খারেজী কারা এবং তাদের সংজ্ঞা দিতে দিয়ে অনেক আলেম অনেক রকমভাবে তাদের পরিচয় তুলে ধরেছেন। তন্মধ্যে,

আবুল হাসান আশআরী রহ.বলেন,

যারা চতুর্থ খলিফা আমিরুল মুনিনীন আলী রাঃ এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং তার দল ত্যাগ করেছে, তারাই হলো খারেজি।

ঈমাম ইবনে হাজাম আন্দালূসী রহ. বলেন,

খারেজী বলতে প্রত্যেক এমন সম্প্রদায়কে বুঝায়, যারা চতুর্থ খলিফা আলী রা. এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে কিংবা তাদের রায় বা মত গ্রহণ করেছে।

তিনি আরো বলেন, খারেজী হলো তারা, যারা নিচের ৫ টি মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করে।

১. যারা ‘সালিশি ব্যবস্থা’ অস্বীকার করে অর্থাৎ বলে থাকে যে, সালিশের বিধান ইসলামে নেই।

২. গুনাহের কারণে অন্য মুসলমানকে কাফের বলে।

৩. মুসলমান শাসক ও সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।

৪. কবিরা গুনাহগারকে চিরন্তন জাহান্নামী মনে করে।

৫. যারা কুরাইশ বংশীয় নয়, তাদের মধ্যে ইমামত বৈধ হওয়ার আকিদার ক্ষেত্রে খারেজীদের সঙ্গে সহমত পোষণ করে।

আর যদি কেউ উপরের ৫ টি বিষয়ের সঙ্গে সহমত পোষণ না করে এবং মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান মতানৈক্যপূর্ণ অন্যান্য মাসআলায় সে খারেজীদের বিরোধী মত পোষণ করে, তাহলে তাকে খারেজী বলা যাবে না।

আল্লামা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ আব্দুল করীম শাহরাস্তানি রহ. বলেন,

জনসাধারণ কর্তৃক স্বীকৃত ও সমাদৃত হক ইমামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীরাই হলো খারেজি। চাই এই বিদ্রোহ খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে হোক বা পরবর্তী যে কোনো সময়ে হোক।

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন,

খারেজী হচ্ছে ওই সকল লোক, যারা তাহকিমের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আলী রা. এর বিরুদ্ধাচারণ করে দলত্যাগ করে।

সেসব লোকেরা আলি রা., উসমান রা. ও তাদের পরিবারবর্গকে গালমন্দ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। তারা যদি উপরিউক্ত পূত-পবিত্র সাহাবীদেরকে কাফির বলে, তবে তারা চরমপন্থী গাদ্দার খারেজী।

ইবনে হাজার রহ. অন্য এক জায়গায় বলেন, খারেজী হলো বিদ্রোহীদের একটি দল। এই দলটি বেদআতি। দ্বীনি বিধান ও মুসলমানদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কারণে তাদেরকে খারেজী বলা হয়।

আবুল হাসান আল মালাতি রহ. বলেন,

খারেজী হলো তারাই, যারা আলী রা. ও মুআবিয়া রা. এর চুক্তিতে “ لا حكم إلا الله” অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানি না” বলে স্লোগান তুলেছিল।

তারা তখন বলেছিল যে, আলী রা. হযরত আবু মুসা আশআরী রা. কে সালিশ মেনে কুফরি করেছেন। (নাউযুবিল্লাহ) অথচ সালিশের অধিকার কেবল আল্লাহর।

এরাই হলো, খারেজী ফেরকার লোক। তারা তাহকিমের দিন আলী রা. এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দলছুট হয়ে যায়।

কেননা তারা আলী রা. ও মুসা আশআরী রা. এর সালিশকৃত কাজকে অপছন্দ করে বলে, আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানি না।

দলীলের আলোকে খারেজী কারা

সিফফিনের যুদ্ধে হযরত আলী রা. সালিশের চুক্তি মেনে সন্ধি করার কারণে যারা আলী রা. এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তারাই খারেজী।

খারেজীদেরকে আরো বেশি কিছু নামে সম্বোধন করা হয়। যেমন: হারুরিয়া, শুরাত, আল মারিকা বা মুহাক্কিমা ইত্যাদি।

নাস্তিকদের নিকট কেন আত্মহত্যা বৈধ? জানুন

কতক আলেমের মতে, খারেজীদের উৎপত্তি রাসূলের জীবদ্দশায় ঘটেছিল। এই আলেমরা প্রথম খারেজী হিসেবে উল্লেখ করেছেন জুল-খুয়াইসারা নামক এক ব্যক্তিকে।

রাসুলের জীবদ্দশায় হযরত আলী রা. ইয়ামানের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তখন তিনি সেখান থেকে সামান্য পরিমাণ স্বর্ণ পাঠিয়েছিলেন রাসূলের নিকট।

