা করেছিল?

খালিদ রা. এর সাথে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর তুলায়হা আবু বকর রা. এর নিকট তওবা করে দ্বিতীয়বার মুসলমান হয়।

তুলায়হা আসাদীর সেনাপতি কে?

উয়াইনা বিন হিসিন

Abdur Rahman Al Hasan
Scroll to Top