খারেজী কারা এবং তাদের সংজ্ঞা দিতে দিয়ে অনেক আলেম অনেক রকমভাবে তাদের পরিচয় তুলে ধরেছেন। তন্মধ্যে,
আবুল হাসান আশআরী রহ.বলেন,
যারা চতুর্থ খলিফা আমিরুল মুনিনীন আলী রাঃ এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং তার দল ত্যাগ করেছে, তারাই হলো খারেজি।
ঈমাম ইবনে হাজাম আন্দালূসী রহ. বলেন,
খারেজী বলতে প্রত্যেক এমন সম্প্রদায়কে বুঝায়, যারা চতুর্থ খলিফা আলী রা. এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে কিংবা তাদের রায় বা মত গ্রহণ করেছে।
তিনি আরো বলেন, খারেজী হলো তারা, যারা নিচের ৫ টি মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করে।
১. যারা ‘সালিশি ব্যবস্থা’ অস্বীকার করে অর্থাৎ বলে থাকে যে, সালিশের বিধান ইসলামে নেই।
২. গুনাহের কারণে অন্য মুসলমানকে কাফের বলে।
৩. মুসলমান শাসক ও সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
৪. কবিরা গুনাহগারকে চিরন্তন জাহান্নামী মনে করে।
৫. যারা কুরাইশ বংশীয় নয়, তাদের মধ্যে ইমামত বৈধ হওয়ার আকিদার ক্ষেত্রে খারেজীদের সঙ্গে সহমত পোষণ করে।
আর যদি কেউ উপরের ৫ টি বিষয়ের সঙ্গে সহমত পোষণ না করে এবং মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান মতানৈক্যপূর্ণ অন্যান্য মাসআলায় সে খারেজীদের বিরোধী মত পোষণ করে, তাহলে তাকে খারেজী বলা যাবে না।
আল্লামা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ আব্দুল করীম শাহরাস্তানি রহ. বলেন,
জনসাধারণ কর্তৃক স্বীকৃত ও সমাদৃত হক ইমামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীরাই হলো খারেজী । চাই এই বিদ্রোহ খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে হোক বা পরবর্তী যে কোনো সময়ে হোক।
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন,
খারেজী হচ্ছে ওই সকল লোক, যারা তাহকিমের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আলী রা. এর বিরুদ্ধাচারণ করে দলত্যাগ করে।
সেসব লোকেরা আলি রা., উসমান রা. ও তাদের পরিবারবর্গকে গালমন্দ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। তারা যদি উপরিউক্ত পূত-পবিত্র সাহাবীদেরকে কাফির বলে, তবে তারা চরমপন্থী গাদ্দার খারেজী।
ইবনে হাজার রহ. অন্য এক জায়গায় বলেন, খারেজী হলো বিদ্রোহীদের একটি দল। এই দলটি বেদআতি। দ্বীনি বিধান ও মুসলমানদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কারণে তাদেরকে খারেজী বলা হয়।
আবুল হাসান আল মালাতি রহ. বলেন,
খারেজী হলো তারাই, যারা আলী রা. ও মুআবিয়া রা. এর চুক্তিতে “ لا حكم إلا الله” অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানি না” বলে স্লোগান তুলেছিল।
তারা তখন বলেছিল যে, আলী রা. হযরত আবু মুসা আশআরী রা. কে সালিশ মেনে কুফরি করেছেন। (নাউযুবিল্লাহ) অথচ সালিশের অধিকার কেবল আল্লাহর।
এরাই হলো, খারেজী ফেরকার লোক। তারা তাহকিমের দিন আলী রা. এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দলছুট হয়ে যায়।
কেননা তারা আলী রা. ও মুসা আশআরী রা. এর সালিশকৃত কাজকে অপছন্দ করে বলে, আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানি না।
দলীলের আলোকে খারেজী কারা
সিফফিনের যুদ্ধে হযরত আলী রা. সালিশের চুক্তি মেনে সন্ধি করার কারণে যারা আলী রা. এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তারাই খারেজী।
খারেজীদেরকে আরো বেশি কিছু নামে সম্বোধন করা হয়। যেমন: হারুরিয়া, শুরাত, আল মারিকা বা মুহাক্কিমা ইত্যাদি।
পড়ুন: হযরত আবু বকর রা. এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী
কতক আলেমের মতে, খারেজীদের উৎপত্তি রাসূলের জীবদ্দশায় ঘটেছিল। এই আলেমরা প্রথম খারেজী হিসেবে উল্লেখ করেছেন জুল-খুয়াইসারা নামক এক ব্যক্তিকে।
রাসুলের জীবদ্দশায় হযরত আলী রা. ইয়ামানের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তখন তিনি সেখান থেকে সামান্য পরিমাণ স্বর্ণ পাঠিয়েছিলেন রাসূলের নিকট।
তখন রাসূলের স্বর্ণ বন্টনে জুল-খুয়াইসারা আপত্তি তুলেছিল।
খারেজী কারা ও খারেজীদের সম্পর্কে হাদীস
حَدَّثَنَا أَبُوْ الْيَمَانِ أَخْبَرَنَا شُعَيْبٌ عَنْ الزُّهْرِيِّ قَالَ أَخْبَرَنِيْ أَبُوْ سَلَمَةَ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ أَنَّ أَبَا سَعِيْدٍ الْخُدْرِيَّ قَالَ بَيْنَمَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ يَقْسِمُ قِسْمًا أَتَاهُ ذُوْ الْخُوَيْصِرَةِ وَهُوَ رَجُلٌ مِنْ بَنِيْ تَمِيْمٍ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ اعْدِلْ فَقَالَ وَيْلَكَ وَمَنْ يَعْدِلُ إِذَا لَمْ أَعْدِلْ قَدْ خِبْتَ وَخَسِرْتَ إِنْ لَمْ أَكُنْ أَعْدِلُ فَقَالَ عُمَرُ يَا رَسُوْلَ اللهِ ائْذَنْ لِيْ فِيْهِ فَأَضْرِبَ عُنُقَهُ فَقَالَ دَعْهُ فَإِنَّ لَهُ أَصْحَابًا يَحْقِرُ أَحَدُكُمْ صَلَاتَهُ مَعَ صَلَاتِهِمْ وَصِيَامَهُ مَعَ صِيَامِهِمْ يَقْرَءُوْنَ الْقُرْآنَ لَا يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ يَمْرُقُوْنَ مِنْ الدِّينِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنْ الرَّمِيَّةِ يُنْظَرُ إِلَى نَصْلِهِ فَلَا يُوْجَدُ فِيْهِ شَيْءٌ ثُمَّ يُنْظَرُ إِلَى رِصَافِهِ فَمَا يُوْجَدُ فِيْهِ شَيْءٌ ثُمَّ يُنْظَرُ إِلَى نَضِيِّهِ وَهُوَ قِدْحُهُ فَلَا يُوْجَدُ فِيْهِ شَيْءٌ ثُمَّ يُنْظَرُ إِلَى قُذَذِهِ فَلَا يُوْجَدُ فِيْهِ شَيْءٌ قَدْ سَبَقَ الْفَرْثَ وَالدَّمَ آيَتُهُمْ رَجُلٌ أَسْوَدُ إِحْدَى عَضُدَيْهِ مِثْلُ ثَدْيِ الْمَرْأَةِ أَوْ مِثْلُ الْبَضْعَةِ تَدَرْدَرُ وَيَخْرُجُوْنَ عَلَى حِيْنِ فُرْقَةٍ مِنْ النَّاسِ
قَالَ أَبُوْ سَعِيْدٍ فَأَشْهَدُ أَنِّيْ سَمِعْتُ هَذَا الْحَدِيْثَ مِنْ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَأَشْهَدُ أَنَّ عَلِيَّ بْنَ أَبِيْ طَالِبٍ قَاتَلَهُمْ وَأَنَا مَعَهُ فَأَمَرَ بِذَلِكَ الرَّجُلِ فَالْتُمِسَ فَأُتِيَ بِهِ حَتَّى نَظَرْتُ إِلَيْهِ عَلَى نَعْتِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم الَّذِيْ نَعَتَهُ