তখন রাসূলের স্বর্ণ বন্টনে জুল-খুয়াইসারা আপত্তি তুলেছিল।

খারেজী কারা ও খারেজীদের সম্পর্কে হাদীস

حَدَّثَنَا أَبُوْ الْيَمَانِ أَخْبَرَنَا شُعَيْبٌ عَنْ الزُّهْرِيِّ قَالَ أَخْبَرَنِيْ أَبُوْ سَلَمَةَ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ أَنَّ أَبَا سَعِيْدٍ الْخُدْرِيَّ قَالَ بَيْنَمَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ يَقْسِمُ قِسْمًا أَتَاهُ ذُوْ الْخُوَيْصِرَةِ وَهُوَ رَجُلٌ مِنْ بَنِيْ تَمِيْمٍ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ اعْدِلْ فَقَالَ وَيْلَكَ وَمَنْ يَعْدِلُ إِذَا لَمْ أَعْدِلْ قَدْ خِبْتَ وَخَسِرْتَ إِنْ لَمْ أَكُنْ أَعْدِلُ فَقَالَ عُمَرُ يَا رَسُوْلَ اللهِ ائْذَنْ لِيْ فِيْهِ فَأَضْرِبَ عُنُقَهُ فَقَالَ دَعْهُ فَإِنَّ لَهُ أَصْحَابًا يَحْقِرُ أَحَدُكُمْ صَلَاتَهُ مَعَ صَلَاتِهِمْ وَصِيَامَهُ مَعَ صِيَامِهِمْ يَقْرَءُوْنَ الْقُرْآنَ لَا يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ يَمْرُقُوْنَ مِنْ الدِّينِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنْ الرَّمِيَّةِ يُنْظَرُ إِلَى نَصْلِهِ فَلَا يُوْجَدُ فِيْهِ شَيْءٌ ثُمَّ يُنْظَرُ إِلَى رِصَافِهِ فَمَا يُوْجَدُ فِيْهِ شَيْءٌ ثُمَّ يُنْظَرُ إِلَى نَضِيِّهِ وَهُوَ قِدْحُهُ فَلَا يُوْجَدُ فِيْهِ شَيْءٌ ثُمَّ يُنْظَرُ إِلَى قُذَذِهِ فَلَا يُوْجَدُ فِيْهِ شَيْءٌ قَدْ سَبَقَ الْفَرْثَ وَالدَّمَ آيَتُهُمْ رَجُلٌ أَسْوَدُ إِحْدَى عَضُدَيْهِ مِثْلُ ثَدْيِ الْمَرْأَةِ أَوْ مِثْلُ الْبَضْعَةِ تَدَرْدَرُ وَيَخْرُجُوْنَ عَلَى حِيْنِ فُرْقَةٍ مِنْ النَّاسِ

قَالَ أَبُوْ سَعِيْدٍ فَأَشْهَدُ أَنِّيْ سَمِعْتُ هَذَا الْحَدِيْثَ مِنْ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَأَشْهَدُ أَنَّ عَلِيَّ بْنَ أَبِيْ طَالِبٍ قَاتَلَهُمْ وَأَنَا مَعَهُ فَأَمَرَ بِذَلِكَ الرَّجُلِ فَالْتُمِسَ فَأُتِيَ بِهِ حَتَّى نَظَرْتُ إِلَيْهِ عَلَى نَعْتِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم الَّذِيْ نَعَتَهُ

আবূ সা’ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি কিছু গনীমতের মাল বণ্টন করছিলেন।

তখন বানু তামীম গোত্রের জুল-খুয়াইসারা নামে এক ব্যক্তি এসে হাযির হল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি ইনসাফ করুন।

নবীজি বললেন, তোমার দুর্ভাগ্য! আমি যদি ইনসাফ না করি, তবে ইনসাফ করবে কে? আমি তো নিষ্ফল ও ক্ষতিগ্রস্ত হব যদি আমি ইনসাফ না করি। ’

উমার (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে অনুমতি দিন আমি এর গর্দান উড়িয়ে দিই। তিনি বললেন, একে ছেড়ে দাও। তার এমন কিছু সঙ্গী সাথী রয়েছে তোমাদের কেউ তাদের সালাতের তুলনায় নিজের সালাত এবং সিয়াম নগণ্য বলে মনে করবে। এরা কুরআন পাঠ করে, কিন্তু কুরআন তাদের কন্ঠনালীর নীচে প্রবেশ করে না। তারা দ্বীন হতে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন তীর ধনুক হতে বেরিয়ে যায়। তীরের অগ্রভাগের লোহা দেখা যাবে কিন্তু কোন চিহ্ন পাওয়া যাবে না। কাঠের অংশ দেখলে তাতেও কিছু পাওয়া যাবে না। মাঝের অংশ দেখলে তাতেও কিছু পাওয়া যাবে না। তার পালক দেখলে তাতেও কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না। অথচ তীরটি শিকারী জন্তুর নাড়িভুঁড়ি ভেদ করে রক্তগোশত পার হয়ে বেরিয়ে গেছে। এদের নিদর্শন হল এমন একটি কালো মানুষ যার একটি বাহু নারীর স্তনের মত অথবা গোশত খন্ডের মত নড়াচড়া করবে। তারা লোকদের মধ্যে বিরোধ কালে আত্ম প্রকাশ করবে।

