ধর্মনিরপেক্ষতার মুখস্ত বুলি – এনলাইটেনমেন্টের পর থেকেই পাশ্চাত্য সমাজে জীবনকে দুইভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে। একটি হলো, ব্যক্তিগত জীবন। আরেকটি হলো, সমষ্টিগত জীবন।
ব্যক্তিগত জীবনে আপনি ধর্ম মানবেন কি মানবেন না, এটা ব্যক্তির ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
কেউ একাকী ধর্মীয় ইবাদত করতে করতে ‘শহীদ’ হয়ে যাক, তাতে রাষ্ট্রের কিছু যায়-আসে না।
কিন্তু সমষ্টিগত জীবনে ধর্মকে টেনে আনা বারণ। এখানে প্রয়োগ হবে হিউম্যান রাইটস মতাদর্শ। এখানে প্রত্যেক কাজে ধর্মকে টেনে আনা যাবে না।
দ্বীনের সমষ্টিগত আদেশ-নিষেধ মান্য করার জন্য অপরকে বলা যাবে না। রাষ্ট্রকে ধর্মের অধীনে আবদ্ধ করা যাবে না। এমনটাই প্রচার করে ইউরোপীয় দার্শনিকরা।
ধর্ম কি?
এখানে যেহেতু ধর্ম নিয়ে আলোচনা হবে, তাই ধর্মের সংজ্ঞা দেওয়া জরুরি মনে করছি।
আমরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি পড়ার সময় ধর্ম শব্দটি উল্লেখ করি।
যেমন পানির ধর্ম হলো প্রবাহিত হওয়া, আগুনের ধর্ম হলো জ্বালিয়ে দেওয়া, লোহার ধর্ম হলো কঠিন ও শক্ত হওয়া, চুম্বকের ধর্ম হলো আকর্ষণ করা ইত্যাদি।
অর্থাৎ ধর্ম একটি কর্মপদ্ধতি বাতলে দেয়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, মানুষের ধর্ম দ্বারা কি উদ্দেশ্য? এককথায় বলা যায়, ‘মানব জীবনের পথ’।
প্রতিটা মানুষ একটি নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করে জীবন অতিবাহিত করে। এটিকেই মানুষের ধর্ম বলা হয়। পৃথিবীতে আমরা বিভিন্ন ধর্ম দেখতে পাই।
যেমন ইহুদি ধর্ম, খ্রিষ্টান ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম। প্রতিটা ধর্মেই মানুষের জীবন পরিচালনার নিয়মাবলী বর্ণিত আছে। তাই এটিকে ধর্ম বলা হয়।
ইসলামকে বলা হয় দ্বীন। মানে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। অর্থাৎ ‘মানব জীবনের পথ’ শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু রীতি-নীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়।
বরং এটি একটি কমপ্লিট লাইফ স্টাইল। জন্ম থেকে মৃত্যু, কবর থেকে হাশর পর্যন্ত এই দ্বীনের কার্যকারণ রয়েছে।
তাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও আলাদা একটি ধর্ম। এটিও নির্দিষ্ট ‘মানব জীবনের পথ’ দেখায়। সে দুনিয়াবী লাইফ স্টাইল দেখাবে।
যেখানে সে নিজের মতো সংজ্ঞা তৈরি করে সত্য-মিথ্যার মানদণ্ড তৈরি করবে।
ধর্মনিরপেক্ষরা রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করতে চায়। তারা ধর্ম দ্বারা উদ্দেশ্য করে ঐশী ধর্মগুলোকে।
অর্থাৎ যেই ধর্মগুলো এককালে আল্লাহ পক্ষ হতে প্রেরিত হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে ইসলাম ব্যতিত সকল ধর্মেই বিকৃত সাধন করা হয়েছে।
ধর্মের নামে মিথ্যাচার
ধর্মনিরপেক্ষরা এই মতাদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নাস্তিক দার্শনিকদের ব্যবহার করেছে। তারা প্রচার করলো, ধর্মের কারণে খুনোখুনি হয়, মারামারি হয়, রক্তপাত ঘটে।
তাই ধর্মকেই বাদ দিয়ে দাও। ব্যক্তিগতভাবে যার ইচ্ছা ধর্ম-কর্ম করবে।
কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম নেই। রাষ্ট্র সকল ধর্মকেই ব্যক্তিগত ধর্মপালনের স্বাধীনতা দিবে।
অথচ তারা এটা কখনো বলবে না, ধর্ম ব্যতিতও খুনোখুনি হয়, মারামারি হয়, রক্তপাত ঘটে। ২টা বিশ্বযুদ্ধ কি ধর্মের ভিত্তিতে হয়েছিল?