আবূ সা’ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি কিছু গনীমতের মাল বণ্টন করছিলেন।তখন বানু তামীম গোত্রের জুল-খুয়াইসারা নামে এক ব্যক্তি এসে হাযির হল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি ইনসাফ করুন। নবীজি বললেন, তোমার দুর্ভাগ্য! আমি যদি ইনসাফ না করি, তবে ইনসাফ করবে কে? আমি তো নিষ্ফল ও ক্ষতিগ্রস্ত হব যদি আমি ইনসাফ না করি। ’ উমার (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে অনুমতি দিন আমি এর গর্দান উড়িয়ে দিই। তিনি বললেন, একে ছেড়ে দাও। তার এমন কিছু সঙ্গী সাথী রয়েছে তোমাদের কেউ তাদের সালাতের তুলনায় নিজের সালাত এবং সিয়াম নগণ্য বলে মনে করবে। এরা কুরআন পাঠ করে, কিন্তু কুরআন তাদের কন্ঠনালীর নীচে প্রবেশ করে না। তারা দ্বীন হতে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন তীর ধনুক হতে বেরিয়ে যায়। তীরের অগ্রভাগের লোহা দেখা যাবে কিন্তু কোন চিহ্ন পাওয়া যাবে না। কাঠের অংশ দেখলে তাতেও কিছু পাওয়া যাবে না। মাঝের অংশ দেখলে তাতেও কিছু পাওয়া যাবে না। তার পালক দেখলে তাতেও কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না। অথচ তীরটি শিকারী জন্তুর নাড়িভুঁড়ি ভেদ করে রক্তগোশত পার হয়ে বেরিয়ে গেছে। এদের নিদর্শন হল এমন একটি কালো মানুষ যার একটি বাহু নারীর স্তনের মত অথবা গোশত খন্ডের মত নড়াচড়া করবে। তারা লোকদের মধ্যে বিরোধ কালে আত্ম প্রকাশ করবে। আবূ সা’ঈদ (রাঃ) বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট হতে এ কথা শুনেছি। আমি এ-ও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, ’আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) এদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। আমিও তার সঙ্গে ছিলাম। তখন ’আলী (রাঃ) ঐ লোককে খুঁজে বের করতে আদেশ দিলেন। খোঁজ করে যখন আনা হল আমি মনোযোগের সঙ্গে তাকিয়ে তার মধ্যে ঐ সব চিহ্নগুলি দেখতে পেলাম, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন।
(সহীহ বুখারী ৩৬১০ নং হাদীস)
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ كَثِيرٍ، أَخْبَرَنَا سُفْيَانُ، حَدَّثَنَا الْأَعْمَشُ، عَنْ خَيْثَمَةَ، عَنْ سُوَيْدِ بْنِ غَفَلَةَ، قَالَ: قَالَ عَلِيٌّ عَلَيْهِ السَّلَام إِذَا حَدَّثْتُكُمْ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَدِيثًا فَلَأَنْ أَخِرَّ مِنَ السَّمَاءِ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أَكْذِبَ عَلَيْهِ، وَإِذَا حَدَّثْتُكُمْ فِيمَا بَيْنِي، وَبَيْنَكُمْ فَإِنَّمَا الْحَرْبُ خَدْعَةٌ، سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: يَأْتِي فِي آخِرِ الزَّمَانِ قَوْمٌ حُدَثَاءُ الْأَسْنَانِ، سُفَهَاءُ الْأَحْلَامِ، يَقُولُونَ مِنْ قَوْلِ خَيْرِ الْبَرِيَّةِ، يَمْرُقُونَ مِنَ الْإِسْلَامِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ، لَا يُجَاوِزُ إِيمَانُهُمْ حَنَاجِرَهُمْ، فَأَيْنَمَا لَقِيتُمُوهُمْ فَاقْتُلُوهُمْ، فَإِنَّ قَتْلَهُمْ أَجْرٌ لِمَنْ قَتَلَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
সুওয়াইদ ইবনু গাফালাহ (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আলী (রাঃ) বলেন, যখন আমি তোমাদের নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সূত্রে হাদীস বর্ণনা করি, তখন তাঁর উপর মিথ্যা আরোপ করার চেয়ে আমার আকাশ থেকে পড়ে যাওয়া অধিক পছন্দনীয়। আর যখন আমি আমার ও তোমাদের মধ্যকার বিষয়ে আলাপ করি তখন বুঝবে যে ’’যুদ্ধ হলো কৌশল।’’ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, শেষ যুগে এমন লোকদের আত্মপ্রকাশ ঘটবে যারা হবে বয়সে নবীন এবং প্রতিজ্ঞাহীন বোকা। তারা সমগ্র সৃষ্টিকূলের মধ্যে সর্বোত্তম কথা বলবে, তীর যেভাবে ধনুক থেকে বেরিয়ে যায় তারাও সেভাবে দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে, তাদের ঈমান কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তোমরা যেখানেই এ ধরণের লোকের দেখা পাবে সেখানেই তাদেরকে হত্যা করবে। কারণ যারা এদেরকে হত্যা করবে কিয়ামতের দিন তারা সাওয়াব লাভ করবে।
সুনানে আবু দাউদ। হাদীস নং ৪৭৬৭
খারেজিদের সাথে বিতর্ক
হযরত আলী রা. যখন তার বাহিনী নিয়ে সিফফিন যুদ্ধ হতে কুফা নগরীতে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন খারেজিরা এক বড় দল নিয়ে আলী রা. হতে পৃথক হয়ে যায়।
তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার। তবে এটি নিয়ে বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থে বিভিন্নরকম বর্ণনা রয়েছে।
আল বিদায়া ওয়ান নিহায় গ্রন্থে বলা হয়েছে, তাদের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার। মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক গ্রন্থে বলা হয়েছে, তাদের সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার।
তারিখুল খুলাফা গ্রন্থে তাদের সংখ্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০ হাজার। তবে এটি ভিত্তিহীন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
হযরত আলী রা. এর উদ্বেগ
কুফায় পৌঁছার পূর্বেই তাদের এভাবে দলত্যাগ করাটা হযরত আলী রা. কে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। তিনি তার সাথে থাকা বাকীদের নিয়ে কুফায় পৌঁছলেন।
সেখানে পৌঁছার পর হযরত আলী রা. খারেজিদের দল গঠনের খবর পেলেন।
খারেজিরা সালাত বা নামাজের জন্য একজন আমির ও যুদ্ধের জন্য আরেকজন আমির নিযুক্ত করেছে।
তারা তখন খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে মানুষকে তাদের দলে আহবান করছিল।
তারা বলতে লাগলো, এটা আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের পথ।
অর্থাৎ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের পথে তারা আহবান করছিল।
হযরত আলী রা. তাদের এমন কর্মকান্ড দেখে আরো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কারণ, তারা সৎ কথার মাধ্যমে মানুষকে ভ্রষ্টতার দিকে আহবান করছিল।
এ ছাড়াও তাদের এসব কর্মকান্ডের দ্বারা মুসলিম জামাতের মধ্যে ফাঁটল দেখা দেয়ার আশংকা ছিল।
তারা যতই অন্যায় করুক, এরপরও আলী রা. চেয়েছিলেন, এরা যেন মুসলিম বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
এই লক্ষ্যে তিনি খারেজিদের সাথে বিতর্ক করার জন্য আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে তাদের কাছে পাঠান।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর সাথে খারেজিদের বিতর্ক
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, আমি তাদের নিকট অর্থাৎ খারেজিদের নিকট গেলাম।
তাদের নিকট যাওয়ার আগে আমি ইয়ামেনের তৈরি সুন্দর জামা পরিধান করলাম।
মাথা আচঁড়িয়ে বের হলাম। দুপুরের সময়ে আমি তাদের নিকট পৌঁছলাম। তখন তারা একটি ঘরে সমাবেত হয়ে ছিল।
তারা আমাকে (আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে) দেখে সম্ভাষণ জানিয়ে বললো, হে ইবনে আব্বাস! এই জামাটি কেমন?