আবূ সা’ঈদ (রাঃ) বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট হতে এ কথা শুনেছি। আমি এ-ও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, ’আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) এদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। আমিও তার সঙ্গে ছিলাম। তখন ’আলী (রাঃ) ঐ লোককে খুঁজে বের করতে আদেশ দিলেন। খোঁজ করে যখন আনা হল আমি মনোযোগের সঙ্গে তাকিয়ে তার মধ্যে ঐ সব চিহ্নগুলি দেখতে পেলাম, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন।

সহীহ বুখারী ৩৬১০ নং হাদীস

শিয়া মতবাদ আকীদাগত বিচ্যুতি কিভাবে হলো, পড়ুন

حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ كَثِيرٍ، أَخْبَرَنَا سُفْيَانُ، حَدَّثَنَا الْأَعْمَشُ، عَنْ خَيْثَمَةَ، عَنْ سُوَيْدِ بْنِ غَفَلَةَ، قَالَ: قَالَ عَلِيٌّ عَلَيْهِ السَّلَام إِذَا حَدَّثْتُكُمْ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَدِيثًا فَلَأَنْ أَخِرَّ مِنَ السَّمَاءِ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أَكْذِبَ عَلَيْهِ، وَإِذَا حَدَّثْتُكُمْ فِيمَا بَيْنِي، وَبَيْنَكُمْ فَإِنَّمَا الْحَرْبُ خَدْعَةٌ، سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: يَأْتِي فِي آخِرِ الزَّمَانِ قَوْمٌ حُدَثَاءُ الْأَسْنَانِ، سُفَهَاءُ الْأَحْلَامِ، يَقُولُونَ مِنْ قَوْلِ خَيْرِ الْبَرِيَّةِ، يَمْرُقُونَ مِنَ الْإِسْلَامِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ، لَا يُجَاوِزُ إِيمَانُهُمْ حَنَاجِرَهُمْ، فَأَيْنَمَا لَقِيتُمُوهُمْ فَاقْتُلُوهُمْ، فَإِنَّ قَتْلَهُمْ أَجْرٌ لِمَنْ قَتَلَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

সুওয়াইদ ইবনু গাফালাহ (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আলী (রাঃ) বলেন, যখন আমি তোমাদের নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সূত্রে হাদীস বর্ণনা করি, তখন তাঁর উপর মিথ্যা আরোপ করার চেয়ে আমার আকাশ থেকে পড়ে যাওয়া অধিক পছন্দনীয়।

আর যখন আমি আমার ও তোমাদের মধ্যকার বিষয়ে আলাপ করি তখন বুঝবে যে ’’যুদ্ধ হলো কৌশল।’’ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি,

শেষ যুগে এমন লোকদের আত্মপ্রকাশ ঘটবে যারা হবে বয়সে নবীন এবং প্রতিজ্ঞাহীন বোকা। তারা সমগ্র সৃষ্টিকূলের মধ্যে সর্বোত্তম কথা বলবে, তীর যেভাবে ধনুক থেকে বেরিয়ে যায় তারাও সেভাবে দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে, তাদের ঈমান কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তোমরা যেখানেই এ ধরণের লোকের দেখা পাবে সেখানেই তাদেরকে হত্যা করবে। কারণ যারা এদেরকে হত্যা করবে কিয়ামতের দিন তারা সাওয়াব লাভ করবে।

সুনানে আবু দাউদ। হাদীস নং ৪৭৬৭

তথ্যসুত্র

খারেজি: ড. আলী মুহাম্মাদ সাল্লাবী। পৃষ্ঠা ১৩-১৭

FAQ

খারেজি কারা

সিফফিনের যুদ্ধে হযরত আলী রা. সালিশের চুক্তি মেনে সন্ধি করার কারণে যারা আলী রা. এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তারাই খারেজি

খারেজীদের লক্ষণ কি

নবীজি বলেছেন, তারা হবে বয়সে নবীন এবং প্রতিজ্ঞাহীন বোকা। তারা সমগ্র সৃষ্টিকূলের মধ্যে সর্বোত্তম কথা বলবে, তীর যেভাবে ধনুক থেকে বেরিয়ে যায় তারাও সেভাবে দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে, তাদের ঈমান কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তোমরা যেখানেই এ ধরণের লোকের দেখা পাবে সেখানেই তাদেরকে হত্যা করবে। কারণ যারা এদেরকে হত্যা করবে কিয়ামতের দিন তারা সাওয়াব লাভ করবে।

Scroll to Top