মুসলমানদের সাথে খ্রিষ্টান দীর্ঘমেয়াদী শত্রুতা ক্রুসেড যুদ্ধে মোট নিহত হয়েছে ২০ লাখের কাছাকাছি মানুষ।
ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের দুই গ্রুপের মধ্যে ‘৩০ বছরের যুদ্ধে’ ৪০ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
বিপরীতে ১ম বিশ্বযুদ্ধে ২ কোটির কাছাকাছি ও ২য় বিশ্বযুদ্ধে সাড়ে ৮ কোটি মানুষ নিহত হয়েছে।
এছাড়াও কমিউনিজমের নামে স্টালিন ও মাও সে তুং এর হত্যাযজ্ঞ, ইংল্যান্ডের ভারতবর্ষে ও আরবে ঔপনিবেশ স্থাপন, ফ্রান্সের আফ্রিকায় ঔপনিবেশ স্থাপন, আমেরিকার ইরাক-আফগানিস্তান আক্রমণ, রাশিয়ার আফগানিস্তান-ইউক্রেন আক্রমণের বিবরণ উল্লেখ করলে নিহতের সংখ্যা শুধু বাড়বে বৈকি, কমবে না। অতএব ধর্মনিরপেক্ষ পৃথিবীতে মানুষ খুব শান্তিতে আছে, তাই না?
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা আইন-কানুন নিজেরা তৈরি করে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন ও আন্তর্জাতিক জীবনের আইন-কানুন।
মানুষের মৌলিক অধিকার কি কি হবে, কত বছর বয়সে বিয়ে করতে পারবে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ কিভাবে ব্যবহার করাহবে, সামাজিক উন্নয়নমূলক কি কি কাজ করা হবে, কোন কোন ব্যবসা করা যাবে, বৈধ-অবৈধ উপার্জনের মাপকাঠি কি, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কি হবে, শত্রুদেশ কিসের ভিত্তিতে বিবেচিত হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়েই সেক্যুলাররা আনুন-কানুন তৈরি করে থাকে।
এরপরও সেক্যুলাররা নিজেদেরকে একটি নতুন ‘ধর্মীয় সম্প্রদায়’ হিসেবে পরিচয় দিতে নারাজ। অথচ উপরোক্ত বিষয়গুলোর মাপকাঠি ইসলামও বাতলে দেয়।
তাদের নিকট যখন ইসলামের মাপকাঠি পেশ করা হবে তখন তারা বলবে, এটা মানা যাবে না। এটা ধর্মীয় গোঁড়ামি।
তোমাকে আমাদের মাপকাঠিই মানতে হবে, আমাদেরটা লিবারেল। এটাই সেক্যুলারদের ডাবল স্টান্ডার্ড, দু-মুখী সাপের আচরণ।
মূল উপাদান
সেক্যুলারিজমের মূল উপাদান হলো, আল্লাহ এবং দ্বীনের প্রভাব ও কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা। ধর্মকে শুধুমাত্র কিছু রীতি-নীতিতে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়।
যেমন নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, কুরবানী, মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ ইত্যাদি। অথচ নিজের জীবনে ধর্মীয় প্রভাবকে পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়।
তাই সে কোন পেশা গ্রহণ করবে, এটা ইসলামের কষ্টিপাথরে কখনোই যাচাই-বাছাই করে না।