আমি বললাম, এই জামার কারণে আমাকে দোষী ভেব না। আমি রাসূল সা. কে উত্তম হতে উত্তম জামা পরিধান করতে দেখেছি।
কুরআনের সূরা আরাফের ৩২ নং আয়াতে বলা হয়েছে,
قُلۡ مَنۡ حَرَّمَ زِیۡنَۃَ اللّٰهِ الَّتِیۡۤ اَخۡرَجَ لِعِبَادِهٖ وَ الطَّیِّبٰتِ مِنَ الرِّزۡقِ ؕ قُلۡ هِیَ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا خَالِصَۃً یَّوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ کَذٰلِکَ نُفَصِّلُ الۡاٰیٰتِ لِقَوۡمٍ یَّعۡلَمُوۡنَ
হে নবী! আপনি বলুন, আল্লাহ্ নিজের বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে? হে নবী! তাদেরকে বলে দিন, ‘পার্থিব জীবনে, বিশেষ করে কেয়ামতের দিনে এ সব তাদের জন্য, যারা ঈমান আনে। এভাবে আমরা জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করি।
খারেজিরা বললো, হে ইবনে আব্বাস! আপনি কেন এসেছেন?
আমি (আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস) বললাম, রাসূলের চাচাতো ভাই ও তার জামাতা এবং তার উপর প্রাথমিক পর্যায়ে ঈমান আনয়নকারী আলী রা. এর প্রতি আপনারা এমন চরমপন্থি মনোভাব পোষণ করছেন কেন?
অথচ তাদের সামনে কুরআন অবতীর্ণ হতো। তারা আপনাদের চেয়েও কুরআনের অর্থ ও মর্ম ভালো বুঝেন। আপনাদের মাঝে তো তার মতো ব্যক্তি নেই।
আমি আপনাদের ও তার চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হতে এসেছি। এ কথা শুনে তাদের মধ্যে ফিসফিসানি শুরু হলো।
কেউ বলছিল, তার কথা শোনা উচিৎ নয়। কেউ বলছিল, তার কথা শোনা উচিৎ। একটু পর সবাই চুপ হয়ে গেল।
তখন আমি বললাম, রাসূলের সাহাবী এবং আলীর মধ্যে আপনারা কি কি ভুল দেখতে পাচ্ছেন?
তারা (খারেজিরা) বললো, আমরা তার তিনটি কাজের বদলা নিতে চাই।
আমি বললাম, সেই তিনটি কাজ কি কি?
তারা বললো,
সিফফিনের যুদ্ধক্ষেত্রে আবু মুসা আশআরী রা. ও আমর ইবনুল আস রা. কে সালিশ নিযুক্ত করে তিনি আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে মানুষকে বিচারক নিযুক্ত করেছেন। অথচ আল্লাহ বলেছেন, একমাত্র আল্লাহর শাসনই চলবে।
আয়েশা রা. ও মুআবিয়া রা. এর বিপক্ষে তিনি যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু তিনি তাদের ধন-সম্পদকে গনিমত হিসেবে ও যুদ্ধবন্দীদের দাস হিসেবে গ্রহণ করেন নি।
মুসলমানেরা তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে তাকে আমির হিসেবে মেনে নেওয়া সত্ত্বেও তিনি আমিরুল মুমিনিন উপাধী পরিত্যাগ করেছেন।
কুরআন-হাদীসের দৃষ্টিতে মাহরাম ও গায়েরে মাহরাম কারা? পড়ুন
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বললেন, যদি আমি আপনাদের নিকট আল্লাহর কিতাব ও নবীজির হাদীস থেকে এমন কিছু কথা বর্ণনা করি, যা আপনারা অস্বীকার করতে পারবেন না, তাহলে আপনারা যে বিশ্বাসের উপর আছেন তা থেকে প্রত্যাবর্তন করবেন কি?
তারা সম্মতিসূচক জবাব দিলে আমি (আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস) বললাম, আপনাদের অভিযোগ – তিনি দ্বীনের ব্যাপারে মানুষকে বিচারক নিযুক্ত করে অপরাধ করেছেন।
অথচ আল্লাহ সূরা মায়েদার ৯৫ নং আয়াতে বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَقۡتُلُوا الصَّیۡدَ وَ اَنۡتُمۡ حُرُمٌ ؕ وَ مَنۡ قَتَلَهٗ مِنۡکُمۡ مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآءٌ مِّثۡلُ مَا قَتَلَ مِنَ النَّعَمِ یَحۡکُمُ بِهٖ ذَوَا عَدۡلٍ مِّنۡکُمۡ هَدۡیًۢا بٰلِغَ الۡکَعۡبَۃِ اَوۡ کَفَّارَۃٌ طَعَامُ مَسٰکِیۡنَ اَوۡ عَدۡلُ ذٰلِکَ صِیَامًا لِّیَذُوۡقَ وَبَالَ اَمۡرِهٖ ؕ عَفَا اللّٰهُ عَمَّا سَلَفَ ؕ وَ مَنۡ عَادَ فَیَنۡتَقِمُ اللّٰهُ مِنۡهُ ؕ وَ اللّٰهُ عَزِیۡزٌ ذُو انۡتِقَامٍ
হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহরাম থাকা অবস্থায় শিকার করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে শিকার করে, তাহলে তার অনুরূপ গৃহপালিত পশু, যার ফয়সালা করবে তোমাদের মধ্যে দু’জন ন্যায়পরায়ণ লোক- কুরবানীর জন্তু হিসাবে কা’বায় পৌঁছতে হবে। অথবা মিসকীনকে খাবার দানের কাফফারা কিংবা সমসংখ্যক সিয়াম পালন, যাতে সে নিজ কর্মের শাস্তি আস্বাদন করে। যা গত হয়েছে তা আল্লাহ ক্ষমা করেছেন। যে পুনরায় করবে আল্লাহ তার থেকে প্রতিশোধ নেবেন। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।
আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, চার দিরহাম মূল্যের (প্রায় ৫২০ টাকা) একটি নিহত খরগোশের ব্যাপারে বিচারক নিয়োগ করার তুলনায় মানুষের রক্ত ও জীবন রক্ষা এবং তাদের পারষ্পরিক ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসার উদ্দেশ্যে মানুষকে বিচারক করা অধিক যুক্তিসঙ্গত নয় কি?
আর আল্লাহ তো সূরা নিসার ৩৫ নং আয়াতে বলেছেন,
وَ اِنۡ خِفۡتُمۡ شِقَاقَ بَیۡنِهِمَا فَابۡعَثُوۡا حَکَمًا مِّنۡ اَهۡلِهٖ وَ حَکَمًا مِّنۡ اَهۡلِهَا ۚ اِنۡ یُّرِیۡدَاۤ اِصۡلَاحًا یُّوَفِّقِ اللّٰهُ بَیۡنَهُمَا ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلِیۡمًا خَبِیۡرًا
যদি তোমরা তাদের উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা কর তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন বিচারক এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন বিচারক পাঠাও। যদি তারা মীমাংসা চায় তাহলে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে মিল করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সম্যক অবগত।
আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, মুসলমানদের মাঝে সমঝোতা এবং পারস্পরিক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ রোধে বিচারক নির্ধারণ করা উত্তম, নাকি মহিলার লজ্জাস্থানের ক্ষেত্রে বিচারক নির্ধারণ করা উত্তম?
