মক্কী ক্যালেন্ডার কী

মক্কী ক্যালেন্ডার কী – পৃথিবীর প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা। রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ক্যালেন্ডার। তারিখ মানব জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তারিখ ব্যতিত মানুষ কখনো কোনো কাজ করতে পারে না। কোনো বড় পরিকল্পনা করতে পারে না।

পৃথিবীর শুরু থেকে এ পর্যন্ত যত ধরণের বর্ষপঞ্জি বা ক্যালেন্ডার রয়েছে সেগুলো হয় সূর্যের সাথে সম্পৃক্ত অথবা চন্দ্রের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে।

প্রাচীনকালে আরবী ভাষার জাতিগোষ্ঠীরা নিজেদের ব্যবহারের জন্য চন্দ্র ক্যালেন্ডারের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু একটা সময় তারা বুঝতে পারে, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বাদেও অন্য বেশ কিছু জায়গায় চন্দ্রবর্ষ হিসাব করলে ব্যবসায়িকভাবে সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়।

প্রাচীন আরবের চন্দ্রবর্ষপঞ্জিকা

হযরত ইব্রাহিম আ. এর যামানা থেকেই মানুষ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি ছিল হজ্জ। আর এই হজ্জ্ব হতো জিলহজ্জ মাসে।

কিন্তু আরবরা দেখলো, যদি হজ্জ প্রত্যেকবার জিলহজ্জ মাস অনুযায়ী হয় আর জিলহজ্জ মাস যেহেতু চন্দ্রবর্ষের সাথে সম্পৃক্ত তাই তাদের ব্যবসা বানিজ্যে মারাত্মক ক্ষতিসাধন হয়।

কারণ হজ্জ কখনো হতো গ্রীষ্মকালে, কখনো হতো শীতকালে।

যার ফলে ফসল ফলন করে হাজিদের নিকট বিক্রি করতে অসুবিধা হতো। তাই তারা এই পদ্ধতি পরিবর্তনের ইচ্ছাপোষণ করে।

প্রাচীন আরবের সৌরচন্দ্র মিশ্রিত পঞ্জিকা

আরবরা সূর্যের সাথে পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার অনুকূল করার জন্য চন্দ্রের হিসেবের সাথে সূর্যের হিসাব মিশ্রিত করে। ফলে এটা চন্দ্র পঞ্জিকা হিসেবে থাকলেও গণনা করা হতো সৌর বছর অনুযায়ী। এই পদ্ধতিকে ‘আননাসি’ বা মক্কী ক্যালেন্ডার বলা হয়।

আমরা একটা বিষয় নিশ্চয় জানি যে, চন্দ্র বছর কিন্তু ঋতুর এক জায়গায় স্থির থাকে না। কিন্তু সৌরবছর ঋতুর সাথে স্থির। যেমন, নভেম্বর থেকে জানুয়ারী মাস পর্যন্ত সর্বদাই শীতকাল থাকে।

আবার মার্চ এপ্রিল মাসগুলোতে গরমকাল বা বসন্তকাল ‍থাকে। অক্টোবরে হেমন্তকাল থাকে।

এই ঋতু ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী কখনো পরিবর্তন হবে না। কারণ, সূর্য পৃথিবীতে প্রদক্ষিণ করতে ৩৬৫ দিন সময় লাগে।

আবার ইংরেজি বছরও ৩৬৫ দিনে গণনা করা হয়। (লিপইয়ারের হিসাব ভিন্ন, আগ্রহীরা ইন্টারনেট থেকে পড়তে পারেন।)

আরবে হজ্জের মৌসুম নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় বনু কিনানার এক সরদার কালাম্বাস আননাসি পদ্ধতি আবিষ্কার করে।

এর ফলে চন্দ্রমাসগুলো সৌরমাসের বরাবর হয়ে যায়। এর ফলে রমজান হতো জুন মাসে এবং হজ্জ হতো আগষ্ট মাসে।

আগষ্ট মাসে যেহেতু গরমের শেষ দিকটা পড়ে ফলে সে সময় ফসল উৎপাদন করে কেনাবেচার উপযোগী হয়ে যায়।

কিন্তু এই সমস্যা দেখা দিল আরেকটা, ইংরেজি বর্ষপঞ্জিতে আমরা চারবছর পর পর ফেব্রুয়ারী মাসকে ২৯ দিন ধরে নেই।

কিন্তু আরবরা চার বছর পর পর আরেকটা নতুন মাস যুক্ত করতো। এই মাসটি যুক্ত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল কিনানা গোত্রের সরদারকে।

সে প্রতিবছর হজ্জের মৌসুমে বলে দিত যে, কোন বছরে নতুন মাস যুক্ত হবে এবং কোন মাসের পর নতুন মাস বৃদ্ধি করতে হবে।

সে সময় চান্দ্রমাসগুলোর নাম ঋতু অনুযায়ী রাখা হয়। যেমন, জুমাদাল আখিরা শীতকালে আসতো। جمد  অর্থ হলো, জমাটবদ্ধতা। নামটি শীতকালের সাথে মিলে যায়।

আননাসি বর্ষপঞ্জি বিলুপ্ত ঘোষণা

বিদায় হজ্জের দিন রাসূল সা. আননাসী পদ্ধতি (মক্কী ক্যালেন্ডার) বা সৌর-চন্দ্র মিশ্রিত বর্ষপঞ্জি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।