সে হারাম ব্যবসা, ব্যাংকে চাকুরি, অভিনেতা, খেলোয়াড় পেশার সাথে জড়িত।
আবার ওদিকে সে দাঁড়ি রাখছে, খেলার মাঠে নামাজ পড়ছে, সেজদায় লুটিয়ে পড়ছে, ‘হালাল’ ফিল্ম তৈরি করছে, টুপি পরিধান করে, পরিপূর্ণ হিজাব পরিধান করে ব্যাংকে চাকুরি করছে।
সুষ্পষ্ট হারাম পেশাকে বৈধ মনে করছে। হালাল ব্যবসার আড়ালে হারাম ব্যবসা করছে।
যেমন মুদি দোকান দিয়ে তাতে সিগারেটসহ মাদক দ্রব্য বিক্রি করছে।
ফার্মের আড়ালে মরা মুরগি, গরুর গোশত বিক্রি করছে। এই সকল কিছুই মুসলিম জীবনে সেক্যুলারিজমেরই প্রভাব।
ধর্মীয় বিধানাবলিকে ওয়াহির মাপকাঠিতে গ্রহণ না করে নিজের বুদ্ধি ও বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে গ্রহণ করাটা ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করার নামান্তর।
তাই ধর্মনিরপেক্ষতা হলো ধর্মহীনতারই মূল রূপ। এটিকে আলাদা একটি স্বতন্ত্র ধর্ম হিসেবে উল্লেখ করাই বাঞ্ছনীয়। এই ধর্মের স্রষ্টা হলো কোটি কোটি। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই নিজের স্রষ্টা!
রাষ্ট্র ও ধর্মের এমন বিচ্ছেদ কি আসলেই সামঞ্জস্যপূর্ণ?
পাশ্চাত্য সমাজ আইনের শাসনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে বেশি।
কিন্তু তাদের এই ‘আইনের শাসন’ হলো স্রেফ ফাঁপা বুলি ও জনগণকে বোকা বানানোর মোক্ষম হাতিয়ার।
যখন তাদের সামনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হয় তখন ডানপন্থী, বামপন্থী, লিবারেল-সকলেই আইনের শাসনের কথা বলে মুখে ফেঁনা তুলে ফেলে।
কিন্তু যখন ‘আইনের শাসন’ তাদেরই বিরুদ্ধে যায় তখন তারা আইন পরিবর্তন করার কথা বলে। বৈধ-অবৈধ, ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে ফেলে।
তাই আজ যা তাদের নিকট আইন, আগামীকাল তাদের নিকট সেটা অবৈধ হতে পারে। আজ যা বৈধ, আগামীকাল সেটি তাদের নিকট অবৈধ হতে পারে।
পাশ্চাত্য সমাজের জীবন পরিচালনার নির্দিষ্ট কোনো মাপকাঠি নেই। তারা বিভিন্ন মতবাদের আড়ালে লুকোচুরি খেলে।
ধোঁকাবাজি ও হীনতায় পরিপূর্ণ তাদের মতাদর্শগুলো। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ হলো স্রেফ ধাপ্পাবাজি।
ধর্ম ছাড়া কখনোই রাষ্ট্রের নীতি-নৈতিকতা নির্ণয় করা যায় না। ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড পরিমাপ করা যায় না। ধর্ম রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যা কখনোই পৃথক হবার নয়।
হয় ইসলাম অনুযায়ী রাষ্ট্র চলবে। অথবা ইসলাম ব্যতিত কোনো কোনো ধর্মের অধীনে রাষ্ট্র চলবে। রাষ্ট্রকে ধর্ম মান্য করাই লাগবে। এটাই বাস্তবতা।