তারা (খারেজিরা) বললো, হ্যাঁ এটা ঠিক। মানুষের রক্তের নিরাপত্তা ও তাদের পারস্পরিক বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য বিচারক নিয়োগ করা অধিক যুক্তিসংগত।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আমি কি আমার প্রমাণ দ্বারা আপনাদের যুক্তি খন্ডন করতে পারলাম?
তারা বললো, হ্যাঁ আপনি পেরেছেন।
এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বললেন, আপনারা বলেছেন – আলী রা. যুদ্ধ করেছেন আয়েশা ও মুআবিয়া রা. এর বিরুদ্ধে।
কিন্তু তিনি তাদের বন্দি করে দাস-দাসী বানান নি। আপনারা কি চান, আপনাদের মা আয়েশাকে দাসী বানানো হোক আর অন্য দাসীদের সঙ্গে যেমন আচরণ করা হয়, তার সাথেও তেমন আচরণ করা হোক?
উত্তরে যদি হ্যাঁ বলেন তাহলে কাফের হয়ে যাবেন। কারণ শরীয়তে দাসীর সঙ্গে স্ত্রী-সুলভ আচরণ বৈধ। আর যদি বলেন, আয়েশা আমাদের মা নয়। তাহলেও কাফির হয়ে যাবেন।
কারণ আল্লাহ সুরা আহযাবের ৬ নং আয়াতে বলেছেন,
اَلنَّبِیُّ اَوۡلٰی بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ مِنۡ اَنۡفُسِهِمۡ وَ اَزۡوَاجُهٗۤ اُمَّهٰتُهُمۡ
নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজদের চেয়ে ঘনিষ্ঠতর। আর তার স্ত্রীগণ তাদের মাতাস্বরূপ।
এবং আল্লাহ সূরা নিসার ২৩ নং আয়াতে বলেছেন,
حُرِّمَتۡ عَلَیۡکُمۡ اُمَّهٰتُکُمۡ
তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতাদেরকে।
এখন এই দুটি জবাবের যে কোনো একটি আপনারা বেছে নিন। এরপর আমি (আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস) বললাম, আমি কি যুক্তি প্রমাণ দ্বারা আপনাদের কথা খন্ডন করতে পেরেছি?
তারা (খারেজিরা) বললো, হ্যাঁ আপনি পেরেছেন।
সর্বশেষে আমি তাদেরকে বললাম, আপনারা এই অভিযোগ তুলছেন যে, আলী রা. আমিরুল মুমিনীন উপাধী পরিহার করেছেন।
অথচ হুদাইবিয়ার সন্ধির সময়ে রাসূল সা. ও মক্কার মুশরিকদের মধ্যে যে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়,
তাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বাক্যটি লেখা হলে কুরাইশরা বলেছিল,
আমরা যদি বিশ্বাসই করতাম আপনি আল্লাহর রাসূল, তাহলে আমরা আপনার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতাম না এবং আপনাকে বাধাও দিতাম না।
আপনি বরং এই বাক্যের বদলে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ লিখুন।
সেদিন কিন্তু রাসূল সা. এই কথা বলতে বলতে তাদের দাবী মেনে নিয়েছিলেন,
আল্লাহর কসম! আমি সুনিশ্চিতভাবেই বলছি, আমি আল্লাহর রাসূল। তোমরা আমাকে যতই অস্বীকার করো না কেন।
আলী রা. ঠিক একই কারণে আমিরুল মুমিনীন উপাধী পরিত্যাগ করেছেন।
যদি মুআবিয়া রা. হযরত আলীকে আমিরুল মুমিনীন স্বীকারই করে নিতেন, তাহলে তো আর কোনো বিরোধ হতো না।
এ কথা বলার পর আমি (আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস) বললাম, আমি কি যুক্তির মাধ্যমে আপনাদেরকে বিষয়টি বুঝাতে পেরেছি?
তারা (খারেজিরা) বললো, হ্যা আপনি পেরেছেন।
খারেজিদের সাথে বিতর্ক এর পর প্রায় ২০ হাজারের ও অধিক ব্যক্তি (যারা পরে খারেজিদের দলে যোগ দিয়েছিল) খারেজিদের দল ত্যাগ করে সত্যকে গ্রহণ করলো।
অবশিষ্ট ব্যক্তিরা আলী রা. এর শত্রুতায় তাদের গোমরাহিতে অটল থাকলো।
তারা যখন নিজেদের ভ্রষ্ট মতবাদ নিয়ে যুদ্ধ শুরু করলো, মুহাজির ও আনসার সাহাবারা তাদেরকে ময়দানে হত্যা করেন।
ফুটনোট
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. তাদের সাথে আলোচনা করার পর খারেজীদের কতজন সঠিক পথে ফিরে আসে,
এটি নিয়ে ইতিহাসের গ্রন্থে মতানৈক্য রয়েছে।
মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস গ্রন্থের তথ্যানুযায়ী, ২০ হাজার ব্যক্তি সঠিক পথে ফিরে আসে।
আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থের তথ্যানুযায়ী, ৪ হাজার ব্যক্তি সঠিক পথে ফিরে আসে।
খারেজি বইয়ের তথ্যানুযায়ী, ২ হাজার ব্যক্তি সঠিক পথে ফিরে আসে।
খারেজিদের কুফায় ফিরে আসা
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর মুনাজারার পরে খারেজিদের মধ্য হতে প্রায় ২ হাজার থেকে ২০ হাজারের মতো খারেজী তাদের দলত্যাগ করে আলী রা. এর নিকট চলে আসে।
এরপর হযরত আলী রা. নিজেই খারেজিদের কাছে যান এবং তাদের সাথে কথা বলেন। ফলে তারা কুফা শহরে ফিরে আসে।
কিন্তু গোঁড়ামির কারণে তারা বেশি সময় সেখানে থাকতে পারে নি। কারণ, তারা ভেবে নিয়েছিল, আলী রা. সালিশের ঘটনা থেকে রুজু বা ফিরে এসেছেন।
এই কথা তারা লোকদের মাঝে প্রচার করছিল। এই প্রেক্ষিতে আশআস ইবনু কায়েস নামক একজন ব্যক্তি খলিফা আলী রা. এর নিকট এসে বললেন,
মানুষ বলাবলি করছে, তাদের কারণে আপনি কুফরি থেকে ফিরে এসেছেন। এটা কি সত্যি?