রাসূল সা. সেদিন বলেছিলেন,

إن الزمان قد استدار كهينته يوم خلق السماوات والارض

নিশ্চয় যামানা প্রদক্ষিণ করে সেই অবস্থায় ফিরে এসেছে, আল্লাহ তা’আলা যেদিন আসমান ও যমিন সৃষ্টি করেছেন।

এখন কথা হলো, রাসূল এই কথাটা কেন বলেছিলেন? রাসূল বলেছিলেন এই জন্য যে, আননাসি বর্ষপঞ্জি বা চন্দ্র-সৌর বর্ষপঞ্জিকা ৩৩ বছর পর পর নিরেট চন্দ্র বছরে পরিণত হতো।

আর বিদায় হজ্জ সেই ৩৩ তম বছরে হয়েছিল।

সুতরাং, চন্দ্র বছরের সাথে সৌর বছর মিশ্রিত হয়ে যাওয়ায় এই অসুবিধাটি সৃষ্টি হয়েছিল। আননাসি বর্ষপঞ্জিকে মক্কী বর্ষপঞ্জি ও বলা হয়।

নবীজির সীরাতের কিতাবগুলো খুললে দেখা যায়, সেখানে নবীজির জন্ম দেয়া হয়েছে রবিউল আউয়াল মাসে।

আবার প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোতে দেয়া হয়েছে রমজান মাসে।

মূলত আননাসি বর্ষ অনুযায়ী রবিউল আউয়াল মাস ছিল তখন। আর নিরেট চন্দ্রবর্ষ অনুযায়ী তখন রমজান মাস ছিল।

বিদায় হজ্জেও দেখা গেছে মক্কার পঞ্জিকা ও নিরেট চান্দ্র পঞ্জিকার সাথে গড়মিল আছে।

বিদায় হজ্জ নিরেট চন্দ্র পঞ্জিকা হিসেবে সংগঠিত হয় জিলহজ্জ মাসে।

কিন্তু মক্কী বা আননাসি বর্ষপঞ্জিকা অনুযায়ী তা সংগঠিত হয় জুমাদাল আখিরাতে সংগঠিত হয়েছে।

এ জন্যই আরবের প্রাচীন ঘটনার সাথে হিজরী সন মিলে না। এটা একটু বুঝে নিলেই হবে।

বিস্তারিত জানতে চাইলে আপনি মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস,  ফাতহুল বারি, তাহকিকাতে ইসলামিয়্যাহ, তাকউয়িমে তারিখি প্রমুখ কিতাব অধ্যয়ন করতে পারেন।

তথ্যসুত্র

১. মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। ইসমাইল রেহান। খণ্ড ১। পৃষ্ঠা ৭৫

২. মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খণ্ড ১। পৃষ্ঠা ৭৫

মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বইয়ের রেফারেন্স অনুযায়ী, তাফসিরে রাজী বা তাফসীরে কাবীর। খণ্ড ১৬। পৃষ্ঠা ৪০

৩. মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খণ্ড ১। পৃষ্ঠা ৭৬

মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বইয়ের রেফারেন্স অনুযায়ী, সিরাতে ইবনে হিশাম। খণ্ড ১। পৃষ্ঠা ৪৪

৪. মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খণ্ড ১। পৃষ্ঠা ৭৭

মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বইয়ের রেফারেন্স অনুযায়ী, তাহযিবুল লুগাহ্। খণ্ড ১৫। পৃষ্ঠা ১৭১

৫. সহীহ বুখারী। হাদীস নং ৪৬৬২

৬. মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খণ্ড ১। পৃষ্ঠা ২৫২-২৫৩

৭. মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খণ্ড ১। পৃষ্ঠা ৭৯

FAQ

মক্কী ক্যালেন্ডার কি?

মক্কী ক্যালেন্ডার হলো চন্দ্র বর্ষ ও সৌর বর্ষ মিশ্রিত ক্যালেন্ডার

আননাসি ক্যালেন্ডার কি?

আননাসি মূলত মক্কী ক্যালেন্ডারেরই অপর নাম

মক্কী ক্যালেন্ডারের প্রতিষ্ঠাতা কে?

বনু কিনানার সরদার কালাম্বাস

মক্কী ক্যালেন্ডার কবে বিলুপ্ত করা হয়?

বিদায়ী হজ্জের দিন নবীজি মক্কী ক্যালেন্ডার বিলুপ্ত করেন

গাজ্জার জন্য অনুদান

৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে তুফানুল আকসা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ফিলিস্তিনের গাজ্জায় অসংখ্য মানুষ আহত ও শহীদ হয়েছে। বহু মানুষ নিজেদের ঘর-বাড়ী হারিয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে গাজ্জার ৯৮% মানুষ অনাহারে জীবন-যাপন করছে। গাজ্জার মানুষের এই দুঃসময়ে আমরা যদি তাদের পাশে না দাঁড়াই তাহলে কে দাঁড়াবে?

আর-রিহলাহ ফাউন্ডেশন তুফানুল আকসা যুদ্ধের শুরু থেকেই ফিলিস্তিনের গাজ্জার জন্য ডোনেশন সংগ্রহ করে আসছে। এই মহান কাজে আপনিও আমাদের সাথে যুক্ত হতে পারেন।

অনুদান দিন

Scroll to Top