হযরত আলী রা. আশআস ইবনে কায়েসের কথা শুনে জুমার দিন খুতবা দিলেন। হামদ ও সালামের পর তিনি খারেজি মতাদর্শী লোকদের সঙ্গে তার মতানৈক্যের স্বরূপ উন্মোচন করেন।
“মারবিয়াতু আবু মিখনাফ ফি তারিখুত তাবারী” কিতাবের ৪৫২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, আলী রা. এর খুতবা দেয়ার সময় একলোক দাঁড়িয়ে বললো,
لا حكم إلا الله অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম চলবে না। এরপর মসজিদের বিভিন্ন কোণ থেকে তারা এরূপ স্লোগান দিতে থাকে।
আমিরুল মুমিনীন আলী রা. তাদেরকে বসতে বলেন। এরপর তিনি বলেন, তোমাদের এই কথা ঠিক আছে। কিন্তু তোমাদের কথার উদ্দেশ্য ভিন্ন। আমি তোমাদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় আছি।
আলী রা. মিম্বার থেকে তাদেরকে বসে যেতে বলেন। এ সময় এক ব্যক্তি তার দুই কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে কুরআনের এই আয়াত পড়তে লাগলো,
وَ لَقَدۡ اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ وَ اِلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ لَئِنۡ اَشۡرَکۡتَ لَیَحۡبَطَنَّ عَمَلُکَ وَ لَتَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ
অবশ্যই তোমার কাছে এবং তোমার পূর্ববর্তীদের কাছে ওহী পাঠানো হয়েছে যে, তুমি শিরক করলে তোমার কর্ম নিষ্ফল হবেই। আর অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
সূরা যুমার। আয়াত ৬৫
আমিরুল মুমিনীন আলী রা. তাদের এই কথার জবাবে বললেন,
فَاصۡبِرۡ اِنَّ وَعۡدَ اللّٰهِ حَقٌّ وَّ لَا یَسۡتَخِفَّنَّکَ الَّذِیۡنَ لَا یُوۡقِنُوۡنَ
তুমি ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি চিরসত্য। যারা দৃঢ় বিশ্বাসী নয়, তারা যেন তোমাকে বিচলিত করতে না পারে।
সূরা রুম। আয়াত ৬০
উপরোক্ত ঘটনা আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড ৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত বইয়ের ৫০৩-৫১০ পৃষ্ঠা এবং মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খন্ড ৫। মাকতাবাতুল ইত্তিহাদ থেকে প্রকাশিত বইয়ের ৮৭-৯২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে।
আলী রা. এর সিদ্ধান্ত
হযরত আলী রা. খারেজিদের এই চরমপন্থি দলটি সম্পর্কে ন্যায়নিষ্ঠ নীতি গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, যতক্ষণ তোমরা আমাদের সাথে থাকবে, ততক্ষণ তোমরা তিনটি অধিকার পাবে।
১. তোমাদেরকে মসজিদে সালাত আদায়ে কোনো বাধা দেয়া হবে না।
২. আমাদের সাথে একত্রে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে প্রাপ্য অনুযায়ী তোমরা গনীমত লাভ করবে।
৩. আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই না করলে, আমরাও তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো না।
এরপর আলী রা. একজন ঘোষণাকারীর মাধ্যমে নির্দেশ দিলেন, যারা হাফেজ তারা যেন আমিরল মুমিনীনের নিকট আসে।
হাফেজরা একত্রিত হলে আলী রা. পবিত্র কুরআনের একটি কপি এনে সবার সামনে রাখলেন। এরপর তিনি হাতের আঙ্গুল দিয়ে কুরআনে মৃদু টোকা দিয়ে বললেন,
হে কুরআন! তুমি লোকদের নিকট তোমার কথা জানাও।
উপস্থিত লোকেরা আলী রা. কে বললো, আমিরুল মুমিনীন! কুরআনের কপি তো কাগজ আর কালি ছাড়া কিছু নয়। সেটা কিভাবে কথা বলবে?
জবাবে আলী রা. বললেন, তোমাদের ওই সকল সাথী, যারা আমার থেকে পৃথক হয়ে অবস্থান নিয়েছে,
তাদের ও আমার মাঝে মহান আল্লাহর কিতাব রয়েছে।
মহান আল্লাহ তার কিতাবে একজন পুরুষ ও একজন নারীর ক্ষেত্রে বলেছেন,
وَ اِنۡ خِفۡتُمۡ شِقَاقَ بَیۡنِهِمَا فَابۡعَثُوۡا حَکَمًا مِّنۡ اَهۡلِهٖ وَ حَکَمًا مِّنۡ اَهۡلِهَا ۚ اِنۡ یُّرِیۡدَاۤ اِصۡلَاحًا یُّوَفِّقِ اللّٰهُ بَیۡنَهُمَا ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلِیۡمًا خَبِیۡرًا
যদি তোমরা তাদের উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা কর তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন বিচারক এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন বিচারক পাঠাও। যদি তারা মীমাংসা চায় তাহলে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে মিল করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সম্যক অবগত।
সূরা নিসা। আয়াত ৩৫
সেই মোতাবেক মুসলমানদের রক্ত তো আরো গুরুত্বপূর্ণ একজন নারী ও পুরুষের থেকে। তারা আমার ব্যাপারে আরো অভিযোগ এনেছে।
পূনরায় খারেজিদের দলত্যাগ
পরিবেশ ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে খারেজিরা আলী রা. এর সঙ্গ ছেড়ে দিয়ে নিজেদের মধ্যে আমির মনোনয়নের সিদ্ধান্ত নিল।
এই লক্ষ্যে সকল খারেজী সমবেত হলো আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহ্হাব রাসিবির ঘরে। ইবনে ওয়াহহার তাদের উদ্দেশ্যে জ্বালাময়ী ভাষণ দেয়।
দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে, আখিরাতের প্রতি আস্থাবান হতে, ভালো কাজ করতে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে সে তাদেরকে উৎসাহিত করে।
জিহাদ সম্পর্কে কুরআন, হাদীস ও ফিকাহ থেকে আলোকপাত : পড়ুন
এরপর সে খারেজিদের বলে, সালিশ ব্যবস্থা হলো সুষ্পষ্ট যুলুম। আমরা এই সালিশ মানি না।
যে জনপদের অধিবাসীরা জালিম, সেখানে আমাদের থাকা উচিৎ নয়।
এভাবে এক এক করে হারকুস ইবনে যুহাইর, হামজা ইবনে সিনান ভাষণ দেয়। এরপর তারা তাদের নেতা নির্ধারণ করতে বসে।
প্রথমে জায়েদ ইবনে হিসন আত তায়ির নিকট আমিরের পদ গ্রহণ করতে প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু সে অনাগ্রহ প্রকাশ করে।
এরপর হারকুস ইবনু যুহাইর, হামজা ইবনে সিনান ও শুরাইহ ইবনে আবু আওফা এর নিকট আমির হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়।
কিন্তু তারাও অস্বীকৃতি জানায়। অবশেষে আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহ্হাব রাসিবির কাছে প্রস্তাব দিলে সে তা গ্রহণ করে।
তখন খারেজিরা চিন্তা-ভাবনা করে যে, তারা মাদায়েন এলাকা দখল করবে। তখন জায়েদ ইবনু হিসন তায়ি তাদেরকে বললো,
তোমরা মাদায়েন দখল করতে পারবে না। সেখানে দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী আছে। তাদেরকে তোমরা কিছুতেই পরাস্ত করতে পারবে না।
তারা তোমাদের তাড়িয়ে দিবে। আমার পরামর্শ হলো, তোমরা তোমাদের সকল সাথি-বন্ধুদের জাওখি নদীর সেতুর কাছে সমবেত হতে বলো।
জায়েদ আরো বললো, কুফা থেকে তোমরা দলবন্ধভাবে বের হয়ো না। বরং একজন একজন করে বের হও।
যাতে কেউ তোমাদের বিষয়টি বুঝতে না পারে।
খারেজিদের জাওখি নদীর নিকট সমাবেত
জায়েদ ইবনে হিসন তায়ির প্রস্তাব সকলে পছন্দ করে। তাই তারা বসরা ও অন্যান্য স্থানে বসবাসকারী তাদের অনুসারীদের নিকট পত্রসহ লোক পাঠালো।
যেন তারা দ্রুত নদীটির নিকট উপস্থিত হয়। শত্রুদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত হতে এই সিদ্ধান্ত নেয় খারেজিরা।
তারা নিজেদের পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের থেকে পৃথক হয়ে রওয়ানা হয়।
তারা ভাবতে থাকে, এর দ্বারাই হয়তো সৃষ্টিকর্তা তাদের প্রতি খুশী হবেন।
এভাবে তারা নাহরাওয়ান নামক স্থানে একত্রিত হয়। এখানে এসে তারা বিরাট শক্তি ও প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে।
হযরত আলী রা. এই সংবাদ পেয়ে তাদের নিকট চিঠি প্রেরণ করলেন। তিনি লিখলেন, তোমরা পূর্বের অবস্থানে ফিরে এসো।
আর আমাদের সাথে সিরিয়াবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। কিন্তু খারেজিরা এই বলে প্রত্যাখ্যান করে যে,
যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আপনার কুফরির কথা স্বীকার না করবেন এবং তওবা না করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা ফিরে আসবো না।
আলী রা. তা অস্বীকৃতি জানালেন। তাদের ব্যাপারে আমিরুল মুমিনীন আলী রা. নিরাশ হয়ে পড়লেন।
নাহরাওয়ানের যুদ্ধ
আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালেব রা. খারেজিদের কিছু শর্তে কুফায় থাকতে দিয়েছিলেন। যেগুলো হলো,
১. অন্যায়ভাবে কারো রক্ত ঝরাবে না।
২. সাধারণ জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করবে না।
৩. কোনো মুসাফিরের পথ আটকাবে না।
আর যদি খারেজিরা এসব শর্ত মান্য না করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধই হবে এর সমাধান। কিন্তু খারেজিরা তাদের প্রতিপক্ষকে কাফের আখ্যা দিয়ে তাদের সম্পদকে নিজেদের জন্য হালাল ভাবতে লাগলো।
খারেজিদের হাতে আব্দুল্লাহ বিন খাব্বাব রা. কে হত্যা
বসরার নিকটবর্তী একটি গ্রামে হযরত খাব্বাব ইবনুল আরাত রা. এর পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ রহ. বসবাস করতেন।
তিনি ছিলেন একজন আলেম ও মর্যাদাবান ব্যক্তিত্বের অধিকারী। খারেজিরা তাকে আটক করে কর্কশ ভাষায় জানতে চাইলো, কে তুমি?
তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রাসূলের সাহাবী হযরত খাব্বাবের পুত্র আব্দুল্লাহ।
খারেজিদের সরদার বললো, মনে হচ্ছে আমরা আপনার মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছি? তিনি বললেন, হ্যাঁ সত্যিই।
খারেজিরা বললো, ভয়ের কিছু নেই। আমাদেরকে শুধু আল্লাহর রাসূলের কোনো একটি হাদীস শুনিয়ে দিন। আব্দুল্লাহ রহ. বললেন,
আমি আমার পিতার নিকট হতে শুনেছি, রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, এমন একটি ফেতনা আসছে, যাতে বসে থাকা ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির থেকে উত্তম হবে।
আর দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি হেঁটে চলা ব্যক্তির চেয়ে উত্তম হবে। যখন সেই ফেতনায় লিপ্ত লোকদের সম্মুখে পড়বে, তখন আল্লাহর নিহত বান্দা হয়ো, হত্যাকারী হয়া না।
খারেজিরা তখন বললো, আমরা এই হাদীসের ব্যাপারেই জানতে চেয়েছিলাম। আচ্ছা, আপনি আবু বকর ও ওমর রা. সম্পর্কে কি বলেন?
আব্দুল্লাহ ইবনে খাব্বাব রহ. তাদের প্রশংসা করলেন। খারেজিরা তখন বললো, উসমান রা. এর শাসনামলের প্রথম দিকের দিনগুলো কেমন ছিল?
তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে খাব্বাব রহ. বললেন, তিনি শুরুতেও সত্যের উপর ছিলেন এবং শেষেও সত্যের উপর ছিলেন। খারেজিরা তখন বললো, আলীর ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?

আব্দুল্লাহ ইবনে খাব্বাব রহ. বললেন, আলী রা. দ্বীন সম্পর্কে অধিক অবগত। তিনি দ্বীনের ব্যাপারে অধিক সতর্ক ও দ্বীনের বাস্তবায়নকারী।
এ কথা শুনে খারেজিরা ক্ষেপে গেল। তারা বলতে লাগলো, আরে তুমি তো নফসের গোলাম হয়ে গেছ। তুমি বিভিন্ন ব্যক্তির নামকে মাপকাঠি বানিয়ে নিয়েছ।
আল্লাহর কসম! তোমাকে এমনভাবে হত্যা করবো, যেভাবে আজ পর্যন্ত হয়তো কাউকে হত্যা করা হয় নি। এরপর খারেজিরা আব্দুল্লাহ রহ. ও তার স্ত্রীকে নদীর তীর ধরে নিয়ে যেতে থাকে।
খারেজিদের লৌকিকতা ১
যখন খারেজিরা আব্দুল্লাহ বিন খাব্বাব রহ. ও তার স্ত্রীকে নিয়ে যেতে থাকে তখন তাদের সাথে করে এক অমুসলিমের শূকর যাচ্ছিল।
এক খারেজী তরবারি দিয়ে সেটিকে মেরে ফেলে। এই দৃশ্য দেখে তার সাথে থাকা এক খারেজী রেগে গিয়ে বলতে লাগলো,
তুমি অমুসলিম অধিবাসীর শূকর হত্যা করেছ কেন? যখন সেখানে শূকরের মালিক আসলো। তারা তখন তাকে শূকরের মূল্য দিয়ে আপদ বিদায় করলো।
হযরত আব্দুল্লাহ রহ. এই ঘটনা দেখে ভাবলেন, তাদের মধ্যে হয়তো কিছুটা মানবতাবোধ আছে। তাই তিনি তাদেরকে বললেন,
তোমাদেরকে আমি এই শূকরের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিষের নাম বলবো?
খারেজিরা বললো, তা কি?
তিনি তখন বললেন, আমার জীবন। আমি কখনো নামাজ কাজা করি নি। কখনো কোনো গুনাহ করি নি।
খারেজিদের লৌকিকতা ২
খারেজিরা তা শুনে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলো। একটু সামনে যাওয়ার পর একটি খেজুর গাছ চোখে পড়লো। তারা তখন আব্দুল্লাহ রহ. কে সেটার সাথে বাঁধলো।
তখন সেই গাছ থেকে পড়ে যাওয়া খেজুর একজন খারেজী মুখে নিল। তখন সাথে সাথে অন্য খারেজী ব্যক্তি রেগে গিয়ে বললো,
তুমি জিম্মি ব্যক্তির খেজুর কেন মুখে নিলে? মূল্য না দিয়ে তুমি এটা কি করে হালাল মনে করলে? শেষে বাধ্য হয়ে লোকটি মুখ থেকে খেজুর ফেলে দিল।
আব্দুল্লাহ রহ. এই দৃশ্য দেখে বলতে লাগলেন, যদি তোমরা বাস্তবেই এতটা পরহেজগার হয়ে থাক, তাহলে তোমাদের থেকে আমার কোনো ভয় নেই।
মুসলমানদের আবিসিনিয়া হিজরতের কারণ পড়ুন
কিন্তু খারেজিরা তাদের ইচ্ছা পরিবর্তন করলো না। তারা আরো অগ্রসর হয়ে হযরত আব্দুল্লাহ বিন খাব্বাব রা. কে নদীর তীরে তরবারি দিয়ে হত্যা করলো।
ফিনকি দিয়ে তার রক্তের ধারা নদীর বুকে ছিটকে পড়লো। কিছুক্ষণ পর সেখানে রক্তের একটি বৃত্তের মতো হয়ে থাকলো।
আব্দুল্লাহ রহ. কে হত্যার পর খারেজিরা তার স্ত্রীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তিনি তখন চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলেন,
“তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আমি তো একজন নারী!” কিন্তু খারেজিদের পাষাণ হৃদয় গলনো না। তারা নির্মমভাবে তার পেট চিঁড়ে হত্যা করলো।
এরপর পাষণ্ড খারেজিরা তাদের লাশ আগুনে পুড়িয়ে ফেললো। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখে এক খারেজী তওবা করে মুসলমানদের এই ঘটনা জানিয়ে দিল।
আলী রা. এর কিসাস দাবী
এত ভয়ংকর কাজ করার পরও হযরত আলী রা. তাদেরকে সমূলে নির্মূল করেন নি। তিনি তাদের নিকট প্রতিনিধি পাঠিয়ে বললেন,
কিসাস নেয়ার জন্য উক্ত হত্যাকারীদের আমার নিকট সোপর্দ করো।
কিন্তু খারেজিরা ঔদ্ধত্য ও ধৃষ্টতা দেখায়। তারা বললো, আমরা সবাই হত্যাকারী। এরপর হযরত আলী রা. তাদের ফেতনায় যাতে আর কেউ ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, সে জন্য ৩৮ হিজরী সনে বাহিনী নিয়ে খারেজিদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
খারেজিদের বিরুদ্ধে নাহরাওয়ানের যুদ্ধ
খারেজিরা তাদের নেতা আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহহাব রাসেবির নেতৃত্বে তাবু থেকে বের হয়ে নদীর উপর দিয়ে নির্মিত ‘দিযাজান’ নামক সেতুর নিকট এলো।
খারেজিরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, আর কোনো আলাপ-আলোচনা হবে না। এবার তরবারী দিয়েই ফায়সালা হবে।
তা সত্ত্বেও আলী রা. বার্তাবাহক পাঠিয়ে তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা তা তো মানলোই না, উল্টো দূতকে হত্যা করে ফেললো।
তখন আলী রা. তার বাহিনীকে খারেজিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার অনুমতি দিলেন।
উভয় দল যখন মুখোমুখি হলো, তখন আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহহাব চিৎকার করে বলতে লাগলো,
বর্শা ছুঁড়ে মারো। তরবারী উঁচু করো।
এদিকে আলী রা. এর এক অশ্বারোহী বাহিনী বর্শা তাক করে খারেজিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। খারেজিরা অত্যন্ত কঠিনভাবে লড়াই করে।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে যায়। প্রায় সকল খারেজি সেখানে নিহত হয়। হযরত আলী রা. এর বাহিনীর মাত্র ২ জন শহীদ হন।
নিহত খারেজিদের মধ্যে অনেকেই উসমান রা. এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জড়িত ছিল। যেমন, হুরকুস বিন যুহাইর।
ফলে এই যুদ্ধের মাধ্যমে আলী রা. উসমান রা. এর হত্যাকারী ও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীদেরকেও শাস্তি দিতে পেরেছেন।
নাহরাওয়ানের যুদ্ধ এ হাদীসে ভবিষ্যদ্বানী ব্যক্তির অনুসন্ধান
যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর আলী রা. ঘোষণা দিলেন, হে লোকসকল! নবীজি সা. আমাদেরকে এমন একটি দলের সংবাদ দিয়েছিলেন, যারা দ্বীন থেকে সেভাবেই বেরিয়ে যাবে, যেভাবে তীর লক্ষ্যভেদ করে বেরিয়ে যায়।
আর এ দলের একটি নিদর্শন বলেছেন যে, এদের মধ্যে একজন কষ্ণাঙ্গ লোক থাকবে, যার হাতের অগ্রভাগ ওলানের মতো স্ফীত থাকবে।
তোমরা তাকে খুঁজে বের করো। নিশ্চয়ই সে এদের মধ্যে রয়েছে। হযরত আলী রা. আরো বলেন,
এই লোকটা আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসে নিহত হবে, এমনটাই নবীজি বলেছেন।
লোকেরা ওইরকম ব্যক্তির তালাশ করতে লাগলো। কিন্তু কাউকে পাওয়া গেল না। তখন কতিপয় ব্যক্তি বলতে লাগলো,
আলী আমাদেরকে আমাদের ভাইদের ব্যাপারে ধোঁকা দিয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত আমরা তাদেরকে মেরেই ফেললাম।
এ কথা শুনে আলী রা. কাঁদতে লাগলেন। তারপর বললেন, তোমরা আবার খোঁজো। আল্লাহর কসম! আমি মিথ্যা বলি নি। আর আমাকেও মিথ্যা বলা হয় নি।
লোকেরা আবার তালাশ করলো। কিন্তু এমন কাউকে পাওয়া গেল না। অবশেষে আলী রা. নিজে সেই ব্যক্তিকে খোঁজতে বের হলেন।
দেখা গেল, নদীর তীরে একটি গর্তের মধ্যে খেজুর গাছের নিচে লাশের স্তুপ পড়ে আছে।
আলী রা. সেখানে গিয়ে নিজহাতে লাশ উল্টিয়ে দেখতে লাগলেন।
শেষ পর্যন্ত সেখানেই সেই ব্যক্তির লাশ পাওয়া গেল। তাকে দেখেই আলী রা. চিৎকার করে বলে উঠলেন, আল্লাহু আকবার! আল্লাহ ও তার রাসূল সত্য বলেছেন।
খারেজীদের আকিদা বিশ্বাস
মুসলিম ইতিহাসের নিকৃষ্ট জাতির মধ্যে অন্যতম হলো খারেজী সম্প্রদায়। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ও মহামান্য ব্যক্তিদের অবজ্ঞা দ্বারাই তাদের সূচনা হয়।
তাদের প্রতিটা বিষয় নিয়ে আমরা নিচে মূলকথা ও ব্যাখ্যাসহ আলোচনা করছি।
ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি
খারেজীদের ব্যাপারে একটা কথা চিরসত্য যে, তারা খুবই ইবাদাত বন্দেগী করে। সর্বক্ষণ খোদার স্বরণে মত্ত থাকে।
কিন্তু তারা ইসলাম বা ধর্মকে বুঝেছে নিজেদের মন ও মত অনুযায়ী। তারা নিষিদ্ধ বিষয় থেকে খুবই দূরে থাকার চেষ্টা করে।
স্বয়ং রাসূল সা. তাদের সম্পর্কে বলেছেন,
يخرج قوم من أمتي يقرءون القرآن ليس قراءتكم إلى قراءتهم بشيء ولا صلاتكم إلى صلاتهم بشيء ولا صيامكم إلى صيامهم بشيء
আমার উম্মতের মধ্য হতে এমন একটি দল বের হবে, তারা কুরআন পড়বে। তাদের কুরআন পাঠের তুলনায় তোমাদের কুরআন পাঠকে নগণ্য মনে হবে। তারা রোজা রাখবে। কিন্তু তাদের রোজার তুলনায় তোমাদের রোজা কিছুই না।
কিন্তু তারা এতটা ফরহেজগার হয়েও ইসলামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে লাগলো। তাদের মতের বাহিরে কেউ গেলে তাদেরকে কাফের মনে করতো তারা।
দ্বীন-ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা
খারেজিদের আরেকটি বড় অসুবিধা হলো, তারা কুরআন-সুন্নাহ বা হাদীস সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ। তারা তাদের মনমতো ইসলামেকে বুঝতে চায়।
শরিয়তকে তারা সঠিকরূপে মান্য করতে চায় না। এরই প্রেক্ষিতে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. তাদেরকে সৃষ্টির নিকৃষ্ট জীব হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
তারা দ্বীন ও ধর্মের বিধানগুলো না জেনেই আলী রা. সহ বড় বড় সাহাবীদের কাজকে কুফরী আখ্যা দিয়ে তাদের কাফের বলেছিল।
মুসলিম খলিফাকে মানতে অস্বীকৃতি
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, খারেজিদের ভ্রষ্ট নীতিগুলোর অন্যতম হলো তারা হেয়াদাত, ইসলামের ঈমাম ও মুসলিম জামাতের ব্যাপারে বেইনসাফির আকিদা পোষণ করে থাকে।
তারা রাফেজী ও অন্যান্য ভ্রষ্ট দলগুলো থেকে নিজের নীতিমালা গ্রহণ করে থাকে। তারা নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলেই কুফরী বলে আখ্যা দিয়ে থাকে।
নিকটবর্তী আসমানে আল্লাহ কখন নেমে আসেন? পড়ুন
তারা আমিরুল মুমিনীন আলী রা. এর খেলাফত মানতে অস্বীকার করে এবং তাকে কাফের বলে।
পাপের কারণে কাফের ফাতওয়া দেয়া ও মুসলমানদের রক্তকে বৈধ মনে করা
খারেজিরা কোনো পাপী ব্যক্তিকে সরাসরি কাফের বলে। সে তাকফিরের ভিত্তিতে মুসলমানদের জানমালকে বৈধ মনে করে।
তাকফির হলো, কোনো মুসলিমের ব্যাপারে কাফির ও মুরতাদ হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়া।
তারা বিশ্বাস করে যে, মুসলিম খলিফার হাতে থাকা ভূখন্ড কখনোই মুসলামনের নিজস্ব ভূ-খন্ড নয়। অর্থাৎ তারা দারুল ইসলামকে দারুল হরব বলে থাকে।
খারেজিরা সর্বদা মুসলিম জামাত হতে পৃথক থাকতে পছন্দ করে। তারা নিজেদের আকিদাকে একমাত্র আল্লাহর মনোনীত মনে করে।
আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, তারা নিজেদের ধর্মবিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে এতটা হীন যে, তাদের মতের বিরুদ্ধাচরণ করলে নারী-শিশুদের হত্যা করে। এমনকি তারা এটাকে বৈধ মনে করে।
তাদের নিকট মুসলমানরা কাফের হওয়ার মুলনীতি হলো,
১. যে ব্যক্তি ভুলে বা নিজের রায়ের মাধ্যমে কুরআনের বিরোধিতা করবে, সে কাফের।
২. যে উসমান রা. ও আলী রা. কে সমর্থন করবে, সেও কাফের।
এমনকি যারা উপরোক্ত ব্যক্তিদেরকে কাফের বলে না, খারেজিদের দৃষ্টিতে তারাও কাফের।
রাসূল সা. কে জালিম বলে আখ্যায়িত করা
খারেজীদের আকিদা বিশ্বাস এর আরেকটি হলো, রাসূল সা. এর ব্যাপারে নিজেদের স্বাধীন ভেবে নিয়েছে।
তারা বলে থাকে, নবীজি যুলুম করেছেন। (আল্লাহ আমাকে এমন বিশ্বাস থেকে হেফাজত করুন)
তারা রাসূলের আনুগত্যকে ওয়াজিব মনে করে না। এমনকি তারা নবীজির হাদীসে বর্ণিত বিষয়কেও অস্বীকার করে।
খারেজিরা মনে করে, রাসূলের প্রয়োজন ছিল কুরআন নাজিলের জন্য। যেহেতু কুরআন নাজিল হয়েছে, তাই এখন আর রাসূলের প্রয়োজন নেই।
তারা কুরআন না থাকা মাসআলার ক্ষেত্রে হাদীস থেকে গ্রহণ না করে নিজেদের মনমতো আমল করে।
দোষচর্চা করা ও ভ্রান্ত বিশ্বাস পোষণ করা
খারেজিরা মুসলিম খলিফাদের ভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট বলে আখ্যায়িত করে। তারা বলে, এসকল মুসলিম খলিফারা হেদায়াতের পথ থেকে দূরে সরে গেছেন।
কু-ধারণা পোষণ করা
রাসূল সা. এর উপর খারেজিদের পূর্বপুরুষ জুল খুয়াইসারার মতো মুর্খ আপত্তি তুলেছে। সেই মোতাবেক তারাও বিভিন্ন বিষয়ে আপত্তি তুলে।
আবূ সা’ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি কিছু গনীমতের মাল বণ্টন করছিলেন।
তখন বানু তামীম গোত্রের জুল-খুয়াইসারা নামে এক ব্যক্তি এসে হাযির হল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি ইনসাফ করুন।
নবীজি বললেন, তোমার দুর্ভাগ্য! আমি যদি ইনসাফ না করি, তবে ইনসাফ করবে কে? আমি তো নিষ্ফল ও ক্ষতিগ্রস্ত হব যদি আমি ইনসাফ না করি। ’
উমার (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে অনুমতি দিন আমি এর গর্দান উড়িয়ে দিই। তিনি বললেন, একে ছেড়ে দাও।
তার এমন কিছু সঙ্গী সাথী রয়েছে তোমাদের কেউ তাদের সালাতের তুলনায় নিজের সালাত এবং সিয়াম নগণ্য বলে মনে করবে।
এরা কুরআন পাঠ করে, কিন্তু কুরআন তাদের কন্ঠনালীর নীচে প্রবেশ করে না। তারা দ্বীন হতে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন তীর ধনুক হতে বেরিয়ে যায়।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে চরমপন্থা অবলম্বন
তারা মুসলমানদের জান-মালকে বৈধ মনে করে। তারা মুসলমানদের হত্যা করা সওয়াবের বিষয় ভেবে থাকে। এমনকি তারা মুসলমানদের শত্রুদের সাহায্য করতে একটুও ভাবে না।
হক্কানি আলেমদের প্রতি বিষোদ্গার
খারেজিরা কোনো আলেম বা ইসলাম সম্পর্কে ধারণা রাখে, এমন ব্যক্তিদের পছন্দ করে না। তারা তাদের বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করে থাকে।
তাদের এসব কর্মকাণ্ডে অমুসলিমরা আরো উৎসাহ পায়। ফলে সাধারণ মুসলমানরাও কখনো কখনো এমন কাজের কারণে ধোঁকা খায়।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যুম রহ. বলেন, শরিয়ত, ইতিহাস ও প্রত্যক্ষদর্শীরা এ ব্যাপারে সম্যক অবগত যে, সকল মর্যাদাবান ব্যক্তি ইসলামের জন্য উত্তম কীর্তি রেখে গেছেন, সুনাম অর্জন করেছেন।
এরপরও তাদের কিছু কিছু ভুল হয়েছে। সেগুলোকে আমরা অপারগ বলে ধরে নিয়ে তাদের জন্য আজর বা পরকালে প্রতিদানের আশা রাখতে হবে।
কিন্তু খারেজিরা তাদেরকে পুরোপুরি পথভ্রষ্ট ও কাফের বলে থাকে।
তথ্যসুত্র
খারেজি: ড. আলী মুহাম্মাদ সাল্লাবী। পৃষ্ঠা ১৩-১৭
খারেজি। ড. আলী মুহাম্মাদ সাল্লাবী। কালান্তর প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ২৪-২৮
মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খন্ড ৫। মাকতাবাতুল ইত্তিহাদ। পৃষ্ঠা ৮৭-৯২
আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া। খন্ড ৭। ইসলামিক ফাউন্ডেশন। পৃষ্ঠা ৫০৩-৫১০
খারেজি। ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবী। পৃষ্ঠা ৩১-৩৮
আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া। খন্ড ৭। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত বইয়ের ৫০৩-৫১০ পৃষ্ঠা
মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খন্ড ৫। মাকতাবাতুল ইত্তিহাদ থেকে প্রকাশিত বইয়ের ৮৭-৯২
খারেজি: ড. আলী মুহাম্মাদ আস সাল্লাবী। পৃষ্ঠা ৫৭-১২৭